অটোর ভাড়া দিতে গিয়ে আবিষ্কার করে, তার কাছে খুচরো নেই। অগত্যা একশ টাকার নোটটা চালকের দিকে দ্রুত বাড়িয়ে ধরে জবা। চালকের অত তাড়া নেই। সে ধীরে সুস্থে পকেট হাতড়ে এক তাড়া পুরোনো খুচরো নোট বের করে গুনতে থাকে শম্বুকগতিতে।
ভাই তাড়াতাড়ি করেন! দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার!–তাড়া লাগায় জবা।
এই তো আপা, দিচ্ছি!–বলে একইগতিতে টাকা গুনে নব্বই টাকা ফেরত দেয় লোকটা। কোনোক্রমে টাকাটা হাতে নিয়েই উর্ধ্বশ্বাসে ছুট লাগায় জবা। ট্রেনটা দাঁড়িয়ে আছে! অথচ জবা ভেবেছিল ট্রেন এখনও স্টেশনে পৌঁছায়নি এসে। প্রায় দৌড়ে গিয়ে ট্রেনে ওঠে সে। চোখ ঘোরায় এদিক সেদিক। আছে। নিত্যদিনের যাত্রীরা সবাই যার যার মতো জায়গা খুঁজে নিয়ে পাশের যাত্রীর সাথে গুটুর গুটুর গল্প জমিয়ে নিয়েছে। মিষ্টির চোখে চোখ পড়তেই আলো ঝিকিয়ে ওঠে তার চোখে। আসেন খালা, সিট রাখছি আপনার জন্যে। আজ এত দেরি যে?
আর বইলো না। এত কাজ জমে যায় সকালে! বের হতে দেরি হয়ে গেলো আজও।
মিষ্টির পাশে বসে স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে জবা। যাক বাবা, একটা ঝক্কি গেলো। এখন সময়মতো স্কুলে ঢুকতে পারলে হয়।–ভাবনাটা মনে আসতেই তেতো হয়ে যায় মন। কী যে বালের ডিজিটাল হচ্ছে দেশ! তাদের স্কুলে ডিজিটাল হাজিরা চালু হয়েছে কদিন হলো, সাড়ে নয়টা বাজার এক মিনিট দেরি হলেই কেল্লা ফতে! মেশিনে কার্ড পাঞ্চ করা যায় না তখন আর। সেদিনের মতো অনুপস্থিত ধরে নেয়! তাহলে সাতসকালে উঠে এত যে কাঠ-খড় পুড়িয়ে, হন্তদন্ত হয়ে, দিন-দুনিয়া ভুলে স্কুলের পথে ছুট লাগিয়ে সে এলো, কী কারণে? আর থানা শিক্ষা অফিসারটাও হাড়বজ্জাত তাদের। পয়সা ছাড়া এক পা নড়ে না, টাকা পেলে সাতখুন মাফ! আর আজকাল হচ্ছেও যেন খোদার খাসি, শার্টের বহর ফুঁড়ে ভুঁড়ি দিনদিন ফুলছে তো ফুলছেই! শিক্ষকদের কেউ দুচোখে দেখতে পারে না লোকটাকে। মিষ্টি তো তাকে দেখলেই আড়ালে জবাকে চোখ টিপ দেয়, হেসে বলে, খালা সাবধান! দশমাস আসে!
জবা হাসে। সেদিন ক্লাস্টার ট্রেনিং শেষে লোকটা তার দিকে তাকিয়ে কেমন বিশ্রীভাবে হেসে বলে, কী জবা, খবর কী? ডিজিটাল হাজিরা এখন! চাকরি কি থাকবে?
জবার ইচ্ছে করে মুখের ওপর বলে দেয়, ঘুষ দিলেই থাকবে স্যার!
বলতে গিয়েও বলা হয় না আর। বলা যায় না। কত কথাই যে না বলা থাকে একজীবনে! অথচ বলা দরকার ছিল খুব। যাত্রীদের অধিকাংশই পরিচিত। ডেইলি প্যাসেঞ্জার। শহর থেকে ভোর হতে না হতেই ট্রেনে চেপে বসে এরা, যার যার কর্মক্ষেত্রে নেমে যায় একে একে, দিন শেষে ফিরে আসে আবার। একে অন্যের সুখ-দুঃখের খোঁজ নেয় এরা যেচে, একজন সিট না পেলে অন্যেরা চেপেচুপে বসে জায়গা করে দেয়, পুরুষেরা কেউ কেউ হাসিমুখে সিট ছেড়ে দাঁড়িয়ে যায়, বসতে দেয় জবা বা তার মতো আরো অনেককে। ট্রেনের স্টাফ থেকে শুরু করে হকাররা পর্যন্ত পরিচিত, আত্মীয়ের মতো হয়ে উঠছে দিনে দিনে। টিকেট চেকার মন্টু যেমন শুকনো মুখে জানায়, তার ছোট মেয়েটার শরীরটা ভালো নেই, কদিন থেকে জ্বর, তেমনি কমলা বিক্রেতা আনোয়ারও হাসিমুখে জানাতে ভোলে না, তার বড় ছেলেটা ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে, এবার তার ভাগ্যের চাকা এই ঘুরলো বলে।
মিষ্টির পাশে বসে জানালা দিয়ে তাকায় জবা। আকাশ মেঘলা, সম্ভবত বৃষ্টি হবে আজ। ট্রেনটা ছুটছে। ঘড়ি দেখে জবা। নয়টা বাজলো প্রায়। সামনের স্টেশনে ক্রসিং পড়ে মাঝে মাঝে। আজও পড়বে মনে হয়। তার মানে স্কুলে যেতে দেরি হবে আজও। আবার সেই বিটকেলে লোকটার বাঁকা কথা, হাজিরা খাতায় নাম তুলতে তার ঘুষের আবদার মেনে নেয়া। নাহ্। ভালো লাগে না আর। জীবন জটিল হয়ে যাচ্ছে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে। অসহ্য। হঠাৎ ও পাশের কামরা থেকে এক বয়স্ক নারীর নাকী, তীক্ষ্ণ স্বর বেজে ওঠে, দেখেন তো ভাই, বললাম বাইছে বাইছে এক কেজি ভালো কুমলা দিতি, সপ পচা কুমলা দিয়ে চইলে গেলো! ব্যাটা গেলো কোনে?–বকের মতো লম্বা গলা বের করে নারীটি কমলা বিক্রেতাকে খোঁজে। তার পাশের যাত্রীরা কেউ কমলা বিক্রেতাকে গালি দেয়, কেউ বা অাবার নারীর বোকামিতে হাসে।
এইটা মনে হয় জয়নালের কাজ খালা, ও মাঝে মাঝেই এমন শয়তানি করে, পচা কমলা গছায়া দিয়ে সুযোগ বুঝে ভাগে।–জবার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে মিষ্টি। চুপচাপ শোনে জবা। মিষ্টিদের স্কুলে এখনও ডিজিটাল হাজিরা চালু হয়নি, সেই কারণে সে নির্ভার। ফুরফুরে মেজাজে বসে মোবাইলে ফেসবুক চালায়। তার স্কুলও বেশ ভেতরে, গ্রামের দিকে, অতটা কড়া শাসন নেই সেখানে। জবা ছটফট করে মনে মনে। নারীটি তখনও কমলা বিক্রেতার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে যায় নাকীসুরে। যাত্রীরা এ ওর দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসে। মিন্টু এসে ভাড়া নিয়ে টিকেট দিয়ে যায়।
জবাদের সাথে রফা করা আছে তার। জবাদের দলে আছে দশজন, মিন্টু টিকেট কাটে দুজনের, বাকী দুজনের ভাড়া নিজের পকেটে রেখে, ছয়জনকে ফ্রি করে দেয়। হেড চেকার এলে মন্টু তাকে নিয়ে আড়ালে কানে কানে কী মন্ত্র যে পড়ে, জবাদের দিকে ফিরেও না তাকিয়ে চলে যায় লোকটা তখন। জবারা একেক সপ্তায় একেকজন ভাড়া দেয়, তারা নিজেরা খুশি, মন্টু খুশি, হেডচেকারও খুশি। শুধু রেলকোম্পানি টইটুম্বুর যাত্রী টেনেও ফি বছর লোকসান গোনে। গুনুক, তাতে কার বাপের কী!
পরের স্টেশনে ক্রসিং এ পড়ে জবা শাপশাপান্ত করে রেলকোম্পানির সৃষ্টিছাড়া শিডিউলের। মিষ্টি ততক্ষণে নেমে গেছে। এ স্টেশনেই তার স্কুল পড়ে। ক্রসিং এ পড়লেও তার তাই ক্ষতিবৃদ্ধি বিশেষ নাই। পরিচিত অনেকেই নেমে যায় এ স্টেশনে। তখন লোকটা জবার সামনের সিটে বসে এসে। গায়ে পড়া স্বভাব। ব্যাংকে চাকরি করে, জবার সাথে একই স্টেশনে নামতে হয় তাকেও। সুযোগ পেলেই মেয়েদের গা ঘেঁষে বসে, ছোঁকছোঁক করে। মিষ্টি মাঝে মধ্যেই জবার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে ফোড়ন কাটে, আলুর দোষ খালা, বুচ্ছেন?
লোকটা অনর্থক বকে, আলাপ জমানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে। জবা পাত্তা দেয় না। ঘড়ি দেখে সে। অধৈর্য হয়ে ওঠে। স্কুলে কতক্ষণে পৌঁছতে পারবে কে জানে!
হঠাৎ ফোনটা কেঁপে ওঠে ভূমিকম্প তুলে। ব্যাগ হাতড়ে হাতে নেয় জবা। রাবুর ফোন। এ সময় ফোন কেন? ভ্রু কুঁচকে রিসিভ করে জবা, হ্যালো!
কথা শেষে গুম হয়ে বসে থাকে জবা। টলটল করে চোখে। রাবু তার ছোটবোন। সে কান্না কান্না গলায় জবাকে জানালো, নুরি আপা নেই। ছোটবেলাটা চোখে ভাসে হঠাৎ। সেই ছোট্টবেলায় মাকে হারিয়ে এই নুরি অাপার কোলে-পিঠেই বড় হয়েছিল তারা দুবোন। নুরি অাপা কাজ করতো তাদের বাড়িতে, কিন্তু বড় অাপনার ছিল তাদের। তার মৃত্যু খবরটা শুনে হঠাৎ কেমন ফাঁকা লাগে সব। এই ছুটে চলা ট্রেন, স্কুল, বিটকেলে শিক্ষা অফিসার, সামনে বসা গায়ে পড়া লোকটা, সব কেমন ঝাপসা, অনিত্য মনে হয়। নুরি আপার হাসি-হাসি মায়াময় মুখটা ভেসে ওঠে চোখে। যেন জবাকে বলে, কী রে? আজও স্কুলে যাবি? শেষবারের মতো দেখবি না আমাকে?
ট্রেনটা ছুটতে থাকে সবেগে। জীবনও। নুরি আপারা হারিয়ে যায় এই গতির স্রোতে, ডুবে যায় তাদের মায়াকাড়া মুখ। জবা উঠে দাঁড়ায়। স্টেশন এসে গেছে প্রায়।