সৌর শাইন

ঘৃণার গোলাপজল

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

রাশি। মেয়েটার বয়স গত মাঘে হলো উনিশ। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা, ছিপছাপ গড়ন, মানান সই উচ্চতা। দেখতে নজর কাড়ার মতো না হলেও, যথেষ্ট সুন্দরী ও মায়াবী! গোলাকার মুখে সূর্যমুখী হাসির ছটা। রাশির বিয়ে হয়েছে মুরাদপুরে। তোফাজ্জল হোসেন ওরফে তোফা বেপারির ছেলে জোবায়েরের সাথে। রাশির স্বামী জোবায়ের ঢাকায় একটি কোম্পানিতে সামান্য চাকুরি করে। জোবায়েরের আয়ের উপর নির্ভর করেই চলে পরিবারটি। তবে রাশির শ্বশুর একেবারে যে আয় রোজগার করে না, তা নয়। গঞ্জে তোফা বেপারীর একটি টঙ দোকান আছে। ওখানে চা বিস্কিট চানাচুর বিক্রি করে হাটের সওদা, পান-সুপারির খরচটা তুলে আনে। মেজো দেবর জোনায়েদ অনেকটা চুপচাপ, লাজুক বোকাটে স্বভাবের। ক্লাস থ্রি থেকে পড়াশোনা ছুটি দিয়ে সে মানুষের জমিতে কামলা খাটে। এটা কেবল কাজের মওসুমে সম্ভব হয়। বাকি সময় ঘরে বসে টিভি দেখা, বাজারে গঞ্জে ঘুরে বেড়ানো, সুযোগ পেলে বিড়ি টানা ছাড়া আর কোনো কাজে লাগে না।

বিয়ের পর থেকে জোবায়ের প্রতি সপ্তাহে বৃহস্পতিবার রাতে বাড়িতে আসে। শুক্র-শনি দু’দিন থেকে রবিবার ভোরের ট্রেনে গিয়ে অফিসে উপস্থিত হয়। এভাবেই চলছে নয়া সংসারের চাকা। বিয়ের পর থেকে এই বহু সদস্যের পরিবারে মধ্যমণি হয়ে ওঠে রাশি। রাশির পুরো নাম রাশিদা বেগম। শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর-ননদ সবাই রাশিকে পছন্দ করে খুব। এ পছন্দের মাত্রা ছিল ব্যক্তি ভেদে ভিন্নতর। এখন চরিত্রের নাম পরিচিতি পর্বে নজর দেওয়া যাক, রাশির শাশুড়ির নাম জোবায়দা, মেজো দেবর জোনায়েদ, ছোটো দেবর জাকির ও একমাত্র ননদ ও ভাইদের আদরের ছোটো বোনের নাম টুম্পা।

নতুন বউ দিন যেতে যেতে পুরাতন হয়ে ওঠে। শাশুড়ি পুত্রবধূকে যথেষ্ট ভালোবাসলেও, দু’জনের মধ্যে হাসি ঠাট্টা সমেত ছোটো-খাটো ঝগড়াও বাদ পড়ে না। কারণ, পুত্রবধূর কোনো কাজ পছন্দ না হলে জোবায়দা বরাবরই ঘ্যান ঘ্যান শব্দের জিগির তোলে। আর এই ঘ্যানর ঘ্যানরের প্রতিবাদে মাঝে মধ্যে না খেয়ে থাকে রাশি। এতে শাশুড়ির অন্তর বেদনা বাড়তেই থাকে, তখন পুত্রবধূকে খাওয়ানোর জন্য ওঠে পড়ে লাগে। আবার দু একটা টিভি সিরিয়ালকে কেন্দ্র করে দু’জনের মধ্যে এক ধরনের সমঝোতাও আছে। তবে এটা দৃশ্যমান পরিবারটি দরিদ্রতার মধ্যে দিন-যাপন করছে। অনটনের সাথে লড়াই করে টেনেটুনে প্রতিদিনের রান্না-বান্নার আয়োজন করতে হচ্ছে।

বাড়িতে একটি মাত্র থাকার ঘর। মাঝখানে বেড়ার পার্টিশন দিয়ে দুটি রুম করা হয়েছে। যখন জোবায়ের বাড়ি আসে তখন রাশিকে সাথে নিয়ে পাশের রুমে ঘুমায়। স্বামী চলে যাবার পর রাশি শ্বশুর-শাশুড়ির রুমে মেঝেতে চাটাই বিছিয়ে শোয়, আর পাশের রুমে দু’দেবর জোনায়েদ ও জাকির থাকে। কখনো আবার দু’ভাইয়ের মধ্যে ঝগড়া হলে জাকির মেজো ভাইকে একা রেখে চলে আসে এই পাশের রুমে। বাবা মা ও বোনের সাথে চাপাচাপি করে একই খাটে শুয়ে পড়ে। এই সংসারে জাকির সবচেয়ে রাগী ও একগুয়ে স্বভাবের প্রাণী। সে এবার ক্লাস নাইনে পড়ছে মুরাদপুর হাই স্কুলে। পড়াশোনায় একেবারে মন্দ নয়, অভাবে দিন কাটিয়েও পড়ার প্রতি অবহেলা করেনি। স্কুল ও পাড়া গাঁয়ে সবার কাছে সে পরিচিত কঠোর রাগের কারণে। রাগটাই ওর মহাদোষ! কখনো কারোর প্রতি রেগে গেলে শত চেষ্টা করেও ওর সে রাগ ভাঙানো যায় না। তবে রাশি কখনো কখনো এই যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে ওঠেছে। বলা চলে, ভাবির কথা জাকির ফেলতে পারে না। কারণ, রাশির মিষ্টি হাসি ওর অভিমানকে ছুটি দিতে বাধ্য করে। মেজো ভাইয়ের সাথে ঝগড়া করাকেও ছুটি দেয় জাকির।

রাশির পড়াশোনা ক্লাস এইট পর্যন্ত। বাপের বাড়িতে দরিদ্রতার কারণে আর স্কুলমুখী হবার সুযোগ হয়নি, তারপর তো বিয়ে নামের বন্ধনে বন্দি হতে হলো। রোজ সন্ধ্যায় রাশি ক্লাস ফোর পড়ুয়া টুম্পাকে পড়াতে বসে। গল্প পাঠ করতে করতে ভাবে নানা কথা, সেই সাথে সময় কাটে স্বামীর জন্য অপেক্ষায়। টুম্পাকে পড়াতে বসার সময় জাকির বলে, ভাবি তুমি কেন যে একটু বেশি পড়াশোনা করলে না, যদি করতে আমাকেও পড়াতে পারতে।

রাশি হেসে বলে, পড়িনি বলে পড়াতে পারবো না, তা কিন্তু নয়। এখনো আমার সব ক’টা বাগধারা মনে আছে, জার্নি বাই ট্রেন প্যারাগ্রাফটা মুখস্থ। রাশি গর গর করে সাত-আটটা ইংরেজি বাক্য শুনিয়ে দেয়।

হেসে লুটিয়ে পড়ে জাকির। হাসতে হাসতে ওর কাশি ধরে যায়।

রাশির সাথে জাকিরের সখ্যভাব এক ধাপ এগিয়ে যায়, ওর কবিতা লেখার কারণে। টেবিলের বাক্সে লুকানো ডায়েরি থেকে রাশি জাকিরের লেখা পড়ত। লেখা নিয়ে হতো আলোচনা সমালোচনা, এতে জাকির ভীষণ উৎসাহ পেতো। যখন তখন রেগে যাওয়া বদমেজাজি জাকির ধীরে ধীরে হাসি আমোদ প্রিয় কিশোর কবি হয়ে ওঠে। প্রতিদিন রাশির হাসি দেখার জন্য নতুন কবিতা রচনায় ঝুঁকে পড়ে। এক এক করে কবিতার সংখ্যা বাড়তে থাকে।

চুপচাপ থাকা জোনায়েদকেও রাশি অনেকাংশে পাল্টে ফেলে। জোনায়েদ বোকাটে হলেও তার মাঝেও রয়েছে কৌতুক প্রিয় একটা মন। যে মন হাসি আনন্দে বিগলিত হয়ে ওঠে।

বৈশাখ মাসে মুরাদপুরে মেলা জমে। জাকির, জোনায়েদ, রাশি, টুম্পা দল বেঁধে মেলায় যায়। মেলা থেকে ওরা জিলাপী ও মিষ্টি কিনে। এছাড়া জোনায়েদ একটি রেজার লাইট, জাকির একটি ক্যালেন্ডার ও টুম্পা একগাছি চুড়ি কিনে। পুরো পথ ওরা হৈ চৈ করে ধুলো উড়িয়ে বাড়ি ফিরে।

বাড়ির বউয়ের এইভাবে মেলায় যাওয়াটা মেনে নেয়নি জোবায়দা। পুত্রবধূর প্রতি রেগে ফেটে পড়ে, গাল মন্দের ঝড় তোলে। কিন্তু ছেলে-মেয়েদের উল্টো রাগের কাছে হার মানতে হয় জোবায়দাকে। নিজের পেটে ধারণ করা সন্তানদের কাছে এমন উল্টো সমর্থনে ভীষণ মনোকষ্ট পায়, ক্রোধ জেগে ওঠে চোখে মুখে।

সে রাতে জাকির রাশির কাছে ডায়েরিটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ভাবি দেখো তো একটু, নতুন একটি কবিতা।

রাশি ডায়েরির ভেতর কাগজে মোড়ানো একটি ইমিটেশনের নাকফুল দেখতে পায়। ওখানে লেখা, তোমায় দিলাম ভুবন ডাঙার হাসি। সাথে একটি বৈশাখের কবিতা।

কবিতা পড়ে রাশি বলে, খুব সুন্দর হয়েছে।

রাশির দিকে তাকিয়ে এক চিলতে লাজুক হাসি ঠোঁটে এঁকে বাইরে বেরিয়ে যায় জাকির। মেঘ মুক্ত আকাশে চাঁদ-তারার জগতে তাকিয়ে জাকিরের দুরন্ত কবিমন রাতের নিরবতা ভেঙে গান গেয়ে ওঠে।

রাশিকে শ্বশুরও বিশেষভাবে স্নেহ করত। এতে শাশুড়ি প্রথম থেকেই রেগে যেত ভীষণ। কারণে অকারণে তোফা বেপারী ও জোবায়দার মধ্যে হতো ঝগড়া। এই তো সেদিন রাশি শ্বশুরকে পান সাজিয়ে দেবার পর জোবায়দা বিড়বিড়িয়ে বলতে থাকে, দিনের মাঝে হাজারবার পান গিলবে পান কেনার সময় তো দেখি না। পোলা কিনেছে বলে ভাগ্যে জুটে নয় তো..

তোফা বেপারী পান চিবিয়ে বলে, চুপ করবি বুড়ি… আমারে তো কোনো সুখ শান্তি দিলি না। দিনে রাইতে দিলে খালি যন্ত্রণা দিছোস। জীবনডা পান্তা ভাত বানায়া রাখছোস।

জোবায়দাও থামে না, প্রতিউত্তরে বলে, কোন মাগির ফান্দে আবার পা দিছো? ঘরের শান্তি কি মনে টিকে না?

তোফা বেপারী ফুঁসে ওঠে, ঘরে শান্তি থাকলে তো মন টিকবো।

জোবায়দা কটমট করে বলে, যাও তবে, যেইখানে শান্তির মেলা জমছে ঐখানেই যাও।

তোফা বেপারী রেগে হাতের কাছে থাকা ঘরের হাড়ি-কলস উঠোনে ছুঁড়ে ফেলে বেরিয়ে যায়।

এরূপ ঝগড়া তাদের মাসে দুয়েকবার ঘটে আর দু’দিন পর মিটে যায়। সংসার গতিবিধি ঝগড়া ও আনন্দে চলতে থাকে। রাশি সপ্তাহ শেষে অপেক্ষা করে স্বামীর জন্য। জোবায়ের আসে ফল-মূল নানা কিছু নিয়ে। অপেক্ষার শেষে আনন্দে মন ভরে ওঠে।

এবার জোবায়ের আসার পর ভীষণ অস্থিরতা দেখায় রাশি। রাতে বিছানায় আসার পর স্বামীকে বলে, এইভাবে যদি প্রতিদিন তোমারে কাছে পাইতাম, তাইলে আর কষ্ট থাকত না মনে।

জোবায়ের রাশিকে জড়িয়ে ধরে বলে, আর কিছু দিন ধৈর্য ধরো বউ, প্রমোশন পাইলে তোমারে শহরে নিয়া যাইমু। তখন আর কষ্টে থাকতে হইবো না।

রাশি নিশ্বাস ছেড়ে বলে, তাই যেন হয়।

কথায় কথায় কাছে আসে শরীর যুগল। হঠাৎ রাশির চোখ যায় দেওয়ালে, একটা নীলাভ রঙের ছোট্ট আলো দেখতে পায়। আলোর উৎস খুঁজতে জানালার দিকে তাকায়। দেখা যায় একজোড়া চোখ! রাশি ঝটপট জানালা আটকে দেয়।

পরদিন রাশি জোনায়েদকে ডাকে। কমলার কয়েকটা কোয়া হাতে দিয়ে বলে, রেজার লাইটটা দে তো।

জোনায়েদ লুঙ্গির গিট্টু থেকে রেজার লাইট বের করে রাশিকে দেয়।

রাশি হুঙ্কার দিয়ে বলে, দাঁড়া মজা দেখাচ্ছি।

সাথে সাথে রেজার লাইটটা ইটের উপর রেখে হাতুড়ির আঘাতে গুঁড়ো করে ফেলে। এ দৃশ্য দেখে ভয়ে পালিয়ে যায় জোনায়েদ।

জোবায়ের চলে যাবার পর, রাশি জাকিরকে নিয়ে বাপের বাড়ি হাজিরগঞ্জ বেড়াতে যায়। গরমের ছুটি আনন্দে কাটতে থাকে। বাড়িতে বাবা মায়ের ঝগড়া ও কথা কাটাকাটি থেকে মুক্তি পেয়ে জাকিরও যেন তৃপ্তি পায়। আম ও লিচুর ডালে মুক্ত পাখির মতো চড়ে বেড়ায় রাশি। জাকিরের কাছে রাশিকে ঘিরে পাকা ফলের আবেশ ও সুধা হয়ে ওঠে মধুময়। রাশিদের বাড়ির কাছে কৃষ্ণমুখী নদী। নদীর পাড়ে হেঁটে ও নৌকায় চড়ে বেরিয়ে জাকিরের কবিমন উদাস হয়ে উড়ে বেড়ায় দূর দিগন্তে। কবিতার খাতা ভরে ওঠে পঙক্তি-চরণে। দু’সপ্তাহ পর ওরা হাজিরগঞ্জ ছেড়ে বাড়ির পথ ধরে।

রাশি বাড়িতে ফিরে দেখে শ্বশুর শাশুড়ি ঝগড়ায় ব্যস্ত।

জোবায়দা বলছে, বুড়ো বয়সে এতো ভীমরতি আসে কোত্থেকে? সব রকমের ভীমরতি ঝেঁটিয়ে বিদেয় করবো, হ্যাঁ, বলে রাখলুম।

তোফা বেপারী বলে, তুই যে কী করবি তা আমার জানা আছে, হারামজাদি আমার জীবনটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে ফেললি।

জোবায়দা বলে, আরো পুড়িয়ে তারপর তোমাকে কবরে পাঠাবো… হ্যাঁ, বলে রাখলুম।

জোবায়দা বেগমের ঝগড়ার স্টাইল দেখে স্পষ্ট বোঝা যায়, ভারতীয় বাংলা টিভি চ্যানেলের সিরিয়াল তার উপর কতটা প্রভাব বিস্তার করেছে। ওপার বাংলার কথার স্টাইল কপি করে তোফা বেপারীর উপর প্রয়োগ করে বেজায় তৃপ্তি পাচ্ছে।

পুরো সন্ধ্যা এই নয়া কলা-কৌশলী ঝগড়ার মধ্য দিয়ে কেটে যায়। কিন্তু রাত নটার সিরিয়াল শুরু হবার সাথে সাথে জোবায়দা গলার স্বর বন্ধ করে টিভিমুখী হয়। এদিকে রাশি ও টুম্পা রান্নার কাজ সেরে রাতের খাবারের আয়োজন করে। রাত দশটার পরপরই সবাই খেয়ে শুয়ে পড়ে। রাশিও মেঝেতে চাটাই পেতে গভীর ঘুমে নিমজ্জিত হয়।

মাঝরাতে হঠাৎ রাশির ঘুম ভেঙে যায়। বুঝতে পারে যে কেউ তার মুখ চেপে ধরেছে। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হতে থাকে, শব্দ করতেও পারছে না। অচেনা কেউ তার শাড়ি ও পেটিকোট উপরে তুলে দেয়। আর যোনীতে হাত ঘষতে থাকে। রাশির তখন প্রাণ প্রায় বেরিয়ে যাবার মতো অবস্থা। হাত তুলে আগুন্তকের দিকে বাড়ায়, ধরতে পারে না। মৌলিক অনুভূতি যেখানে অনুপস্থিত সেখানে সবই ভয়ংকর কুৎসিত। নাভির তলদেশে প্রবেশ করে ধারালো লাঙ্গলের ফলা! যেন মাটির বুক চিরে ভেতরে ঢুকে যায়! এক সময় সব ক্ষান্ত হয়। অচেনা দেহটি দরোজা খুলে বাইরে বেরিয়ে যায়।

রাশি জ্ঞান হারায়।

পরদিন ঘুম থেকে জেগে ওঠে রাশি আবিষ্কার করে জাকিরের উপহার দেওয়া ইমিটেশনের নাকফুল ভেঙেচুরে রক্তাক্ত হয়ে আছে। শরীরে ভীষণ ব্যথাও অনুভব করে। সবাই স্বাভাবিকভাবে বাড়িতে নিজের মতো ব্যস্ত, কেবল রাশি এক অজানা ঘোরের ভেতর যন্ত্রণায় কুঁকড়ে মরে। রাশির চুপচাপ থাকার দৃশ্য ধরা পড়ে জাকিরের চোখে, কয়েকবার প্রশ্ন করার পরও কোনো উত্তর করে না।

দু’দিন পর সেই একই ঘটনার সূত্রপাত ঘটে। শরীর পিষে কাপড় সরাতে থাকে আগুন্তক। রাশির হাত দুটো লোকটার একহাতের মুঠিতে বন্দি। অপর হাতে চেপে ধরে রেখেছে রাশির মুখ। পায়ের কায়দায় মাটিতে সেঁটে দিয়েছে রাশির ছিপছিপে সামান্য পাতলা শরীরটুকু। কেবল নাকে এসে লাগে জর্দ্দা বিড়ির গন্ধ!

নিরূপায় রাশির চোখ ফেটে জল নামে। জড়বস্তুর মতো পড়ে থেকে নিঃশব্দে কাঁদে।

পরদিন জোবায়ের বাড়ি আসে। এক অজানা ভয়ের কারণে বিক্ষত হৃদয়ের ব্যথাটুকু প্রকাশ করতে পারে না রাশি। সারাক্ষণ মনমরা হয়ে সময় কেটে যায়। দিনে একবার একমুঠো ভাত মুখে দেয় কিংবা দেয় না। অনাহারে পার হয় দিন। জোবায়ের অনেক প্রশ্ন করেও কোনো সদুত্তর পায় না। ছুটি ফুরাবার পর সে ঢাকা ফিরে যায়।

সেদিন রাতে রাশির চোখে ঘুম নামেনি। দেখতে পায়, খাটে শোয়া জোবায়দা বেগমের পাশ থেকে একটি শরীর ওঠে বসেছে। তারপর অতি ধীর পায়ে এদিকে এগিয়ে আসছে। রাশি ঘুমের ভান করে পড়ে থাকে, বিন্দুমাত্র বাধা দেবার চেষ্টা করে না। রাশির শরীর ডলে মাটিতে মিশিয়ে দিতে চায়, কিন্তু নিস্তব্ধ ভাবের কারণে চাপ প্রয়োগ করে না আগুন্তক। আগের মতো হাত জোড়াও বন্দি করে না। বুকের কাপড় সরিয়ে স্তনদ্বয়ে জিহ্বা নামিয়ে চাটতে থাকে। রাশি বুঝতে পারে, মাংশ দলার উপর সূঁচালো কিছু খোঁচা খাচ্ছে। হঠাৎ রাশি হাত বাড়িয়ে আগুন্তকের মুখ স্পর্শ করে। আন্দাজের সাথে অবয়ব মিলে যায়। মুখের উপর একগুচ্ছ গোঁফ। লোকটা হেঁচকা দিয়ে রাশির হাত সরিয়ে চেপে ধরে। গোঁৎ গোঁৎ… রেগে কামড়ে ধরে স্তনের বোঁটা। যন্ত্রণায় আঁৎকে ওঠে রাশি, চিৎকার দিতে চায়। এক টুকরো শব্দ টিনের চাল অবধি উড়ে যায়।

আগুন্তক বলে, লাও পারবি তো একেবারে জানে মেরে ফেলব।

লোকটা একহাতে রাশির গলা চেপে ধরে, অপর একটা হাত মুখ চেপে রাখে। নিরূপায় হয়ে একটা সময় চিৎকার করার প্রচেষ্টা ছেড়ে দেয়। আগুন্তকের ঘাতক আঙুলের সুরু ফাঁক দিয়ে হালকা অক্সিজেন টেনে বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বনটুকু ধরে রাখে।

প্রতিদিনের মতো সকালের আলো জেগে ওঠে। অসহায় উপায়হীন রাশি কী করবে বুঝতে পারে না। কেবল কেঁদে যায় দিনভর। শ্বশুর শাশুড়ি সেই সকাল থেকে কান্নাকাটির কারণ জিজ্ঞেস করছে। জাকির জোনায়েদ টুম্পাও বাদ যায়নি, ভাবীর দুঃখ জানার চেষ্টা করেছে। রাশি সবার প্রশ্নে নিরুত্তর। কী উত্তর করবে তাই সে খুঁজে পায় না।

এক সময় শাশুড়ির কাছে কেঁদে সবকিছু জানায়।

শাশুড়ি শুনে রেগে বলে, হারামির ভীমরতি ছুটায়া দিমু, হাতের কাছে সুবিধা মতো ধইরা লই। কান কেটে দিমু। তুমি মন খারাপ কইরো না বউ।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে শাশুড়ি রাশির পিঠে হাত বুলিয়ে বলে, মা গো, মানুষরে জানায়া মসিবত বাড়াইওয়ো না বউ, লোকে শুনলে ঘরে-বাইরে মান সম্মান থাকবো না। পুরুষ লোকেরা এমন বাজে প্রকৃতিরই, এমুন কম-বেশি বদ মেজাজ থাহেই। আগের রাজা-বাদশারাও এমুন আছিল। আর শোনো, খবরদার এইসব কথা কক্ষনো স্বামীর কানে দিবা না। যদি এই রকমের কোনো অঘটন ঘটাও তবে, এই বাড়ির ভাত তোমার কপালে আর জুটবো না, বলে রাখলুম… হ্যাঁ।

রাশি হতাশ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। অন্ধকারে হাতড়ে কিছুই খুঁজে পায় না। অবশেষে পাগলের মতো ছুটে যায় জাকিরের কাছে। কেঁদে বলে, আমাকে একটু হাজিরগঞ্জ দিয়ে আসবি ভাই।

জাকির রাশির চোখের পানি মুছতে মুছতে নিজেও কেঁদে ফেলে।

বলে, ভাবি দিন দিন তোমার এই দশা হচ্চে কেন? কী হয়েছে তোমার? আমাকে বলো। আমি তোমাকে সদরে ডাক্তারের কাছে নিয়া যাবো।

রাশি সামান্য বিশ্বস্ত আশ্রয় পেয়ে জাকিরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। জাকিরের অনুরোধে রাশি কান্না থামায়। বলে, আমার অনেক বড় অসুখ হয়েছে রে, এমন অসুখ হলে নারীরা বাঁচতে পারে না।

কী হয়েছে আমাকে বলো।

তুই দেখবি কী হয়েছে আমার?

হাঁ, দেখবো।

রাশি স্তনদ্বয় বের করে দেখায়। স্তনের বোঁটা থেকে গলা, শরীরের আরো নানা প্রান্তে ক্ষতের চিহ্ন!

আঁৎকে ওঠে জাকির, বলো, কিভাবে তোমার এই সর্বনাশ হলো?

রাতের রাক্ষস এসে আমারে কামড়ায় রোজ।

এতোটুকু বলে কান্নায় ভেঙে পড়ে রাশি।

সেদিন রাতে জাকির মেজো ভাই জোনায়েদের সাথে ঝগড়া বাঁধিয়ে পাশের ঘরে এসে ঘুমায়।

পরদিন গাঁ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ছেলের হাতে পিতা খুন! বাঁশ কাটার ধারালো দায়ের কোপে ধড় থেকে মাথাটা আলাদা হয়ে মেঝেতে পড়েছে। এমন খুন মুরাদপুরে আগে কখনো ঘটেনি। মানুষজনের ঘৃণা বিদ্বেষ বন্দুকের টোটার মতো ছুটে আসছে খুনির দিকে। খুনি আর কেউ নয় কিশোর কবি জাকির। সে চুপচাপ বসে আছে পিতার লাশের কাছে। চোখে এক ফোঁটা পানি পর্যন্ত নেই। একটু পর পর সে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলছে। সে একটি খুন করেছে, এই ভাবনার লেশমাত্র মুখমণ্ডলে নেই। ওর চোখে গতরাতের ঘটনাটা একটা দুঃস্বপ্ন যেন। লাশের পাশে বসে আছে জাকিরের মা, মেজো ভাই, ছোটো বোন ও বড় ভাইয়ের স্ত্রী রাশি। সবাই নিশ্চুপ!

জাকিরের কানে আসছে নানা জনের নানা কথা। কেউ বলছে, পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যাবে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে, ফাঁসিও হতে পারে। পুলিশ কখন আসবে, সে প্রশ্নও লোকমনে ঘুরপাক খাচ্ছে। উত্তরে কেউ বলছে, থানায় খরব দেওয়া হয়েছে, শীঘ্রই আসবে। লাশ নিয়ে যাবে, কাটাছেঁড়া করবে। তারপর পচে-গলে একাকার হবার পর কবর দিবে হয়তো।

পাশের বাড়ির চাচা ফিরোজ মিয়া এসে জাকিরের কানের কাছে বলে, বাবা তুই কোথাও পালিয়ে যা। পুলিশ আসার আগেই চলে যা, বাকিটা আমরা সামলে নেবো। জোবায়দা বেগম পাশেই বসা ছিল, দীর্ঘক্ষণ কাঁদতে কাঁদতে স্তব্ধ হয়ে আছে এখন। ফিরোজ মিয়ার কথাটা কান আসে। মাথা তুলে তাকায় সেদিকে। ফিরোজ মিয়া আবারো বলে, ভাবী কথাডা ভালোর জন্যই কইলাম, একটু ভাইব্যা দেখেন। এবার জোবায়দা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে হু-হু করে কেঁদে ওঠে।

বাবারে এই কাম ক্যান করতে গেলি? ক্যান করলি এই কাম?

জাকির কোনো কিছুতেই ভ্রুক্ষেপ করে না।

এবার শান্ত স্বরে জোবায়দা বলে, যা বাবা তুই কোনো জায়গায় পলায়া যা। অন্তত তোর বড় খালার বাড়িতে যা। পুলিশে নিয়া গেলে তোরে পামু কই?

মায়ের কথাগুলো জাকিরের কানে পৌঁছে না। ঢাকা থেকে জোবায়ের এসে আছড়ে পড়ে উঠোনে। পিতার লাশের কাছে গড়াগড়ি দিয়ে বিলাপ করে। এক সময় রাগে বিক্ষুব্ধ হয়ে অতি আদরের ছোটো ভাই জাকিরের কলার চেপে ধরে। জোবায়ের চিৎকার করে বলে, কেন? কেন? আমার বাপকে মারলি? উত্তরহীন জাকিরকে দূরে ছুঁড়ে মারে। মুর্ছা যায় জোবায়দা। কাঁদতে থাকে টুম্পা ও জোনায়েদ।

ঘণ্টা খানেক পরে বাড়িতে পুলিশ আসে। গাড়ি রাস্তায় থামিয়ে পাড়ার ভেতর প্রবেশ করে চারজন কন্সটেবলের দল। প্রাথমিক তদন্তেকে কিভাবে খুন করেছে সে প্রশ্ন করা হয়। জাকির নির্বিঘ্নে উত্তর দেয়, আমি দা দিয়া কোপায়া মারছি…।

নিস্তব্ধ চারপাশ! হ্যান্ডকাফ লাগানো হয় জাকিরের হাতে। বাড়ির কর্তা, চার সন্তানের পিতা তোফাজ্জল বেপারীর লাশ কাপড়ে মুড়ে গাড়িতে রাখা হয়। জাকিরকে নিয়ে যাবার সময় ছুটে আসে রাশি। চিৎকার করে বলে, জাকির খুন করে নাই। খুন করছি আমি…। ওরে ছাইড়া দেন স্যার…

হতবাক পুলিশ অফিসার ভ্রু কুঁচকে বলে, মাথা ঠিক করে কথা বলুন। মিথ্যা আবেগ মাখবেন না। কে খুন করেছে সঠিক উত্তর দেন?

রাশি বলে, ওরে ছাইড়া দেন। খুনটা আমি করছি।

পুলিশ অফিসার পরিবারের অন্য সদস্যদের দিকে চোখ বুলায়। জোনায়েদ কিছু বলতে পারে না, কান্নায় গলা আটকে আছে। আঙুল তোলে জাকিরকে দেখায়।

সদ্য জ্ঞান ফেরা জোবায়দা একটিবার স্বামীর মুখ দেখতে চায়। পুলিশ অফিসার তার ইচ্ছে পূরণ করে। তারপর খুব ধীরভাবে জিজ্ঞেস করে, বলুন তো খুনের সময় আপনি কোথায় ছিলেন?

জোবায়দা বলে, আমরা চারজন একই খাটে শুইছিলাম। আমার ছেলে-মেয়ে জাকির, টুম্পা, আমি ও আমার স্বামী। শব্দ শোনার পর সজাগ হয়ে চিৎকার দেই। তারপর বাকিরা সজাগ হইয়া ওঠে।

তখন আপনার ছেলের বউ কোথায় ছিল?

পোলার বউ মাটিতে বিছানা কইরা থাহে। আমি চিৎকার দেওনের পর, বউ নিচে থেইক্যা ওইঠ্যা আসে।

খুন করার পর দা কার হাতে ছিল?

থমকে যায় জোবায়দা।

কী হলো, বলুন!

আমারে ছোটো ছেলের হাতে।

চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে ছেলেকে খোঁজে। না পেয়ে বলে, সে তো পলায়া গেছে। পরে একসময় আইস্যা খোঁজ নিয়েন।

পুলিশ অফিসার বলে, আচ্ছা, ঠিক আছে।

গাড়িটা চলে যায়।

দু’দিন পর জোবায়ের পিতার লাশ নিয়ে আসে থানা থেকে। জানাজার সময় প্রচণ্ড ঘৃণায় লাশের উপর গোলাপজল ছিটিয়ে দেয়।

রাশির মনের ভেতর ঘুরপাক খায় খুনির কচি মুখ! জোবায়ের জানায়, জাকিরকে থানা থেকে কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে।


This is an original content which is written by a DORPON author. Copying and publishing any part of the content is strictly prohibited.

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu