মোজাম্মেল হক নিয়োগী
কথাসাহিত্যিক
মোজাম্মেল হক নিয়োগী

শোধ

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

রাস্তায় বাসের চাকাটি পাংচার না হলে ঠিক দুপুর তিনটায় বাড়ি পৌঁছতে পারতো লাবিব। পাংচার হওয়ার কারণেই না আরও দুঘণ্টা দেরি হয়ে গেল। তবুও ভাগ্য ভালো যে, পিছনের চাকাটি নষ্ট হওয়াতে দুর্ঘটনা থেকে বাঁচা গেল। অসুবিধা তেমন হয়নি যা শুধু ক্ষিধের উপদ্রবটা সামান্য বেশি।

বিকেলে মনসুর সাহেব বাগানে কাজ করছেন। পাশে দাঁড়িয়ে আছে ওনার বিধবা কন্যা নাজমার পাঁচ বছরের মেয়ে নীপা। লাবিব গিয়ে নীপার সামনে দাঁড়ালে নীপা জিজ্ঞেস করে, তুমি কে?

আমি লাবিব। এটা কি মনসুর সাহেবের বাড়ি?

হ্যাঁ। ওই যে নানাভাই বাগানে কাজ করে। কথাটি শেষ করেই নীপা বাড়ির ভেতরে দৌড়ে পালিয়ে গেল।

লাবিব বাগানের ভেতরে মনসুর সাহেবের সামনে দাঁড়াতেই তিনি জিজ্ঞেস করেন, কাকে চাও?

আমি লাবিব। আপনার কাছেই এসেছি।

মনসুর সাহেব হতভম্ব হয়ে লাবিবকে জড়িয়ে ধরলেন। আমার দাদাভাই! তিনি লাবিবকে জড়িয়ে ধরে বাগান থেকে বের হয়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি একা এসেছো দাদাভাই? তোমার বাবা, মা, সন্ধ্যা ওরা আসেনি?

আমি একাই এসেছি। স্কুল ছুটি। ভাবলাম গ্রামের বাড়িতে বেড়াব।

ওরা সবাই ভালো আছে?

লাবিব মাথা নেড়ে জবাব দেয়, হুঁ, ভালোই আছে।

লাবিব যখন বাড়ির ভেতর ঢুকল তখন সারা বাড়িতে হুলস্থুল পড়ে গেল। লাবিবের জন্মের পর একবার এ বাড়িতে এসেছিল। তাও মায়ের সঙ্গে, সেদিন বাবা আসেনি। মনসুর সাহেবের একমাত্র পুত্র জুবায়ের বিয়ের পর এ বাড়িতে কোনদিন আসেনি। সে আর কোনোদিন আসবে না বলেও বাবাকে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে। পিতাপুত্রের মন কষাকষি, বিরোধটা গ্রামের বাড়ি ও জমিজমা নিয়ে। জুবায়ের বলেছিল, গ্রামের সব জমিজমা বিক্রি করে শহরে চলে যাওয়ার জন্য। কিন্তু বাবা হননি। আর তখন থেকেই দুজনের মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। বলতে গেলে জুবায়েরই বিচ্ছিন্ন করেছে।

লাবিবের জন্মের পর জুবায়েরই লাবিব ও স্ত্রীকে পাঠিয়েছিল বাবাকে রাজি করাতে। লাবিবের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে যেন মনসুর সাহেব গ্রামের বাড়ি ছাড়তে যাতে সিদ্ধান্ত নেন সেজন্যই তাদেরকে পাঠিয়েছিল। কিন্তু এই অস্ত্রও কাজে লাগেনি। তিনি সরাসরি ওদের প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন।

জুবায়ের সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে গ্রামের ধূলি কোনো দিন মারাবে না।

লাবিবকে দেখে বাড়ির চাকর-বাকর ঘরের বিছানা পত্র গুছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নাজমাও লাবিবের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে। সারা বাড়িতে খুশির ঢল নামে। খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন, ঘরদোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, কোন ঘরে থাকবে লাবিব ইত্যাদি ব্যাপারে সবাই ব্যস্ত।

রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর মনসুর সাহেব নিজের পড়ার ঘরে ঢোকেন। দাদাভাইয়ের পড়ার ঘর আর শোবার ঘর একই। গ্রামের বাড়ি, আলো বলতে হ্যারিকেনই ভরসা। হ্যারিকেনের আলোয় পড়তে হয়।

দাদাভাইয়ের লাইব্রেরি দেখে হতবাক লাবিব। এতো বই গ্রামের একটা বাড়িতে! কয়েক হাজার বই তো হবেই। অনেকক্ষণ সেলফগুলো দেখে একটি বই নিয়ে মনসুর সাহেবের পাশের একটি চেয়ারে বসে লাবিব। হ্যারিকেনের আলোয় লাবিব অভ্যস্ত নয়। সে বলল, দাদাভাই হ্যারিকেনের আলোয় তুমি দেখতে পারো?

দেখতে তো অসুবিধা হয় না। তোমার অসুবিধা হচ্ছে বুঝি?

হ্যাঁ হ্যারিকেনের আলোতে পড়া আমার পক্ষে সম্ভব না।

না পড়তে পারলে পড়বে না। তুমি বরং ঘুমাও। এতটা পথ জার্নি করে এলে।

ঠিক আছে আর কিছুক্ষণ দেখা যাক। লাবিব বইয়ের দিকে মনযোগ দেয়। কিছুক্ষণ পর বলে, তুমি ঢাকায় চলে আসলেই পারো। এখানে শুধু শুধু পড়ে আছো কেন?

মনসুর সাহেব কোনো জবাব দেননি। একটু হাসলেন। একবার লাবিবের দিকে তাকিয়ে আবার বইয়ের পাতায় ডুবে যান। কোনো উত্তর না পাওয়াতে লাবিব হতাশ হয়।

রাত একটায় তারা বইপড়া চুকিয়ে ঘুমোতে যায়।

মনসুর সাহেব ফজরের নামাজ পড়ে কোরআন তেলাওয়াত করে নাশতা করেন। এটিই তার গত বিশ বছরের নিয়ম। এই নিয়মের কোনো ব্যতিক্রম নেই। আজকে নাশতা খেতে বসলেন উঠোনে মাদুর পেতে। নাজমা চালের গরম রুটি, গরুর মাংসের ভুনা, দুধের ক্ষির দিয়ে নাশতা সাজিয়ে রেখেছে। লাবিব নিজ হাতে খাচ্ছে, নীপাও নিজ হাতে থাবে। আজকে তুলে খাওয়াতে হবে না। লাবিব ভাইয়্যা যদি একা খেতে পারে তাহলে আমিও খাব।

বাহ্। আমি যা পারি তুমি তা পারবে? লাবিব জিজ্ঞেস করল।

আমি যা পারি তুমি তা পারবে? দুজনের খুনসুঁটি চলল কিছুক্ষণ। দাদাভাই বেশ উপভোগ করলেন। এমনই হয় বুঝি!

সকালের নরম রোদ। ঝিরঝির বাতাস। গাছগাছালিতে পাখির কলতান। মনসুর সাহেব লাবিবকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ফসলের মাঠের দিকে এগিয়ে গেলেন। এমন বিস্তৃত মাঠ দেখে লাবিব মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। এতো ফাঁকা জায়গায় সে আর কোনো দিন দেখেনি। মাঠের এক পাশে দুজন দাঁড়িয়ে দেখে মাঠের পরে মাঠ। লাবিবের মন ভরে যায়। বিশুদ্ধ বাতাসে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয় লাবিব। মনে মনে বলে, প্রকৃতি এতো সুন্দর! এতো স্নিগ্ধ!

কিছুক্ষণ পরে দুজন ফিরে আসে বাগানের পাশে। এতো ফুলগাছ, ফলের বাগান, এতো সুন্দর পরিপাটি বাড়ি দেখে লাবিবের মুগ্ধতা ছাপিয়ে যায়।

বাগানের পাশে এসে দুজন দাঁড়িয়ে কথা বলে। লাবিব রাতের প্রশ্নটি আবার করল, তুমি ঢাকায় চলে আসতে পারো। এখানে শুধু শুধু পড়ে আছো কেন দাদাভাই?

ধর ঢাকায় চলে গেলাম, তাহলে কী হবে?

সেখানে তুমি সবার সাথে থাকতে পারবে। আমাদের সাথে থাকতে পারবে।

মনসুর সাহেব হেসে হেসে বললেন, ধর আমি ঢাকায় গেলাম। সেখানে গিয়ে কার সাথে কথা বলব?

আমাদের সাথে।

তোমাদের সবারই তো কাজ আছে। তোমার মা চাকরি করে, তোমার বাবা চাকরি করে, তোমরা লেখাপড়া করো। শুধু খাবার টেবিল ছাড়া কি তোমাদের দেখা হয়, কথা হয়?

লাবিবের কচি মুখে এবার চিন্তার ছায়া দেখা দেয়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, কিন্তু বেশি কথা বলার দরকার কী?

মানুষের সঙ্গ ছাড়া বুড়ো বয়সে বেঁচে থাকা খুব কঠিন দাদুভাই। বড় হও বুঝবে। এতক্ষণে তারা বাগানের উত্তর পাশটায় চলে এসেছে। একটি কবরের পাশে দাঁড়ালেন মনসুর সাহেব। কবরটির দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন, এটি তোমার দিদার কবর।  তিনি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, এই কবরটি ছেড়ে কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না দাদুভাই। তারপর তোমার ফুফু আছে, তাকে কার কাছে রেখে যাব? জোবায়ের আমার ছেলে। কিন্তু নাজমাও তো আমার মেয়ে। নীপা বাবাকে হারিয়েছে। এখন ওদের আর কোথাও যাবার জায়গা নেই।

লাবিব বেশ চিন্তায় পড়ে যায়। দাদাভাইয়ের কথা তো ঠিকই। কিন্তু তাহলে বাবা কেন বুঝতে চায় না দাদাভাইয়ের কষ্ট! এ কেমন কথা?

মনসুর সাহেবকে দেখে গ্রামের জমির শেখ কাছে এসে সালাম দিয়ে পাশে দাঁড়ায়। লাবিবকে দেখে বলল, ছোট সাহেবের ছেলে নাকি? কোনদিন আইলো?

মনসুর সাহেব বললেন, কাল এসেছে। তিনি জমির শেখকে জিজ্ঞেস করলেন, এবার আমন কেমন হবে?

ফলন ভালা। এইবার ভালা ফলন অইবো।

তাদের আলোচনা লাবিব খুব মনোযোগ দিয়ে শোনে। জমির শেখ চলে যাওয়ার পর লাবিব অনেক কিছু জানতে চাইলে দাদাভাই সরাসরি উত্তর না দিয়ে বললেন, কয়েকদিন থাকো, নিজেই জানতে পারবে।

পরদিন দাদাভাইয়ের দু’জনেই মাঠের আইল ধরে হাঁটে। মনে হয় অনেক দূরে যাবে। লাবিব বিভিন্ন প্রশ্ন করছে আর মনসুর সাহেব উত্তর দিচ্ছেন। এ যে প্রকৃতির মাঝে দাদা-নাতির খোলা পাঠশালা। লাবিব মুগ্ধ হয়ে প্রকৃতিকে পাঠ করে। প্রকৃতিই শিক্ষার বড় পাঠশালা। জীবনকে জানতে হলে প্রকৃতির কাছে আসা প্রয়োজন, প্রকৃতির সঙ্গে থাকা প্রয়োজন লাবিব বুঝতে পারে।

আমরা প্রকৃতি থেকে শিখতে পারি, কিন্তু এসব শিখে আমাদের কী হবে? আমি কি চাকরি পাব?

চাকরি কেন প্রয়োজন? দাদাভাইয়ের পাল্টা প্রশ্ন।

শান্তিতে থাকার জন্য। গাড়ি কেনার জন্য। বাড়ি বানানোর জন্য।

শান্তির জন্য গাড়ি আর বাড়িই বুঝি সব? জীবনে শান্তির জন্য ওসবের প্রয়োজন নেই। শান্তি নিজের কাছে। ওসব বরং শান্তি নষ্ট করে।

দাদাভাইয়ের কথাটা লাবিব বুঝতে চেষ্টা করে। সত্যি কি তাই? তাহলে মানুষ বেপরোয়া কেন এসবের পেছনে ছুটছে? কোথায় শান্তি? আমাদের বাসায় শান্তি আছে বলে তো মনে হয় না? বাবা-মাকে আমরা কতক্ষণ কাছে পাই? তাদের আদর-ভালোবাসা আমরা কতটুকু পেয়েছি? এমন নানা-রকম প্রশ্নের জাল তৈরি হতে থাকে লাবিবের মাথায়।

একদিন পর লাবিব নগরের সবকিছু ভুলে যেতে চায়। মিশে যেতে যায় প্রকৃতির সঙ্গে। মিশেও প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যায়। দুদিনেই হয়ে যায় জমির শেখের ছাত্র। মুগ্ধ হয়ে শুনে জমির শেখের কথা। প্রকৃতির কথা। ফসলের কথা। ময়মনসিংহ গীতিকার কাহিনি। যতই সময় যায় আর লাবিব বিস্মিত হয়।

এক রাতে খেতে বসে লাবিব বলল, প্রকৃতি থেকেই যদি এতো শেখা যায় তাহলে বই পড়ে কী লাভ, দাদাভাই?

দাদাভাই হেসে হেসে বললেন, বই পড়েও অনেক কিছু শেখা যায়। প্রকৃতির জ্ঞানই বইপত্রে লেখা হয়। আসল কথা হলো জ্ঞানের জন্য তুমি কতটুকু চেষ্টা করছ, কতটুকু ধৈর্য্য ধরছ সেটিই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রকৃতিকে পাঠ করে জ্ঞানীরা। আর তারাই প্রকৃতির বিষয় নিয়ে বই লিখেন তোমাদের পাঠের জন্য।

দাদাভাইয়ের কথা ভালো লাগে লাবিবের। চিন্তা করতে থাকে জীবন-জগৎ নিয়ে। এক সময় লাবিব বলল, দাদাভাই আমি আর ঢাকায় ফিরে যাব না। তোমার সাথে থেকে যাব।

মনসুর সাহেব হাসলেন। তা কি করে হয়? বরং তুমি সেখানেই থাক। মাঝে মাঝে আসবে গ্রামে। গ্রাম দেখবে। মানুষের সঙ্গে মিশবে। মানুষের সঙ্গে কথা বলবে।

ঢাকার বন্দি জীবন লাবিবের ভালো লাগে না। এই খোলামেলা প্রকৃতির কাছে লাবিব হারিয়ে যেতে চায়। মনে মনে সে স্থির করে ঢাকায় ফিরে যাবে না। এখানেই দাদাভাইয়ের গড়া স্কুলে পড়বে।

সে আবার দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, আমি ঢাকায় ফিরে যাব না।

লাবিবের কথা শুনে দাদাভাই চিন্তিত হয়ে পড়েন।

 

 

২.

লাবিবকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। থানা জিডি করা হয়েছে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। পাড়ায় মহল্লায় মাইকিং করা হয়েছে। এভাবে চলে গেল সাত দিন। কোথায় গেল? মা-বাবার খাওয়া নেই, নাওয়া নেই, ঘুম নেই। সবাই অস্থির। বাসায় কান্নাকাটিরও শেষ নেই। সবশেষে গ্রামের বাড়িতে গাড়ি দিয়ে ড্রাইভারকে পাঠানো হলো।

বারান্দায় বসে যখন মনসুর সাহেব বিকেলে মুড়ি খাচ্ছিলেন তখন লাবিব হাঁটু অবধি কাদা মাখিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল। লাবিবের এই অবস্থা দেখে মনসুর সাহেব হো হো হো করে হাসতে শুরু করলেন। লাবিব কি যেন বলতে চাইছিল ঠিক তখনই বাড়ির আঙ্গিনায় গাড়ির হর্ন শোনা গেল। লাবিবের বুক কেঁপে উঠল। মনসুর সাহেবও বাড়ির বাহিরের দিকে আগন্তুকের আসার ক্ষণটির দিকে অপেক্ষা করেন।

বাড়ির ভেতরে ঢুকল লাবিবদের ড্রাইভার। ড্রাইভারকে দেখে লাবিবের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে যেন এক্ষুণি পুলিশের কাস্টডিতে ঢুকতে হবে।

ড্রাইভার নিজের পরিচয় দেওয়ার পর মনসুর সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, তুমি একা এসেছো অন্য কেউ আসেনি কেন?

ড্রাইভার বলল, ছোট সাহেব যে বাসা থেকে পালিয়ে এসেছে। তাকে খুঁজতে আমি একা একাই এসেছি।

মনসুর সাহেব লাবিবের দিকে ফিরে তাকান। এতটুকু ছেলে এতো সাহস করে এতো দূর চলে এসেছে? মিথ্যে কথা বলেছে? মনসুর সাহেব মিথ্যে বলা একদম করতে পারেন না। নিজেও জীবনে মিথ্যে কথা কয়টি বলেছেন তা আঙুলে গুনে বলে দিতে পারেন। কিন্তু তারই ছেলের ছেলে একটুখানি পুঁচকে সে কি না তার সঙ্গে মিথ্যে বলল। নিজের ক্ষোভ ও রাগটা চাপা দিয়ে ভাবলেন, লাবিবের পালিয়ের আসার কারণ না জানা পর্যন্ত চড়াও হওয়া যাবে না। তিনি ড্রাইভারকে বললেন, তুমি যাও হাত-মুখ ধুয়ে আস। নাশতা-পানি খাও।

ড্রাইভার বলল, বাসার সবাই খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে মরতে বসেছে। আমি খবরটা দিয়ে আসি। ঝটিতে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল।

মনসুর সাহেব অবাক হয়ে বললেন, ছেলেটা কত বোকা কেন? সে তো লাবিবকে নিয়েও যেত পারতো। এমনভাবে চলে গেল…।

লাবিব বলল, আমাদের ড্রাইভার খুব বোকা। তাকে যা বলবেন তাই করবে। রোবটের মতো। আব্বু হয়তো বলছে, লাবিব আছে কিনা দেখে আয়। এখন সে দেখেছে তাই চলে গেছে।

মনসুর সাহেব মনে মনে যে রাগ পোষণ করেছিলেন ড্রাইভারের বোকামি দেখে হাসতে লাগলেন। রাগ জল হয়ে গেল।

মনসুর সাহেব বিকেলে লাবিবকে আর কিছুই বলেননি। রাতে খাওয়ার দাওয়ার পর লাইব্রেরির টেবিলে একপাশে তিনি এবং অন্যপাশে লাবিব। তিনি আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলেন, সারাদিন কি করেছো?

লাবিব জবাব দেয়, মার্বেল খেলা শিখেছি। হাডুডু শিখেছি। কাবাডি শিখেছি। তারপর ধান কীভাবে চাষ করা হয়, কতদিনে ধান হয়। কি করলে ভাল ধান হয় এই সব শিখেছি। কিন্তু দাদাভাই জানো, আমি শুধু মার্বেল খেলাটি বেশি পারিনি। পাড়ার ছেলেরা আমার সব মার্বেল জিতে নিয়ে গেছে। অন্য খেলায় আমি শোধ নিয়েছি। ওরা পারেনি।

মনসুর সাহেব হাসতে হাসতে বলেন, কিন্তু বাসা থেকে পালিয়ে এসেছো কেন?

লাবিব জবাব দেওয়ার জন্য ভাষা খুঁজে পায় না। সে মাথা নিচু করে থাকে। কিছুক্ষণ পরে বলে ঢাকায় থাকতে আমার ভালো লাগে না। আমি তোমার কাছে থাকব। আর কোনদিন যাব না। আচ্ছা দাদাভাই তুমি যে স্কুলে গড়লে সেখানে আমাকে ভর্তি করে দেবে?

মনসুর সাহেব চিন্তিত হয়ে পড়েন। ওর শরীরে যে রক্ত তার বিরুদ্ধে যাওয়া খুবই কঠিন। মনসুর সাহেবের বংশধরেরা যা মুখ দিয়ে বের করে তাই করে। একটু কমবেশি হয় না। তিনিও কম কিসের? পাকিস্তানী অফিসার একদিন বাঙালিকে তুচ্ছজ্ঞান করে কথা বলেছিল বলে তার গালে কষে চর বসিয়ে দিয়েছিলেন। ইপিসিএসের চাকরি ছেড়ে এসে গ্রামের স্কুল প্রতিষ্ঠা করে নিজের স্কুলেই মাস্টারি করে জীবন কাটিয়ে দিলেন। পিতাপুত্রের মতের মিল হয়নি বলে তিনি ছেলের বাসায় থাকতে চান না। ছেলেও ঢাকায় থাকবে বলে বাড়ি ছেড়েছে। একদিনও গ্রামের বাড়িতে আসে না। বাবাকে দেখতেও না পর্যন্ত। এই রক্তের স্রোতের ধারা যে তারই শরীরে।

লাবিব বলল, যদি তোমার সাথে থাকতে না দাও তাহলে আমি বাসা থেকে অন্য কোথাও পালিয়ে যাব যেখান থেকে আর কোনদিন আমাকে খুঁজেও পাবে না।

শেষের বাক্যটিতে তিনি সাংঘাতিকভাবে আহত হলেন। তিনি লাবিবের মাথায় হাত রেখে বলেন, এমন কথা বলতে নেই দাদাভাই। তুমি হারিয়ে গেলে তোমার বাবা-মা আমরা সবাই ভীষণ কষ্ট পাব। চিন্তায় চিন্তায় মারাই যাব।

দাদাভাইয়ের কথায় লাবিবের মধ্যে কোনো পরিবর্তন এসেছে কিনা কে জানে। সে বলল, আমি কেন পালিয়ে এসেছি জানো?

না। কেন?

বাবা কেন তোমার খোঁজ-খবর নেয় না তা আব্বু-আম্মুকে বোঝানোর জন্য। এখন আম্মু-আব্বু বুঝতে পারবে পিতাপুত্রের সম্পর্কটা কী? কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর লাবিব আবার বলল, আব্বু-আম্মু যে তোমার খোঁজ-খবর না নিয়ে ঢাকায় পড়ে থাকে, তোমার কষ্ট হয় না?

এতোটুকুন লাবিবের কথা শুনে মনসুর সাহেবের চোখ দু’টি পানিতে ভিজে যায়। মনের অজান্তেই চশমাটা খুলে ফেলেন। সামনের বইটি উল্টিয়ে রাখেন। লাবিবের মাথাটি বুকের ওপর চেপে ধরে নরম চুলে বিলি কাটেন। মনে হলো এক সিংহ-পুরুষ মনসুর সাহেব এখন সত্যিকারের একজন শিশু।


 

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu