তরুন ইউসুফ
জন্ম ১৯৮৯ সালের ২৬ মার্চ সিরাজগঞ্জের সলঙ্গায়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর পাশের পর বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উপপরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন। উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত গ্রন্থ: না গৃহী না সন্ন্যাসী (২০১৮), কান্না হাসি রম্য রাশি (২০১৯)।
তরুন ইউসুফ

চাপ

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

প্রসব বেদনা উঠেছে এক মহিলার। চারিদিকে ঘিরে আছে দাইসহ অন্য মহিলারা। সবার মুখে দুঃশ্চিন্তার ছাপ। প্রসব বেদনায় মহিলা তারস্বরে কোকাচ্ছে। দাই মাঝে মাঝে পরীক্ষা করছে আর বলছে, চাপ দাও মা আরেকটু চাপ দাও।

সাথে সাথে অন্য মহিলারাও কোরাসে আওড়াচ্ছে, চাপ দাও আরেকটু চাপ।

মা জননী দাঁত কিরমির করে আরও চাপ দিচ্ছে। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। প্রধান দাই তখন সহকারী দাইকে পরীক্ষা করে দেখতে বলছে, বাচ্চার মাথাটা ঠিক ডিরেকশনে আছে কিনা। মহিলা দেখে বুঝতে পারছে না।

প্রধান দাই আবার মা জননীকে উদ্দেশ্য করে বলছে, চাপ দাও। এই তো আরেকটু। বাচ্চার মাথাটা ঘুরে গেলে বিপদ হয়ে যাবে। তখন হাসপাতাল ছাড়া গতি নেই।

মা জননী এত বেদনার ভেতরেও দাইয়ের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে যাচ্ছে। উনি নিজেও জানেন দশ মাস কষ্ট করে যাকে গর্ভে লালন করলেন, একটু এদিক-ওদিক হলে সেই কষ্টটা মাটি হয়ে যাবে। মা জননী যখন চাপ দিতে দিতে সর্বোচ্চ সহ্য ক্ষমতার প্রান্তে গিয়ে চাপ দিলেন, কেউ একজন আমার ঘাড়ে হাত দিয়ে টেনে বের করল। আমি ভূমিষ্ট হয়ে গেলাম পৃথিবীর এই রঙ্গমঞ্চে। যেখানে সবাই অভিনেতা, সবাই আবার দর্শকও। শুধু মাঝে মাঝে একে ওপরকে বলে, নাটক করছ কেন? আসল কথায় আসো।

যেমন আপনারাই এখন বলছেন, নাটক করছো কেন? আসল কথায় আসো।

আমি ভূমিষ্ট হয়ে গেলাম। মা জননী এলিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। কিন্তু ভূমিষ্ট হয়েও আমি ছাড় পেলাম না। সবাই লক্ষ করল নবজাতক কাঁদছে না। সবার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে গেল। কেউ একজন তারস্বরে চেঁচালো, আরে বাচ্চা তো কাঁদছে না!

তোমরা বড় বেরসিক হে। এতক্ষণ কেউ চাপাচাপি করছিলে, কেউ ঘাড় ধরে টানছিলে, এখন বলছ কাঁদছে না। আরে বাবা, কাঁদব না হাসব– সেটাই তো বুঝে উঠতে পারছি না। ছিলাম এতটুকু একটা জায়গায়। ভেসে ভেসে, হেসে হেসে, শুয়ে বসে খেয়ে। খানিকটা অবছা অনুভূতি আর ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে। কিন্তু তোমাদের তো আর আমার সুখ সইল না। কেউ ধাক্কাধাক্কি শুরু করল, কেউ চাপাচাপি আর একজন তো সটান ঘাড় ধরে বের করে আনল। বের হয়ে এসে এই বিশাল পৃথিবী, তারপর তোমাদের মত আজব চিড়িয়া এইসব দেখে তাজ্জব বনে গেছি। হাসব না কাঁদব সেটা তো একটু বুঝে উঠতে হবে। কিন্তু বোঝার আগেই তোমরা বলছ কাঁদছে না। বড় বেরসিক হে তোমরা।

ব্যাস ব্যস্ততা, চিল্লাপাল্লা শুরু হয়ে গেল– নবজাতক কাঁদছে না। দাইমা পা ধরে উল্টো করে ঝাঁকাঝাঁকি শুরু করে দিলো। নবজাতক কাঁদছে না। মুখে ফুঁ দেয়া হলো। না, তাতেও কাজ হচ্ছে না। সবার কপালে চিন্তার ভাঁজ। এরপর আবার উল্টো করে ধরে পেছনে দু’ঘা দিয়ে দিলো। আমি দেখলাম বিপদ। এরপর আরও কী করবে কে জানে। এ কেমন আতিথেয়তা বুঝলাম না। কাঁদছি না বলে মারধর করছে। যাই হোক, আর বেশি রিস্ক নেয়া ঠিক হবে না। এই ভেবে আমি কাঁদলাম, সবাই হাসল। এই হলো জন্মবৃত্তান্ত।

এটা শুধু আমার না, সব মানুষের জন্ম বৃত্তান্তই এমন। অর্থাৎ জন্মের প্রক্রিয়া থেকে শুরু হয় চাপ দিয়ে। তারপর ভূমিষ্ট হওয়ার সাথে সাথে দেখতে পেলেন, এখানে এলাহি কারবার। চাপের চাপাচাপিতে জরাজীর্ণ চারিদিক।

জন্মের পর–

দিন যায়। দিন থেকে মাস।

এখন নবজাতকের বয়স ছয়মাস। ছয় মাস হওয়ার পর দেখা গেল ছয় মাস হয়েছে ঠিক কিন্তু নবজাতকের আকৃতি এখনও সেই ন্যাকড়ার পুটলির মতোই। ব্যাস বাবা-মার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে গেল। সন্তান তাহলে সঠিক পুষ্টি পাচ্ছে না। আর পুষ্টি না পেলে তো বড় হবে না।

শুরু হয়ে গেল পুষ্টির চাপ। তখন বুকের দুধের পাশাপাশি অন্য খাবার যুক্ত হওয়া শুরু করে। যেমন শিমের বিচি, ডিমের কুসুম, তোলা দুধ, নরম খিচুড়ি। মাঝে মাঝে নবজাতক এসব খেতে চাইবে না। মোচড়ামুচড়ি করবে। অনিচ্ছায় বমি করে দিবে। সমস্যা কী? দু চোয়াল চেপে খানিকটা হা করিয়ে হায়ের ভেতর খাবার চেপে দিলে গলা হয়ে সোজা পেটে চলে যাবে। ব্যাস পুষ্টি সমস্যার সমাধান। বেচারা কাঁদছে, কাঁদুক না। এখন কাঁদলেও পরে এর মাহাত্ম্য বুঝতে পারবে। পেটে খেলে তবেই তো পিঠে সয়। যখন পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চের আসল নাটক দেখবে; তখন ভিমরি খেতে খেতে সামলে নেবে। তাই পুষ্টির চাপ বাড়িয়ে দিন। পেটে খেলে পিঠে সয় কথাটা তো আর এমনি আসেনি। এজন্যই এসেছে।

নবজাতক পুটুলি থেকে ধীরে ধীরে সাইজে বড় হয়। হামাগুড়ি দিয়ে কোনো জিনিস দেখলে টেনে ধরে। তারপর এদিকে ওদিক করে জোরসে এক চাটা। পৃথিবীর সবকিছুই তার খাদ্যবস্তু তখন। হামাগুড়ি থেকে হাঁটি হাঁটি, গুটি গুটি পায়ে এদিক ওদিক। পড়ে গিয়ে আবার হাচরে পাচরে দাঁড়ানো। এভাবে হাঁটি হাঁটি থেকে দৌড়াদৌড়ি। দুষ্টুমি করে এটা কামড়ায় ওটা ভাঙে। অতিথি এলে আঁচড়ে কামড়ে একাকার করে দেয়। বাবা মা আনন্দে আটখানা হয়ে দাঁত কেলায়। মানিক আমার।

অতিথিরাও হাসে। বিটকেলে হাসি। মনে মনে ভাবে, কী রকম দস্যি ছেলে বাপু। বাঁদর কোথাকার।

