অনার্স ২য় বর্ষের পরীক্ষা শেষ। ফ্রি সময় কাটছে। কলেজ জীবনের প্রথম থেকেই পাঠ্য বইয়ে মন নেই। পাঠ্য বইয়ে কোনো টান অনুভব করছি না। সব ভালবাসা কবিতা-উপন্যাসে। বড় বড় উপন্যাস পড়া হয়ে যাচ্ছে অল্প দিনেই। শীর্ষেন্দুর মানবজমিন পড়লাম, বলা চলে এক নিঃশ্বাসে। কবিতা লেখার ভূতও পেয়ে বসেছে মাথায়। আর এই পরীক্ষার বিরতিতে ওসবের পালে আরও হাওয়া পেল। আর ক্রিকেট খেলা– নেশার মত টানে। হাই স্কুল মাঠে খেলা শেষে ফিরেছি এগারটার দিকে। মা বললেন, তোর বড় ভাই খবর পাঠিয়েছে সাবিকুনের এসএসসি পরীক্ষার ক’দিন তোকে থাকতে হবে ওদের ওখানে। সাবিকুন বড় ভাইয়ের মেয়ে। ভালো নাম সাবিকুন নাহার। আমরা সংক্ষেপে সাবিকুন বলেই ডাকি।
বড় ভাই আব্দুল রাজ্জাক মিয়া আদমগঞ্জ উপজেলা সমাজ সেবা অফিসের হিসাব রক্ষক। সপরিবারে বাসাভাড়া নিয়ে সেখানেই থাকেন। ওখানে যেতে ভালই লাগে আমার। এর আগেও অনেকবার গিয়েছি ওখানে। ওখানে অনেক বন্ধুও জুটেছে আমার। বিশেষ করে ক্রিকেট খেলতে গিয়েই বন্ধুত্ব। শীতের সময় ওখান দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটি মরে যায়। বাংলাদেশের বেশিরভাগ নদীর শীতকালে যে দশা হয় আর কি। মরা নদীর মাঝেই চলে ক্রিকেট। আমি মূলত নিজেকে একজন বোলার হিসেবে দাবি করলেও, সেবার প্রথম ম্যাচেই অনেক রান এসেছিল আমার ব্যাট থেকে। সেই থেকে ভালই কদর এই অতিথির।
দুপরে খাবার খেয়ে বেরিয়ে বিকালে গিয়ে পৌঁছালাম আদমগঞ্জ। আমার যাওয়ার একটু পরেই বড় ভাই বাসায় ফিরলেন অফিস থেকে। বাসায় এসেই আমার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন। এরকম দায়িত্ব এর আগেও পালন করতে হয়েছে আমাকে। সাবিকুনের পড়ার খোঁজ খবর নেয়া। একটু গাইড দেয়া। অঙ্ক বুঝিয়ে দেয়া। পরীক্ষার হলে প্রথম দু’একদিন নিয়ে যাওয়া, পরীক্ষা শেষে আনা ইত্যাদি।
সন্ধায় দেখা হলো রোহানের সাথে। রোহান বাড়িওয়ালার ছেলে। পঞ্চম শ্রেণিতে উঠেছে এবার। ভাল ছাত্র। ছোট খাটো গড়ন। দেখলে মনে হয় টু-থ্রীতে পড়ে। বড় ভাইর এক ছেলেও পড়ে রোহানের সাথে। হেবলা মার্কা ছাত্র। কিন্তু গায়ে পায়ে রোহানের দ্বিগুণ। ছোট বেলা আমিও ছিলাম রোহানের মতো। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এক থেকে তিনের মধ্যেই ছিল আমার রোল। ক্লাস ফোরে সিপন নামে আমার এক ক্লাসমেট ছিল। ওর মাথাটা ছিল অনেক বড়। পড়াশুনায় একেবারেই ভাল ছিল না। তাই মোল্লা স্যার একদিন রাগ করে বলেছিলেন, তোর মাথাটা একটা পঁচা কুমড়া। কুমড়া পঁচলে যেমন কোন কাজে লাগে না। তোর মাথাটা সেরকম। আর আমার মাথা দেখিয়ে বলেছিলেন, দেখ ওর মাথা। ছোট কিন্তু সরিষা চাপলে যেমন তেল বের হয়, ওর মাথা থেকেও ঠিক ওরকম পড়া বের হয়।
– আস্সালামু আলাইকুম, সজিব আঙ্কেল।
– অলাইকুম আস্সালাম।
– কেমন আছেন, আঙ্কেল?
– ভাল আছি। তুমি?
– ভাল আছি। আপনি কখন আসলেন?
– এই তো একটু আগে।
– তোমার পড়াশুনা কেমন চলছে?
– ভাল। আপনি আসছেন, ভালই হলো।
– কেন?
– আগে বলেন, আপনি কতদিন থাকবেন?
– এই তো, এসএসসি পরীক্ষা যতদিন চলবে।
– তাহলে তো ভালই হলো।
– কেন?
– বলছি, আসেন আমার সাথে। এই বলে রোহান আমাকে বাড়ির সামনের বাগানে নিয়ে গেল। যেখানটায় গাছ কিছুটা কম আর যায়গা পরিষ্কার করা।
– এই জায়গাটা এরকম পরিষ্কার কেন রোহান?
– এটা বলার জন্যই তো আপনাকে এখানে ডেকে আনছি।
– আচ্ছা বলো, আমার কাছে তো রহস্যময় কিছু মনে হচ্ছে।
– রহস্যময় কিছু না, আমি এখানে একটা শহিদ মিনার বানাবো। এরপর একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে ও সকালে এখানে ফুল দিয়ে ভাষা শহিদদের শ্রদ্ধা জানাবো।
– বাহ, ভালো উদ্যোগ।
– আপনার কিন্তু এ-ব্যাপারে আমাকে সহায্য করতে হবে।
– বলো কি! আমি?
– হা আঙ্কেল, আপনি। আপনাকে পেয়ে আমার সাহস বেড়ে গেল। একা একা এসব করা বড়ই কষ্টসাধ্য।
– বলো আমি তোমাকে কিভাবে সাহায্য করবো?
– মাগরিবের আযান পড়ে গেছে, আঙ্কেল চলেন আগে নামায পড়ে আসি। নামাজ পড়ে এসেই আবার পড়তে বসতে হবে। কাল আপনাকে সব বলব।
– চলো।
রাতে শুয়ে শুয়ে চিন্তা করতে লাগলাম রোহানের কথা। যতই চিন্তা করি ততই বিস্মিত হই। এতটুকুন ছেলে কত বড় চিন্তা চেতনা ও দেশপ্রেম। ভাল ছাত্র। ধর্মকর্মেরও বেশ মনোনিবেশ। আমাদের শিক্ষিত সমাজ, আমার মত ছাত্র যুবা- ভাবতে পেরেছি কি কখনো রোহানের মতো করে? ইচ্ছে হলো ওর কাছে গিয়ে মাথা নিচু করে কুর্নিশ করে আসি। আমাদের দেশে প্রতি ঘরে ঘরে যদি জন্ম নিত রোহানের মতো ছেলে! এসব চিন্তা করতে করতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙ্গলো সাবিকুনের পড়ার শব্দে।
– তোর পড়াশুনার কি খবর? কোথাও কোন সমস্যা নেইতো?
– না কাকু, সমস্যা নাই।
– সমস্যা হলে আমাকে বলিস।
– ঠিক আছে।
সাবিকুন আবার পড়তে আরম্ভ করলো। আমি দাঁত মাজতে মাজতে সেই শহিদ মিনারের জায়গাটার দিকে গেলাম। দেখি রোহান সেখানে কাজ করছে।
– কী করছো রোহান?
– ও, আঙ্কেল। আসেন। আপনি ঘুমাচ্ছিলেন তাই ডাকিনি। এইতো উঁচুনিচু জায়গাটা একটু সমান করে দিচ্ছি।
– আমাকে কি করতে হবে বলো।
– বাসার দিকে চলেন। আজ আর কাজ করবো না। যেতে যেতে আপনাকে সব বলছি। ফেরার সময় রোহান ওর পরিকল্পনার কথা আমাকে সব খুলে বলল। আর আমার কী দায়িত্ব, তাও বুঝিয়ে দিল।
পরিকল্পনা মতো কাজ চলছে ঠিকঠাক। কলা গাছ ও বাসের চোটি দিয়ে বানানো হয়ে গেল শহিদ মিনার। বাকি থাকলো শুধু মাঝখানের লাল বৃত্ত। সেটা কিভাবে হবে তা নিয়ে আলোচনা হলো দুজনের কিছুক্ষণ। রোহানেই একটা উপায় বের করল। প্লেন টিন কাটা হবে গোল করে। তারপর সেটাতে লাল রঙ করা হবে। বাসায়তো রঙ নেই, তাহলে কিভাবে করব, রোহান ভাবতে লাগলো। হঠাৎ, পাইছি বলে লাফিয়ে উঠলো।
– কী পেলে?
– বুদ্ধি পাইছি। স্কুলে যাওয়ার সময় কাটা গোল টিনটাকে নিয়ে যাবো বাজারে। সাইনবোর্ড লেখেন এমন এক দোকানদার আঙ্কেলের সাথে আমার পরিচয় আছে, তাকে দিয়েই রঙ করিয়ে আনবো।
– তাহলে তো ভালই হয়। আজ ঊনিশ ফেব্রুয়ারি। আজি রঙ করাতে পারলেই ভালো হয়।
কাটাকুটিতে ছোট বেলা থেকেই আমি ওস্তাদ। সুন্দর করে একেবারে নিখুঁত ভাবে, গোল করে কেটে দিলাম টিনটাকে। বাজারের উপর দিয়েই যেতে হয় রোহানের স্কুলে। স্কুল থেকে ফেরার সময় টিনের বৃত্তটাকে লাল রঙ করিয়ে আনলো ও। বিকেলে শুরু হল সেটা স্থাপনের কাজ। রোহান আর আমি মিলে একরকম নিভৃতেই করে যাচ্ছিলাম শহিদ মিনার বানানোর কাজ। শহিদ মিনার এলাকায় ঢুকতেই রোহান সেন্ডেল খুলে ফেলে। ওর দেখাদেখি আমিও খুলি আর বিস্মিত হই প্রতি বার। শহিদ মিনারের কথা ছড়িয়ে পড়লো এলাকার ছোটদের মাঝে। ছোট ছেলেমেয়ের দল, দলবেধে আসতে লাগলো। ছেলেমেয়ের দল কাছে আসতেই রোহান চেঁচিয়ে ওঠে, তোমরা জুতা খুলে আসো। সবাই আমাদের জুতার পাশে সিরিয়াল করে জুতা রেখে, শহীদ মিনার এলাকায় ঢুকলো। ওদের অনেকে এসে আবার আমাদের সাথে হাত লাগালো। আসলে বাচ্চাদের মন ফুলের মতই সুন্দর ও কোমল। এর মধ্যে সাবিকুন ওর দু’তিন জন বান্ধবীকে নিয়ে এসে জুতা পায়ে শহীদ মিনার এলাকায় ঢুকে পড়ল। রোহান চেঁচিয়ে উঠলো। তারপরও শুনলো না ওরা। বরং রোহানকে নিয়ে উপহাস করতে লাগল। এতে রোহান ক্ষেপে গিয়ে আরও জোরে চিৎকার করে উঠলো। রোহানের চিৎকার শুনে, ওর মা বেড়িয়ে এলেন।
– কী হয়েছে রোহান? চেঁচামেচি করছো কেন?
রোহানের সেদিকে খেয়াল নেই। চেঁচিয়েই যাচ্ছে। আরও কাছে এসে রোহানের মা আমাকে দেখে জিগ্যেস করল, কী হইছে সজিব ভাই?
– আমি সাবিকুন ও ওর বান্ধবীদের দেখিয়ে বললাম, ওরা জুতা পরে এখানে ঢুকেছে তাই…। শুনে তিনি মৃদু হাঁসলেন।
– রোহান সন্ধ্যা হয়ে গেছে বাসায় আসো, এই বলে ভাবি চলে গেলেন।
পরদিন সকালে একটা ছোট সাইনবোর্ড হাতে রোহান আমার কাছে আসলো। আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি।
– হাতে ওটা কী রোহান?
– আঙ্কেল বাইরে আসেন। আমি কাছে যেতেই সামনে উঁচিয়ে ধরে আমাকে দেখালো।
“সংরক্ষিত এলাকা, পবিত্রতা রক্ষার্থে জুতা খুলে প্রবেশ করুন”- সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে।
– এটা কী?
– এটা শহিদ মিনার এলাকায় টানাতে হবে, চলেন।
– চলো।
একটি গাছের সাথে টাঙিয়ে রাখলাম ওটাকে। আমি আরও একবার বিস্মিত হলাম রোহানকে দেখে। আমি যেন প্রতিক্ষণে নতুন রোহানকে আবিষ্কার করছি। সাইনবোর্ড টাঙানো হয়ে গেলও, কি যেন ভাবছে ও।
– রোহান আবার কী ভাবছ?
– আঙ্কেল আপনি দাড়ান, আমি একটু আসছি।
আমি কিছু বলার আগেই দৌড়ে মিলিয়ে গেলে ও। কিছুক্ষণ পর এসে হাজির হল অনেক গুলো দড়ি হাতে ।
– এগুলো দিয়ে আবার কী করবা?
– আঙ্কেল, আপনি এক মাথা ধরেন।
দু’জনে দড়িগুলোর প্যাঁচ ছাড়িয়ে গাছের সাথে বেঁধে দিলাম আড়াআড়ি ভাবে। যাতে কেউ ঢুকতে না পারে শহীদ মিনার এলাকায়। আসলে, ও কোন কিছুতেই নিশ্চিত হতে পারছিলা না। ওর মনে একটা চিন্তা সবসময় কাজ করতেছিল কালকের পর থেকে। কেউ যদি আমাদের অনুপস্থিতিতে শহীদ মিনার এলাকায় জুতা পায়ে ঢুকে পড়ে। পবিত্রতা নষ্ট হবে, শহিদদের অমর্যাদা হবে এই ভেবে।
– আঙ্কেল, কি চিন্তা করেন?
– না, কিছু না।
– আমি স্কুলে যাচ্ছি, আপনি একটু খেয়াল রাইখেন। আজকের দিনটাই তো। আমি ফুল জোগাড় করে রাখছি। সন্ধ্যার পর গিয়ে নিয়ে আসবো। রাতের প্রথম প্রহরে আপনি আর আমি এক সাথে ফুল দিব। আর সকালে সবাই মিলে।
দুপুরে খেয়ে ঘুমানোর অভ্যেস আমার নেই। কিন্তু সেদিন খেয়ে একটু গড়াগড়ি দিতে গিয়ে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেচি শুনে লাফিয়ে উঠলাম। দ্রুত বেরিয়ে গেলাম বাইরে। ভিড় ঠেলে ঢুকতেই দেখি রোহান অজ্ঞান হয়ে উঠানে পড়ে আছে। ওর মা প্রলাপ করতেছেন। আমার ভাবি ওর মায়ের মাথায় পানি ঢালছেন। আমি, রোহান রোহান বলে ডাকলাম কয়েক বার, কোনো সাড়া নেই। ভাবিকে জিগ্যেস করলাম, কি হয়েছে?
– স্কুল থেকে আসার সময়, বাসার পিছনের সাঁকো থেকে পড়ে গেছে।
বাসার সামনে দিয়ে একটা রাস্তা চেলে গেছে মেইন রোডে। এটা ছাড়াও একটা সটকার্ট রাস্তা আছে। বাসার পেছনের ছোট খালের সাঁকো পার হয়ে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে, দিঘির দক্ষিণ পার ঘেষে। সেটা দিয়ে সহজেই বাজারে চলে যাওয়া যায়। দিঘির দুই পারের প্রায় ক্ষয়ে যাওয়া সানবাঁধা পুকুরঘাট দেখেই বুঝা যায় এখানটায় হিন্দুবাড়ি ছিল এককালে। তারা হয়ত সসম্মানে চলে গেছেন অথবা মুসলমানরা নিজেদের স্বার্থের কারণে তাদের ভিটাবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। জঙ্গল ও হিন্দুবাড়ির শ্মশান থাকায়, এপথে দিনের বেলা ছাড়া মানুষ খুব একটা যাতায়াত করে না। দু’একবার গিয়েছি আমি।
হঠাৎ রোহান গোঙানি দিয়ে নড়ে উঠলো। বুঝলাম জ্ঞান ফিরেছে। রোহান বলে ডাকতেই তাকালো। বাম হাত উঁচিয়ে ধরলো, মুখে কিছু বলতে পারলো না। দেখি হাতটা ফুলে উঠছে। বুঝলাম ভেঙ্গে গেছে।
– রোহান? এই রোহান? কয়েক বার ডাকলো ওর মা। সাড়া নেই। তবে তাকিয়ে রয়েছে।
এক অপরিচিত বয়স্কা নারী বলে উঠলো– পোলায় ডরাইছে। মনে হয় পেতনিতে ধাক্কা দিছে।
– তুমি চুপ কর। আরেক জন তাকে থামিয়ে দিল।
আমি মনে মনে হাসলাম। আমি জানি ওর কি হয়েছিল। ওর মন ছিল শহিদ মিনারে। কেউ জুতা পায়ে ঢুকলো কিনা – শহিদদের পবিত্রতা লঙ্ঘিত হচ্ছে কিনা – ফুল সংগ্রহ করতে যেতে হবে। হয়ত এইসব ভাবতে ভাবতে আসার সময় সাঁকোর দিকে মনোসংযোগ ছিল না।
দু’জন লোক মটরসাইকেল করে গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলো। রোহানের কাছ থেকে সবার চোখ সেদিকে চলে গেল। রোহানের বাবা ব্যাংক ম্যানেজার। খবর পেয়ে তার একজন সহকারীর মটর সাইকেলে করে চলে এসেছেন। তিনি এসেও কয়েকবার রোহান বলে থাকলেন। কোনো সাড়া নেই।
– ভাই কী করবেন? আমি জানতে চাইলাম।
– সদর হাসপাতালে নিয়ে যাব।
– তাই করেন।
সবাই ধরাধরি করে নিয়ে গেলাম মেইন রোডের কাছে। একটি স্কুটার ভাড়া করে ওর বাবা নিয়ে গেলেন সদর হাসপাতালে। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। ফিরে আসলাম বিষণ্ণ মনে। সকালে কি প্রাণবন্ত ছিল ছেলেটা। স্কুলে গেল হাসি মুখে। বাড়ির কাছে এসেই অঘটনটা ঘটলো। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলো। কিছুতেই বিষণ্ণতা কাটছে না। ছেলেটা হয়ত যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে হাসপাতালের বেডে। কি হবে প্রথম প্রহরে। আমি কী একা একাই ফুল দিব প্রথম প্রহরে? আহারে ছেলেটা, সব কিছু তাসের ঘরের মত হয়ে গেল। সৃষ্টিকর্তা কার কপালে কী লিখে রেখেছেন, তিনিই ভালো জানেন। এসব চিন্তা করতে করতে সময় পার হয়ে গেল।
ঠিক রাত বারটা ঘড়ির কাটায়। বাসার সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি আস্তে করে দরজাটা খুলে বেড়িয়ে পরলাম। সন্ধায় ভাতিজাকে দিয়ে কিছু ফুল আনিয়ে নিয়েছিলাম। সেখান থেকে হাতে নিলাম দুটো ফুল। তারপর আস্তে আস্তে এগোতে লাগলাম শহিদ মিনারের দিকে। ফুল দুটি রাখলাম শহিদ মিনারের পাদদেশে। এরপর যা ঘটলো, তা দেখে আমি রীতিমত বিস্মিত হলাম। রোহানের সহপাঠি আমার ভাতিজা অয়নসহ, একে একে আশেপাশের সব ঘর থেকে ফুল হাতে বেড়িয়ে আসতে লাগল ছেলেমেয়ের দল। সাবিকুনসহ ওর বান্ধবিরাও এলো। ওরা এবার জুতা খুলেই প্রবেশ করলো রোহানের সংরক্ষিত এলাকায়। আমি মনে মনে ভাবলাম তাহলে ওরাও কি আমার মত বিষণ্ণতায় ডুবে ছিল রোহানের জন্য। কেউ কি ঘুমাতে পারেনি ওকে ভালোবেসে?
শুধু তাই না, রোহানের মাও এলেন একটা মোবাইল ফোন হাতে আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে।
– সজিব ভাই, আপনারা সবাই প্রথম প্রহরে এখানে এসেছেন, ফুল দিচ্ছেন এর একটা ছবি আমার মোবাইল ফোনে তুলে দেন। রোহান ভাল হয়ে বাড়ি ফিরলে ওকে দেখাবো। তাহলে হয়তো ওর কষ্টটা ভুলে যাবে।
সে সময় কেবল অল্পকিছু দামি ফোনেই ক্যামেরা সংযুক্ত ছিল। আমি হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিলাম। ক্যামেরা অন করলাম। তারপর আবছা আলো আর অন্ধকারে, ফুলে শোভিত শহীদ মিনারের কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম। আমার মনে হলো শহীদ মিনারের ফুলের পাশে রোহানও আছে। আমার চোখে ধরা পড়ছে, ক্যামেরায় ধরা পড়ছে না।