আহমেদ ফারুক

প্রশ্ন

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

ইবু লক্ষ করে দেখেছে প্রচণ্ড কষ্টের সময়গুলোতে সে খুব একা হয়ে যায়। তার চারপাশে সে কাউকে খুঁজে পায় না। মানুষ যত বড় হয় আস্তে আস্তে সে তত একা হতে থাকে। কিন্তু সব মানুষের ক্ষেত্রে কথাটা সত্যি কি না এটা সে জানে না।

আজ প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। তার চেয়েও ঠাণ্ডা মনে হচ্ছে চাঁদটাকে। চারদিক কেমন নীরব। প্রচণ্ড কোলাহলের এ শহরটা রাতে একটু চুপসে যায়।

আজ রাতটা হয়তো আরো বেশি নিশ্চুপ। অথচ এমন একটা নির্মল রাতে ইবুর ঘুম এলো না। অপরিচিত কষ্টরা তাকে ঘিরে বসে আছে। অতীতের নানা স্মৃতির শিকলে তার দুর্বল আত্মাটাও যেন ক্লান্ত।

রাত দুটোর দিকে বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়েছিল সে। ছোটবেলায় নানীর কাছে শুনেছিল, ঘুম না এলে ঘর অন্ধকার করে, চোখ বন্ধ করে আয়াতুল কুরসি পড়তে হয়। দুই-তিনবার পড়লেই নাকি মন শান্ত হয়। ঘুম চলে আসে। সে ঘুমটা হয় শান্তির। সারা রাত মরার মতো ঘুমাবে। টেরও পাওয়া যাবে না। ইংরেজিতে যাকে বলে সাউন্ড স্লিপ।

ইবুও তাই করল। চোখ বন্ধ করে আয়াতুল কুরসি পড়া শুরু করল। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। বরং নানীর মুখটা ভেসে উঠল। তিনি হাসছেন। স্পষ্ট চোখের সামনে তিনি হাসছেন।

ঘরটা বেশ ছোট। ইবুর অবশ্য এর চেয়ে বড় ঘরের দরকার নেই। সে একা একটা মানুষ। বিশাল বড় ঘরের দরকার কী!

বলতে গেলে ইবু তো এই শহরে পালিয়ে আছে। অবশ্য পালানোর কোনো কারণ ছিল না। সবাই বেশ ক্লান্ত হয়ে গেছে। তারাও বুঝে গেছে ইবুকে তাদের দলে ফেরানো যাবে না।

বড় ফুফু মনে হয় সবচেয়ে বেশি ক্লান্ত। অথচ তিনিই সবচেয়ে বেশি উৎসুক ছিলেন। দেখা হলেই বলতেন, ইবু এদিকে আয় তো। তোর সাথে জরুরি কথা আছে।

ইবু জানে জরুরি কথাটা কী? তারপরও বাধ্য ছেলের মতো প্রতিবারই বলত, ঠিক আছে ফুফু, বলেন।
তোর কী এমন বয়স হয়েছে বল তো? তোর বয়সী অনেকে এখনো বিয়েই করেনি। কী বলিস?

ইবু মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বলে।

আমি বলছি না তুই খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করেছিলি। তাছাড়া তোর চেয়ে অনেক কম বয়সেও অনেকে বিয়ে করে। কী বলিস?

ইবু আবারো মাথা দোলায়।

তা ছাড়া মাত্র তো আড়াই বছর তোর সংসার হয়েছিল। তাই না?

জি।

আড়াই বছরে সংসারের ‘স’-ও বোঝা যায় না। আরে প্রথম দুই বছর তো সবাই বুকে ফুঁ দিয়ে চলে। সংসারের প্যাঁচ বুঝতে হলেও সাড়ে চৌদ্দ বছর লাগে। বুঝলি?

