সফি সুমনের গল্প
রিক্সা
বিয়ার পর হশুর বাড়ি থিকা যৌতুক হিসাবে এ্যাকটা রিক্সা ছাড়া আর কিছুই পাই নাই। হশুর মশাই খুব বুদ্ধিমান বইলা, তার মাইয়ার জীবন আর আমার কর্মের কতা চিন্তা কইরা ভবিষ্যতে রাস্তায় নিশ্চিত মরণ অইবার পারে, এ্যামন গাড়ী আমার আতে তুইলা দিলেন। যাতে কইরা পরের বোজা টানতে টানতে কবে জানি হুনি– আমি আর দুনিয়ায় নাইকা!
প্রতিদিন রিক্সা চালাইতে ভাল্ লাগে না। আইজকা শরীলডা ইট্টু বেশিই ম্যাচ ম্যাচ করতাইছে। বউওে তা কইবার সাউস পাই নাই। কইবার গেলে আবার কহন কি জানি কি কইয়া বইসে! তাই, বউরে কিছু না কইয়া; হালকা চোইক বুইজা হুইয়া রইছি। ঘুমাই নাই। তাই, আমার চাইরপাশে যা যা অইতাছে হগল কিছুই হুনতাইছি!
পয়লা হুনলাম, বড় শাওয়ালডা যহন স্কুলে গ্যালো; তহন বউ কইলো– যাহ্ জাইরার জাত, স্কুলে যা। কুনু ট্যাহা-পয়শা চাইবি না।
আবার হুনলাম– তর বাপ না রাজা, রাজার পোলা অইছোস? (লগে আরো দুইডা ধমক !)
ছোডো ছাওয়ালডা এ্যাকবার কাঁইন্দা উঠলো। তহন হুনলাম, চুপ থাক শয়তানের বাচ্চা, তুই অইছা এ্যাকদম বাপের নাহাল! তর বাপ যেমুন আমার জেবনডা ভাঁজা ভাঁজা কইরা খাইছে, তুইও হেইরহম শুরু করছা! বাফের এ্যাককানি ছাড়াও অস নাই!
বড় ছাওয়ালডা এ্যাকবার কইয়া উঠলো– মাগো, দুইডা ট্যাহা না দিলি স্কুলে যামুনা।
বউ রা-রা কইরা উঠলো– সামনে থিকা হরিস কইলাম শয়তানের জাত! নয়লে কইল দিমু কয়ডা; ডামুর ডুমুর…
বড় শাওয়ালের কতা আর হুনলাম না। মনে অয় স্কুলে গ্যাছে গা। মাইর খাওয়ার ডরে আর ট্যাহা চাইবার সাউস পায় নাই। কিছুক্ষণ এক্কেরে চুপ! কুনু টু শব্দ নাই!
হঠাস কইরা ছোডো ছাওয়ালডা দাইয়া চিক্কুর মাইরা কাইন্দা উটলো! ছোডো শাওয়ালের কাঁন্দা হুইনা আমি চইমকা গ্যালাম! এ্যাকবার কইবার চাইলাম– এ্যাই কি অইছেরে?
আমি কিছু কইবার আগেই দেকলাম; বউ কইয়া উটলো– শয়তানের বাচ্চা, তরে মরিচ খাইবার কইছে ক্যারা?
আবার হুনলাম– ধর ধর, আরাকটু পানি খা। তর বাপের এ্যাককানি ছাড়াও অস নাই! বেশি জ্বালাইলি কবে দেগবি নুন খিলাইয়া মাইরা থুমু!
বউ ঘরে ঢোকার আগে ছোডো ছাওয়ালরে কইলো– কান্বিনা কইলাম। ঘরে যাইয়া দেহি; তর বাপে মরছে নাহি! কি শয়তানের শয়তান, এ্যাহুনো ঘুমাইতাইছে!
ঘরের মইধ্যে বউ’র জোরে জোরে পায়ের আওয়াজ হুনলাম! ভাবলাম, আমার কাছেই আইতাছে! তাই, হোয়া থিকা ওঠার জইন্যে মোচার দিমু, এইসময় বউ শুরু করলো তার আইলাজাইলা কতা কওয়া– এ্যাই; উটপানা কইলাম। ঘোমাইছো, ঘোমাইয়াই থাহো!
আমি চোকিতে বইসা এ্যাকবার হাইক ছাড়লাম। চোইক দুইডা ঘইসা ঘইসা কইলাম– কি অইছে, এইরহম করতাইছো ক্যা?
বউ ধমক দিয়া কইলো– এ্যাই, কতা কইবানা কইলাম! কি রহম করতাইছি, হ্যাঁ কি রহম করতাইছি?
– হগাল ব্যালায় এ্যাত চেইত্বা আছো ক্যা?
বউ আমার কতা হুইনা আরো ক্ষেইপা গ্যালো!
কইলো– চেইত্বা আছি তর মাতা খাওয়ার লাইগা! সব্বোনাইশা, ভরান্নাইশা! তর মনে যুদি এ্যাই আছিলো, তাইলে আমারে বিয়া করছিলি ক্যা, হ্যা? আইজ আমার কপালে এই দুঃকু…
– কি অইছে খুইলা কইবা তো?
– কি খুইলা কওয়া লাগবো, হ্যাঁ কি খুইলা কওয়া লাগবো? যে মানুষ দফুর ব্যালা নাগাত ঘোমায়, হ্যারে আর কি খুইলা কওয়া লাগবো?
আমি ঠান্ডা গলায় বউরে কইলাম– পরানের মাও, আমার শরীলডা আইজকা ভালা না।
শরীল ভালা না, এ কতা হোনার পরে বউ আরো জোরে গলা কইরা উটলো!
– পোরতিদিন তোমার শরীল খারাব থাহে, অসুক করে, শরীল ভালা থাহে কোন্দিন, হুনি? এই সগালে ইট্টু রিক্সা লইয়া বাড়াও আর বিহালে, এ্যাতেই যুদি শরীল খারাব অয়, তাইলে আমার বাপের কাছ থিকা রিক্সা যৌতুক আনছিলা ক্যা? দুনিয়ায় আর কেই রিক্সা চালায় না, হ্যাঁ? আমারে তুমি ঢং বুঝাও?
আমি ফের ঠান্ডা গলায় কইলাম– পরানের মাও, গলাডা ইট্টু আস্তে কইরা কওনা?
– কিয়ের লাইগা আস্তে কমু? আমার গরীব বাপের কত ট্যাহা ভাঙ্গাইয়া তুমি রিক্সা আনছাও, হেই কতা ভুইলা গেছি মনে করছাও?
– আহারে, এই কতা মাইনষে হুনলে কি কইবো, কও?
– হুনুগ গা মাইনষে, ক্যা- বিয়ার দিন তোমার বাপে কি গোনা করছে, মনে নাই? খালি, এ্যাকটা রিক্সার লাইগা বিয়ার হগল জিয়াফতের মাইনষের সামনে কিবা করছে!
– চুপ করো পরানের মাও।
– রিক্সা লইয়া বাড়ির বাইর না অওয়া নাগাত চুপ করমু না কইয়া দিলাম?
আমি আর কুনু কতা কইলাম না। দেকলাম, অরে বুঝাইলেও যেবা, না বুঝাইলেও হেবা। শরীল যতই খারাব থাইক, আর যতই ম্যাচ ম্যাচ করুক, এই সীমার’রে বুঝাইয়া কুনু কাম অইবো না।
তাই কইলাম– কয়ডা খাইবার দিবা?
– হগালে রাঁন্দি নাই।
– তাইলে জুরান কি খাইয়া স্কুলে গ্যাছে?
– কয়ডা পান্তা আছিলো খাইয়া গ্যাছে।
– তুমি কি খাইবা?
– আহারে, দরদ আমার। হারামী! কয়দিন ধইরা আটবাজার করোস না, হ্যা? পোলা দুইডা আমার…
বউ ইট্টু ফাও কাঁইন্দা দিয়া, আবার কইলো– আর কমুনা, তরে কইয়াই কি অইবো? বিয়া অওয়ার হেই পয়লাদিন থিকাই তরে চিনি! খালি, এ্যাকটা রিক্সার জইন্যে তুই আমারে বিয়া করবার চাইছিলি না! তোরা যে কোন বজ্জাতের গুষ্ঠি, চিনবার বাহি নাই!
গুষ্টির কতা হুইনা কইলাম– দ্যাহো, কতায় কতায় বেশি গুষ্টি তুলবা না?
বউ দুইডা ধমক দিয়া কইলো– হ্যাই! হ্যাই! গুষ্টির কতা কইলেই কইলজার মইধ্যে বিন্দা পড়ে? কি হ্যারে গুষ্টিআলা অইছে! পাছায় নাই চাম, আধাগুষ্টির নাম! এ্যাকশোবার তুলমু…
আমি ঘর থিকা দুয়ারে আইসা বউরে কইলাম– তোমার নাহাল বউ জানি দুনিয়ার কুনু ঘরে না আইসে!
আর কুনু কতা না কইয়া রিক্সাডা লইয়া আমি বাইরে আইলাম।
আমার কতা হুইনা, বউ ঘর থিকা ইছামাছের নাহাল ছাট পাইড়া বাইরে আইলো! আমি সড়কে আইসাও বউ’র গলা হুনবার পারলাম!
বউ কইতাইছে- মরার জাইরা, রাইতে খালি আমার কাছে আইছিস! তহন দ্যাহামুনি আমি কি রহম বউ? কামের কতা কইলিই আমি তর কাছে ভালা না? জাইরা, আমার নাহাল বউ পাইছাস; এইডা তো তর চৌদ্দোগুষ্ঠীর কফাল!
বউ’র নাহাল বউ গলা বাইরাইতে থাকলো। আমার নাহাল আমি হগালকার হগালে খালি প্যাডে মন খারাব কইরা রিক্সা লইয়া সড়কে বাইর অইলাম!
পরে বউ’র গলা কহন থামছিলো, নাহি থামে নাই, তা আল্লাতালাই ভালা জানে!
হগাল ব্যালা কিছু না খাইয়া বাইরে বাইর অইলে শরীলে বেশি জোর পাইনা। রিক্সা ভালা কইরা টানবার পারি না। তার মইধ্যে যুদি কুনু অফিসের লোক রিক্সায় ওডে, তাইলে ওডার লগে লগেই কইবো– এ ভাই, ইট্টু জলদি চালাও, জলদি চালাও! আমি তহন কতা কই না। চুপ কইরা থাহি।
আইজ সাতবছর অইলো রিক্সা চালাই। কোনে কোন গলি, কোনে কোন মোড়, ভাড়া কত, হগল কিছুই আমার জানা। মাইনষের চ্যাহারা দেইহাই কইবার পারি, কোন লোক ভাড়া ঠিকআলে দিবো, আর কোন লোক ভাড়া লইয়া ক্যাচক্যাচ খ্যাচখ্যাচ করবো।
আমি কিছু কইবার চাইলেই কইবো- হালার পো হালা, বেশি কতা কস? বেশি বোঝোস?
তাই, চোইক কান খোলা রাইহা, মুক (মুখ) বুইঝা রিক্সা চালাই! ভাড়া যে যা দ্যায় তাই লই।
ঘরের বউ’র খাই খাই হারা জন্নমের। কুনুদিন খাওয়ার কষ্ট দেই নাই। কুনুদিন অভাবে ফালাই নাই। নিজে পুরান কাপড় পড়ছি, তাও বউ শাওয়ালেরে নয়া নয়া কাপড় দিছি।
সাতবছর অইয়া গ্যালো এ্যাকটা প্যান কিনছিলাম, হেই বিয়ার সময়! এ্যাহুনো ঐ এ্যাকটা প্যানই আছে! ঈদ আইলে ঐ দিনকার লাইগা এ্যাকব্যালা পিন্দি! ত্যাল চিক্চিকা এ্যাকটা তফন (লুঙ্গি) আর রোইদের মইধ্যে মাতায় বাঁন্ধার জইন্যে এ্যাকটা গামছা। আমার আর ম্যালা কিছু লাগেনা।
লেহাপড়া করি নাই, তাই কুনু চাকরি বাকরির আশাও করিনা। মনে মনে খালি আল্লার কাছে কই–হশুর বাড়ির যৌতুকের এ্যাই রিক্সাডা যুদি ফেরত দেওয়া হারলামনি, তাইলে ঘরের বউ’র আর খোডা দেওয়ার কিছু থাকলোনি না। হশুররে খালি এ্যাকটা কতা কইলামনি যে– যার লাইগা আফনের মাইয়া গ্যালো সাতবছরের মইধ্যে এ্যাকদিনের জইন্যেও আমার প্যাডের ভাত অজম করবার দ্যায় নাই, আইজকা হেইডা আফনেরে দিয়া গ্যালাম! পরান আর জুরানের মায়রে খালি কইয়া দিয়েন, ও জানি আমার লগে ভালা কইরা দুইডা কতা কয়!
এই রহম ম্যালাকিছু ভাবতাইছি। এ্যার মইধ্যে রাস্তার ওপার থিকা এ্যাক ভদ্দলোক কইলো– এ্যাই খালি, যাইবা?
কইলাম– যামু, কোনে যাইবেন?
– আড়াপাড়া, চাইর নাম্বার গেট।
– খাঁড়া ’অয়ান আইতাইছি।
আমি ক্যাবলি রিক্সাডা রাস্তার ঐপারে যাওয়ার জইন্যে ঘুরাইতে যামু, এ্যামুন সমায় ডাইনে থিকা এ্যাকটা সিএনজি আইসা আমার রিক্সার সামনের চাক্কায় লাগাইয়া দিলো! সিএনজি’র ধাক্কায় রিক্সার চাক্কা মুচুইরা মুয়া অইয়া গ্যালো! আমি বোবা মাইনষের নাহাল এ্যাকধ্যানে খাঁড়াইয়া রইলাম! এ্যাকবার রিক্সার দিকে চাই, আর এ্যাকবার সিএনজি’র দিকে চাই! মনে অইলো, ব্যাটা আমার রিক্সায় মারে নাই, আমার কইলজায় মারছে!
কিছুদূরে সিএনজির ডেরাইবার গাড়ী থিকা নাইমা আমারে কইতাইছে– হালার পুত, দেইহা হুইনা গাড়ী ঘুড়াইবার পারোস না? কান পাতাইলা মারমু কয়ডা! কালা, তগো নাহাল রিক্সাআলাগোরে কয়াকটা না মারলি, তোরা জিন্দিগেও ঠিক অইবি না!
সিএনজি ডেরাইবারের কতা হুইনা দুঃকু লাগলিও, আমি অরে কিছুই কইলাম না।
ভাবতাইছি, আইজ বউ না জানি কি কয়!
অনেক কষ্টে রিক্সাডা লইয়া গ্যারেজে গ্যালাম। চাক্কা ঠিক করতে দুই দিন লাগবো!
কিন্তু, দুইডাদিন বউরে বুঝামু কী দিয়া?