হাসান আজিজুল হক

শকুন

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

কয়েকটি ছেলে বসে ছিল সন্ধ্যার পর। তেঁতুলগাছটার দিকে পিছন ফিরে। খালি গায়ে ময়লা হাফশার্টকে আসন করে। গোল হয়ে পা ছড়িয়ে গল্প করছিল। একটা আর্তনাদের মত শব্দে সবাই ফিরে তাকাল। তেঁতুলগাছের শুকনো ডাল নাড়িয়েপাতা ঝরিয়ে সোঁ সোঁ শব্দে কিছু একটা উড়ে এল মাথার ওপর। ফিকে অন্ধকারের মধ্যে গভীর নিকষ একতাল সজীব অন্ধকারের মত প্রায় ওদের মাথা ছুঁয়ে সামনের পড়ো ভিটেটায় নামল সেটা। হৈ-চৈ করে উঠল ছেলেরাছুটে এল ভিটেটার কাছে। আবছা অন্ধকারে খানিকটা উঁচু মাটি আর অন্ধকার একটা ঝোঁপ ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না তাদের। ওদের সর্দার ছেলেটি বুঝতে পারলহামেশা দেখা যায় এমন পাখিদের মধ্যে শকুনই তীব্রভাবে মাটিতে নেমে তাল সামলানোর জন্যে খানিকটা দৌড়ে যায়। তাই তার চোখেই প্রথমে পড়ল অন্ধকারের তালটা দৌড়তে দৌড়তে খানিকটা এগিয়ে বিব্রত হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে গেল।

অপেক্ষাকৃত ছোট ছেলেটি বলল ভয়চকিতস্বরেকিরে ওটোআর একজন জবাব দিলমুটেই বুঝতে পারচি না। পাখি ওটো। পাখি-টাখি হবে। ক্যা জানেসঞ্জেব্যালায় ক্যার মনে কি আচেসে বুকে থু থু দিল। অনড় হয়ে রয়েছে অন্ধকারের দলাটা। লুকিয়ে যাওয়ার একটা ভাবপারলে কোন বহু পুরনো বটের কোটরেকোন পুরীষ গন্ধে বিকট আবাসেকোন নদীর তীরে বেনাঝোপের নিচে শেয়ালের তৈরি গর্তে লুকিয়ে যাওয়ার মতলব। শালা ক্যার মনে কি আচেক্যা কি চায়ক্যার ভ্যাকে ক্যা আসে। চ বাড়ি যাই। দলের মধ্যে গরু চরানো রাখাল আছে। স্কুলের ছাত্র আছে। স্কুলের ছাত্র অথচ দরকার হলে গরু চরায়ঘাস কাটেবীজ বোনে এমন ছেলেও আছে। তু তো ভীতুদ্যাখলোম একটো জিনিসশ্যাষ পর্যন্ত দেখি দাঁড়া। নাআমি চলে যাব। তু যা গা তবেআমরা যাব না। ক্যারে বাড়ি যেচিসতেঁতুলতলাটা পার হয়ে দ্যাখগা। স্কুলে পড়ে সেই ছেলেটি বললজিনিসটো দেখতে হবে। প্রায় সবাই দাঁড়িয়ে গেল। তারপর বড় ছেলেটা এগিয়ে এল। অতি সন্তর্পণে পা টিপে টিপে। সর্দার ছেলেটি জানতসেটা একটা বুড়ো শকুন। একেবারে কাছে এগিয়ে গেল সে। এত কাছে যে হাত বাড়ালে ধরা যায়। শালাক্যার মনে কি আচেক্যার ভ্যাকে ক্যা আসেরাখালটা তখনও বিড়বিড় করছে।

একটা দমকা বাতাসে অজস্র শুকনো পাতা ঝরে পড়ল।

পুকুরের পানিতে প্রথমে মৃদু কম্পনতারপর ছোট ছোট ঢেউ উঠলকার হাত থেকে কোথায় ধাতব কিছু পড়ে বিশ্রী অস্বস্তিদায়ক একটা শব্দ হলো। ছেলেটা খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ালদেখল সত্যিই সেটা একটা শকুনআলো থাকতে থাকতে বাসায় ফিরতে পারে নি। এখন রাতকানা। উগ্র একটা দুর্গন্ধ ওর নাকে এল। ভাগাড়ের আঁশটে গন্ধ। গলিত শবদেহের পচা পাঁকে সে যেন এইমাত্র স্নান করে এসেছে। শকুন কুকুরে লড়াইয়ের শেষ চিহ্ন এখনও ছিটকে বেরিয়ে-আসা মোটা খসখসে নোংরা পালক থেকে টের পাওয়া যায়। মারামারি করেচে শালা ঠিক সারা দোপরবেলা। একনও ধুকচে। পলটু এগিয়ে এল। পিছু পিছু জামুএদাই। আরও অনেকে যারা ছিল। পলটু বললশিকুনি লয়হ্যাঁদেকতে পেচিস নামোল্লা শিকুনি লয় তোবোধহয় মোড়ল শিকুনি। রাখাল জামু বললমেদী না মদা বলতে পারলে বলি হ্যাঁ! সর্দার রফিক বললতু তো গরু। তাই গরুর মতন কথা বলিস। শকুনটা তখনও দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। বোধহয় সে পছন্দ করছে না এই বিরক্তিকর অবস্থাটা। রফিক হাঁক দিলআয়খানিক মজা করিয় লাচাই খানিকটো ওটোকে। হৈ-চৈ করে উঠল ছেলের দল। বাড়ি যাবার ইচ্ছা অথচ ভয়ে তেঁতুলতলাটা পার হতে পারছে না সেই যে ছেলেটিসেও চেঁচিয়ে উঠল। রফিক এগিয়ে শকুনটার ডানা ধরে ফেলল। এতক্ষণে চেতে উঠল কুৎসিত পাখিটাঅত সহজে সে ধরা দিতে চায় না। নোংরা বিরাট দুটো পাখা মেলে বিচ্ছিরি নখওয়ালা পা-দুটো ক্ষিপ্রতার সঙ্গে চালিয়ে দৌড়ুতে শুরু করল সে গাঁয়ের সরু গলিটার মধ্যে দিয়ে। এইভাবেই ওরা ওড়বার প্রস্তুতি নেয়ভারমুক্ত হবার চেষ্টা করেবোধহয় সে শেষ পর্যন্ত উড়তে পারতঅন্তত মুক্তি পেত এই অসহনীয় কিশোরদের হাত থেকেতাদের হিংস্র কৌতূহল আর প্রাণান্ত খেলার খপ্পর থেকে। কিন্তু তার চোখে দৃষ্টি নেইচলার কোন উদ্দেশ্য নেই। শকুনটার মাথা ঠুকে গেল দেয়ালে। পেছনে পেছনে একদল খুদে শয়তানের মত প্রতিহিংসাপরায়ণ ছেলের দল নিষ্ঠুর আনন্দে ধাওয়া করেছে। কিন্তু পাখিটা পার হতে পেরেছে অন্ধকার গলিটা। কারণ গলিটা কানাগলি নয়। গলির দুপাশের দেয়ালের ফুটোয় যে সাপগুলো গ্রীষ্মের গরমে গলা বের করে থাকেযদি তারা সেই অবস্থায় থাকত তাহলে নিশ্চয়ই মাথা আবার গুটিয়ে নিয়েছে। কুলতলার পাশ দিয়েআরও দুটো পড়ো ভিটের ওপর দিয়েহাড়গোড় জড়ো-হওয়া টুকরো জমিটার নীরস আর্তনাদ উপেক্ষা করে জীবটা অনবরত ডানা মেলে ওড়বার চেষ্টা করছেআরও দ্রুত দৌড়ুচ্ছেআরও পরিষ্কারভাবে পথ চিনতে চাচ্ছেপালাতে চাচ্ছে। কিন্তু সে নিস্তেজউপায়হীন। আক্রমণ করতে জানে না। দারুণ রোষে ছেলেদের দলের মধ্যে পড়ে তীক্ষ্ণ-ঠোঁটে এদের খেলার আয়োজন বন্ধ করে দিতে পারছে না। চিৎকার করে কে আর্তনাদ করে উঠল। তার পায়ে শুকনো হাড়ের চোখাদিক ফুটে গিয়েছে। আচ্ছা উ বসে থাকুকশিকুনিটোকে ধরবুই। চেঁচিয়ে বলে উঠল রফিক। হ্যাঁতু বোসআমরা ওটোকে ধরবুই। নাইলে তু বাড়ি যা। এঃ লউ পড়ছে যি। যাকে লেগেছে সে বললপড়ুক যা। বলে খোঁড়াতে খোঁড়াতে আবার ছুটল। সামনেই একটা এঁদো ডোবা। মোড় ফিরেই মাটি ছাড়লউড়ল সে। কিন্তু বড় ইতস্ততবড় অনিশ্চিত তার পক্ষসঞ্চালনহয়ত হাঁফ ধরে গিয়েছেক্লান্ত হয়েছে সে। হয়ত দিকনির্ণয় করতে পারে নি। সে পড়ল ডোবাতেপানি ছিটকেনোংরা মোটা পানির ঢেউ তুলে যেসব ঢেউ আঁধারে চকচকে চোখে চেয়ে রইলপ্রায় শোনা যায় না এমনিভাবে আঘাত করল তীরে। একটি কদর্য জীব হিঁচড়ে উঠল ওপারে। পরিবর্তিতভিজেধুলোমাখা। ছেলেরা দৌড়ে এসেছে এপারে। গ্রামের ঘনবসতি পাৎলা হতে হতে এখানে ছিটিয়ে গিয়েছে। কালো কালো স্তূপের মত হঠাৎ হঠাৎ গজিয়ে উঠেছে।

সহজ বুদ্ধিতে ফাঁকফোকর দিয়ে জন্তুটা পড়ল মাঠে। খোলা বিস্তৃত মাঠে। ছেলেরা পরস্পর পরস্পরের মুখ দেখতে পাচ্ছে না। তারাও হাঁফিয়ে উঠেছে। শালা কত দড়বি দড়যিখানে যাবি চ। আর লয় মানিকআর লয়। তুমার ইবার হয়ে আলচে। অকে ধরবুই আজ। হ্যাঁধরবুই। এবার আল টপকে উঁচুনিচু এবড়ো-খেবড়ো জমি পেরিয়ে পগার আর শিশুশস্যের ওপর দিয়েশেয়ালকুলের কাঁটায় জামা ছিঁড়ে ছিঁড়ে মরণপ্রতিজ্ঞায় ক্ষেপে উঠল ছেলের দল। এদাই জিগ্গেস করল রফিককেকি করবি উটোকে ধরেকিছু করব নাশুধু ধরব। তার পরহুঁ। হুঁ ক্যানেতা পর কি করবিএগু ধরে তা পর অন্য কাজ। কেউ আর কথা বলছে না। বলতে পারছে না। ভূতের মতঅন্ধকারে চলন্ত চঞ্চল বিভীষিকার মত ছুটেছে। দক্ষিণদিকের বাতাস গায়ে লাগছে না। দূরে বাবলাবনের পাশে আমের পাতা ভাঙার মড়মড়মসমস শব্দ কানে আসছে না। কিংবা শেয়াল ডেকে উঠলকি ঝিঁ ঝিঁ সিমেন্টের মেঝেতে পাথর ঘষার মত একটানা শব্দ করছেকি প্রতি পদক্ষেপে পায়ের নিচের নাড়া গুঁড়িয়ে যাচ্ছেঅন্ধকার ঘনতর হয়েছে এসব কিছুই না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবাই ধরে ফেলল ওকে। আঁকড়ে জাপটে দুমড়ে ধরে ফেলল শকুনটাকে। তারা বুক দিয়ে অনুভব করল হাঁপরের মত ফ্যাসফেসে শূন্য শব্দ উঠছে শকুনটার ভিতর থেকে। দীর্ঘশ্বাসের মতফাঁপাশূন্যধরা-পড়ার। ছেলেগুলোর উত্তেজিত বক্ষস্পন্দন পাখিটা অনুভব করতে পারল কিসেইসেটোই বটে তোযেটোর পেচু পেচু অ্যালোম এটো সেই শিকুনিটোই বটে তোক্যানেপেত্যয় হচে না তোরকি জানি ক্যামন পারা লাগচে। ক্যামন ভকভক করে বই বেরুইচে দেখচিসবই কি র্যা বল দুগ্গন্ধ। তাতে বই কমচে কিঅর্থাৎ দুর্গন্ধ কমছে কিভিজে গিয়ে চিমসে গন্ধ ছাড়ছিল শকুনটা। জমাট গন্ধ তরল হয়ে এসেছে। গলা গলা দম আটকানো গন্ধ। রফিক বলললে এ্যাখন ধর এটোকেঠোঁটটো ধরতে হবে নাদোম বন্ধ হয়ে যাবে। রাখালটা এগিয়ে এলশালোকে আমি ধরব। পীরিত ক্যাকে বলে দেখবি শালো! একদিকে জামু আর একদিকে রফিক ছড়িয়ে মেলে ধরল শকুনটার বিশাল শক্তিশালী পাখা দুটো। কি পেল্লাই ড্যানা র্যা আট  হাত হবে। গোটানো ঘনবুনুনির পালক মেলে গেল। বুনট যেন পাতলা হয়ে এল।

স্তরে স্তরে সাজানো পালক পাশাপাশি চওড়া হয়ে কারকিত করা গালিচার মত বিছিয়ে যাওয়ার কথাকিন্তু শকুনটা ভিজে গিয়েছেধুলো লেগে গুটিয়ে গিয়েছে তার পালক। এখন তাই অনেক ফাঁকপাশাপাশি পালক অনেক ছিটোনো ছিটোনো। দুই ডানা অসহায়ভাবে ছড়িয়ে দিয়ে আত্মসমর্পণ করল শকুনটা। এবার দ্বিতীয় দফা দৌড়। দড় দড়লেংগুড় তুলে দড়। শকুনের পা পারে না অতো জোরে তাল দিতে। কিন্তু তাতে কি বা এসে যায়পা না হয় মাটিতে পড়চে না। ছেলেদের দৌড়ের গতিই চানচে তাকেহিঁচড়ে নিয়ে যাবে। এ্যাদামুখটো ঠুকে গেল। কি টেনে লিয়ে যেচিস দ্যাকমরে গেল লিকিন দ্যাক এগু। ক্যার গরজ কেঁদেছে দ্যাকবার। মরাটোকেই টানব। ভয়ানক হুল্লোড় করে ওরা দৌড়ুচ্ছে এই টানার পিছু পিছু। চেঁচাতে চেঁচাতে। ভার মজা পেয়ে। অদ্ভুতরকমের খেলা পেয়ে। কি লাভলাভলাভতোকে দেখে লোবতু তো শিকুনিতোর গায়ে গন্ধতু ভাগাড়ে মরা গরু খাসকুকুরের সাথে ছোঁড়াছিড়ি করিসতোকে দেখে রাগ লাগে ক্যানেছেলেদের কথায় শকুনটাকে দেখে তাদের রাগ লাগেমনে হয় তাদের খাদ্য যেন শকুনের খাদ্যতাদের পোশাক যেন ওর গায়ের গন্ধভরা নোংরা পালকের মতসুদখোর মহাজনের চেহারার কথা মনে হয় ওকে দেখলেই। নইলে মহাজনকে লোকে শকুন বলে কেন। কেন মনে হয় শকুনটার বদহজম হয়েছে। যে ধূসর রঙটা দেখলেই মন দমে যায় তার সঙ্গেই এর রঙের এত মিল থাকবে কেন। প্রায় জীবন্তফেলে দেওয়া যে শিশুগুলোকে গর্তেখানা-ডোবায়তেঁতুলতলায় ছেলেরা দেখেনা বোঝার যন্ত্রণায় মন যখন হু হু করে ওঠেতখন তাদের কচিমাংস খেতে এর এত মজা লাগে কিসের! কে বললভোক লেগেছে। কিছু খাস নাইদোপরবেলায় গোস্ত দিয়ে ভাত। আমিওআমার ভোক লেগেছে। তোর জামার রঙটো দেখে রাগ লাগে। য্যামন মোটাতেমনি খসখসে। ঠিক শালা শিকুনিটোর মতুন। হামিদের বাপটো দুএকদিনের ভিত্রেই মরবে। আজ সারা বৈকালি কি করচে জানিসজানিখালি হাঁফিয়েছেএই শালোর মতুন। জামু বললসব শালোর হাঁফনির ব্যায়রাম। ওরে শালাপালাইতে চাওশালা শিকুনিশালা সুদখোর অঘোর বোষ্টম। অঘোর বোষ্টমের চেহারার কথা মনে পড়তে হা হা করে হেসে উঠল সবাই। মাতামাতি চলেআল টপকে টপকেউঁচুনিচু জমির উপর দিয়ে ক্ষতবিক্ষত মনে আর দাগরা দাগরা ঘায়েশেয়ালকুল আর সাঁইবাবলার বনে লম্বা শুকনো ঘাসেপগারেসাপের নিশ্বাসের মত ফাটা মাটির উষ্ণ ভ্যাপসা হাওয়ায়আখ আর অড়হর কাটা জমির বল্লমের মত ছুঁচলো সরল গুঁড়ির আক্রমণে ও আর্তনাদে। একটা মাটির ঢেলার মত গড়িয়ে গড়িয়েশক্তির বেদনাবোধের অতীত অবস্থায়আচ্ছন্ন চেতনাহীন তন্দ্রার মধ্যে শকুনটা শুধুই চলেছে। যখন ছেলেরা বিশ্রাম নিচ্ছেকথা বলছে নিজেদের মধ্যে ক্ষতের রস মুছলে প্যান্টেশকুনটা তখনও দাঁড়িয়ে আছে। পালানোর অসম্ভব চেষ্টা করছে না সে। কত তারা উঠেছে দ্যাক। কিন্তুক আলো তো হচে না। চাঁদ নাইকো যি। বাতাস দিচে লয়রেদিচেতা শালার বাতাস। আমার কিন্তুক জাড় লাগচে। তোর ভয় লেগেচে। কতদূরে এ্যালোম র্যাগউরে সব্বোনাশমাঝমাঠে এসে পড়িচিমানুষমারীর মাঠ যে র্যাত! উইটো নিচ্চয় কেলেনের পাড়। চ কেলেনের পাড়ে যাইআর একবার গা ধোয়াই গা চ শিকুনিটোকে। পথটা ঠাহর করা যায় না। চারদিকের গাঁ ঝাপসাদিশাহারা মনে হয়এতবড় আকাশএত অন্ধকার। জামু বলেশুনিচিস রাত দোপরে কি সব হয়হেই ভাই পায়ে পড়িবলিস না। যিখানে সিখানে তেঁতুলগাছ দেখা যায়। ঘরের খিল খুলে মেয়ে হোক আর মরদ হোক ঘুমের ঘোরে ঘোরে মাঝমাঠে চলে আসেদ্যাখেখালি শালা তেঁতুলগাছ আর মিশমিশে কালো বিলুই। যিদিকে তাকাও খালি বিলুই আর বিলুই। ক্যার ভ্যাকে ক্যা আসেশকুনটাকে হঠাৎ কালো বিড়াল বলে মনে হয়।

ছেলেদের আর কারো গায়ে হাত দেবার সাহস নেই। নিজের নিজে বুকে হাত দিয়ে অনুভব করে। একটা বেপার তো হরে পারেধর্ সবাই ভূত আর সবাই মানুষের ভ্যাকে এয়েছে। নানা আমি ভূত লইএ্যাদা আমি মানুষ। তাইলে আমাকে ছুঁয়ে দ্যাকআমি যদি মানুষ না হইআমি উড়ে মিরিয়ে যাবছোঁ আমাকে। আমি ছুঁতে পারব না। সবাই সবাই-এর থেকে সাবধান হয়ে ক্যানেলের পাড়ে বসল। একে অপরের দিকে তীব্র চোখে তাকাচ্ছে। তারপর নিজের হাতে চিমটি কাটছে। শকুনটাকে ছেড়ে দিয়েছে ওরা। সে দুটো ডানা ঝেঁপেপা দুমড়ে মাটিতে গোঁজ হয়ে পড়ে আছে। রাত দোপর ঘুরে গেয়েচে লয়এ্যাকন সাঁজও লাগতে পারে আবার দোপর রাতও হতে পারে। বোধহয় তাই। তাদের হিসেব নেই। এ সময়টুকু ঠিক সময় নয়। এ খেলাটা তাদের সময়ের বাইরে ঘটেচে যেন। তবু কে বললতিনবার শেয়াল ডেকেচে। তাইলে পেরায় শ্যাষ রাত। চ ভাইপানিতে নামি। পাগলের মত ছুটে ক্যানেলে নামল ছেলেরা। একটা বাতাসও সঙ্গে সঙ্গে অগভীর পানির উপর দিয়ে সরসর করে এসে ওদের চোখে মুখে লাগলকি একটা যেন সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এল। আর একবার স্নান করল শকুনটা। শালা কিছু খাবে নাকি খাবেমরা আচে এখানে যে খাবেজামু বললভুঁই-এর লাড়া ছিঁড়ে লিয়েঐ খাক শালা। তাই নিয়ে এল কে। রফিক বললগরু তো লয় যে খ্যাড় খাবে। কিন্তুক এখন ঐ শালাকে তাই গিলতে হবে। হ্যাঁলাও গেলাও। দেখি র্যা তোর ছড়িটা দে। হ্যাঁঠিক অমনি করে অর ঠোঁটটো চিরে ধর। খ্যাক খ্যাক করে শব্দ করে উঠল শকুনটাতার ঘাড় মুচড়ে ঠোঁট ফাঁক করে অতি সাবধানে ছেলেরা তাকে খড়ের টুকরো খাওয়াচ্ছে। খা শালামর্ শালা। আমিও লোবমুটূক করব। রফিক সব থেকে বড় পালকটা ছিঁড়ে নিল। মাংসের ভিতর থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে এলো পালকটা। শিউরে উঠলো যেন শকুনটা। তারপর সবাই ছিড়ল। কদাকার বড় মুরগির মত দেখাতে লাগল তাকে। তারা সবাই ফিরছে। টলতে টলতে। বসে দাঁড়িয়ে। হোঁচট খেতে খেতে। ছেঁড়া শার্ট দেখতে দেখতে।

আগামীকালের কথা ভাবতে ভাবতে। গাঁয়ে ঢুকতেই এপাশে তালগাছ ওপাশে ন্যাড়া বেলগাছের যে ছোট তোরণটি আছে তারই আবছা ছায়ায় শাদামত কি দেখা যাচ্ছে। জামু বললউদিকে যাস না ঘুরে যাই। তোর বাড়ি তো উদিকেই দেখি না  দুটো কি। বাড়ি কাচে বলেই জানি  শালা শালী ক্যাকা র্যা দরকার কি তোর শুনেবল্ ক্যানে! উ হচে জমিরদ্দি আর কাদু শ্যাখের রাঁড় বুন। কি করচে উখানেআমড়ার আঁটি। চ বাড়ি যাই। পুবদিকে রঙ ধরবার ঠিক আগেই যখন গভীর অন্ধকার নেমে আসে তখন ছেলেরা ছেঁড়া মাদুরেসোঁদা মাটিতে অচৈতন্য হয়ে ঘুমোয়-অসুবিধের মধ্যেঅশান্তির মধ্যে না খেলে খালি পেটে ছেলেগুলো বেঘোরে ঘুমোয়। যখন সূর্য উঠলরোদ উঠলগাছপাতা ঝকমক করে উঠল তখন এবং তারপর যখন রোদ চড়া হয়বাতাস গরম হয়মাঠে ছেড়ে দেওয়া গরুগুলো মাটি শুঁকে শুঁকে শুকনো ঘাস খেয়ে ফেরে তখনও ছেলেদের ঘুম শেষ হচ্ছে না। ন্যাড়া বেলতলা থেকে একটু দূরে প্রায় সকলের চোখের সামনেই গতরাতের শকুনটা মরে পড়ে আছে। মরার আগে সে কিছু গলা মাংস বমি করেছে। কত বড় লাগছে তাকে! ঠোঁটের পাশ দিয়ে খড়ের টুকরো বেরিয়ে আছে। ডানা ঝামড়েচিৎ হয়েপা দুটো ওপরের দিকে গুটিয়ে সে পড়ে আছে। দলে দলে আরও শকুন নামছে তার পাশেই। কিন্তু শকুন শকুনের মাংস খায় না। মরা শকুনটার পাশে পড়ে রয়েছে অর্ধস্ফুট একটি মানুষের শিশু। তারই লোভে আসছে শকুনের দল। চিৎকার করতে করতে। উন্মত্তের মত। আশপাশের বাড়িগুলি থেকে মানুষ ডেকে আনছে মৃত শিশুটি।

 কাজটো ক্যা করল গোমেয়ে-পুরুষের ভিড় জমে গেল আস্তে আস্তে। শুধু কাদু শেখের বিধবা বোনকে দেখা যায় না। সে অসুস্থদিনের চড়া আলোয় তাকে ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে।



 

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu