তিনি বললেন, “আমি একজন আর্টিস্ট।”
আমার হৃদয়ে বিস্ময় জাগ্রত হলো। লোকটি কে, কোথা থেকে এসেছেন সেটি জানার আগ্রহ বৃদ্ধি পেল বহুগুণ। গত কয়েকদিন ধরেই লক্ষ করছি, লোকটি গভীর রাতে বিন্নিতলায় এসে বসে থাকেন। আমি অবশ্য তার মতো অতিথি পাখি নই, আমি প্রতিদিনই আসি। দুঃসহ অতীতের নানা প্রকার যন্ত্রণা ভুলতে গভীর রাতে বিন্নিতলায় একাকী বসে থাকাটা আমার একরকম অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সাথে থাকে এক প্যাকেট সিগারেট। সবসময় যে বিন্নিতলাতেই বসে থাকি তা নয়। মাঝে মাঝে বিন্নিতলা ছেড়ে সামনের ত্রিকোণাকার মাঠের ঠিক মাঝখানটাতে গিয়ে বসি। চারপাশটা ভালো করে দেখি। আকাশ দেখি, অন্ধকার দেখি, মায়াবী চাঁদ দেখি, সবচেয়ে বেশি দেখি বিন্নিগাছটিকে। এই বিন্নিগাছের দাম নাকি কয়েক কোটি টাকা। একবার হাজারীবাগ থেকে জিগাতলা রিক্সাতে যাবার সময় এরকমই বলেছিলেন এক রিক্সাওয়ালা। বিন্নিগাছটা নাকি ফাঁপা, এর মধ্যে বসবাস করে বিশাল এক গুই সাপ। তার মাথায় আছে বড় একটি ম্যাগনেট। ওই ম্যাগনেটের জন্যই বিন্নিগাছটার দাম এত আকাশচুম্বী। এসব গাঁজাখুরি গল্পে অবশ্য আমি বিশ্বাস করি না। শিক্ষকদের কাছে শুনেছি, একসময় এই গাছের ছাল-পাতা দিয়ে চামড়া ট্যানিং করা হতো। তবে এসব কিছু আমার জিনিস নয়। আমি যখন গভীর রাতে বিন্নিগাছটির দিকে তাকিয়ে থাকি, আমার কাছে মনে হয়, ওই বিন্নিগাছটি জলজ্যান্ত কোনো একটা দুঃখী প্রাণী। যেন স্থিরভাবে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে আর জানান দিচ্ছে পৃথিবীটা নিষঙ্গতার।
শুধু যে চারিদিকটা আনমনে দেখতে থাকি তা নয়, মাঝে মাঝে গার্ডরুমের নাজিম চাচার নাকের ডাকও শুনি। বিকট সেই শব্দ। নাজিম চাচা অবশ্য রাত বারোটা-একটার আগে ঘুমান না, ঘুমালেও মাঝে মাঝেই মাঠের কোণার গার্ডরুম থেকে তিনি বেরিয়ে আসেন ভূতের মতোন। কতক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে এদিক ওদিক তাকিয়ে কী যেন খোঁজেন, তারপর আবার ঢুকে পড়েন গার্ডরুমে, আবার শুরু হয় নাসিকাবাদ্য।
এখানে যারা রাতের বেলায় আসে তারা সবাই হলের ছাত্র-ছাত্রী। রাত একটায় ঘড়ির কাটা টোকা মারলেই বেশিরভাগ জনই চলে যায় ঘুমানোর জন্য। আর শীতের সময়ে তো তেমন কেউ আসেই না। এখন অক্টোবর মাস। শীত শুরু হয়নি, তবে শীতের আসি আসি ভাব। তাই রাত বারোটার পর এখন আর কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। সকলে চলে যায়। সবাই চলে গেলেও আমি কিন্তু যাই না। আমি একা একা উপভোগ করি হালকা শীতের আমেজ, উন্মুক্ত মাঠের সবুজ ঘাসের সান্নিধ্য; আমার একাকীত্বকে।
এই শহরটাতে দু’বছর হলো এসেছি, তবু কোনো কিছুর সাথেই আমি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারি না। এই মানিয়ে নিতে না পারার দগ্ধতা আমার ভিতর প্রকটভাবে প্রভাব ফেলে। আমার মনে হয়, আমি এমন কোথাও এসে পড়েছি যেখানে কেউ নেই। শুধু আমিই একা। আমি ছাড়া আর সবাই সবার মতো। কিন্তু ওই যে লোকটি কয়েকদিন ধরে এখানে আসেন, লোকটার দিকে তাকালেই আমার মনে হয় লোকটির সাথে আমার বড্ড মিল আছে, লোকটি আমার মতোই; লোকটির বেদনাগুলো আমার বেদনার মতোই গভীর, স্থবির।
লোকটি আসেন সবাই চলে যাবার কিছুক্ষণ পরে, যখন আমি ছাড়া আর কেউ এখানে থাকে না তখন। রাত দুটোর পরে। এসে বিন্নিতলায় আধাঘণ্টা বসে থাকেন চুপচাপ। কোনো কথা নেই নড়াচড়া নেই, বলতে পারেন অনেকটা পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে বসে থাকেন। তারপর তিনি মাঠটা একবার চক্কর দেন খুব ধীর পায়ে, যেন তার বড্ড অসুখ করেছে, অথবা তার শরীরে তেমন শক্তি নেই। কিন্তু একটু ভালো করে লক্ষ করে আমি একদিন দেখলাম, লোকটি বয়স্ক কেউ নন। মাঝবয়সী। মুখে দাঁড়িগোফ কিছু নেই। চেহারা মাটি রঙের। সুঠামদেহী। চুলগুলো বড় হয়ে তার কাধ ছুঁই ছুঁই। এসব দেখে আপনার কাছে লোকটিকে খুব একটা অস্বাভাবিক মনে হবার কথা নয়, এমন মানুষ এই উদ্ভট নগরীতে কম নেই। কিন্তু না, আপনার তা মনে হবে না। কেননা, লোকটির আসল বৈচিত্র্য তার পোশাকে। নোংরা সাদা রঙের ছেঁড়া আলখেল্লা টাইপের কিছু একটা পরে থাকেন লোকটি।
প্রথম দু’চারদিন আমি বিষয়টাকে তেমন গুরুত্ব দিইনি। তবে আস্তে আস্তে আমার মাঝে লোকটির প্রতি আগ্রহ বাড়তে লাগলো। এই যে প্রতিদিন সবাই চলে যাবার পর তার বিন্নিতলায় আসা, কাটায় কাটায় আধা ঘন্টা বিন্নিতলায় বসে থাকা, তারপর আধা ঘন্টা পরে খুব ধীরে ধীরে ত্রিকোণাকার মাঠটাকে চক্কর দিয়ে চলে যাওয়া। এটা খুব অস্বাভাবিক। প্রতিদিন নিশ্চুপ কোনো একজন মানুষকে একটি নির্দিষ্ট সময়ে এরকম অদ্ভুত কাজ করতে দেখলে কার মনেই না শঙ্কা জাগবে না! আর এমন দৃশ্য কেউ নিস্তব্ধ গভীর রাতে একনাগাড়ে সপ্তাহখানেক দেখলে, তার মনে নানা প্রশ্নের উদয় হবে– এটাই স্বাভাবিক। আমারও তাই হয়েছে। আমার মনে এখন নানান প্রশ্নের ঝড়।
তাই একদিন বিন্নিতলায় এসে লোকটি বসবার পর পরই আমি তার কাছে গেলাম। ইতস্ততভাবে এক অযাচিত প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম, “আপনি কে?”
ঊনি আমার প্রশ্নের উত্তরটি দিলেন মাথা উঁচু না করেই। প্রতিদিন যেভাবে মাথা গুজে তিনি বসে থাকেন সেভাবেই রইলেন। খুব নরমসুরে তিনি বললেন, “আমি একজন আর্টিস্ট।”
তার কথা শুনে আমার হৃদয়টা শীতলতায় পূর্ণ হলো। এমন শুভ্র-শান্ত পুরুষ কন্ঠস্বর আমি আমার জীবনকালে কখনো শুনিনি। তার উপর তিনি যখন নিজেকে একজন চিত্রশিল্পী দাবী করলেন, তখন আমি আরও অবাক হলাম। এখানে, এই চম্রশিল্পের বিদ্যাপীঠের আঙিনায় নিস্তব্ধ গভীর রাতে একজন চিত্রশিল্পী কী কারণে আসবেন? তার কাজ কী এখানে?
আমি বললাম, “ইদানীং আপনি প্রতিদিন এখানে কেন আসেন?”
এবারেও আগের মতো অবস্থায় তিনি নরম সুরে বললেন, “রাতের সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে।”
আমি বললাম, “কই, আপনি তো এখানে এসে প্রতিদিন চুপটি করে মাথা গুজে বসে থাকেন। এভাবে কী রাতের সৌন্দর্য্য উপভোগ করা যায়?”
লোকটি বললেন, “সৌন্দর্য্য উপভোগের তুমি কী বোঝো? তুমি কী মনে করো, পূর্নিমার চাঁদ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে দেখাটাই উপভোগ করা? তুমি কী মনে করো, দেখার জন্য চোখের প্রয়োজন হয়?”
কথাটা বলে আচ্ছা বিপদেই পড়ে গেলাম বোধহয়। প্রতিউত্তরে আমি বললাম, “চোখ ছাড়া আবার মানুষ দেখে কীভাবে?”
আমার কথা শুনে লোকটি মৃদ্যু হাসলেন। হাসির স্বরটা বেশ রহস্যময়। তার মৃদ্যু হাসি শুনে আমার লোমকূপগুলো উত্তেজনায় খাড়া হয়ে উঠলো। তারপর তিনি বললেন, “এখনকার জেনারেশনের এই হলো গিয়ে এক সমস্যা। সব কিছু চোখ দিয়ে করতে চায়। চোখ দিয়ে খেতে চায়, চোখ দিয়ে উপভোগ করতে চায়।”
একথা শুনে আমার মনে হলো, আচ্ছা লোক তো! বিষয়টাকে পেঁচিয়ে পুঁচিয়ে আবার আমার দিকে একরকম প্রশ্ন ছুড়ে দিল! তার কথাটা যে অসত্য নয় আমি হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারলাম। তবে তার ওই নরম প্রশ্নের বিপরীতে আমি আরেকটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম, “আপনি কোন জেনারেশনের লোক?”
লোকটি কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। আমি তো ভেবেই বসেছিলাম এই প্রশ্নের উত্তরটি হয়তো তিনি দেবেন না। অথবা বলে বসবেন, আমি পূর্বের জেনারেশনের লোক! লোকটিকে দেখলে পূর্বের প্রজন্মের বলা যাবে না, কেননা, লোকটি বড়জোর আমার চেয়ে দশ-বারো বছরের বড়। কিন্তু প্রশ্নের উত্তর পাবার আশা ফুরিয়ে আসতেই, তিনি বলে উঠলেন, “আমার কোনো জেনারেশন নেই। আমি শূন্য একজন মানুষ। শূন্যদের কোনো জেনারেশন থাকে না।”
আমি এবার বলে উঠলাম, “বেশ মজার তো! এমন জেনারেশনের কথা আগে তো শুনিনি। আর এই যে আপনি বলছেন, আপনি শূন্য মানুষ, কিন্তু একটু আগেই দাবি করলেন, আপনি একজন আর্টিস্ট। একজন চিত্রশিল্পী কীভাবে শূন্য হয়?”
লোকটি এতক্ষণে আমার দিকে ফিরে তাকাবার মতো একটা প্রশ্ন পেলেন। তিনি আমার দিকে অবাক চোখে তাকালেন। তার প্রতি আমার যেমন আগ্রহ, তার চোখে আমার প্রতি তেমন একটা আগ্রহ টের পেলাম। তিনি সেই আগ্রহ লুকিয়ে রাখলেন না। শিল্প ও শূন্যতার তত্ত্ব আমাকে বুঝাতে লাগলেন তিনি। তার মতে, শূন্যতায় শিল্পের সৃষ্টি হয়, পূর্ণতা শিল্পের অন্তরায়। কেউ পূর্ণ হয়ে গেলে তার ভেতরটা থেকে ভালো কোনো শিল্প বের হয় না৷ একজন পূর্ণতায় ভরা মানুষ শিল্পচেষ্টায় মগ্ন হলে তার শিল্প থেকে দুর্গন্ধ বের হয়। এসব কথা বলা শেষ করে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কী করো?”
আমি বললাম, “আমি আপনার মতো চিত্রশিল্পী নই। আমি একজন ছাত্র।”
তিনি আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “তুমি খুব ভালো ছাত্র।”
কথাটা শুনে আমার হাসি পেল বটে। কেননা, এখানে পড়তে আসার পর থেকে আমাকে কেউ ভালো ছাত্র বললে আমার লজ্জা লাগে। পরীক্ষার পূর্বরাত্রি বাদে পড়ার টেবিলে বসাটা হয়ে উঠে না।
তাই আমি বললাম, “আমাকে আপনি মোটেই ভালো ছাত্র বলতে পারবেন না। আসলে আমি একদম ফাঁকিবাজ গোছের ছাত্র। পড়াশুনাতে তো আমার একটুও মনোযোগ নেই।”
তিনি আমার কাঁধে হাত রাখলেন। তার শীতল হাতের ছোঁয়ায় আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হলেও নিজেকে সামলে নিয়ে স্বাভাবিক থাকলাম। তিনি আমার কাঁধে হাত রেখেই বললেন, “ছাত্র সবাই হতে পারে না। তুমি একজন উত্তম ছাত্র। তুমি যেদিন শূন্য জেনারেশনে পৌঁছাতে পারবে সেদিন তুমি সব বুঝতে পারবে।”
আমি কথাটির আগামাথা কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না৷ তিনি উঠে দাঁড়ালেন। ধীর পায়ে মাথা নীচের দিকে রেখে তিনি মাঠটি চক্কর দেওয়া শুরু করলেন। আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, তিনি ঠিক আধা ঘন্টা পরেই তার হাঁটাহাঁটি শুরু করেছেন। আমি চোখ মেলে তার সাদা আলখেল্লা, তার লম্বা চুল, তার ধীর পায়ে হেটে চলা পূর্নিমার রাতে স্পষ্ট দেখতে পেলাম।
পরদিন আমি ঠিক মাঠের মাঝখানে বসে সিগারেট ফুঁকছিলাম। মাথায় জগতের শত চিন্তা। সারাদিনের হিসেব নিকেশ কষছিলাম। বাবার অসুস্থতা আমার মনে নতুন শঙ্কা সৃষ্টি করেছে। ভাবছিলাম এবার একটা কিছু করতে হবে। নিজের খরচ নিজেকে চালাতে হবে। পরিবারের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। এসব দুনিয়াবি চিন্তায় যখন আমি মশগুল, তখন অনুভব করলাম, কেউ একজন আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। আমি পিছন ফিরে দেখি সেই লোকটি। হঠাৎ করে লোকটি আজকে মাঠের মাঝখানে কেন আসলেন বুঝলাম না। এমন তো এ ক’দিনে হয়নি! তাহলে তার আগমনের কারণ কী? আমি কিছু বলে ওঠার আগেই তিনি আমাকে বললেন, “আমার সাথে যাবে?”
আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, “কোথায়?”
তিনি বললেন, “আমার বাড়িতে। আমার চিত্রকর্মগুলো তোমাকে দেখাতে চাই।”
আমি মাথা নাড়লাম। তিনি হাঁটতে শুরু করলেন। মাঠটা একবার চক্কর দিয়ে তারপর নৌশ প্রহরীর কক্ষ (গার্ড রুম) দিয়ে বাইরে বের হলেন। আমিও তার পিছু পিছু গেলাম। রাতের বেলায় পাঁচিলে ঘেরা মাঠটির মূল ফটক সাধারণত বন্ধ থাকে। তাই নৌশ প্রহরীর রুমের কোণের একটা ছোট্ট দরজা দিয়ে ছাড়া যাওয়া-আসার উপায় থাকে না। বুঝতে পারলাম, লোকটির এই ফটকটি ভালোভাবেই চেনা।
মাঠ থেকে বের হয়ে আমরা সেই গভীর রাতে চলতে থাকলাম রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের বৈদ্যুতিক আলোর পথ ধরে। এই রাস্তায় পথ চলা দুষ্কর। রাস্তার পাশের ড্রেনগুলো ট্যানারির বর্জে ভরপুর; যেন উপচে উপচে পড়ছে। প্রথম প্রথম আমার এসব দেখলে বমির উদ্রেক হতো। সময়ের সাথে সাথে সব সয়ে গেছে। এখন চামড়ার গন্ধ নাকে আসলে মনে হয় টাকার গন্ধ।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে ট্যানারি মোড়ের দিকে গেলাম। তারপরও আমাদের যাত্রা শেষ হলো না। আমরা হাঁটতে থাকলাম। শেষমেশ রায়ের বাজারের একটি ভগ্নপ্রায় বাড়ির সামনে এসে আমাদের যাত্রা সমাপ্ত হলো।
লোকটি বাড়িটির দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই যে বাড়িটি দেখছো। এই বাড়িটি আমার। বাড়ির মালিকের কাছ থেকে আমি বাড়িটি চড়া দামে কিনেছিলাম বছর দশেক আগে।”
আমি চোখ মেলে দেখলাম। দোতলা জীর্ণশীর্ণ বাড়ি। কোথাও কোনো আলোর রেখা নেই। স্বভাবতই বুঝলাম, লোকটি নির্জনতা পছন্দ করেন। বাড়িটি দেখেই আমার গা ছম ছম করে উঠলো। পূর্ণিমার রাত হওয়ায় অবশ্য বাড়ির চেহারা বুঝতে বেগ পেতে হলো না। এখানে ওখানে প্লাস্টার উঠে গেছে, লোহার দরজা জানালায় জং ধরেছে। আমার কাছে বাড়িটাকে ভূতুড়ে বাড়ি মনে হতে লাগলো। তাই বলেই বসলাম, “এমন দশা কেন আপনার বাড়ির?”
লোকটি কিছুক্ষণ চুপ থেকে তার বাড়ির দিকে তাকিয়ে আমার কথার উত্তরে বললেন, “জানো, বাড়িটা যখন কিনেছিলাম তখন এটি সুন্দর ছিল। চকচকে ছিল। তারপর দিনে দিনে বাড়িটির চেহারা পাল্টে গেল। ধীরে ধীরে বাড়িটি জীর্ণশীর্ণ হয়ে উঠলো। মানুষের বয়স বাড়তে থাকলে মানুষ যেমন কুঁচকে যায়, বাড়িটিও যেন আজকাল কুঁচকে যাচ্ছে। এখান থেকে আমি শিক্ষাগ্রহণ করি। জীবনের মানে খুঁজে পাই। শুধুমাত্র এটা দেখার জন্যই আমি বাড়িটা কিনেছিলাম। আমি বাড়িটার প্রটিটি ইঞ্চি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি, যাতে আমি জীবন সম্পর্কে জানতে পারি।”
আমি বিস্ময়ের সাথে বললাম, “তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন, আপনি এই বাড়িটাকে আপনার শিক্ষক মনে করেন!”
তিনি আনমনে বলে গেলেন, “শিক্ষক? হ্যা। শুধু শিক্ষক নয়। বহুমূল্য মহান শিক্ষক। বাড়িটি আমি চড়া দামে এইজন্যই কিনেছিলাম, যাতে আমি টাকা উশুলের জন্য বেশি বেশি শিখতে পারি।”
আমি হলফ করে বলতে পারি, আপনার সাথে জীবনে এমন উদ্ভট মানুষের দেখা হয়নি। তাই লোকটির সাথে তার বাড়ির সম্মুখে এসে নিজেকে যতটা না ভাগ্যবান মনে হলো, তার চেয়ে বেশি অসহায় মনে হতে লাগলো। এছাড়া আমি ভাবতে লাগলাম, যে লোকটি এতটা অদ্ভুত। তার চিত্রকর্মগুলো না জানি কতটা অদ্ভুত!
তিনি তার বাড়ির দরজা খুললেন। শহুরে বাড়ি যেমন হয় তার বাড়িটাও তেমন। তিনি ভেতরে ঢুকেই কোথা থেকে একটা মোমবাতি এনে জ্বালালেন। এর অর্থ হচ্ছে এই বাড়িটিতে কোনো বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। তিনি মোমবাতি জ্বালাতেই বুঝলাম বাড়িটির বেশিরভাগ ঘর অব্যবহৃত। ঠিক কয়টা ঘর বাড়িটাতে বলতে পারবো না। তবে বাড়িটি যখন চকচকে ছিল তখন সেটি যে দারুণ জমকালো ছিল তা নির্দ্বিধায় বলা যায়– বাড়ির সেকেলে আসবাবপত্রই তার প্রমাণ। চারিদিকে মাকড়শার জাল পুরো ঘরগুলোকে জঞ্জাল বানিয়ে রেখেছে, ঘুণধরা আসবাবপত্র থেকে শুরু করে সবকিছু অবহেলায় পড়ে রয়েছে, যেন কোনো কিছুর সাক্ষী! মেঝেতেও প্রচুর ধুলো। আমি কোনো কথা না বলে তার পিছু পিছু গেলাম। আমার মনে হলো, এসবই হচ্ছে উদ্ভট নোংরা লোকটির শিক্ষার উপকরণ। কিন্তু না, একটু পরেই বুঝলাম, লোকটি নোংরা নয়। মোমবাতি হাতে হাঁটতে হাঁটতে তিনি একটি পরিষ্কার দরজার সামনে থমকে গেলেন। আমি স্তন্ধ হয়ে গেলাম। এমন নোংরা বাড়িতে এত পরিষ্কার একটা দরজা আসলো কোথা থেকে? দরজাটা এতটা পরিষ্কার যে মোমবাতির আলোতেই আমার মুখটা দরজায় ভেসে উঠলো। তিনি কোনো বাক্যব্যয় না করে মোমবাতিটি আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ঘরটা খুললেন। আমি ভিতরে ঢুকলাম। প্রথমে একটি মোমবাতির ক্ষীণ আলোয় বুঝতে পারলাম না ঘরের মধ্যে কী আছে। আমি মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলাম কক্ষের মাঝখানে। কয়েক মূহুর্তের মধ্যেই তিনি পুরো ঘরের বিভিন্ন জায়গায় সজ্জিত মোমবাতিগুলো জ্বালিয়ে দিলেন। আমার চোখে ধাঁধাঁ লেগে গেল। একদম চকচকে পরিষ্কার ঘরটি। কোথাও একটু ধুলোর অস্তিত্ব নেই, সবকিছু সাজানো গোছানো, যেন একটু আগে কেউ স্বযতনে ঘরটা পরিষ্কার করে রেখে গেছে। ঘরের চারিদিকে সুসজ্জিত তার চিত্রকর্মগুলো। একপাশে গাদা করে রাখা হয়েছে আরও অনেক চিত্রকর্ম। আমি সেগুলোর একটির দিকে তাকালাম।
মাথাল মাথায় একজন কৃষক একটি বাঁশের লাঠি হাতে। তার অন্য হাতের প্রসারিত তালুতে কয়েকটি শষ্য দানা। তার বুকের বামপাশে উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত শষ্যগাছ। ছবিটির বিশেষণ এখানেই শেষ নয়। ছবিটির মূল তাৎপর্যপূর্ণ দিক হচ্ছে কৃষকের আবেগী চোখ, ম্লান মুখ। পুরো ছবিটিতে একটা দুঃখী ভাব যেন ঠিকরে বের হচ্ছে। নাহ! ছবিটি অদ্ভুত নয়, সাধারণ নয়। ছবিটি বাস্তবিকতার রূপক, ছবিটি অসাধারণ । এই চিত্রকর্মটি একটি গল্পের মতো। দেখলেই মনে ভেসে উঠবে একজন কৃষকের জীবন।
এছাড়াও অনেক চিত্রকর্ম। ধর্ষিতা নগ্ন এক নারীর আত্মহননের দৃশ্য। মুখঢাকা বোরকা পরা কোনো এক প্রেয়সীর চিত্র। শাড়ি পরা রমণীর প্রতীক্ষায় থাকা চাতক দৃষ্টি। মৌলিক অধিকারহীন শহরের টোকাই। রাস্তার পাশের ড্রেনের চিত্র। ব্যস্ত রাস্তায় বসে পড়া পঙ্গু কোনো ভিক্ষুকের বেদনা– সবই ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। অথবা দুর্বোধ্য সব সাংকেতিক চিত্র। সেসব সাংকেতিক চিত্রের ভাষা বোঝার সক্ষমতা আমার হয়ে ওঠেনি। আমি বুঝতেও চাইনি। আমার মতে, সেই মূহুর্তে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পী সেই লোকটি, যার চোখ দিয়ে সর্বদা ঠিকরে বের হত আমার মতোই বেদনারশ্মি। সেই চিত্রশিল্পীর সাথে দেখা হবার অনেক বছর হয়ে গেছে। তবে আজও আমি তাকে ভুলতে পারি না। আমি আজও রয়ে গেছি তার অঙ্কিত শঙ্কিত ধর্ষিতা নারীর প্রেমিকরূপে।
সেদিন লোকটি আমাকে তার চিত্রকর্মগুলো দেখাতে দেখাতে একটি গল্প বলেছিলেন। গল্পটি চমৎকার। আমি মগ্ন হয়ে সেই গল্পটি শুনেছিলাম।
অনেক বছর আগে এক দেশে এক রাজা বাস করতেন। কিন্তু অবাক করার বিষয় হচ্ছে, সেই দেশে কোনো প্রজা ছিলো না। একদিন রাজাটি পাশের রাজ্যের এক সুন্দরী রাজকুমারীকে বিয়ে করে নিয়ে আসলেন। রাজকুমারী রাজ্যে এসে তো অবাক! এ কেমন রাজ্য? এ রাজ্যে তো নেই কোনো সৈন্যসামন্ত, নেই কোনো রাজকর্মচারী! শুধু আছেন একজন। তিনি হলেন রাজা। তারপর তার মনে ভাবনা আসলো, এই যদি হয় এক বিশাল রাজ্যের অবস্থা, তাহলে কেন অন্য রাজ্যের কেউ সেই রাজ্যটি দখল করছে না। ধীরে ধীরে রাজকুমারী সব বুঝতে পারলেন। তিনি একদিন আবিষ্কার করলেন, সেই রাজ্যের রাজা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাদুকর। তিনি তার প্রজা, রাজকর্মচারী, সৈন্যসামন্ত এমনভাবে উধাও করে রেখেছেন তা কেউ বুঝতে পারে না। তার জাদুর ক্ষমতার কাছে সবাই নস্যি। তাই কেউ তার রাজ্য আক্রমণ করে না। একথা জানার পর থেকে রাজার সাথে তার সখ্যতা বেড়ে গেলো, তার ভিতর রাজার জন্য প্রেম জাগ্রত হলো। রাজকুমারী রাজ্যের প্রকৃত রাণীতে পরিণত হলেন। রাজাও তাতে খুশি। কিন্তু তাদের সেই সুখ বেশিদিন রইলো না। রাণী রাজ্যের একাকীত্বে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। জাদুকর রাজা তার সকল জাদুবিদ্যা দিয়ে রাণীকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। রাণী আর রইলেন না, জগতের মায়া ত্যাগ করে পাড়ি জমালেন ওপাড়ে। রাণীর মৃত্যুর পর রাজা মনের দুঃখে অস্থির হয়ে উঠলেন। তিনি তার সকল প্রজা, সৈন্যসামন্ত, রাজকর্মচারীদের ফিরিয়ে আনলেন। তবে তারপর থেকে সেই রাজ্যের রাজা উধাও!
গল্পটি শুনে আমি তাকে বললাম, “তারপর?”
লোকটি বললেন, “পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাদুকরের জাদুর খেলাটা বুঝতে পারাটা সহজ নয়।”
আমি কথাটার অর্থ বুঝতে পারলাম না। বুঝতে চেষ্টাও করলাম না। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, পৃথিবীর সবকিছু বুঝে ওঠা খুব একটা জরুরী নয়। আমার মনে তখন একটিই ভাবনা, আমি তবে পৃথিবীর সেরা চিত্রশিল্পীর সান্নিধ্যে আছি। এটা আমার জন্য কতটা সৌভাগ্যের বিষয় মনে হয়েছিল, আমি তা বলে বুঝাতে পারবো না।
আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, “কেন তিনি ফুল, পাখি, নদী, শস্যক্ষেত, পাহাড়, পর্বতের দৃষ্টিনন্দন ছবি আঁকেন না?”
তিনি আমাকে বলেছিলেন, “আমি যখন প্রতিদিন সকালে উঠে পত্রিকার প্রথম পাতায় ধর্ষিতার ছবি দেখি, না খেতে পাওয়া টোকাইয়ের গল্প দেখি, নির্যাতনের কলাম দেখি, লাশের সংখ্যা দেখি– তখন আমার হৃদয়ের দৃশ্যপটে ফুল-পাখি-নদী-পাহাড় আসে না। আমার মানসপটে এগুলোর পরিবর্তে ভেসে ওঠে এক স্বপ্নিল কৃষকের ছবি, যে তার ফসলের ন্যায্যমূল্য পায়নি। এই অস্থির সময়ে যারা ফুল-পাখি এঁকে অন্যের মনোরঞ্জন করে বেড়ায় তাদের আমি শ্রদ্ধা করি। তবে আমি এযুগে এসে তাদের শিল্পী বলি না। একজন শিল্পীর মন হতে হয় বাস্তবতা দ্বারা শাণিত। দগ্ধতা দ্বারা পরিশুদ্ধ।”
আমি শুধু তার জ্বলজ্বলে চোখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে লাগলাম। অনুভব করতে লাগলাম জীবন, বাস্তবিকতা আর স্বপ্নকে। আবিষ্কার করতে লাগলাম শূন্য জেনারেশনের একজন মানুষের অনুভূতিকে।
যাই হোক, তার চিত্রকর্মগুলো দেখার পরে আমি শেষরাতের দিকে টলতে টলতে আমার হলে ফিরলাম। হল জিনিসটা আজকাল অতটা ভালো লাগে না। পানশে মনে হয়। ঢাকাকে আরও বেশি। মন চায় সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে চলে যাই কোনো এক গ্রামে। যেখানে সবুজ মাঠ আছে, গরু আছে, গরুর রাখাল আছে। সেই গ্রামে একটা খড়ের কুঁড়েঘর থাকবে আমার। আর থাকবে একখণ্ড জমি, যে জমিতে আমি ধান আর শাকসবজি চাষ করবো। কিন্তু মন চাইলেই সবকিছু করতে পারি না। আমি এখন ইট পাথরের নগরের বাসিন্দা। এসব নানা ভাবনায় ডুবে যাওয়া আমার প্রতিরাতে ঘুমাবার আগের নেশা। এ থেকে মুক্তি কিসে? জানতে চেয়েছিলাম এক সাধু ফকিরের কাছে। সাধু বলেছিল, সিদ্ধি লাভ করো। তাহলেই পথ দেখাবো।
তার কথা মনে হলেই নাকের কাছে আমি গাঁজার গন্ধ পাই। ঘুম আমাকে কাছে ডাকে। আমি ঘুমরাজ্যের রাজকুমারীর ডাকে চলে যাই ঘুমরাজ্যে। বড়ই বিচিত্র ব্যাপার। তারপর কখন যে সকাল হয় কিছুই টের পাই না। উঠে দেখি, ঘড়ির কাটা অবিরাম চলছে। ঘড়ির কাটার কোনো ঘুম নেই। সময়ের কোনো ঘুম নেই। ঘুম আছে শুধু আমার আর সেই চিত্রশিল্পীর। আর যারা ঘুমায় সবাই ঘুমের অভিনয় করে চলেছে নিত্যদিন। তাদের ঘুমের কোনো মানে নেই। আমাদের ঘুম বড়ই বিচিত্র। বড়ই প্রশান্তির।
সেই রাতের পর থেকে আমি অনেক খুঁজেছি সেই চিত্রশিল্পীকে। নাহ, খুঁজে পাইনি। তার খোঁজ পাওয়াটা সহজ নয়। হাজার হলেও তিনি হচ্ছেন পৃথিবীর সেরা শিল্পী। তাকে খুঁজতে খুঁজতে কয়েক বছর পেরিয়ে যায়। আমি তবু হাল ছাড়ি না। আমি শুধু তাকে নয়, তার সেই বাড়িটাকেও খুঁজেছি হন্য হয়ে। রায়ের বাজার চষে বেড়িয়েছি দিনের পর দিন। তবে কেউ সেই জীর্ণশীর্ণ দোতলা বাড়ির খবর বলতে পারে না। যে নির্জন রাস্তার নির্জন গলিতে তার বাড়ি ছিল, সেই রাস্তাও আর খুঁজে পায় না আমি।
বছর তিনেক পরে আমার একাডেমিক পড়াশুনা শেষ হলো। আমার পড়াশুনা শেষ হবার আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন আমার জন্মদাতা-জন্মদাত্রী। আমি নিজেকে এখন আরও অসহায় ভাবি, কিন্তু এখন আর থেমে থাকতে পারি না। আমাকে ছুটতে হয় এখন। বিন্নিতলায় বসে সিগারেট ফুঁকে বেরুলে আমার আর এখন চলে না। আমাকে আমার জীবনটাকে সাজাতে হবে। আমাকে তাদের স্বপ্ন পূরণ করতে হবে। এসব ভাবনায় আমি চাকুরির পিছনে ছুটতে লাগলাম লাগামছাড়া ঘোড়ার মতো। তবে একদিন আমি বুঝতে পারলাম, চাকুরীর বাজারে আমার কদর নেই, সেখানেও আমি নিঃস্ব। তাই সময়ের সাথে সাথে চাকুরির প্রস্তুতিও কমিয়ে দিলাম। চাকুরির আশাটাই ছেড়ে দিয়েছিলাম আমি। ভেবেছিলাম নতুন কিছু করতে হবে আমাকে। এমন কিছু হয়ে যেতে হবে আমাকে যাতে করে এই ব্যস্ত শহরের সবাই এক নামে আমাকে চেনে। ঠিক এমন একটি সময়ে আমার জীবন যখন স্থির, ঠিক তখনি একটা চাকুরীর সাক্ষাতকারে আমি ডাক পেলাম। আমি ভেবে নিলাম হয়তো এটাই আমার শেষ পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় পাশ না করতে পারলে হয়তো আমি হয়ে যাব নাবিকবিহীন একটি নৌকো।
কিন্তু না, সেরকমটি হলো না। আমি সেই চাকুরীর পরীক্ষার ভাইভা বোর্ডে তাকে খুঁজে পেলাম। আমার নাবিককে খুঁজে পেলাম। সেই লোকটিকে আমি খুঁজে পেলাম, যে লোকটিকে আমি বছরের পর বছর ধরে খুঁজে চলেছি। সেই শিল্পী, সেই চোখ, সেই ব্যক্তি। ভুল হবার কোনো সুযোগ নেই, তাকে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, “পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাদুকর কে?”
আমি দেখলাম, ভাইভা বোর্ডের আর সবাই বিস্ময় ভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি শুধু তার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তাকে বুঝবার চেষ্টা করলাম। আমার মনেও সেই পুরনো প্রশ্ন, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাদুকর কেন উধাও হলেন?
তবে না, এই প্রশ্ন ওখানে করা অশোভন। আমাকে আজ একটা উত্তর দিতেই হবে। তাই আমি বলে উঠলাম, “পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাদুকর একজন শিল্পী।”
তিনি বললেন, “কোন শিল্পী?”
আমি বললাম, “যে শিল্পী গাইতে চায়, কিন্তু গাইতে পারে না।”
তারপর তিনি আর আমাকে কোনো প্রশ্ন করলেন না। আমি ভাইভা বোর্ড থেকে বেরিয়ে এলাম কিছুটা উত্তেজিত হৃদয় নিয়ে। আমার সকল অস্থিরতা সেই চিত্রশিল্পীকে ঘিরে। তিনি ফিরে এসেছেন আবার ব্যস্ত, নোংরা এই নগরীতে। আমাকে যে করেই হোক আবার তার সাথে দেখা করতে হবে। আমাকে জানতেই হবে সেই জাদুকর এখন কেমন আছেন! আমার মধ্যে বদ্ধমূল একটা ধারণা জন্মেছে, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাদুকর কখনো মরতে পারেন না। তিনি শুধু উধাও হতে পারেন।
তাই বহুদিন বাদে বিন্নিতলায় আবার আমি ফিরে এসেছি। আমি অপেক্ষায় রয়েছি কখন তিনি আসবেন। আমার বিশ্বাস তিনিও আমার সাথে দেখা করতে চান। তিনি তার নতুন চিত্রকর্মগুলো আমাকে দেখাতে চান। হয়তো তিনি এবার আমাকে দেখাবেন একটি রক্তাক্ত লাশের চিত্রকর্ম, যে লাশ আবার জ্যান্ত হবার জন্য উদগ্রীব। কিন্তু না, তিনি আসলেন না। রাত একটা, দুটো, তিনটে পেরিয়ে গেল। তবু তিনি আসলেন না। তার বদলে আমার সামনে আসলো একটি ছেলে। হয়তো এখানেই পড়ে। আমি ছেলেটির চোখের দিকে তাকালাম। ছেলেটির চোখেও আমার মতো বেদনা! আমি বুঝতে পারলাম, ছেলেটি একজন উত্তম ছাত্র। প্রতিটি উত্তম ছাত্রই উৎসুক বিষয়ে প্রশ্ন করে থাকে।
ছেলেটি আমাকে প্রশ্ন করলো, “আপনি কী একজন আর্টিস্ট?”