জি।

এমন জি জি করছিস কেন? তোর বউ বেঁচে থাকলে কি তোকে আবার বিয়ে করতে বলতাম? জীবন তো আর থেমে থাকে না। জীবন হচ্ছে নদীর মতো। স্রোত কমে গেলেও বয়ে বয়ে সাগরে যাবেই।
জি ফুপু। কিন্তু আমি তো নদী না। আমি সাধারণ একটা মানুষ। নদীর মতো গড়াগড়ি করার ইচ্ছে নেই।

বাজে কথা বলবি না। এসব ঠুনকো কথা না। জীবন নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হয়। জীবন যে অনেক কঠিন রে।

ইবু চুপ করে থাকে। ফুপুর এই হচ্ছে অভ্যাস। কথা বলতে বলতে তিনি এক সময় উদাসী হয়ে যান। জীবনের গহীনে চলে যান। এ জগৎ সঙসার তার কাছে হযে যায় তুচ্ছ। কোন কিছুর প্রতিই তার কোন মায়া থাকে না।

এর কারণ, গত তিন চার বছর হলো তিনি এক বাবার মুরিদ হয়েছেন। সেই বাবা নাকি বলেছে পার্থিব জীবনের মায়া ত্যাগ করতে হবে। তিনি যথাসাধ্য পার্থিব মায়া ত্যাগ করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু পার্থিব খোলস থেকে বের হয়ে আসতে পারছেন না।

লাভের মধ্যে যা হয়েছে তিনি আরো কিপ্টে হয়ে গেছেন। কোন খরচের প্রসঙ্গ এলেই তিনি বলেন, বাবা বলেছেন অপব্যয় না করতে। তিনি বাবার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করছেন। তবে বাবাকে কোন কিছু দেয়ার সময় তার খরচের কথা মনে থাকে না। বাবা, সত্যিই আসল বাবা।

ইবু অপেক্ষা করছে কখন ফুপু খোলস থেকে বের হয়। খুব বেশি অপেক্ষা করতে হলো না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারো পার্থিব মায়া আষ্টেপিষ্টে আকড়ে ধরলেন।

শোন আমি বলি কী, আবার বিয়ে করে ফেল। সোহেলী চলে যাওয়ার পরও তো প্রায় চার বছর হয়ে গেল। কম দিন তো আর না।

হ্যাঁ, তা ঠিক। চার বছর তিন মাস উনিশ দিন হয়েছে।

আরে বুড়ো বুড়ো দামড়া ব্যাটাও বউ মরলে চল্লিশ দিন পার হতে দেয় না। পাখা নিয়ে বউয়ের কবরে বাতাস

করে কখন কবরের মাটি শুকাবে, আর কখন আবার বিয়ে করবে?

সবাই তো আর এক রকম না।

সবাই এক। তুই শুধু আলাদা। শোন, পঁয়ত্রিশ বছর কী এমন বয়স? বল, তুই বল?

ইবু হাসে। কোনো জবাব দেয় না। কারণ ফুফুকে ঠাণ্ডা করতে হলে তাকে মিথ্যা কথা বলতে হবে। এটা সে

করবে না। কারণ গত চার বছর সে কোনো মিথ্যা কথা বলেনি। সে প্রতিজ্ঞা করেছে, যত কষ্টই হোক একচল্লিশ বছর মিথ্যা কথা বলবে না।

সোহেলী যেদিন মারা যায়, সেদিন সে কাঁদেনি। ইবু কাঁদতে পারেনি। সব মানুষ কাঁদতে পারে না। একটা অপরাধ বোধ তার মাঝে কাজ করেছিল। তবে সেদিন অপার্থিব একটা কান্না কেউ কেঁদেছিল। সেদিনই ইবু প্রতিজ্ঞা করে, সে একচল্লিশ বছর মিথ্যা কথা বলবে না। এরপর চার বছর পার হলো। সে মিথ্যা বলে না।

দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো। সে চমকে উঠে তাকাল। এত রাতে কে আসতে পারে? ঘড়ির দিকে তাকাল সে। রাত তিনটা দশ। এত রাতে তো তার কাছে কেউ আসার কথা না।

ইবু সেকেন্ডের কাঁটার দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে। এই অসময়ে মনটাই খারাপ হয়ে গেল।
অনেক রাত, রাত বলেই হয়তো কাঁটা ঘোরার শব্দটা তীব্র। শব্দ করে প্রতিনিয়ত জানিয়ে দিচ্ছে ক্রমশ ছোট হয়ে

আসছে তোমার জীবন। আর মাত কটা দিন, তারপরই তোমার শেষ ঘন্টা বেজে যাবে।

আচ্ছা তার জীবনটা কত বড় হতে পারে। একচল্লিশ বছর মিথ্যা কথা না বলে থাকতে হলে আরো সাঁইত্রিশ বছর বাঁচতে হবে। তার মানে তখন তার বয়স হবে বাহাত্তর বছর। বাহাত্তর বছর বয়সে অনেক কিছুই ফিকে হয়ে যায়। ইচ্ছে শক্তি কাজ করে না।

দরজায় আবারো মৃদু শব্দ হলো। বিরক্ত লাগছে উঠে দরজা খুলতে। এটা কি কারো আসার সময়?
ইবু উঠে দরজার দিকে এগোল। ছোট্ট একটা ঘর। বিছানা থেকে চার কদম ফেললেই দরজা, অথচ মনে হচ্ছে অনন্ত দূরত্ব পার হলো সে।

দরজার সামনে গিয়ে একবারও বলল না কে? অথচ তার জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। ইদানিং সময়টা খারাপ যাচ্ছে।

ইদানীং চোর-ডাকাত নেমেছে। এরা না চোর-না ডাকাত। আসে চোরের মতো চুপিচুপি। দরজা খুললেই ডাকাতের মতো ছোরা ঢুকিয়ে দেয় পেটে। কী ভয়াবহ!

বজলু হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকবে– দরজা খোলার পর ইবু ভাবতেই পারেনি। বেশ সুন্দর একটা সোয়েটার পরেছে সে। ধবধবে সাদা। বুকের বামপাশে নীল রঙের ছোপ ছোপ। মনে হচ্ছে বুকের ওপর এক টুকরো আকাশ নিয়ে এসেছে। তবে গলার গোলাপি মাফলারটা বিশ্রীভাবে ঝুলে আছে। এত সুন্দর সোয়েটারটার সাথে তার এমন খবিশ মার্কা মাফলারটা বেমানান। সত্যিই বেমানান।

বজলু কিছু বলল না। খাটের পাশে রাখা চেয়ারে গিয়ে বসল। টেবিলে রাখা জগের পানি ঢকঢক করে গিলল। খাওয়ার সময় মুখ থেকে পানি পড়ে বুক ভিজে গেল।

ইবু তো অবাক! ব্যাটা সেই আগের মতোই আছে। গ্লাসে পানি ঢেলে খাওয়াও শিখল না।

ইবু খাটের একপাশে গিয়ে বসল। বজলু বলল, রাত-বিরাতে আমার খুব পানির তেষ্টা পায়।

ইবু নিরস দৃষ্টিতে তাকাল। বজলুর রাত-বিরাতে পানির তেষ্টা পাওয়ার ঘটনা তাকে আকৃষ্ট করল না। সে সব বিষয়ে আগ্রহ কমিয়ে ফেলেছে। বেশি আগ্রহ থাকলে মিথ্যে কথা মুখে চলে আসতে পারে। সব চেষ্টা বিফলে যাবে। এটা হতে পারে না।

বজলু একটু ঝুঁকে এসে বলল, এত মন খারাপ করে বসে আছিস কেন? কি হয়েছে তোর?

কেন? আমার কি মন খারাপ হতে পারে না? আমি কি মানুষ না?

তোর কি মোনামীর জন্য মন খারাপ?

ইবু তাকিয়ে আছে। উত্তর দিচ্ছে না।

তুই উত্তর দিচ্ছিস না। কারণ তুই সত্য উত্তর দিতে চাচ্ছিস না। আবার মিথ্যা কথা তো তুই বলবি না।

ইবু চমকে তাকায়। সে যে মিথ্যা কথা বলবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছে এটা সে কাউকে বলেনি। তা ছাড়া এটা বলার মতো বিষয় না।

অবশ্য সে সত্য কথা বলা শুরু করেছে বলেই হয়তো সবাই তাকে এখন অন্য দৃষ্টিতে দেখে। আর সব সময় সত্য কথা বলার জন্য তাকে কথা বলতে হয় ভেবেচিন্তে। আগের তুলনায় সে কথাও বলে কম! কিন্তু বজলুর তো বিষয়টা জানার কথা না। সে জানল কি করে?

কী হলো, কথা বলছিস না যে?

ইদানীং প্রয়োজন ছাড়া তেমন কথা বলি না।

যেসব প্রশ্নের উত্তর মাথা দুলিয়ে দেয়া যায় তা মাথা দুলিয়েই সেরে নিস, তাই না?

ইবু মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বলল।

বজলু হেসে উঠল। তার চকচকে দাঁত যেন কাঁপছে। হাসলে বজলুকে সুন্দর লাগে ইবু তা কখনও খেয়াল করেনি।

তুই এত রাতে কী মনে করে!

তোর সাথে গল্প-গুজব করতে এলাম। তুই তো সারা রাত জেগেই থাকবি। তাই না?

ইবু মাথা দোলাল।

তোকে একটা গোপন কথা বলি।

বল।

তুই সাঁইত্রিশ বছর বাঁচবি না!

ইবু চোখ বড় বড় করে তাকায়।

বজলু আবারো অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। তুই এমন করে তাকাচ্ছিস কেন? সৃষ্টিকর্তার সাথে তোর তো কোনো চুক্তি নেই যে, তোকে আরো সাঁইত্রিশ বছর বাঁচিয়ে রাখতেই হবে।

বজলু হাসল। ইবুর দিকে তাকিযে থাকল। সে কিছু বোঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু ইবু কিছুই বলল না।
বজলু বলে উঠল, তুই তো আর মহাপুরুষ না। তুই অন্য দশটা পাঁচটা মানুষের মতো সাধারণ মানুষ। সো সৃষ্টিকর্তার সাথে তোর কোন বোঝাপড়া নেই। সো তুই আরো সাঁইত্রিশ বছর বাঁচবি না।
তা ঠিক, তবে বেঁচে থাকাটা দরকার।

এ পৃথিবীর অনেক কিছুরই দরকার। কিন্তু সব দরকার কিন্তু পূর্ণতা পায় না। কী বলিস?
ইবু কিছু বলল না।

বজলু উঠে দাঁড়াল। সোয়েটার খুলে বিছানায় রাখল। বলল, গরম লাগছে রে। কে বলবে মাঘ মাসের শীত। আগে শুনতাম মাঘের জারে বাঘ কাঁন্দে। ‘জার’ মানে বুঝিস তো?

না। বুঝি না।

গ্রাম এলাকায় ‘জার’ মানে শীত।

ইবু মাথা দোলাল। তারও বেশ গরম লাগছে। অবশ্য জানালা-দরজা বন্ধ এ কারণে এমন হতে পারে। মাঝে মাঝে শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। তখন শরীর গরম হয়। তাছাড়া আজ কোন কারণে তার শরীর উত্তেজিত। অনিদ্রার কারণেও নানান অনিয়ম দেখা দেয়।

সোয়েটার খোলার পর বজলুকে অন্যরকম লাগছে। সাদা সোয়েটারে ওকে শরতের শুভ্র আকাশের মতো লাগছিল। এখন লাগছে আষাঢ়ের আকাশের মতো। যেন কিছুক্ষণ পরই কালবৈশাখী ঝড় শুরু হবে। বজলু হঠাৎ বলে উঠল, তোর কি মনে হয়, তুই একচল্লিশ বছর মিথ্যা কথা না বলে থাকতে পারবি?
পারব।

পারব বলার পর সে আবারো চমকে উঠল। কারণ সে মিথ্যা বলবে না এটা যেমন কাউকে বলেনি, তেমনি একচল্লিশ বছরই মিথ্যা না বলে থাকতেই হবে এটাও সে কাউকে বলেনি। তার এই প্রতিজ্ঞার কথাটা বজলুর জানার কথা না। সত্যিই অবাক করার মতো।

কি রে কোন কথা বলছিস না যে?

না তেমন কিছু না। তুই বল?

একচল্লিশ বছর মিথ্যা না বলে থাকার কারণটা কী?

কেউ একচল্লিশ বছর মিথ্যা কথা না বলে থাকলে সৃষ্টিকর্তা তার একটা প্রশ্নের জবাব দেন।

বজলু এবার ইবুর দিকে ঝুঁকে এলো। যেন অনেক গোপন একটা কথা ইবুর মুখ থেকে বের করতে পেরেছে। বলল, কিন্তু একচল্লিশ বছর যেদিন তোর পূর্ণ হবে, সেদিন তোর মনে দুটো প্রশ্ন জাগবে। তুই সৃষ্টিকর্তার কাছে কোন প্রশ্নটার উত্তর জানতে চাইবি। তিনি তো নিয়মানুযায়ী একটা প্রশ্নেরই উত্তর দিবেন। তাই না?

ইবুর চোখ ছোট হয়ে এলো। সত্যিই তাই, সে কোনটা জানতে চাইবে! মোনামীকে তো সে মন থেকে ভালোবাসে। এখনো বাসে। চোখ বন্ধ করলেই তার মুখ ভেসে ওঠে।

ইবু চোখ বন্ধ করে ফেলল। হলুদ একটা জামা গায়ে মোনামী দাঁড়িয়ে। হলুদ ওড়না মাথায়। তার মুখ হাসি হাসি। দৃশ্যটা ভাবতেই চোখে জল এলো তার। এই দৃশ্য কল্পনার মধ্যে যদিও জল ফেলার মতো কিছুই নেই। তারপরও জীবনের ফেলা আসা টুকরো ঘটনা ভাবলেই তার চোখে জল আসে।

চট করে চোখ খোলে ইবু। চোখ মোছার চেষ্টা করে না। বজলু আবারো ঝুঁকে এসে বলল, আচ্ছা মোনামীকে তো তুই এখনো ভুলতে পারিসনি। তাই না? সত্যিই এ সময়ে কেউ কাউকে এভাবে ভালোবাসে না।

ইবু তাকিয়ে আছে। কী বলবে বুঝতে পারছে না।

বজলু উত্তরের অপেক্ষা করল না। বলল, কোনো প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যাওয়াও কিন্তু মিথ্যা বলার শামিল। উত্তর না দেয়া মানে মিথ্যাকে প্রশ্রয় দেয়া। এটা কি তুই মানিস?

মানি। তবে মাঝে মাঝে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করতে পারি না। তোর এই প্রশ্নটাও এমন। তবে মোনামীকে ভুলে যাওয়ার অনেক চেষ্টা করেছি, পারিনি। সত্যি বলছি।

কেন ভুলে যেতে চেয়েছিলি?

ভুলে যাওয়াটাই আমাদের সবার জন্য মঙ্গল ছিল। কিন্তু চাইলেই সব কিছু ভুলে যাওয়া যায় না।
নিশ্চয়ই তোর চেষ্টার মধ্যে খাদ ছিল।

হতে পারে। তবে ভুলে যেতেই হবে এমন তো কোনো কথা নেই। মন তো আর আমার ইচ্ছে মতো চলে না। তা অন্য কেউ নিয়ন্ত্রণ করে। এটা সৃষ্টিকর্তাও জানেন।

কিন্তু ভেবে দেখ। তোর ভুলে না যাওয়ার কারণেই সোহেলীর ক্ষতি হয়ে গেছে।

মনের ওপর তো জোর করা যায় না। তবে আমি সোহেলীকে ভালোবাসার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারিনি।

সৃষ্টিকর্তা আমাকে সে ক্ষমতা দেননি। আমি কি করতে পারি।

ভুল বললি? এটা হচ্ছে দোষ এড়িয়ে যাওয়ার কথা। অক্ষমতা ঢাকার জন্য এমন খোঁড়া যুক্তি যুগে যুগে মানুষ দেখিয়ে এসেছে।

আমি মিথ্যে বলছি না। এটা তো তুই জানিস।

জানি। তবে ভেবে দেখ সৃষ্টিকর্তা তোকে বিবেক দিয়েছেন। যেন তুই তার সঠিক ব্যবহার করতে পারিস। তুই তোর বিবেকের সঠিক ব্যবহার করতে পারিসনি। এই অপাগতার কথাও তো তোর মানতে হবে। নাকি দোষ এড়িয়ে যাওয়ার জন্য আরো কোন যুক্তি তুরে ধরবি।

আমি চেষ্টা করেছি। সত্যি বলছি চেষ্টা করেছি। এটা যুক্তির কথা না। আমি যা অনুভব করেছি তাই বললাম। সব কিছু জোর করে হয় না।

যে মেয়েটাকে আল্লাহর নামে শপথ নিয়ে বিয়ে করলি। তাকে কোনো দিন ছুঁয়ে দেখলি না, এটা কেমন কথা? তুই যে মোনামী ছাড়া কাউকে ছুয়েই দেখতে পারবি না তা তোর মন জানত। তাহলে তুই বিয়ে না করলেই পারতি। কেন শুধু অন্যের জীবন নিয়ে খেলেতে গেলি।

আবারো বলছি, সত্যি বলছি, আমি অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি। শুধু মোনামীর কথা মনে পড়ত। কেন মনে পড়ত?

ভালোবাসা কোনো নিয়ম মানে না। আমি জানতাম, মোনামীকে গ্রহণ করার মতো ক্ষমতা আমার ছিল না। তারপরও অপেক্ষা করতে পারতাম। অপেক্ষা না করাটাই আমার ভুল ছিল।

তোর কি ধারণা, অপেক্ষা করলেই মোনামীর বাবা তোর কাছে মোনামীকে তুলে দিত?

দিত। তারা একদিন বুঝত।

দিত না বন্ধু। দিত না। কারণ ওর বাবা সব সময় আমেরিকার পাত্র খুঁজত। ছেলে নিউইয়র্ক থাকবে। অনেক টাকা পয়সার মালিক হবে। তার হাতেই তিনি মেয়েকে তুলে দিবেন। এতেই নাকি তার মেয়ে সবচেয়ে সুখে থাকবে। মোনামীর কি সেরকম কোনো পাত্রের সাথেই বিয়ে হয়েছিল?

হ্যাঁ। ছেলেটার নাম আরমান। ডিভি নিয়ে এদেশ থেকে আমেরিকায় গিয়েছিল। শুধু এতটুকু জানি।

মোনামী তো তাহলে অনেক সুখে আছে। যাক এটা শুনে ভালো লাগল। ও তো সুখে আছে।

হো হো করে হেসে উঠর বজলু। বলল, তুই সত্যি পাগল। তুই সত্যিই পাগল রে।

হ্যাঁ, আমারে নিজেকে মাঝে মাঝে পাগল মনে হয়।

মোনামীর সাথে তোর বিয়ে হলে যে সে সুখী হতো তার নিশ্চয়তা কী? এটা কখনো ভেবেছিস?

আমি মোনামীকে যতটা ভালোবাসতাম, মোনামী তার চেয়ে বেশি আমাকে ভালোবাসত। এ কারণেই ও সুখী হতো।

বজলু আবারো হো হো করে হেসে উঠল।

ইবু বলল, হাসছিস কেন?

এমনি হাসছি। কারণ মোনামী যদি তোকে এতই ভালোবাসত তাহলে তোকে সে এখন ঘৃণা করে কেন? প্রচণ্ড ভালোবাসার বিপরীতে ঘৃণা থাকে। আমাকে না পাওয়ার কষ্ট থেকে ওর মাঝে ঘৃণা জন্মেছে। তা ছাড়া ও আমাকে ভালোবাসল না ঘৃণা করল তা আমার দেখার বিষয় না। এটাতে আমার কিচ্ছু আসে যায় না। আমি মোনামীকে এখনো প্রচণ্ড ভালোবাসি এটাই আমার কাছে সত্য। এর চেয়ে বড় কোনো সত্য নেই।

এ কারণেই তুই সোহেলীর সাথে অন্যায় করেছিস?

আমি আসলে পারিনি। বিয়ের পর অনেক চেষ্টা করেছি। পারিনি।

বিয়ের পর তোদের সংসার আড়াই বছর গড়েছিল। এই আড়াই বছরে তুই একদিনও তাকে ছুঁয়ে দেখিসনি। কতটা বঞ্চিত করেছিস তাকে?

 

কিভাবে ছোঁব বল। আমার সব কিছুই তো মোনামীকে দিয়ে ফেলেছি।

ইবুর চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে। সে অশ্রু আটকানোর চেষ্টা করছে না। শুধু বলল, আমি জানি আমার পাপ হয়েছে। কিন্তু কী করব? এ পৃথিবীর এমন কোনো নিয়ম, এমন কোনো উপায় কি আছে, যা আমার কাছে আমার মোনামীকে ফিরিয়ে দিতে পারে?

একচল্লিশ বছর মিথ্যা কথা না বলে সৃষ্টিকর্তার কাছে তুই এই একটা প্রশ্নের উত্তরই জানতে চাস?
ইবু চমকে উঠল। কিন্তু কোনো উত্তর দিল না।

বজলু মুচকি হেসে বলল, কিন্তু আমার মনে হয় তোর মনে দুটো প্রশ্ন আছে। তুই ভেবে পাচ্ছিস না সৃষ্টিকর্তাকে তুই কোন প্রশ্নটা করবি।

তুই কী করে জানলি?

উত্তর কিন্তু দিলি না। সৃষ্টিকর্তাকে তুই কী প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবি?

আমি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না। একচল্লিশ বছর পূর্ণ হোক। প্রশ্নটা সৃষ্টিকর্তাকেই করব।

দূরে আজান হচ্ছে। শেষ রাতের হিমেল বাতাসে স্তব্ধ পৃথিবী দাঁড়িয়ে আছে ইবুর সামনে।

বজলু উঠে দাঁড়াল। বলল, তুই আসলেই অন্য রকম। তোর ভালোবাসাটা মোনামীর কাছে পৌঁছল না। এই যা। যখন ও আমার কাছে ছিল তখন বুঝতামই না ভালোবাসা কী? মোনামীকে না হারালে কখনও ওকে এমনভাবে হয়তো অনুভবই করতাম না।

বজলু হাসল। ওর চোখটা চকচক করছে।

ইবু বলল, একটা অদ্ভুত ব্যাপার কি জানিস? মানুষের কিছু অদ্ভুত ইচ্ছে থাকে।

আমি জানি তোর অদ্ভুত ইচ্ছে কী ছিল।

কী বলতো?

কোনো মানুষের শেষ নিঃশ্বাস নেয়ার দৃশ্য দেখার খুব ইচ্ছে ছিল তোর। মানুষ কিভাবে এক জগৎ থেকে অন্য জগতে যায় এটা তুই বুঝতে চেয়েছিলি। সব মানুষই একবার এটা বোঝে। সত্যটা হলো এটা যখন বোঝে তখন তার ফিরে আসার পথ বন্ধ হয়ে যায়।

ইবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বজলু ঠিকই বলেছে। মানুষের মৃত্যু সে কখনও দেখেনি। অথচ সে নিজেই একদিন মরে গেল।

মোনামীকে হারানোর পর সে নিজেই নিজের মৃত্যু দেখেছে। মানুষ মানুষকে মরতে দেখে। কিন্তু নিজেকে মরতে দেখে কয়জনে?

ইবু চোখ বন্ধ করে ফেলে। কেন জানি তার চোখ ভিজে আসছে। বজলুর সামনে চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লে বড়ই লজ্জার ব্যাপার হবে। মোনামীর জন্য প্রায়ই এমন হয়। কিন্তু তা একান্তই ভিতরের। মোনামী তো আত্মার গভীরের মানুষ। সে ভিতরেই থাক। তাকে নিয়ে ওর যা জানার তা সাঁইত্রিশ বছর পরই জানবে। আজানের শব্দে চমকে ওঠে ইবু। আরো একটা নির্ঘুম রাত কাটল। বজলু যেদিন মারা যায় সেদিনও সে নির্ঘুম জেগে ছিল। মানুষ কিভাবে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করে তা দেখার আশায়। কিন্তু ইবু তা দেখতে পারেনি। শেষ রাতে ফজরের আজানের পর তার চোখ জড়িয়ে আসে। ঠিক তখনই বজলু মারা যায়। মানুষ মারা যাবার দৃম্যটা তার আর দেখা হয়ে ওঠে না।

চমকে উঠে চোখ খোলে ইবু। তার মাথার ভিতর চাপ বাড়তে থাকে। কারণ বজলু তো মারা গেছে ছয় বছর আগে। তার নিমুনিয়া হয়েছিল। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে তার মৃত্যু হয়।

বজলু ছয় বছর আগে মারা গেলে এতক্ষণ সে কার সাথে কথা বলছিল?

চোখ বড় বড় করে তাকায় সে। নাহ্! বজলু নেই। ঘরের কোথাও নেই। কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। ইবুর নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলো। মৃত মানুষ কখনও এভাবে আসে না এটা সে জানে। সবই যে চোখের বিভ্রম, মনের কল্পনা– এটাও সে জানে। তারপরও মনকে শান্ত করতে পারছে না সে।

ইবু আস্তে আস্তে খাটের পাশে দাঁড়ায়। বালিশের পাশে বজলুর সাদা সোয়েটার পড়ে আছে।

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu