———-সমাপ্ত———-
মা যেদিন বললেন আমার জন্য মেয়ে দেখেছে, সেদিনই আমার মনে কি যেন এক আশংকা দোলা দিয়ে ছিল। সমস্ত বিবেক স্তব্ধ হয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছিল। মায়ের মুখে বিজয়ে হাসিতে আমি সেদিন আর বলতে পারিনি- আমি বিয়ে করব না। অথচ, কত প্রতিজ্ঞা করেছি চিরকুমার থাকার জন্য। সে সব প্রতিজ্ঞা চোখের সামনে ধুলোয় পড়ে গড়াগড়ি করছে, আমি নির্বাক, অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না।
মানুষের জীবনের উপর থেকে এ বিষয়গুলো অবধারিত কি না জানি না, তবে হয় তো ইচ্ছে করলেই আমি এগুলোকে এড়িয়ে চলতে পারতাম। এ বিষয়ে বন্ধুদের মধ্যে অনেক কটাক্ষও শুনেছি। তারা একেকবার বলেছিল, এখন বলছিস বিয়ে করবি না, কিন্তু সময় মতো দেখবি ঠিকই দৌড়াচ্ছিস।
সত্য সত্যই আমি দৌড়াচ্ছি। জানি না এ দৌড়ের শেষ কোথায়!
মা বললেন, খোকা মেয়ে দেখতে রাজকন্যা, যেমনি রূপ, তেমনি গুণ। ও মেয়েকে ঘরে আনলে আমার ঘর আলোকিত হবে, তুই আর না বলিস না বাবা। বড় ভালো মেয়ে, তোদের দুজনে বড় মানাবে!
মায়ের সে কথায় সেদিন কথা বলিনি, সাহস করে মায়ের আনন্দভরা চোখের দিকেও চোখ রাখিনি। শুধু অপরাধির মতো বিবেকের কটাক্ষের কাছে বার বার পরাজিত সৈনিক হয়ে দাড়িয়ে থেকেছি। ভেবেছিলাম সকলের সামনেই বিয়েটাতে দ্বিমত করব। আমার সিন্ধান্তটা সকলকে জানিয়ে দেবো। কিন্তু যখন মায়ের কাছ থেকে একটি ছবি পেলাম। তখন বুকের মধ্যেটাতে আর একটা অজানা আশংকা ছুঁয়ে দিয়ে গেল। যদি হারিয়ে যায়!
আজন্মের সাধনা শেষ হতে চলেছে এ বিষয়ে আর কোন সন্দেহ রইল না। ছবিটা এখনও বুক পকেটে রাখি। মাঝে মাঝে খুব বেশি মনে পড়লে ছবিটা বুকে চেপে ধরি।
আমার সম্মতি পেয়ে বাবা বিয়ের দিন ধার্য করলেন। শেষ মেষ বিয়েও করে ফেললাম।
আমার অর্ধাঙ্গিনীর নাম অন্তিকা। বাবা মায়ের একমাত্র কন্যা। তিন ভাইয়ের একমাত্র বোন। অনেক আদরেই বড় হয়েছে। আমার শ্বশুরের অনেক সহায় সম্পত্তি আছে, শুনেছি মাঠেও নাকি অনেক জমি জমা আছে। তিনি সেগুলোই দেখা শোনা করেন। তাছাড়া গ্রামের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি হিসেবেই দু-পাঁচ গ্রামের মানুষও তাকে খুব ভালোভাবেই চেনেন।
অন্তিকা এ সংসারে এসে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই নতুন করে সংসারটিকে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে। মায়ের টুকিটাকি কাজগুলোতে সাহায্য করা, বাবাকে সময়মত ঔষধ খাওয়ানো তার প্রধান দায়িত্ব এখন। আমার দিকে দৃষ্টিপাত করার অবসরটুকুও যেন সে খুঁজে পায় না। মাঝে মাঝে প্রচণ্ড অভিমান হতো, আমি স্বামী আমার খোঁজ খবর নেবে না! কিন্তু মা যখন তার নববৌমার প্রসংশা করতেন তখন মনে হতো তাই তো, ভালোই তো আছি! মাঝে মাঝে আমাকে ডেকেও দেখাতেন খোকা দেখ, বৌমা আমার গ্রামের মধ্যে একটাই, পুরো গ্রাম তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও এমন চাঁদ পাওয়া যাবে না। বাবাও মাঝে মাঝে তার বৌমার প্রসংশায় পঞ্চমুখ করে গল্প করতেন। বলতেন, খুব ভাগ্যবান হলেই এমন পুত্রবধু কপালে জোটে! খোকা আমার বৌমার যেন গড়াদর হয় না।
অন্তিকার ফুল বাগানে বড় শখ ছিল। একদিন আমাকে ডেকে বলল, কই গো, শুনছো? একটু এদিকে আসবে?
আমি গিয়ে জানতে চাইলাম কী হয়েছে? মুখের দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসলাম। ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখা একগুচ্ছ রজনীগন্ধা যেন নিরব লজ্জায় মাটিমুখ হয়ে রয়েছে। বিয়ে হয়েছে কয়েক মাস হলো এখনো আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহসটুকুও সে অর্জন করতে পারেনি। হইত মেয়েদের স্বভাবই এমন! এই নিরিহ বধুটির চন্দ্রবদন দেখার সাধ আমার আজ মিটল। সত্যই তো সুন্দর! এরও কি প্রশংসা আছে! সুন্দরের প্রশংসা করা যায়; কিন্তু অপরুপ সুন্দরের প্রসংশা কী?
অন্তিকার সুকণ্ঠ মৃদু বাতাসে হঠাৎ দোলা দিয়ে গেল। বলল, আমাকে একটি বকুলের চারা এনে দিবে?
আমি অবাক হয়েছিলাম, বকুলের চারা কেন? গোলাপ চাইতে পারত, রজনীগন্ধা চাইতে পারত কিংবা আমার প্রিয় হাসনাহেনাও চাইতে পারত। এত কিছু রেখে বকুল, কেন?
এমনিভাবে কয়েক মাস চলে গেল। আমাদের সংসারের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নায় অল্প অল্প করে স্থান করে নিয়েছে অন্তিকা। প্রথম প্রথম বাড়ির কথা মনে করে খুব মন খারাপ করতো, ঘরের মধ্যে গুমটবেঁধে বসে থাকত। আমরা হৃদয়ের মধ্যে তখন যেন চৈত্রের শষ্যশূণ্য মাঠ! শুধুই খাঁ খাঁ। বেশ কয়েকবার আমি তাকে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে রেখেও এসেছি। আবার কিছুদিন পরে নিয়ে এসেছি। কিন্তু এখন আর বাড়ির কথা বলে না। যেনবা আমাদের বাড়িটাই তার নিজের, সে অন্যজন্মেও অন্যগৃহে জন্ম কিংবা বসবাস করে নাই।
সেইবার যখন সে বাবার বাড়ি যেতে চাইল আমি নিয়ে যাইনি, আমাকে অনুরোধও করেনি। শুধু যাবার বেলা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, তোমাকে আমার চিরকাল মনে থাকবে!
আমি সেদিন তার সে কথার কোনো জবাব দিতে পারিনি, শুধু তার অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে একবার তাকিয়েছিলাম। সে চোখের ভাষা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। অমাবশ্যার একরাশ গোমটবাঁধা বেদনা বহন করা হৃদয় বারবার আমাকে ধিক্কার জানাচ্ছে। তার পরিধি এতটাই দুর্বল যা অন্তরেই জন্ম নিয়ে সেখানেই ঝিমিয়ে যায়। কিন্তু তার সে ধিক্কার প্রতিরোধ করার কোনো ক্ষমতাই আমার ছিল না। তাই আজ রিক্তবদনে বসে থাকা। তা না-হলে হয়ত জীবনটা অন্যরকম হতে পারত!
আজ শ্রাবণের শেষ রাত। এসময় অন্তিকাকে খুব বেশি মনে পড়ছে। গতবছর এ রাতটি ছিল একাকী, এখনও একাকী। অন্তিকা এ সংসারে এসে যে বকুল গাছটি লাগিয়ে ছিল সেটির তলায় সবুজ শ্যাওলা জন্মেছে। বকুল ফুল বর্ষার বৃষ্টির মত ঝড়ে পড়ে। কিন্তু ওখানে যেতে সাহস পাই না, যদি অন্তিকার মতো শ্যাওলাগুলোও হারিয়ে যায়! এগুলো ছাড়া যে আমার কাছে অন্তিকার শেষ স্মৃতি কিছুই নেই।
শ্রাবণের ধারা আকাশ ফেটে ধরনীর বুকে লুটিয়ে পড়ে; কষ্টগুলো ভোলার জন্য। আমার বুকের ভিতরে যে শ্রাবণের মেঘ জমাট বেঁধেছে তাকে কি করে ধরনীর বুকে লুটিয়ে দেবো, কি করে শ্রাবণ জলের মতো মিশিয়ে দেবো মাটির বুকে নিজের অন্তর্দহনগুলো? অন্তিকাই তো শিখিয়েছিল যত দুঃখ-কষ্টই আসুক না কেন পুরুষদের কাঁদতে নেই। দেখ অন্তিকা, আমি কাঁদছি না, আমি তোমার সেই আগের মতোই আছি, যেমনটি তুমি রেখে গিয়েছিলে।
ক্রমাগত চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে, শ্রাবণের শেষ রাতে শ্রাবণকলঙ্ক ঘুচাবার জন্য মাথার উপরে এক চিলতি মেঘ এসে জমাট বাঁধতে শুরু করেছে, ধিরে ধিরে রাত গভীর হয়ে আসে। বকুল বাদলগন্ধে রাতের সাথে সাথে মিলিয়ে যায়। শুধু আমি একা বসে থাকি এই নির্জন শ্রাবণের শেষ রাতে…
———-সমাপ্ত———-