এভাবে বড়জোর বছর পাঁচেক। এরপর বাবা-মায়ের আহ্লাদে আটখানা ভাবটা কমতে থাকে। সাথে বাড়তে থাকে কপালের ভাঁজ। ভবিষ্যতের চিন্তা। ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার। কিংবা নিদেনপক্ষে ভালো কোনো ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, হাই স্যালারি। এসব স্বপ্নে বিভোর হয়ে জমে ওঠে জীবন যুদ্ধের আগাম প্রস্তুতি।

এখন তো প্লে গ্রুপ থেকেই ভর্তিযুদ্ধ। দুঃখে হাসি পায়। আমরা গ্রামে যারা বেড়ে উঠেছি, তাদের প্লে করতে স্কুলে যেতে হতো না। প্রকৃতি ছিল আমাদের অকৃত্রিম অবারিত খেলার মাঠ। বেড়ে উঠেছি লতাপাতার মতো। কিন্তু এখন এসব চলবে না। এখন মডার্ন যুগ। সবকিছু ফাস্ট। আসাও ফাস্ট যাওয়াও ফাস্ট। মাঝখানে ইঁদুর দৌড় ওটাও ফাস্ট। তাই প্লে করতে গেলেও ভর্তি হতে হবে। আর ভর্তি হতে হলে ভর্তিযুদ্ধ। শুরু হয়ে গেল জীবনযুদ্ধের আসল খেলা। মেধায় চান্স পেলো তো হয়ে গেল। না হলে একে ধরতে হবে। নেতাকে তোয়াজ, টাকাপয়সার শ্রাদ্ধশান্তি অবশেষে ভর্তি।

এভাবে চলতে থাকে ওয়ান, টু, থ্রি, ফোর। এই তো আরেকটু এই তো আরেকটু। আরেকটু আর শেষ হতে চায় না। নবজাতক আর নবজাতক থাকে না। খোলস পাল্টে বেরিয়ে আসে কিশোর। আহ দুরন্ত কৈশোর আমার!

তারপর হঠাৎ একদিন গলার স্বর ভাঙে। কোথা থেকে খানিকটা লজ্জা এবং সংকোচ এসে ভর করে। একটু লুকিয়ে চুপিয়ে চলতে ভালো লাগে। ঠোঁট আর নাকের মাঝখানে গোঁফের রেখা দেখা যায়। বয়ঃপ্রাপ্তির সময়টা বড় অদ্ভুত কাটে। বুকের ভেতর হঠাৎ উদাস হয়ে যায়। একদিন ক্লিন শেভ। মাঝে মাঝে রোমিও দাড়ি। শরীরের নদীতে কলকলিয়ে নেমে আসে যৌবন। শুরু হয়ে যায় যৌবনের চাপ।

যৌবন বড় অদ্ভুত। বুকের ভেতর কেমন করে। মনের মধ্যে মাধুরীর নাচ। রাস্তায় ও পাড়ায় পরিচিত মেয়ে নামটা অপরিচিত কিন্তু দেখলে কেমন যেন লাগে। তাকানোর ভঙ্গিতে চোখের ভ্রুকুটি। চলার গতি ছন্দময়। জলবেলুনের মতো জোড়া বুক, সুডৌল নিতম্ব। আহ! মাধুরীর কোনো অংশে কম যায় না। তাকালেই বুকে চাপ পড়ে। নিঃশ্বাস ঘন হয়। আমিও তাকাই সেও তাকায়। চোখে চোখে কথা হয়। চোখ টিপুনি চলে। হাসি বিনিময়। একদিন পাশ কাটাতে গিয়ে পুকুরের ধারে আসলে দেখা হবে বলে পালাই। তারপর সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত। পুকুরের ধারে দেখা। হাতে হাত। চোখে চোখ। ঠোঁট ছুঁয়ে যায় অবাক ঠোঁট। প্রেম হয়ে গেলো। শুরু হলো প্রেমের চাপ।

মোবাইলের যুগ ডিজুস বাড়ায় প্রেম জুস। কথা হয় রাত নিশিতে ঘন হয় আবেগ। কাল কিন্তু দেখা করতেই হবে। থাকতে পারছি না। লুকিয়ে চুরিয়ে কলেজের পেছনে। দূরের পার্ক।

কিন্তু প্রেম কী লুকানো যায়? যায় না। ফাজিল ছেলেপেলে বলে প্রেম আর চুলকানি নাকি লুকানো যায় না।

