তাসরুজ্জামান বাবু

সরীসৃপ

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

“সামিনা, দেখো; বিষয়টা তুমি কীভাবে নেবে জানি না। কিন্তু আমি খোলাখুলিই বলতে চাই—বেবিটা অ্যাবরশন করে ফেলব।” গায়ে কোট চাপাতে চাপাতে বলল যুবাবয়সী ডাক্তার সাঈদ।

বিস্ময়ে অস্ফূট শব্দ করে বলল তার স্ত্রী ডাক্তার সামিনা, “এ কী বলছ তুমি, সাঈদ?”

সে বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল, এতক্ষণ জানালার গ্রীল চুঁইয়ে যে সকালের মিষ্টি রোদ এসে পড়ছিল মুখে, তা ইতোমধ্যেই তিতে লাগতে শুরু করেছে।

“বাবা-মাও চাচ্ছে আমাদের একটা ছেলে হোক,” ড্রেসিং আয়নার সামনে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল ডা. সাঈদ, “আর তুমিই বলো, নেব তো মাত্র দুটো সন্তান, সেখানে একটা মেয়ে তো অলরেডি আছেই। আরেকটা কি ছেলে নেব না? এত টাকা পয়সা কি তাহলে দুই জামাইকে দেওয়ার জন্য কামাই করছি?”

“আমি পারব না সাঈদ, আমি এই মেয়েকে পৃথিবীতে আনব।” বলতে বলতে বিছানায় উঠে বসল সামিনা, ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস পড়ছে তার।

“একগুঁয়েমি করলে কিন্তু রাস্তা মাপতে হবে! আমার স্পষ্ট কথা!” হাসপাতালের ডিউটিতে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল ডা. সাঈদ।

তাকে পেছন থেকে থামাল সামিনা। “দাঁড়াও সাঈদ! একজন ডাক্তার হয়ে তুমি সেই অজপাড়াগাঁয়ের অশিক্ষিত লোকদের মতো কথা বলতে পারো না! তুমি যদি ওয়াই ক্রোমোজোম দিতে না পার সেই দায় কি আমার?”

তার দিকে অগ্নিদৃষ্টি হেনে পেছন ফিরল ডা. সাঈদ। “দেখো সামিনা, ডিউটিতে যাওয়ার আগে মাথাটা গরম করাবে না। আমি মানছি আমার ব্যর্থতা। আর তাই আমি সফল হতে চাই, যতদিন না আল্ট্রাসনোতে দেখব যে আমার ছেলে হচ্ছে ততদিন আমি চেষ্টা করে যেতে চাই। যেহেতু সন্তান আমার, সিদ্ধান্তটাও আমাকেই নিতে দাও। রেস্ট নাও এখন, রাতে ক্লিনিকে নিয়ে যাব অ্যাবরশন করাতে।”

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে হনহন করে বেরিয়ে গেল ডা. সাঈদ।

এই একগুঁয়ে লোকটাকে বোঝানো অসম্ভব, চোখ ফেটে পানি আসছে সামিনার। অশ্রুসজল চোখে সে নিজের পেটে হাত বুলালো।

***

“হালিমা, তুই আজকে আবারও দেরি করে এসেছিস? কিচেনে কত্তগুলো এঁটো বাসন পড়ে আছে। আর আজকে ক’টা কাপড়ও কাঁচাবো ভেবেছিলাম!” কিছুটা রাগত স্বরে বলল ডা. সামিনা।

“সোরি আপা!” বলল কাজের বুয়া হালিমা, নিজের পেটে হাত রেখে। “বাবুটা খুব লড়েচড়ে!”

ওর পেটের দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে যায় সামিনার, গর্ভবতী সে। আর একমাস পর ডেলিভারি হওয়ার কথা আছে। ওর দেরি করে আসাটা তাই মাফ করে দেয়। বলে, “আচ্ছা, ধীরে সুস্থে কাজ করিস। আর শোন, ভারী কাজ করিস না। থাক, কাপড় কাঁচতে হবে না, লন্ড্রিতে পাঠাব।”

“জ্বে আপা।”

যাওয়ার সময় হালিমা এসে বলে, “আপা, আমার মাইয়াডারে তো দেখছেনই; গত আশ্বিনে নয় বছরে পড়ছে; ঘরের সব কাম করবার পারে। আমি যহন এহানে আসি, সে-ই বাড়ির রান্না-বান্না করে।”

সামিনা বুঝতে পারে মেয়েকে নিয়ে কিছু বলতে চায় হালিমা। “কী বলবি বল?”

“ইয়ে মানে আপা…আমি একমাস না আইসা তারে পাঠাইলে অসুবিধা হইব? বাবুটা খুব লড়েচড়ে!” আবারও কোমলভাবে পেটে হাত বুলায় হালিমা।

সিদ্ধান্ত নিতে ইতস্তত করে ডা. সামিনা। হালিমা তা দেখে আবারও বলে ওঠে, “আপা, আপনি তো তারে দেখছেনই কেমুন শান্ত? ঘরের কোনো জিনিসে হাত দিব না, গ্যারান্টি!”

“না…ঠিক সেজন্য না,” কিছুটা দ্বিধা করতে থাকে ডা. সামিনা। পরমুহুর্তে রাজি হয়ে যায়, “…আচ্ছা যা, পাঠাস।”

“আপা, আপনার মনে অনেক দয়া। আল্লাহ আপনার বাবুটারেও সহীহ সালামতে পৃথিবীতে আনুক!”

তার কথা শুনে কোনোক্রমে উথলে ওঠা কান্নার গমকটা থামাল সামিনা। বলল, “হালিমা, এখন যা!”

হালিমা চলে যেতেই সামিনা দৌড়ে ঘরের দিকে ছোটে। বিছানায় লুটিয়ে পড়ে বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। হালিমাকে সে বলতে পারেনি যে তার পেটে আর কোনো বাবু নেই, সাত দিন আগে অ্যাবরশন করতে বাধ্য হয়েছে। কাঁদতে কাঁদতেই অনেক কথা মনে পড়ে যায় সামিনার। সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে সাঈদের সাথে একই ব্যাচে পড়ত সে। আট বছর আগে ডাক্তারি পাশ করার পর প্রেম করে বিয়ে করে ওরা। ওদের ঘরে ছয় বছরের একটা মেয়ে, এই মুহুর্তে যে আছে স্কুলে। মেয়েটার ভবিষ্যত আর আট বছরের সংসারের দিকে তাকিয়ে তাকে শেষ পর্যন্ত গর্ভপাতটা করতেই হয়েছে।

হালিমার কথা মনে পড়তেই তার উপর একটু একটু হিংসা হতে থাকে সামিনার। ইশ! এক মাস পর ছুঁড়িটার কোলে আসবে ফুটফুটে একটি ছেলে! অবশ্য তার দরকারও ছিল, একটা মেয়ে যেহেতু আছে হালিমার, গরীবের সংসার—শেষ বয়সে বাপ মাকে দেখার জন্য, বোনটার একটা বিহিত করার জন্য হলেও গ্রামের মানুষ একটা ছেলে চায়।

হালিমার কথা ভাবতে ভাবতে সামিনার শোকটা বাসি হতে থাকে। হালিমার স্বামী ডিঙ্গিডুবি নামের দূরের গ্রামের এক ওয়াক্তিয়া মসজিদে ইমামতি করে, মাসে তিন হাজার টাকা বেতন পায়। তিন হাজার টাকায় এই যুগে সংসার চলে? হালিমাকে তাই মাসে চার হাজার টাকা দেয় সামিনা। এই দিয়ে ঢাকার বুকে স্বামী ও মেয়ে নিয়ে কষ্টে-শিষ্টে দিন গুজরান করে মেয়েটা। হালিমার এই সময়ে পুষ্টিসম্মত খাবার দরকার। এর আগে বার কয়েক ট্রিটমেন্ট দেওয়া হয়েছে, আরেকবার চেকআপ করে দেখতে হবে। পেশেন্টের চিন্তায় মনে মনে ব্যস্ত হয়ে ওঠে সরকারি হাসপাতালের গাইনি ডাক্তার সামিনা সাঈদ। একজন নারীর কাছে মাতৃত্ব ব্যাপারটাই গুরুত্বপূর্ণ, চাই তা নিজের হোক, অথবা অন্যের।

***

সাত দিন পরে ডা. সামিনাকে ক্ষীন গলায় ফোন করলো হালিমা। “আসসালামু আলাইকুম। আমার বাবু হইল গো আপা, আলহামদুলিল্লাহ!”

“বলিস কী, তোর না ডেলিভারী ডেট সামনের মাসে?”

“আল্লাহ তার আগেই দিয়া দিছে আপা, সবই তার ইচ্ছা!”

“তা তোরা মা-শিশু দুজনেই সুস্থ আছিস তো?”

“বাবুটা একটু নরম আছে আপা, চোখ খুলে কম! তয় আমার কুনো সমস্যা নাই।”

শঙ্কায় বুকটা কেঁপে ওঠে সামিনার। “শোন, কষ্ট করে তোর স্বামীকে নিয়ে বিকেলে একবার আয় দেখি বাসায়? প্রিম্যাচিউরড বেবি তো, কিছু ডিফিকাল্টি থাকতে পারে, একটু চেকাপ করব।”

“জ্বে আপা, আসুম। আমার সোয়ামিও কইতাছিল ম্যাডামের লগে একবার দেখা করি। বাবুর ইসলামিক নামডা সে রাখব, আর আপনের কাছ থেইকা একটা কিউট বাংলা ডাক নাম চাইতাছিল।”

“কিউট বাংলা নাম!”হেসে ফেলল সামিনা, হালিমার হুজুর স্বামীকে তার কিছুটা অন্যরকম মনে হলো। বলল, “আয়তো আগে!”

***

ড. সামিনা সাঈদ নিজের হোম-চেম্বারে বসে আছে, তার সামনে বসে আছে হালিমা, কোলে তার কাঁথায় মোড়া একটা বুনোগোলাপ-সদ্যপ্রসূত শিশুটি। পাশে তার স্বামী, পরনে জোব্বা, মাথায় পাঁচকল্লি টুপি। নিজের পরিচয় দিয়েছে হাফেজ জুবায়ের আহমাদ, ডিঙ্গিডুবি ওয়াক্তিয়া মসজিদের মুয়াজ্জিন কাম ভারপ্রাপ্ত পেশ ইমাম হিসেবে। সামান্য সাধাসাধির পর ডা. সামিনা সাঈদ তার হাত থেকে মিষ্টির প্যাকেটটি গ্রহণ করল যেটির কোণায় ছোট করে লেখা আছে—আদি ও আসল; মাঝখানে বড় করে লেখা—বিক্রমপুরী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার।

এরপর বেশ বিনয়ের সাথে আর্জি পেশ করল হাফেজ যুবায়ের আহমাদ, “ম্যাডাম, আমার বাবুটার ইসলামি নাম রাখছি হুমায়রা—হুমায়রা জান্নাত। আম্মাজান আয়েশা (রাঃ)কে আদর কইরে হুমাইরা বলি ডাকতেন আমাদের নবী মোহাম্মদ মোস্তফা (সঃ)। আপনি যদি একটা সোন্দর বাংলা নাম দিতেন!

চমকে ওঠে ডা. সামিনা। “মানে! মেয়ে বাবু হয়েছে নাকি?”

হেসে বলে হালিমা, “জ্বে আপা, আল্লাহর ফায়সালা! আল্টাসনোর রিপোট মিলে নাই। হিহি!”

“বলিসনি তো! দেখি, দেতো মৌটুসী পাখিটাকে!” বলতে বলতে দুহাত বাড়িয়ে দিল সামিনা।

ততক্ষণে শিশুটাকে ওর কোলে তুলে দিয়েছে হালিমা। মুখ দিয়ে অর্থহীন শব্দ করে ডা. সাঈদা তাকে আদর করতে থাকে, তার অতৃপ্ত মাতৃত্বসত্ত্বাটা যেন জুড়িয়ে যায়। হাসিমুখে তার আদর করা দেখতে থাকে শিশুটির বাবা-মা।

কিছুক্ষণ পর কথা বলে উঠল হাফেজ যুবায়ের আহমাদ, “মৌটুসী! মাশাআল্লাহ ম্যাডাম, খুব সোন্দর নাম রাখলেন! ধন্যবাদ আপনাকে!”

অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল সামিনা। নিজের মেয়ের জন্য যে নামটা ঠিক করে রেখেছিল কখন যে শিশুটিকে সেই নামে ডেকে ফেলেছে নিজেও খেয়াল করেনি। আর নামটা সাদরে গ্রহণও করেছে হুমায়রার বাবা। ভালো তো, তার ভেবে রাখা নামটা কাজে লেগে গেল! হঠাৎ করে নিজের মেয়েটির কথা মনে হওয়ায় বুকটা টনটন করে উঠল তার।

কিন্তু সে নিজেকে প্রবোধ দিয়ে মৌটুসী ও তার মায়ের চেক-আপ সারল। হঠাৎ করে একটা ব্যাপার জানার কৌতূহল হলো তার। হাফেজ সাহেবের দিকে ঘুরে বলল, “তারপর হুজুর! দ্বিতীয় মেয়ের বাবা হয়ে কেমন লাগছে?”

“জ্বী ম্যাডাম, আলহামদুলিল্লাহ!” উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল হুজুর।

শুনে ধক করে উঠল সামিনার বুক। এভাবে মেয়ের জন্মে সন্তোষ প্রকাশ করবে এক অনুচ্চশিক্ষিত গ্রাম্য যুবক তা তার কল্পনায় ধরে না।

কিন্তু পানখেকো লাল দাঁত বের করে বলে যাচ্ছে হাফেজ যুবায়ের আহমাদ, “…আল্লাহ তাআ’লা আমার দোয়াটা একটু একটু কইরা কবুল করতাছেন! আর একটা মাইয়া হইলেই আমার মনের আশাটা পূর্ণ হয়।”

চোখের চশমা খুলে তার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল ডাক্তার। আরো একটা মেয়ে চায় এই লোক? ভুঁরু কুঁচকে তাকে জিজ্ঞেস করল, “কী আপনার মনের আশা, হুজুর?”

গড়গড় করে বলতে শুরু করল হাফেজ সাহেব, “হুজুর (সাঃ) এরশাদ ফরমাইছেন, যে ব্যক্তির তিনটি কন্যা সন্তান অথবা বোন রহিয়াছে, আর সে তাহাদের সহিত ভালো ব্যবহার করিয়াছে এবং তাহাদেরকে নিজের জন্য অসম্মানের কারণ মনে করে নাই সে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করিবে। সুবহানআল্লাহ!…”

হালিমার মাথার ভেতর কড়াৎ করে বাজ পড়ল। হুজুর অনর্গল্ভাবে বাংলা-আরবি মিলে আরো অনেক কথা বলে যাচ্ছে, কিন্তু তার আর কোনো কথাই কানে আসছে না সামিনার। আচমকা সামিনার চোখ গেল দেয়ালে ঝুলানো ফ্যামিলি ফটোটার দিকে—মেয়েটাকে সামনে নিয়ে সাঈদের পাশে হাসিমুখে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে, মেয়ের মাথায় চোঙাকৃতির একটা লম্বা মুকুট, তার সামনের টেবিলে রাখা জন্মদিনের কেক। সামিনার গা-টা ঘিনঘিন করে ওঠে, মনে হয় একটা কিলবিলে সরিসৃপের সাথে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে সে। এর বিপরীতে সামনে বসে থাকা শুভ্রপাঞ্জাবি হুজুরকে ফেরেশতা বলে ভ্রম হতে থাকে।

“এ কী আপা! আপনার কি মাথা ঘুরতাছে?” হালিমার উৎকণ্ঠিত কন্ঠ শুনতে পায় সামিনা।

নিজেকে কোনোরকমে সামলে নিল সে। “না, আমি ঠিক আছি। ঠিক আছে হালিমা, যেগুলো বললাম সেগুলো ঠিকমতো ফলো করিস।”

ওরা চলে যাওয়ার পর বিকারগ্রস্তের মতো টলায়মান পায়ে চেয়ার ছাড়ে সামিনা। এক ছুটে দেয়ালের কাছে গিয়ে ছবিটা নামিয়ে মেঝেতে আছাড় মারে। ঝনঝন শব্দে কাঁচ ভেঙে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ে। ছবিটা বের করতে গিয়ে ডা. সামিনার ডান হাতটা একটু কেটেও যায়। তার কোনো পরোয়া না করে ছবিটা ছিঁড়ে কুটি কুটি করে ফেলে সে। তারপর অক্ষত থাকা ধাতব ফ্রেমটা তুলে বার বার আছড়াতে থাকে পাগলিনীর মতো। মুখ দিয়ে চাপা ক্রোধ শব্দাকারে বের হতে থাকে।

এমন সময় দরজার কাছে দেখা দিল তার ছোট্ট মেয়েটি। “আম্মু, আম্মু! তুমি ছবিটা ভেঙে ফেললে কেন? আমি আব্বুকে বলে দেব!”

মেয়ের দিকে ক্রুদ্ধলাল চোখে তাকিয়ে বলে সামিনা, “বলিস!”

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu