রেল লাইনের ধারে কৃষ্ণকাকার দোকান। রোজ সন্ধ্যায় সেখানে গিয়ে বসি। সিগারেট ধরাই। পাশে প্রবহমান নদী। চন্দ্রিমার ছায়া পড়ে সেখানে। মূলত সবুজ ধানখেত স্বয়ং একটি আর্ট, শিল্প। যার প্রতীকি ব্যঞ্জনায় ফুটে ওঠে চাষার নিরলস পরিশ্রমের চিত্র। মাথার উপরে নির্মল, স্বচ্ছ ও সুন্দর আকাশ। রাস্তার দু ধারে ফসলের খেত ও দিগন্ত বিস্তৃত নীলিমা। সেখানে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকার ভেতর রয়েছে সুখ ও আনন্দ। অনুভূতি অক্ষরবৃত্ত ছন্দে সাবলীল শব্দচয়নের মাধ্যমে একটি কবিতা লিখে প্রকাশ করা যেতে পারে। কিন্তু আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, টিয়ে পাখিটিকে না পাওয়া পর্যন্ত কবিতা অনশন ব্রত পালন করবো। অতএব কৃষ্ণকাকা বললেন, তুমি মাইকিং-এর ব্যবস্থা করো।
একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি। এত দ্বারা জানানো যাচ্ছে যে, গত কুড়ি বছর আগে সবুজ রঙের ১২০ গ্রাম ওজনের একটি টিয়ে পাখি হারিয়ে গেছে। যার পরনে কোনো পোশাক ছিল না। ধারণা করা হচ্ছে, পাখিটি কুড়ি বছর আগে দূর্গা পূজার নবমীতে অভিমানবশত অন্য কোথাও গিয়ে আশ্রয় নিতে পারে। কোনো সহৃদয়বান ব্যক্তি যদি পাখিটির সন্ধান জানেন, তবে তাকে সর্বজনবিদিত কৃষ্ণকাকার দোকানে যোগাযোগ করার জন্য বিনীত অনুরোধ করা হলো। মাইকিং শেষ হওয়ামাত্র কৃষ্ণকাকা বললেন, ঐ দ্যাখো মেঘ সঙ্গে নিয়ে টিয়ে পাখিটি এদিকেই আসছে। কিন্তু এ কি! এ যে ঝড়, নিমেষেই লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে সব। মাঠ, ফসল, উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন এই দোকান। সব ধ্বংস হয়ে যাবে। একমাত্র তুমি-ই আমাদের বাঁচাতে পারো, নকুল। আমি বললাম, ধ্বংস বলে কিছু নেই কৃষ্ণকাকা, পদার্থবিজ্ঞান তাই বলে। তখন কৃষ্ণকাকা বললেন, এখন তর্ক করার সময় নয়, তুমি যেহেতু ঘুমিয়ে আছো, কাজেই এই জনপদের মানুষদের বাঁচাতে হলে তোমায় এখন জেগে উঠতে হবে। আমি বললাম, আপনি ভুল বকছেন, এটি আমার জাগ্রত মুহূর্ত, স্বপ্ন হবে কেন? কিন্তু আমার টিয়ে পাখিটি কোথায়, কোথায়, কোথায়... বলতে পারেন কৃষ্ণকাকা! নকুল ঘুম থেকে জেগে ওঠো, ওঠো।
যদি ঘুমিয়েই থাকি, ঘুম মূলত শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তির স্থান, তবে স্রেফ স্বপ্ন নিয়ে ঘাবড়ানোর কোনো মানে হয় না, বাবার মৃত্যুও আমায় ঘাবড়াতে পারেনি, অথচ স্বপ্ন তো ঘুমের সহজাত এবং প্রত্যাশিত উপাদান। এক্ষেত্রে ঘুমানোই সহজ সমাধান, অথচ সায়ন্তিকার জীবনে কোনো সমাধান নেই। এদিকে কৃষ্ণকাকার দোকান লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। যে দোকানে বসে আমরা চা খাই। একদিন চা খেতে খেতে খুনশুটি আলাপে সায়ন্তিকাকে বলে ফেলি, হয়তো ষোড়শ শতকে জন্মেছিল আমার প্রেমিকা এবং আমি জন্মেছি একুশ শতকে। বললো সে, মেয়ে হয়ে জন্মানো নাকি তার অপরাধ। খিস্তিখেউড় শোনা যার হয়ে ওঠে নিত্যদিনের অভ্যাস। অবশ্য সিগারেট টানার অভ্যাস আমি আজও ছাড়তে পারিনি। হঠাৎ বলে ফেলি, ধরো সায়ন্তিকা, একজন মানুষের ফাঁসি হয়ে যাচ্ছে, অথচ সে তখন পর্যন্ত জানে না, কী তার অপরাধ? এক্ষেত্রে তোমার অভিমত কী? তখন কৃষ্ণকাকা হাউমাউ করে কাঁদছে। কাঁদতে গিয়ে চোখ বেয়ে নেমে আসছে জল। বন্যার জলে ডুবে যাচ্ছে গ্রাম। কেবল সায়ন্তিকার চোখে জল নেই। মূলত তার চোখ-ই নেই। সে অন্ধ। নকুল, একটা দারুণ বিষয় আমার মাথায় এসেছে। এভাবে বলা শুরু করলো সায়ন্তিকা। আমি বললাম, বলো।
– জন্মগতভাবে আমরা সবাই মৃত্যুর আসামী, ঠিক না?
আমি বললাম, ঠিক।
– ফাঁসির আসামী কি কখনো বিচারককে ভালোবাসে?
আমি বললাম, না।
– তাহলে আমরা কেউ স্রষ্টাকে ভালোবাসি না।
আমি বললাম, কেউ কেউ তো বাসে।
সায়ন্তিকা বললো, কেউ ভালোবাসে না। প্রত্যেকেই ভালোবাসার ভান করে।
কৃষ্ণকাকা আমায় ঘুম ভাঙ্গার তাগিদ দিচ্ছেন। মূলত জীবনের তাগিদ আমাদের সর্বদা সচল রাখে। এদিকে আমি ভাবছি, হয়তো আমার প্রিয়তমা জন্মাবে অপর কোনো শতকে এবং আমি কাকতালীয়ভাবে জন্মে গেছি এই একুশ শতকে। আমাদের শতকের ব্যবধান ভেঙ্গে কি মিলন সম্ভব? কিংবা হয়তো সে কখনোই জন্মাবে না। লক্ষ লক্ষ শুক্রাণুর ভেতর সংগ্রাম করে ডিম্বানুর সঙ্গে মিলিত হওয়ার শক্তি হয়তো সে কখনোই সঞ্চয় করে উঠতে পারবে না। কিন্তু আমি ঘুমের গহব্বরে সায়ন্তিকার নগ্ন শরীরে কী খুঁজছি?–প্রশান্তির প্রকরণ।
ঘুমানোর আগে আমি পুরোপুরি চিন্তাহীন হয়ে যাই। অথচ তখনও ভাবনার ডালপালা, শাখা-প্রশাখা মগজের ভেতর বিস্তার করে। আমি বিস্ময়ে তাকাই, ভাবি, আমার অন্য কোনো সত্তা নিশ্চয়ই এখন ভাবছে, চিন্তা করছে? কই, আমি তো ভাবছি না। এভাবে ক্রমশ একসময় ঘুমিয়ে পড়ি। ঠিক তখন, স্বপ্নের ভেতর খাঁচায় বন্দী টিয়ে পাখিটি আত্মহত্যার পথ বেছে নিলে, আমি হতাশা ও বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে যাই। কাঁদি। হঠাৎ ভোরে ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখি, পাখিটি বেশ চঞ্চলতার সাথে পাখা নাড়াচ্ছে। তাহলে আমার বিগত অনুভূতি কি মেকি ছিল? নাকি এখন যা জাগ্রত মুহূর্ত বলে ঠাহর করছি সেটি মিথ্যে? সবসময় স্ববিরোধের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি এবং ক্রমশ হয়ে উঠছি নিঃসঙ্গ, একা। হয়তো নিজেই নিজের থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি ক্রমাগত।