তারপর যা হবার তা-ই হয়। কানাকানি থেকে জানাজানি। পারিবারিক হট্টগোল। হট্টগোল থামিয়ে পরিবার মেনে নিলে লাভ কাম এরেঞ্জড ম্যারেজ। না মানলে পালিয়ে কাজী অফিস। ভয় কীসের? দুজন একসাথে থাকলে গাছতলায়ও সুখ। গাছতলায়ই না হয় থাকবো, বিয়েটা তো আগে হোক।

গাছতলায় থাকবো বলা যায় বটে, কিন্তু থাকা যায় না। থাকতে হবে বাসায়। কনডোমোনিয়াম না হোক অন্তত একটু ভদ্র ফ্লাট। জীবনের নানান চাওয়ার নানান চাপে যৌবনের সেই স্বপ্নময় দুরন্ত দিনগুলো পালাতে থাকে এক এক করে। কিংবা নিজেদের পালাতে হয় স্বপ্ন থেকে।

মিস্টার অ্যান্ড মিসেসের বিয়ে হয়েছে বহুদিন। প্রায় ত্রিশ বছরের সংসার। লাভ ম্যারেজ। লাভটা বাদ দিয়ে এখন শুধু ম্যারেজটা চালু আছে। লাভ শুধু স্মৃতিতে অম্লান। মিস্টার বড় কোম্পানির ম্যানেজার। মিটিং ট্যুর, ট্যুর মিটিং। বেশিরভাগ সময়ই ফোনে তুমি খেয়ে নাও, আমি পরে খাব করে চলে। মিসেস গৃহিণী শক্ত হাতে সংসার সামলেছেন। দুজনেরই আজকাল উচ্চ রক্তচাপ। হাই ব্লাড সুগার।

মাঝে মাঝে বুকের বাপাশে হাত বুলিয়ে হৃদপিণ্ডকে আদর করতে হয়। তবু হঠাৎ করে ব্যাটা কেমন যেন বিগড়ে যায়। তখন নার্সিং হোম। ছেলেমেয়েরা মানুষ না অমানুষ সেটা তর্কসাপেক্ষ ব্যাপার। দুপায়ে চলে হাত দিয়ে ভাত খায়, মানুষই বটে। লেখাপড়া শিখেছে তবে লেখাপড়া শেখা আর মানুষ হওয়া তো এক জিনিস নয়। শরৎবাবু যেমন বলেছিলেন, বাবা তাহাকে লেখাপড়া শিখাইয়াছিলেন ঠিকই কিন্তু মানুষ করিতে পারেন নাই।

তবে বিদ্যার সাথে বুদ্ধি হয়েছে বেশ।

ছেলে প্রাইভেট কোম্পানির বড় পদে চাকরি করে। ভালো স্যালারি পায়। ঘরে সুন্দরী বউ। মাঝে মাঝে বাইরে বাইকের পেছনে অন্যের বউ। নিজেদের টাকাপয়সা যা আছে, তাতে ছেলের টাকাপয়সার দরকার নেই। এই বয়সে একটু সময়ের দরকার ছিল কিন্তু ছেলেমেয়েদের কাজের যে চাপ সময় কই?

মেয়ে নাচনেওয়ালি। নিজেও নাচে অন্যকেও নাচায়।

আজকাল মিস্টার অ্যান্ড মিসেস পাশাপাশি শোয় চুপচাপ। দুজনই ঘুমের মতো করে রাত জেগে মটকা মেরে পড়ে থাকে। প্রয়োজনের বাইরে অপ্রয়োজনে কথা হয় না আর। স্মৃতিরা ঘুরে ফিরে হানা দেয়। সেই পুকুর পাড়। সদ্যফোটা যৌবনপ্রাপ্ত দুজন। ঠোঁটের আকাশে ঠোঁটের লুকোচুরি। আহ কী সময় ছিল সেসব! কতকিছুর ভিড়ে জীবনের চাপে চাপা পড়ে যাওয়া সোনালি সময়।

এখন শুধু শেষ চাপের অপেক্ষায় প্রহর গোনা।


This is an original content which is written by a DORPON author. Copying and publishing any part of the content is strictly prohibited.

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu