মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়

শুধুই আমার

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

‘এসো এসো বৌদিভাই। এই দেখ, এই হলো তোমার ঘর। কী সুন্দর করে সাজিয়েছে ছোড়দাভাই। তাই না?’ হাত ধরে টানতে টানতে বীথি নিয়ে আসে রঞ্জাকে।

নতুন বউ রঞ্জা সদ্যই পা রেখেছে শ্বশুরবাড়িতে। এখনও মনে নানা দোলাচল। চোখদুটো আচমকা জলে ভরে ওঠে। সেই মানুষটাকে যে কোনদিন ভুলতে পারবে না রঞ্জা। সবার চোখ বাঁচিয়ে নিজের চোখের জলটা মুছে সামনে তাকায় রঞ্জা। হ্যাঁ, এখন থেকে এই ঘরটাই হবে ওর পৃথিবী। এই ঘরটাকে ভাবতে হবে নিজের ঘর। ভালো করে চোখ বুলিয়ে দেখে। নাহ, ভদ্রলোকের রুচিবোধ আছে।

এই বিয়েটায় রঞ্জার একেবারেই মত ছিল না। বাবার হঠাৎ অসুস্থতা রঞ্জাকে অসহায় করে তোলে। আর ওইসময় বাবাকে শান্ত, নিশ্চিন্ত করতে এছাড়া তার সামনে আর কোনো পথ ছিল না। বাধ্য হয়েছিল বাবাকে কথা দিতে। নাহলে তার পক্ষে ধৃতিকে ভোলা…

# # #

ফেসবুকে আলাপ ধৃতিমানের সঙ্গে। সুদর্শন না হলেও বেশ স্মার্ট। ছবি দেখে রঞ্জার তাই মনে হয়েছিল। পরে সামনাসামনি দেখে ধারণা পাল্টায়নি। আর তার পরেই একটু একটু করে আলাপ গাঢ় হয়। গড়ে ওঠে এক পরিপূর্ণ ভালবাসার সম্পর্ক।

ধৃতিমান সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। সেক্টর ফাইভে একটা নামি কোম্পানীতে চাকরি করত। ধৃতি কলকাতায় থাকলেও ওর ফ্যামিলি থাকত ধানবাদে। মা, দুই ভাই, দুই বোন। বাড়ির বড় ছেলে হবার জন্য ধৃতির দায়িত্ব ছিল অনেক। অবশ্য এটা সে হাসিমুখেই সব করত। বাড়ির প্রতিটা লোকের ওপর ছিল তার ভীষণ ভালবাসা। খুব অল্পবয়সে বাবাকে হারিয়েছে। মা তার ওপর খুব নির্ভর করে। ভালবাসার গভীর অধ্যায়ে ক্রমশ এসব জানতে পারে রঞ্জা। এই সব কথা যখন ধৃতি বলত তার মুখে অদ্ভুত এক আলো ছড়িয়ে পড়ত।

ছোট সচ্ছল পরিবারের মেয়ে রঞ্জা। বাবা মা আর সে। মা গৃহবধূ। বাবা পোস্ট এন্ড টেলিগ্রাফে বেশ উঁচু পোস্টে কাজ করেন। রঞ্জা নিজে একটা বেসরকারি স্কুলে চাকরি করত। ধৃতির কাছে নিজেদের পরিবারের খুঁটিনাটি কথা জানিয়েছে সে।

বিয়ের ব্যাপারে রঞ্জাই বেশি আগ্রহী ছিল। কিন্তু আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকা সত্ত্বেও বিয়েতে বাধা হয়ে উঠেছিল ধৃতির দিদি। শ্বেতী থাকার জন্য অনেকগুলো সম্বন্ধ নাকচ হয়ে গিয়েছিল। অথচ ধৃতির মা মেয়ের বিয়ে না দিয়ে ছেলের বিয়ে দিতেও নারাজ। তাই চাইলেও ধৃতি বাড়িতে বলে উঠতে পারেনি তার আর রঞ্জার সম্পর্কের কথা। বিয়ের কথা তো অনেক দূর। অথচ রঞ্জার চাওয়াও তার কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ।

একদিন হঠাৎ-ই ধৃতি বলে রঞ্জাকে, ‘চল রেজিস্ট্রির নোটিশটা দিয়ে আসি।’

অবাক হয়ে রঞ্জা বলে, ‘হঠাৎ!’

‘খুব ইচ্ছা করছে জানো, সম্পর্কটাকে একটা পাকাপোক্ত বাঁধনে জড়াতে। কিছুই না। রেজিস্ট্রিটা করে রাখব। একটা আংটি কিনে তোমায় পরাবো। ভাই তো দুর্গাপুরে চাকরি করে দুদিনের জন্য ছুটি নিয়ে আসতে বলব আমাদের রেজিস্ট্রি বিয়ের সাক্ষী দেবার জন্য। মাকে সময়মত পরে জানাব। আর তুমি দেখো যে করেই হোক দিদির বিয়েটা সামনের বছরের মধ্যেই ব্যবস্থা করে ফেলবো। তারপর নো চিন্তা। লাল টুকটুকে বেনারসী আর একমাথা সিঁদুর নিয়ে তুমি পাকাপাকিভাবে এন্ট্রি নেবে আমার বউ হয়ে আমাদের বাড়িতে। মিস রঞ্জা বোস থেকে মিসেস রঞ্জা মিত্র’, বলেই হা হা করে হেসে ওঠে ধৃতি।

রঞ্জা জানে ধৃতি ভীষণভাবে আবেগপ্রবণ। আর এই কারণে রঞ্জার ভালবাসা বহুগুণ বেড়ে যায় ধৃতির ওপর। সম্মতি জানাতেই খুশিতে উচ্ছল হয়ে ওঠে ধৃতি।

এরপর বেশ তড়িঘড়ি করে রেজিস্ট্রি অফিসে নোটিস দেয়। তারপর জুয়েলারি হাউস থেকে একটা খুব সুন্দর ডায়মন্ড আর চুনী বসানো রিং কেনে ধৃতি। রঞ্জাকে কিচ্ছু কিনতে দেয় না। বলে, ‘আজ নয় গো। তোমার কাছ থেকে উপহার নেবো সেই বিশেষ দিনে আমাদের বাড়িতে।’

এর দিন তিনেক পরই খুব সকালে ফোন আসে ধৃতির।

‘রঞ্জা, একটা বড় অঘটন ঘটে গেছে। দিদি সুইসাইড অ্যাটেম্পট করেছে। কন্ডিশান সিরিয়াস। জানি না বাঁচাতে পারব কিনা। মা একেবারে ভেঙ্গে পড়েছে। আমি ধানবাদ যাচ্ছি। কবে ফিরতে পারব কিছু বুঝতে পারছি না। তুমি চিন্তা করো না। আমি ঠিক টাইম টু টাইম তোমায় খবর দেব।’

অজানা আশঙ্কায় রঞ্জার বুকের ভিতরটা কেঁপে ওঠে। আর মাত্র কয়েকটা দিন পরেই ওদের রেজিস্ট্রি। আর এর মাঝে একি অঘটন! হে ঈশ্বর, দিদিকে তুমি সুস্থ করে দাও। ধৃতিকে ঠিক সময়ে আমার কাছে এনে দাও। আমরা যে ওই দিনটা নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছি।

এরপর থেকে প্রতিটা মুহূর্ত অসহ্য হয়ে ওঠে রঞ্জার কাছে। দুদিন কেটে যাবার পরও কোনো খবর না পেয়ে ফোন করে ধৃতিকে। ফোন বেজে যায়। এরপর সারাদিন ধরে হয় ব্যস্ত নয় বেজে যায় ফোন। শেষে অনেক রাতে মেসেজ আসে ধৃতির।

‘দিদির ব্যবস্থা আগের থেকে সামান্য উন্নতি হলেও বিপদ এখনো কাটেনি। ব্লাড লাগবে প্রায় চার বোতল। তার চেষ্টাতেই সারাদিন ছোটাছুটি করেছি। তিন বোতল অ্যারেঞ্জ করতে পেরেছি। এখনো এক বোতল বাকি। চিন্তা করো না। আমি ঠিক আছি।’

রঞ্জার মন কিছুটা শান্ত হলেও পুরোপুরি চিন্তামুক্ত হয় না। সারারাত এপাশ ওপাশ করতে করতে ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়ে রঞ্জা। ফোনের রিংটোনে ঘুম ভাঙে। আধো ঘুমের মধ্যে হাতড়ে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে ছটা বাজে। তার থেকেও অবাক হয় ফোনে ভেসে ওঠা নামটা দেখে। ধৃতির অফিস কলিগ অলকদা ফোন করেছে।

এই অলকদা এক অদ্ভুত মানুষ। বিয়ে-থা করেননি। আপনার বলতে দাদা, বউদি আর এক ভাইপো। তার থেকেও আপনজন হল শিয়ালদা স্টেশনের কাছে কিছু পথশিশু। তাদের কখনো বই আবার কখনো খাবার যোগান তো দেনই, তাছাড়াও এমনিতেই যেকোন মানুষের প্রয়োজনে অলকদা সবসময় হাজির। সবসময় এই ভদ্রলোকের মুখে হাসি লেগে আছে। ধৃতির কাছেই শোনা, অলকদাকে নাকি আজ পর্যন্ত কেউ কখনো রেগে কথা বলতে শোনেনি। ধৃতির সুবাদে রঞ্জারও খুব কাছের মানুষ অলকদা। রঞ্জাকে খুব স্নেহ করেন। অফিসে একমাত্র অলকদাকেই তাদের সম্পর্কের কথা জানিয়েছে ধৃতি।

এত ভোরে ফোনে অলকদার নাম দেখে বেশ অবাক হয় রঞ্জা। এখন উনি কেন ফোন করেছেন! ভাবতে-ভাবতে ফোনটাই কেটে যায়। রঞ্জা নিজে কলব্যাক করতে যাবে, তখন দেখে আবারও অলকদাই ফোন করছেন। বুকের ভেতরটা কেমন অস্থির হয়ে ওঠে রঞ্জার।

রিসিভ করতে অলকদা বলেন, ‘রঞ্জা, রঞ্জা…’

‘কী হয়েছে অলকদা? এত সকালে ফোন করেছেন। কোন সমস্যা?’

‘মনটা শক্ত করো। একটা খবর দেবার আছে।’

‘কী হয়েছে? ধৃতির দিদি ভালো আছে তো?’, উৎকণ্ঠার সঙ্গে বলে রঞ্জা।

‘না, না, ধৃতির দিদি ঠিক আছে। কিন্তু কাল রাতে বাড়ি ফেরার সময় ধৃতির…’

কথা শেষ করার আগেই রঞ্জা উদভ্রান্তের মতো বলে ওঠে, ‘কী হয়েছে ধৃতির, বলুন অলকদা। চুপ করে থাকবেন না। কী হলো বলুন?’

‘কাল রাতে হসপিটাল থেকে বাড়ি ফেরার পথে অ্যাক্সিডেন্ট হয় ধৃতির। উল্টো দিক থেকে একটা লরি ব্রেকফেল করে এসে সোজা ধাক্কা মারে বাইকটায়। স্পট ডেড। রঞ্জা, রঞ্জা কথা বলো। কী হলো রঞ্জা!’

রঞ্জা তখন কথা বলার অবস্থায় নেই। জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেছে।

জ্ঞান ফেরার পর থেকে রঞ্জা পুরো পাথরের মূর্তি। খাওয়া নেই, কথা নেই, ঘুম নেই। সারাটা সময় শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। চাকরিটাও আর করা সম্ভব হয় না তার পক্ষে। নিজেকে সম্পুর্ণভাবে ঘরবন্দী করে নেয়। শরীর একেবারে ভেঙে পড়ে।

মেয়ের এই সম্পর্কের কথা অল্পবিস্তর রঞ্জার মা জানলেও বিকাশবাবু একেবারেই কিছু জানতেন না। সবটুকু জানা আর তারপর মেয়ের এই অবস্থা সহ্য করতে পারেন না রঞ্জার বাবা বিকাশবাবু। মেয়েকে নানাভাবে বোঝাতে গেলেও বিফল হন। অদ্ভুত এক শীতলতার মোড়কে নিজেকে মুড়ে রেখেছে রঞ্জা।

এর কিছুদিন পর বিকাশবাবু হঠাৎ বাথরুমে মাথা ঘুরে পড়ে যান। সঙ্গে-সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে গেলে ভর্তি করে নেয়। চলে বিভিন্ন টেস্ট। জানা যায় উনার একটা মেজর অ্যাটাক হয়ে গেছে। বাবার ওই অবস্থা রঞ্জাকে আরও দুর্বল করে তোলে।

বাড়ি ফিরে যখন রঞ্জার হাতদুটো ধরে বিকাশবাবু বলেন, ‘তুই এবার মত দে মা। তোর জন্য পাত্র দেখি। দেখছিস তো আমার শরীরের অবস্থা। তোকে সুপাত্রস্থ করতে পারলে তবে আমি নিশ্চিন্ত হই।’ বাবার শরীরের অবস্থা আর ডাক্তারের সাবধানবাণীর জন্য বাধ্য হয় রঞ্জা বিয়েতে মত দিতে।

মেয়ের মতো পেয়ে বিকাশবাবু খুশিতে ভরে ওঠেন। একটু সুস্থ হয়ে ওঠার পরই কাগজের বিজ্ঞাপন, ম্যাট্রিমনি ওয়েবসাইট সব জায়গায় উপযুক্ত পাত্রের সন্ধানে উঠেপড়ে লাগেন। প্রায় সাত আট মাস বাদে মনমতো পাত্রের সন্ধান পান। দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্টে ছেলে কাজ করে। বিধবা মা। দিদির বিয়ে হয়ে গেছে, আর একটি অবিবাহিত বোন আছে। বাবাকে আগেই কথা দিয়ে ফেলার জন্য রঞ্জা অমত করতে পারে না। যদিও ধৃতিই তার সমস্ত মনপ্রাণ জুড়ে রয়েছে।

‘কিগো বৌদিভাই, কী ভাবছো?’ চমক ভাঙে ননদ বীথির গলায়।

‘না না কিছু না তো।’ নিজেকে সামলে নেয় রঞ্জা।

‘ঘরটা পছন্দ হয়েছে তো?’

ননদের কথায় মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানায় সে।

বিয়ে উপলক্ষ্যে বাড়ি ভর্তি লোকজন। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব। রঞ্জার একটু অস্বস্তিও হচ্ছে। শাশুড়িমা খুব কম কথা বলেন। কিন্তু দেখলে মনে হয় বেশ স্নেহময়ী। নতুন বউ সে, কথা না বলে চারদিক দেখে পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করে।

জানতে পারে বড় ননদের শ্বশুরমশাই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় আসতে পারেনি। এতে শাশুড়িমার বেশ খারাপ লেগেছে। কিন্তু এই পরিস্থিতে কোনো উপায়ও নেই। অবশ্য এইসব কথা তার ছোট ননদ বীথির মুখ থেকে শোনা। ছোট ননদ বীথি খুব হাসিখুশি, মিশুকে। এক দেখাতেই আপন করে নিয়েছে। কিন্তু যার হাত ধরে এই বাড়িতে এলো রঞ্জা তাকে গতকাল এই বাড়িতে আসার পর থেকে আর একবারও দেখেনি।

রঞ্জাকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়ে বীথি বললো, ‘বৌদিভাই, তুমি এখানে একটু বসো। একটু পরে তোমার ভাতকাপড়ের অনুষ্ঠান। আমি এসে তোমায় নিয়ে যাব।’

অনেকগুলো ছোটছোট বাচ্চা রঞ্জাকে ঘিরে বসে আছে। তারা কত রকমের প্রশ্ন করছে। কেউ রঞ্জার কাপড় ধরে টানছে, আবার তাদের মধ্যে যারা একটু বড়, তারা আবার রঞ্জার গয়নাগাটি ছুঁইয়ে দেখছে। রঞ্জার বেশ মজা লাগছে ওদের আচরণে। দুটো পুঁচকে তো কতরকম প্রশ্ন করছে তাকে। বেশ ভালো লাগছে রঞ্জার ওদের সঙ্গে কথা বলতে।

একজন বয়স্ক মহিলা এসে তাড়া দিলেন বাচ্চাগুলোকে।‘এই সব চল তোরা খেয়ে নিবি। তারপর একটু বিশ্রাম নিয়ে সাজতে হবে তো সন্ধ্যের জন্য।’ বাচ্চাগুলো হইহই করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

এবার বেশ রঞ্জার একা লাগে। অনেকক্ষণ হয়ে গেছে বীথি ‘এই আসছি’ বলে ঘর থেকে গেছে। খানিকক্ষণ একা বসে থাকার পরও বীথি না আসায় গুটিগুটি পায়ে রঞ্জা দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। বেশ বড়ো বাড়িটা। পুরোটা দেখাও হয়নি। বলা ভালো শ্বশুরবাড়ির লোকজন যতটা দেখিয়েছেন ততটুকুই দেখেছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দ্যাখে সামনে একটা টানা লম্বা বারান্দা। আর সেই বারান্দার মেঝেটা গাঢ় লাল রঙের। রঞ্জার ইচ্ছা করে সামনে এগিয়ে যেতে। কিন্তু কী ভেবে না এগিয়ে সামনে তাকায়। দেখে সেই বারান্দার শেষে একটা ঘর। ঘরের দরজাটা বন্ধ। ভাবে কেউ হয়ত জামাকাপড় চেঞ্জ করছে। কিন্তু বেশ কিছুটা সময় কেটে যাবার পরও কেউ দরজা খোলে না। আরও একটা ব্যাপার দেখে অবাক হয় রঞ্জা, অন্যান্য লোকজনও কেউ ওই ঘরটার দিকে যাচ্ছে না।

এক অদম্য কৌতূহলে ওই ঘরটার দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে যায়। এদিক ওদিক তাকিয়ে বন্ধ দরজাটায় চাপ দেয়। চাপ দেওয়া মাত্র দরজাটা খুলে যেতেই একটু চমকে ওঠে রঞ্জা। পিছিয়ে আসে কয়েক পা। তারপর কিছুটা নিজেকে সামলে নিয়ে পা রাখে ঘরের ভেতরে। চোখ তুলে সামনের দিকে তাকাতেই সারা শরীর থরথর করে কেঁপে ওঠে রঞ্জার। সমস্ত পৃথিবীটাই যেন প্রবল বেগে দুলতে থাকে। দরজাটা প্রাণপন শক্তি নিয়ে আঁকড়ে ধরে।

এ কী দেখছে! কাকে দেখছে! এ তো ধৃতির ছবি। টাটকা মালা ঝুলছে। হঠাৎ-ই রঞ্জার মাথায় এলো, শুনেছিলো যে ছেলের দাদা অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। কিন্তু ধৃতির মৃত্যুর পর থেকে এই ধরনের কোনো কথা ও শুনতে চাইত না, বলা ভাল নিতে পারত না, তাই ভুলেই গিয়েছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, কেন তখন ভালো করে শুনলো না। শেষপর্যন্ত সে ধৃতির বাড়ির বউ হয়ে এলো! কীভাবে সে এখন থাকবে এখানে?

আর কিছু ভাবতে পারে না রঞ্জা। মাথা ঘুরে মাটিতে পড়ে যায়। আচ্ছন্ন অবস্থায় মনে হয় ধৃতি তার পাশে এসে বসেছে। আলতো করে তার মাথাটা কোলে তুলে নিয়েছে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলছে, ‘আমি জানতাম রঞ্জা, তুমি আমার কাছে ঠিক আসবে। নাহলে যে আমাদের ভালবাসা মিথ্যে হয়ে যাবে। আর আংটিটাও যে পরানো হয়নি তোমায়।’ রঞ্জা অবচেতনেও টের পায় যে ধৃতি তার আঙুলে আংটি পরিয়ে দিচ্ছে।

অনেকগুলো গলার স্বর আবছাভাবে রঞ্জার কানে আসে। আস্তে আস্তে চোখ মেলতে দেখে অনেকগুলো উদ্বিগ্ন মুখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। খানিকটা লজ্জা খানিকটা ভয় আঁকড়ে ধরে রঞ্জাকে। ধড়ফড় করে উঠে বসতে যায়। বীথিই ধরে ধরে বসায়।

শাশুড়িমা বলেন, ‘তুমি ওঘরে কি করছিলে? আর কেনই বা গিয়েছিলে?’

‘মা তোমরা সবাই একটু বাইরে যাও, আমি কথা বলছি।’ যাকে রঞ্জা সকাল থেকে দেখতে পায়নি সেই অর্চিস্মান, রঞ্জার স্বামী, বেশ জোরের সঙ্গে বললো।

‘তুই যা ভালো বুঝিস। কিন্তু দেখিস, মেয়েটা মনে হচ্ছে বেশ ভয় পেয়ে গেছে।’ ছেলের কাছে গিয়ে বেশ আস্তে বলেন কথাগুলো।

সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পর রঞ্জাকে জিজ্ঞাসা করে অর্চি, ‘কী হয়েছিল রঞ্জা, বলবে?’

দুহাতে মুখ ঢেকে কান্না ভেজা গলায় রঞ্জা বলে, ‘আমি… আমি ঠিক বলতে পারছি না।’

রঞ্জার হাতের দিকে চোখ পড়তেই চমকে ওঠে অর্চিস্মান। আঁতকে ওঠা গলায় বলে, ‘রঞ্জা, ওই আংটিটা কী করে তোমার হাতে এলো। তুমি কে? কে তুমি রঞ্জা?’

রঞ্জা হতচকিত হয়ে হাতটা নিজের চোখের সামনে মেলে ধরে। তারপর নিজেই প্রচণ্ডভাবে চমকে ওঠে। এটা তো সেই আংটিটা, ডায়মন্ড আর চুনী বসানো। যেটা ধৃতি আর ও দুজনে মিলে গিয়ে কিনেছিল।

রঞ্জার চমক নজর এড়ায় না অর্চিস্মানের। মনে পড়ে যায় দাদা ধৃতিমানের কথাগুলো। দিদির ওই ক্রাইসিস পিরিয়ডেও একসময় আংটিটা দেখিয়ে বলেছিল, ‘এই দেখ, এটা তোর বৌদির জন্য কিনেছি। দিদি সুস্থ হয়ে উঠলে তুই আর আমি কলকাতা যাব। তুই আমাদের রেজিস্ট্রি বিয়ের প্রধান সাক্ষী হবি। জানিস না তুই, আমি কী ভীষণ ভালবাসি ওকে। ও আমার, শুধুই আমার।’

অর্চিস্মান আর রঞ্জা দুজন দুজনের দিকে অপরিসীম বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে। সামনে রঙিন আলোর সারি দুলতে দুলতে কোনো অন্ধকারের দিকে একটু একটু করে হারিয়ে যেতে যেতে…


This is an original content which is written by a DORPON author. Copying and publishing any part of the content is strictly prohibited.

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu