বুকের ওপর তখনও খুব ভারি মতোন কিছু একটা অনুমান করতে পারছে ফাতেমা। মেয়েটা উজ্জ্বল শ্যামলা। কিন্তু চেহারার মধ্যে একটা আভিজাত্যের ভাব তখনো ফুটে আছে।
একদলা কদর্য ছুঁড়ে মারলো এই পর্যায়ে তিন নম্বর বেঞ্চে বসা ধলা চামড়ার পাষণ্ডটা। বিবেক যখন শুন্যের কোঠায় তখন মানুষের হিংস্র হতে সময় লাগে না।
ফাতেমা বেশ লম্বা সময় ধরে কেঁদেছে। এখন অনেকটাই ক্লান্ত সে। আর যেন কাঁদতে পারছে না। চোখের জল সবটা শুকিয়ে গেছে বোধহয়। বাবা, মা, বাড়ি-ঘর সব ছেড়ে ভদ্র ছেলেটার হাত ধরে যখন বেরিয়ে আসছিল ও তখন কি এসবের কিছুই মাথায় ছিল! আসলে মানুষ যখন অতি সুখে থাকে সুখটাও এক সময় তার কাছে বিষিয়ে ওঠে। সে পরিত্রাণ চায়। বেশি সুখ তখন অসুখ হয়ে ধরা দেয়। মানুষ যে ওপরে এক রকম ভেতরে তার অন্যটা এই বা ভাববে কী করে। কী সুন্দর ব্যবহার। লেবাস–পোশাক। আহা; আর ভাবা যায় না। তবে এতটাও যে নিজের– দেহের সঙ্গে, আত্মার সঙ্গে আর মানসিকতার সঙ্গে মানুষ প্রতারণা করে এটা জানা ছিল না ওর। সময় হারিয়ে গেলে বোঝা যায় ঠিক ঠিক।
তিনদিন হলো ফাতেমার এই দশা। ওর এখন একটাই আর্তি– খোদা, সব তো গেলো, এবার একটু শান্তিতে মরতে চাই। কিন্তু কই! হাব ভাব দেখে মনে হচ্ছে এতো আনন্দের মরণ ওর কপালে নেই।
পৃথিবীটা সুন্দর। ততধিক সুন্দর মানুষ। এলাকায় ছেলে হিসেবে রাইসুল বড় সুন্দর এবং সুদর্শন যুবক। আর দশটা মানুষ থেকে ভিন্ন ভাবে দেখা যায় এমন! পরোপকারী। সৎ। এই সুন্দরের মোহগ্রস্ত হয় ফাতেমা। বাবার রাখা লজিং মাস্টার হিসেবে ফাতেমা রাইসুলের হালকা আলাপ হয়। হালকা হালকা একটা আস্তরে জমা পড়ে। কালে ভদ্রে সেই আস্তর মেঘের মতো দৃঢ় রূপ নিয়ে আসে সমাজের চোখে মানুষের মুখে।
সন্ধ্যার আগে লিয়াকত ব্যাপারি বাড়ি ফেরার পথে কানে ভেসে আসে কথাগুলো। চায়ে চুমুক দিতে দিতে রফিজ মন্ডল বলে ওঠে, ‘মাইয়াডারে আসলে যতডা ভালা মনে করতাম, মাইয়াডা আসলে তার চেয়েও মেলা গুণ খবিস।’
লিয়াকতকে দেখেই কথাগুলো লাগাতার বলে যায় রফিজ। কথাগুলো যে লিয়াকতকে উদ্দেশ্য করেই বলা এটা আর তার বুঝতে সমস্যা হয় না। ক’দিন হলো মেয়েটা তার হারিয়ে গেছে। সাথে লজিং মাস্টারও।
‘গেলি যখন একলা যাইতে পারলি না, আমারেও শেষ কইরা গেলি।’ নিজেকে খানিকটা ধমকিয়ে বলে ওঠেন ব্যাপারি।
কী করা; সমাজ রাষ্ট্র পৃথিবীটাই আজকাল পরিবেশগতভাবে অনুকূলে নেই। প্রতিকূলতা চারপাশে। বিশ্বাস বলতে যে শব্দটা আজও অভিধান থেকে মুছে যায়নি, মিলিয়ে গেছে তা পৃথিবী থেকে। ভাবতে ভাবতে তার চোখের কোণ বেয়ে দু ফোঁটা অশ্রু নেমে আসে। পানি মিলিয়ে গেলেও দাগ মুছে যায় না। দাগটুকু থেকে যায়। ব্যাপারি সাহেব এই দাগ নিয়েই বাড়ি যান। সমস্ত দাগের সাক্ষী হয়ে থাকে কিছু অশ্রু, কিছু অশ্রু নেমে আসার পথ।
লিয়াকত ব্যাপারি সকাল সকাল বাড়ি ছাড়েন। ঢাকার পথ ধরতে হবে তাকে। কিছু জমি জমার সমস্যা নিয়ে ঢাকায় আসার কথা বাড়িতে বলে রেখেছেন আগ থেকেই। আজ সকালে তার ছোট বোনের ছেলেটা ফোন করে জানালো ঢাকায় যেন একটু আগে ভাগেই রওয়ানা দেন। নতুবা অফিসে ঝামেলায় হয়তো নিজেদের মানুষকে অবহেলা করা হয়ে যাবে একরকম। লিয়াকত যত সত্তর সম্ভব বেরিয়ে আসেন বাড়ি থেকে। ঢাকার পথে ছুটতে তাকে প্রথমে অটোতে চেপে বসতে হয়। অটোতে উঠে তিনি খেয়াল করেন অটোগুলো আজকাল একটু ভিন্নরকম দেখাচ্ছে। এই যে ডান পাশটায় ওপর-নিচ মিলিয়ে দুটো লোহার পাইপ দিয়ে একদম ওয়েল্ডিং করা। খোলারও আর ভয় নেই। তবে অন্য পাশটা আবার খোলা আছে। তিনি এই ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না। তবুও এক পাশের বাড়তি নিরাপত্তা দেখে ভেতরে ভেতরে পুলকিত হন। এবং নিজে ওই বাড়তি নিরাপদ পাশটাতে আশ্রয় নেন। মানুষ মৃত্যু থেকে হরদম পালিয়ে বেড়ায়– এই কথার চেয়ে সত্য পৃথিবীতে কিছু নেই। এই যে লিয়াকত সাহেবের বাড়তি নিরাপত্তার আগ্রহের পেছনেও কিন্তু সেই নিগূঢ় সত্য লুকিয়ে। পাছে অটো থেকে সে আবার ছিটকে না পড়েন, অন্তত এই বাড়তি সাপোর্ট তাকে সেই হতাশা থেকে রেহাই দিচ্ছে।
সেদিন তিনি ঢাকায় বোনের ছেলে রফিকের বাসায় থেকে যান। তাছাড়া কাজেরও কিছু অসম্পূর্ণতা ছিল বৈ কি। বাড়িতেও কোনো তাড়া নেই। মেয়ে আর তার মা একা হলেও তিনি মাস্টারকে জানেন বহু দিন। এবং নিজের ছেলের মতোই জানেন। অন্তত তার অবর্তমানে মাস্টারই তাদের সুরক্ষা বা ভৃত্যের ন্যায়। যেমনটা কোনো কুকুর তার মালিকের সঙ্গে করে থাকে। পরদিন সকালে অসম্পূর্ণ কাজ সমাপ্ত করে যখন বাড়ির পথ ধরেন লিয়াকত ব্যাপারি, সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে হেলান দিয়ে আছে। আর তার সেই সোনালী ঝাঁঝালো রৌশনিটা একদম যেন বরফ গলা পানির মতো মিইয়ে আসতে শুরু করেছে। সেই হালকা মিহি আলোয় শহরের ভেজা সন্ধ্যা দেখতে দেখতে তিনি ছোটেন বাড়ির দিকে। বাড়ি পৌঁছুতে সময় লেগে যায় স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। এই পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন সত্য এটা যে এ অঞ্চলে জ্যাম ছাড়া গাড়ি এগোয় কম। এই জ্যামের শহর থেকে লিয়াকত বহু আগেই সুন্দরের কোলে পাড়ি জমিয়েছেন। কিন্তু পৃথিবী, জীবন এবং প্রয়োজন– এসবের তাগিদে কত কিছু করতে হয়, কত জায়গায় যেতে হয় এবং হারাতেও হয় কত মূল্যবান বস্তু। আজ আর ভাবতে পারেন না তিনি। বাড়ি পৌঁছে সেদিন শুধু একবার হেঁচকি দিয়ে কেঁদে উঠেছিলেন। ওই তার শেষ কান্না। এখন আর কান্নাও আসে না। শুকিয়ে গেছে বোধহয় চোখের পানি। অতি শোকে নাকি মানুষ পাথর হয়ে যায়– তিনিও তেমন কিছু একটা অনুভব করেন নিজের বেলায়। বাড়ি যেতে যেতে অনেক রাত। ঘুটঘুটে অন্ধকার। পথে পথে দু চারটে পা, রিকশা আর টং দোকানে আড্ডারত ক’জন লোক ছাড়া তেমন কিছুই নজরে পড়েনি। তিনি তখনো স্বাভাবিক মানুষ। পাশের বাড়ির জসিম টং দোকানের চা’র পয়সাটা দিয়ে সেরে সাইকেলের প্যাডেল চাপতেই খেয়াল হলো লিয়াকত মিয়াকে। তিনি বাস থেকে নামছেন। জসিম তাকে শুধু বলে, ‘চাচা বাড়ি যাইবেন তো নাকি! সাইকেলে ওডেন।’ লিয়াকত চঞ্চল তখনো। হেসে হেসে কত কথা। এই হাসি একটু পরেই ফুরিয়ে যাবে চিরতরে কে জানতো। বাড়ি পৌঁছে জসিমকে কিছু বলতে হয় না। লিয়াকত নিজেই টের পেতে থাকেন আস্তে আস্তে সব।
বাড়ির ভেতরটা এলোমেলো। রুবিনা কেঁদেই চলছেন বিরামহীন। তিনি বার কয়েক ডেকে ওঠেন ফাতেমা বলে। কিন্তু এই নামে কেউ সাড়া দেয় না। এই নামে এ বাড়িতে কেউ আর নেই এখন। নেই সেই মাস্টার। ভদ্র মতোন সেই সৎ ছেলেটা। একটু পর তিনি পুরো ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারেন। যখন আর কিছুই করার থাকে না। শুধু লজ্জা লজ্জা। এই গ্লানি আজন্ম বয়ে যেতে হয় একটা পরিবারকে।
এক সকালে চা হাতে পত্রিকার পাতায় চোখ বুলাতে গিয়ে আটকে যান লিয়াকত ব্যাপারি― রামলালপুর থানাধীন তেঁতুলিয়ায় ধর্ষণের পর নিহত তিন কন্যার লাশ উদ্ধার। রোকেয়া ১৬, তাসলিমা ১৮, ফাতেমা ২০।