মাথায় পাশ্চাত্যের হ্যাট, পরনে ঢিলেঢালা প্যান্ট, গায়ে দৃশ্যমান শার্ট– এমন সাহেবি মানুষ গ্রামটিতে এসে এর আগে বসবাস করেনি। তাদের পোশাক বলতে ধুতি আর গায়ে জড়ানো এক থানকাপড়, মেয়েদের পোশাক বলতে শাড়ি। এমন এক গ্রামে এসে শিকারি দোপেয়ো, যার নাম রাজচরণ– সে মোটেই বিস্মিত নয়। এমন পরিবেশে এমন অভিযানে তার আসাটা নতুন নয়।
নদী তীরবর্তী গ্রামটির নদীর পাশের এক ছোট্ট কুটিরে সাময়িক অবস্থান করছে রাজচরণ, তার পিতা একজন প্রাক্তন বন কর্মকর্তা। তাই বনপাশের কোনো গ্রামের পরিবেশ পরিস্থিতি তার কাছে বিশেষ অপরিচিত নয়, বরং সুপরিচিত। রাজচরণ তার কুটিরের ঘরটি ভরিয়ে তুলেছে তার কিছু অগোছালো নিদর্শনে। এই যেমন একটি বাঘ্রের ছাল, হরিণের শিং, বাঘ্রকে ঘায়েল করার নানান ফন্দী ফিকিরের অস্ত্রপাতি-যন্ত্রপাতি, গোটাকতক বই, বিদেশি ল্যাম্প ইত্যাদি। তার আগমনের পর থেকেই গ্রামের মানুষের মধ্যে তাকে নিয়ে প্রবল আগ্রহ দেখা দেয়। ছোট খুপরির মতো ঘরটিকে ঘিরে নানান আলাপ-আলোচনা গ্রামের আনাচেকানাচে দানা বাঁধতে শুরু করে। সেদিকে অবশ্য রাজচরণের ভ্রুক্ষেপ নেই, তার দৃষ্টিপাতের বিষয়বস্তু একটাই– কীভাবে মানুষখেকো বাঘ্রকে ঘায়েল করা যায়?
বাঘ্র শিকারের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে তার সাথে সাক্ষাৎ-পরামর্শ করতে আসে গ্রামটির মোড়ল, যার বিশ্বাস যদি কেউ সেই সুচতুর বাঘ্রকে শিকার করতে পারে তো— তা রাজচরণই পারবে। রাজচরণেরও সে বিশ্বাস আছে। তবে তাকে যে বাঘ্র শিকারে এসে কোনো বাঘিনীর শিকারে পরিণত হতে হবে তা বুঝি তার জানা ছিল না। তার দেখভালের দায়িত্ব মোড়লের কাঁধে। আর মোড়ল তা পালনে তার সুদর্শিনী কন্যা লীলাকে ব্যবহারের উদ্যোগ নিলেন। অষ্টাদশী লীলা রঙিন শাড়ি শরীরে পেঁচিয়ে, মুখে হাসির বাঁশরি বাজিয়ে তিনবেলা থালা-বাটি ভরে সুস্বাদু খাদ্য পরিবেশনের জন্য রাজচরণের কুটিরের দিকে রওনা দিতো। কিন্তু কুটিরে প্রবেশের সাথে সাথে তার হাসি উবে যেতো, হঠাৎ লাজুকতা তার হৃদয়ে ভর করতো। যতক্ষণ সে রাজচরণের সেবায় থাকতো, ততক্ষণ একটা কথাও মুখে উচ্চারণ করতো না। রাজচরণও করতো না। তবে কিছুকাল পরে একদিন রাজচরণ লক্ষ করলো মোড়লকন্যা লীলার সুমিষ্ট হাসি নিয়ে তার কক্ষে প্রবেশ, তারপর তার হাসি হারিয়ে লাজুকলতা বনে যাওয়া। সেদিন খাবার সময় রাজচরণ মুখ তুলে ভালো করে লীলার মুখদর্শন করতে গিয়ে তাদের একরকম চোখাচোখি হয়ে গেল। এতে লীলা লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে, তার হৃদয়ে তার সামনে বসা সুপুরুষের জন্য আবেগের স্রোত বয়ে যেতে থাকে। রাজচরণ তা অনুভব করে নিরবতা ভেঙে বলে– কী?
লীলা মুখে লাজুকতামিশ্রিত মুচকি হাসি এনে বলে– কী আবার?
– এসব কী হচ্ছে?
– কোন সব?
– ন্যাকা, তাই না?
– ন্যাকামি যদি বোঝেন, ওটুকু বুঝতে বাকি আছে বুঝি?
রাজচরণ আর কিছু বলে না, শুধু তার কাষ্ঠমিশ্রিত বলিষ্ট মুখাবয়বে একটা পরিবর্তন দেখা যায়, যে পরিবর্তন শুধু লীলাই বুঝতে পারে। এ ঘটনার দিন দুয়েক পরে এক রাত্রিবেলা– যে রাত্রে পূর্ণিমার চাঁদ আলোকিত করেছিল সে অঞ্চল; সেরাতে সে বাঘিনীকে বাহুডোরে বেঁধে বিছানায় শুয়ে, এমন সময় লীলা বলে ওঠে– আমার ভয় হয়!
রাজচরণ তার হাতটি লীলার মাথার কেশে বিলি কাটতে কাটতে বলে– কিসের ভয়?
লীলা বলে– মামার ভয়। তোমাকে হারানোর ভয়।
রাজচরণ সহাস্যে বলে– অযথা ভয় করো কেন! দাঁড়াও না আর ক’টা দিন, মামাকে তোমার পায়ে এনে ফেলবো!
লীলা রাজচরণের কথায় সন্তুষ্ট হতে পারে না। কিছুদিন পূর্বে আরেক শিকারি এসেছিল সেই গ্রামে। সে সুচতুর চারপেয়ো বাঘ্রকে ঘায়েল তো করতেই পারেনি, তার উপর একটা ক্ষত-বিক্ষত হাত নিয়ে তাকে পালাতে হয়েছে। তাই সে রাজচরণকে বলে– আমি একটা কথা বললে রাখবে?
রাজচরণ বলে– কী কথা?
লীলা বলে ওঠে– মামাকে তুমি মেরো না! মামার নামে আমি পূজো দিয়েছি, দেখবে মামা আর এ তল্লাটে আসবে না।
রাজচরণ গ্রামের অষ্টাদশী নারীর মুখের নির্মল শঙ্কা দেখে হাসে, তারপর বলে– ও আমি পারবো না। আমার কাজই বাঘ্র শিকার করা। তার পূজো করা নয়। তুমি পূজো করেছো বেশ! তবে একটা কথা বলে রাখি শোনো, তোমার পূজোয় কাজ দেবে না। বাঘ্র কী আর ওসব পূজো-টূজো বোঝে। সে শুধু বোঝে ঘাড় মটকানো।
লীলার কাছে মনে হয় রাজচরণ তাকে বড্ড তাচ্ছিল্য করছে; তার চেয়ে তার পূজোকে বেশি তাচ্ছিল্য করছে, তার অর্থ হচ্ছে সে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাকে তাচ্ছিল্য করছে– একারণে লীলা মুখ গোমড়া করে একটানে নিজেকে ছাড়িয়ে সে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। রাজচরণের এতে বিকার নেই, অনুভূতি নেই। সে তার ফন্দি মতো ফাঁদ তৈরির সরঞ্জামাদি জোগাড় করে, বন্দুকটা ঝেড়ে মুছে চকচকে করে, কখনোসখনো বইয়ের পাতায় চোখ বুলায়।
পরদিন লীলা আর তার ধারেকাছে ঘেঁষে না। লীলার বদলে তার ছোটো বোন শিলা আসে তার ঘরে খাবার নিয়ে। রাজচরণ ভাবে, মেয়েটার দেমাগ আছে বটে! এমনকি সেদিন রাতেও লীলার দেখা নাই। সেরাতে উধাও হয় একজন গ্রামবাসী। হ্যা, রাজচরণের সেই একাকীত্বের রাতেই আরেকটি দোপেয়ো উধাও হয়ে যায় গ্রামটি থেকে। সকলের সন্দেহ কাজটি বৃহৎ চারপেয়ো বাঘ্র ব্যতীত অন্যকিছুর হতেই পারে না।
তার পরের দিনও লীলার দেখা নেই। রাজচরণ কয়েকজন লোককে সাথে নিয়ে, মাথায় হ্যাট চাপিয়ে, বন্দুক কাঁধে ঝুলিয়ে বনের দিকে যায়। সারাদিন নানা গবেষণা শেষে সন্ধ্যাবেলা তারা ফিরে আসে খালি হাতে।
ওদিকে চারপেয়ো বৃহৎ বাঘ্র সব খবর পেয়ে যায়। নতুন শিকারির নতুন কারসাজি সম্পর্কে সে আঁচ করতে পারে। তাই সে নিজে ফন্দি আঁটতে থাকে। শিকারির উদ্দেশ্য যেমন শিকারকে ঘায়েল করা, তার উদ্দেশ্যও শিকারকে ঘায়েল করা। এ যেন দুই প্রজাতির দুজনের নির্মোহ প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতায় একজন জয়ী হবে, আরেকজন হেরে যাবে– এটাই স্বাভাবিক। নিজের রণ কৌশলের অংশ হিসেবে মানুষখেকো বৃহৎ বাঘ্র তার শত্রু আরেক বাঘ্রের কাছে যায়। তাকে গিয়ে বলে– দেখেছিস?
শত্রু বাঘ্র বলে– কী দেখবো?
– আমার সুঠাম দেহ। তোমার নুইয়ে পড়া শরীর!
– তো! তুমি ইদানীং খুব খাবার বাগাচ্ছ, আমি তো খাবারই খুঁজে পাই না। জঙ্গলে খাবারের বড্ড অভাব।
– আমি তোমাকে খাবারের সন্ধান দেবো। তুমি সহজেই মজার মজার খাবার খেতে পারবে। বিনিময়ে জঙ্গলে আমার রাজত্ব মেনে নিতে হবে।
শত্রু বাঘ্র এই প্রস্তাবে উৎসাহী হয়, বৃহৎ বাঘ্র তাকে খাবারের সন্ধান দেয়।
রাজচরণ আবার বনাঞ্চলে যায়। এবার আর সে খালি হাতে ফেরে না। সন্ধ্যাবেলা যখন সে ফিরে আসে তখন দেখা যায় তার পিছন পিছন দু’জন লোক একটা মৃত বাঘ্রের চার পা বাঁশের সাথে বেঁধে কাঁধে করে নিয়ে আসছে।
এমন খবর চাপা থাকে না। বাতাসের গতিতে মূহুর্তে ছড়িয়ে পড়ে গ্রামজুড়ে। হাসি মুখে গ্রামবাসীরা রাজচরণের কুটিরের দিকে যাত্রা করে।
কেউ কেউ বলে– সাহস কত ছেলেটার, শেষপর্যন্ত মেরেই ফেললো!
সবাই সমবেত হলে রাজচরণ ঘোষণা করে– গ্রামটি সেদিন থেকে ভীতিহীন। কোনো বাঘ্র আর কাউকে খাবে না, কোনো মানুষ আর রাতের বেলা ঘর থেকে বেরুতে ভয় পাবে না।
গ্রামবাসী হাততালি দেয়। তাদের হৃদয়ে প্রশান্তি আসে। গত দু’মাসের বাঘ্র আতঙ্ক থেকে তারা মুক্ত হয়। রাজচরণকে অভিনন্দন জানায় নানা ভঙ্গিমায়। তারা উৎসবে মাতে, নিশ্চিন্তে ঘুমাতে যায়। আনন্দ উৎসব শেষ হলে লীলা চুপিচুপি রাজচরণের ঘরে যায়, বলে– তুমি ঠিকই বলেছ! মামা কী আর পূজো-টূজো বোঝে!
রাজচরণ গ্রাম্য রমণীর বোধোদয়ে আপ্লুত হয়, বলে– বলেছিলাম না। আজ যদি ওটাকে না মারতাম। বলা যায়, কাল হয়তো তুমিই তার পেটে যেতে!
লীলা আহ্লাদিয়া ভঙ্গিমায় বলে– হয়েছে মহান বীর, এসব অলক্ষুণে কথা বলতে নেই।
কথাটি উচ্চারণ করতেই কেন জানি না, তার মুখটা মলিন হয়ে ওঠে, হয়তো কোনো গভীর চিন্তায় পড়ে যায় সে, কীসের ভাবনা সেটা বলতেও ভুলে যায় না– তুমি কী তাহলে চলে যাবে?
রাজচরণের বাঘ্র শিকার শেষ, যে বাঘ্রটি গ্রামে প্রবেশ করে দোপেয়োদের বিনাশ করতো তার খেল খতম। এখন বনপাশের গ্রামটিতে তার সময় কাটানো সম্ভব হবে না। এটাই সবসময় হয়, এটাই হয়ে থাকে। তবে এবারের ব্যাপার কিছুটা ভিন্ন, এক বাঘিনী তাকে ঘায়েল করেছে। যে কিনা রাজচরণের জানতে চাচ্ছে– সে কি চলে যাবে? রাজচরণ এর উত্তরে কিছু বলে না, চুপ থাকে। অতি সম্প্রতি সেখান থেকে ফিরে যাবার ইচ্ছে তার জাগে না। আবার ভাবে লীলার মায়ায় সে যদি বশীভূত হয় তাহলে তার জীবনপ্রবাহে নানা বাধা আসতে পারে। তাই কিছুক্ষণ চুপ থেকে সুকৌশলে বলে– যাবো। কয়েকদিন পর।
তবে লীলা একথার পিঠে যা বলে, তার জন্য রাজচরণ মোটেই প্রস্তুত ছিল না। সে বলে– আমায় তুমি নিয়ে যাবে? আমার শহর দেখার বড্ড শখ।
রাজচরণ দ্বিধায় পড়ে যায়। শহুরে জীবন অন্য জীবন। শহরের কথা শুনেই তার হৃদয়পটে ভেসে ওঠে রমেলার মুখাবয়ব। সৃষ্টিশীল সেই মুখাবয়ব তার অতি প্রিয়। তাকে কেন্দ্র করেই তার শহুরে জীবন, শহুরে যৌবন। সেখানে নতুন আরেকজনের আবির্ভাব তার কাছে শুধু অসঙ্গত মনে হয় না, বরং অনৈতিক মনে হয়। রাজচরণ কম্পিত স্বরে লীলাকে বলে– না, এ হয় না।
লীলার বক্ষের পাহাড়সম আশা মূহুর্তে তাকে বিপর্যস্ত করে। তাকে মাটিচাপা দেয়। আবার সে এটাও ভাবে, সে বোধহয় অত্যধিক প্রত্যাশা করে ফেলেছে। শহুরে বাবুগোছের কেউ তাকে গ্রহণ করে তার জগতে আশ্রয় দেবে– এ ভাবনা বাতুলতা ছাড়া আর কি-ই বা হতে পারে! আবার তার মনে আরেকটি চিন্তাও দানা বাধতে শুরু করে। সে কী করে তার গ্রাম্য সমাজে বসবাস করবে? রাজচরণের সংস্পর্শের ফলে তার আসন্ন বংশধর যখন দুনিয়াতে আসবে, সবাই জানতে চাবে তার পরিচয়। তখন সে কী বলবে! সে কী চুপ থাকবে? এত সংশয়, অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও লীলা রাজচরণের বাহু থেকে বের হতে পারে না, যেন সে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ-কে মাথা পেতে নেবে কিন্তু অল্প সময়ের তীব্র আবেদনটুকু থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারবে না।
দিন যায়। গ্রামে দোপেয়োখেকো বাঘ্রের আর উৎপাত নেই, নেই কোনো প্রাণঘাতী শঙ্কা। শুধু আছে রাজচরণ-লীলার প্রেম। রাজচরণ সেই গ্রামেই দিন কতক পড়ে থাকে। এদিকে লীলার হৃদয়ে যে শঙ্কার জাল বিস্তৃত হয় তা ঠেকিয়ে রাখা যায় না, সে ভাবে একদিন হয়তো রাজচরণ তাকে হুট করেই বলে বসবে– লীলা, আমার যাবার সময় হয়েছে, আমায় এবার যেতে হবে।
সেই শঙ্কার মাঝেও লীলার একটা ইচ্ছে জাগ্রত হয়। একদিন সে রাজচরণকে বলে– আমার বড্ড একটা ইচ্ছে আছে। আমি কখনো বনে যায়নি। আমায় তুমি নিয়ে যাবে?
রাজচরণ অবাকই হয় একরকম। বনপাশ গ্রামের মেয়ে হয়েও কেন যে লীলা আজও বনে যায়নি তা তার বোধগম্য হয় না। আবার এও ভাবে হয়তো মোড়লের আদুরে মেয়ে বলে মোড়ল তাকে যেতে দেয়নি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে, কিংবা লীলাও কারো সাথে কখনো যেতে চায়নি। তবে রাজচরণের মতো সাহসী সুপুরুষের সাথে সে নরকে যেতেও যেখানে নির্ভীক– সেখানে বনে যাবার ইচ্ছা তার জাগতেই পারে। এবারে রাজচরণ আর ‘না’ করতে পারে না। সে চিন্তা করে, লীলার এ আকাঙ্ক্ষাটি পূর্ণ করেই সে শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দেবে।
তার কিছুকাল পরেই একদিন সকলের চোখের আড়ালে তারা দুজনে উড়াল দেয় বনাঞ্চলে। লোকচক্ষুর সম্মুখে গেলে নানা কথার জঞ্জালের সৃষ্টি হতো, তাই তাদের এই পরিকল্পনা। লীলা প্রথমবারের মতো বনে এসে সৌন্দর্যে পুলকিত হয়। গাছপালা, গাছে ঝুলে থাকা বানর, পাখি, হরিণ প্রভৃতি তার হৃদয়কে হরণ করে। রাজচরণ লীলার উচ্ছ্বাস, পাগলামো নতুনভাবে আবিষ্কার করে, তার হাত ধরে নিজেকে সম্পূর্ণ করে– ভাবে, কোনও দিন সে লীলাকে ছেড়ে যাবে না। লীলা রাজচরণের হ্যাট মাথায় পরে, বন্দুক হাতে নেয়। রাজচরণ পিছন থেকে লীলার হাত ধরে পাখি শিকারের কলকব্জা বুঝাতে থাকে, বন্দুক তাক করার ফিরিস্তি শেখাতে থাকে। একসময় সে নিজেকে হারিয়ে ফেলে লীলার মধ্যে।
এমন সময় পিছনে মৃদ্যু খসখস শব্দ শোনা যায়। চারপেয়ো বৃহৎ বাঘ্রের আগমন ঘটেছে। কিন্তু তার নিরব পদধ্বনি তারা টের পায় না।
তারপর অকস্মাৎ একটি গর্জন আর একটি আর্তনাদের শব্দ! লীলা আঁতকে ওঠে। সে খেয়াল করে তার হাতের সাথে লেগে থাকা দিকনির্দেশী রাজচরণের হাতটি আর নেই। কাঁপা কাঁপা শরীরে, প্রকম্পিত হৃদয়ে সে পিছন ফিরে দেখে জ্যান্ত চারপেয়ো বৃহৎ বাঘ্রকে। তীক্ষ্ণ তার নখর, হিংস্র তার মুখাবয়ব। রাজচারণ নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে, লীলা বন্দুকের ট্রিগার টেপার প্রচেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। চারপেয়ো বাঘ্র গর্জন করতে করতে রাজচরণের ঘাড় মটকে দেয়, টানতে টানতে নিয়ে যেতে থাকে রাজচরণকে। লীলা চিৎকার করে ওঠে অসহায়ভাবে। সে জানে কিছুক্ষণ পরই সেখানে লাঠিসোটা নিয়ে আসবে অনেক লোক, কিন্তু রাজচরণকে সে আর ফিরে পাবে না।
লীলা শেষবারের মতো দৃষ্টিপাত করে অসহায় নিথর রাজচরণের দিকে। সে অতি স্বল্প সময়ের মধ্যে তার দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যাবে। চিৎকার ছাড়া আর কী করবে, লীলা তা বুঝতে পারে না। সে একবার তাকায় উন্মুক্ত আকাশের দিকে– যেখানে ঈশ্বর বাস করে। আরেকবার তাকায় তার আগত ভবিষ্যতের দিকে– যেখানে বসবাস করবে তার নিষ্কলঙ্কিত বংশধর। তারপর তার চোখ যায় বৃহৎ বাঘ্রের অনুসন্ধিৎসু শিকারি চোখের দিকে।