প্রিজন ভ্যানের জালিকাটা ছোট্ট জানালার বাইরের জগতে চোখ রাখতে রাখতে জহুরুল হক পিছনে ফেলে আসা পাঁচটি বছরের দিকে মনের চোখ জোড়া মেলে ধরে। আহা কী রঙ্গিন সে সব দিন। শখের বেলুন ফুলতে ফুলতে যখন বিশাল এক পাহাড় এবং সে বেলুনের শরীরে ভর করে জহুরুল হক যখন প্রায় আকাশের নীল ছুঁই ছুঁই করছে ঠিক তখনই শক্ত পোক্ত বিশাল বেলুনটির গাঁয়ে কে যেনো পেরেক ঠুকে দিলো। তাও একটা নয় শত শত পেরেক। টর্নেডোর গতিতে বিশাল বেলুনের সমস্ত বাতাস বেরিয়ে শুধু আবরনটা ল্যাকপ্যাক করতে করতে নেমে এলো মাটিতে। সাথে আদি ও অকৃত্রিম জহুরুল হক।
সূঁচ হয়ে ঢুকে ছিলো জহুরুল হক। কর্পোরেশনের হিসাব রক্ষক। চেহারায় আদি ও অকৃত্রিম গোবেচারা। কিন্তু মাথায় লক্ষ মেগাবাইট ধান্দার ফরমূলা। খুব ধীর লয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল সে। বসের বাজার খরচ থেকে বাচ্চাকে স্কুলে আনা নেওয়া। পিয়ন-দারোয়ান-সুইপার থেকে সব ধরনের কাজেই দক্ষ ছিলো সে। আর তাই কলা-মূলো দুটোই নিরবে হাতিয়ে যাচ্ছিল। প্রমোটি হায়দার অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে যাওয়ার সুযোগে সহ-পরিচালক এর পদে প্রমোশন হয়ে যায় জহুরুল হকের। ধান্দাবাজির ফরমুলায় এবার শাখা-প্রশাখা গজাতে থাকে। পারচেজ শাখার মূল টেবিলটাও দখলে নিতে সময় লাগেনা তার। অলিখিত অনেক আইন তৈরী হয়ে যায় কর্পোরেশনের পারচেজ শাখায়। ডিডি, ডাইরেক্টার এর চক্ষু লজ্জার পর্দাটাও খুব দ্রুতই খসিয়ে ফেলতে পারে সহকারী পরিচালক জহুরুল হক। এর মধ্যে ছাগল দাড়িও গজিয়ে উঠে ওর চোয়ালে। ওর বড় শখ ছিলো গালভর্তি চাপদাড়ি। কিন্তু উপরওলা প্রয়োজন মতো হরমোন ওর শরীরে সাপ্লাই করেননি বলেই ঐ ছাগল দাড়িতে তাকে সন্তষ্ট থাকতে হয়। দেলোয়ার হুজুরের সাজেশনে তার পরই কিস্তি টুপিও চড়ে মাথায়। শার্ট-প্যান্ট, সু সাথে কিস্তি টুপী আর ছাগল দাড়িতে বড় অদ্ভুত দেখায় জহুরুল হক কে। আড়ালে আবডালে আজে বাজে কথা বলে অনেক কলিগ। পাত্তা দেয় না জহুরুল হক। পাত্তা দিলে সোনার হরিণের নাগাল কি পাওয়া যাবে? তবে কয়েক জনকে টার্গেট করে রেখেছে সে। ডিডি হবার পর শোধ নেবে। দেখাবে কত ধানে কত চাল হয়।
পার্সেন্টেজ সিষ্টেম করার পর বড় শান্তিতে ছিলো জহুরুল হক। কোন ঝুট-ঝামেলা নেই। ফেলো কড়ি মাখো তেল। দিব্যি বিল আসছে যাচ্ছে। ভাগের টাকা ব্যাংক একাউন্টে জমা হয়ে যাচ্ছে। দেখো রশিদ ছাড়া বিল। শর্ট সাপ্লাই। সমস্যা নাই, পেনাল্টি তাও না। শুধু পার্সেন্টেজ একটু আপগ্রেড হবে। ইন্টারন্যাল অডিট, গভঃমেন্ট অডিট, ফরেন অডিট আরে ভাই জহুরুল হকের ফর্মুলা আছে না? কিস্তি টুপির ফাঁক থেকে দিব্যি বেরিয়ে এসে সব একাকার করে দেবে।
টিনশেডের দেড় রুমের ঘরে থাকতেই হিমশিম খেতে হতো এক সময়। বউ এর কাছেও অনেকটা নীচু হয়ে থাকতে হতো ওর। বাচ্চাদের দাবী-দাওয়া পূরণ করার সাধ্য ছিলো না জহুরুল হকের। কিন্তু হঠাৎ করেই সব পাল্টে যেতে শুরু করলো। নির্ঝঞ্জাট গৃহিনী ফাতেমা বেগম প্রথমে কিছুই বুঝতে পারলো না । ভাবলো প্রমোশনের পর বেতন বেড়েছে। কিন্তু বাজারেও যে আগুন লেগেছে। তাহলে? ছোট্ট একটা সন্দেহ দানা বাধে ফাতেমার মনে। এক রাতে ঘনিষ্ট মূহুর্তে জিজ্ঞেস করে ফাতেমা
– হঠাৎ করে পাল্টে গেলো যে সব কিছু। কেমন করে বলো না গো। হঠাৎ করেই কঠোর হয়ে যায় জহুরুল হক।
– ঘরের বউ, বউয়ের মতো থাকো।
সাংঘাতিক রকম থমকে যায় ফাতেমা। স্বামীকে এটুকু বলার অধিকার তার নিশ্চয়ই আছে। প্রায় দশ বছরের সংসার জীবনে অনেক ভয়াবহ সময় কাটিয়ে এসেছে সে। আজকাল প্রাচুর্য এসেছে ঠিকই কিন্তু সেই মানুষটি যে অনেকখানি পাল্টে গেছে এটা বুঝে নেয় ফাতেমা। সে আর কথা বাড়ায় না। চুপ করে থাকে। ক্লান্ত জহুরুল ঘুমিয়ে যায়। কিন্তু ফাতেমার চোখে ঘুম আসে না। হাত খুলে খরচ করে জহুরুল। আগে সে প্রতিটি খরচ এর হিসেব রাখতো এখন আর হিসেব রাখে না। সামান্য কিছুদিনের মাথায় টিনশেড ছেড়ে বেশ বড় সড় একটা ফ্ল্যাটে উঠে পড়ে সে। প্যাকাটি টাইপ জহুরুল এর শরীরেও বেশ মাংস লেগেছে। চুপসানো পেটে এখন ছোট খাটো ভূঁড়ি। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাদের গাল ও ঘাড়ের মতো ওর গাল ও ঘাড়েও একটা চকচকে ভাব। ফাতেমার এসব ভালো লাগে না। আগের মতো স্বত:স্ফুর্ত থাকতে পারে না ও। ফাতেমার এই নিষ্পৃহতা চোখেই পড়ে না জহুরুলের। আজকাল আবার জমি কেনার ব্যস্ততা ওর। ছুটির দিনগুলোতে জমির দালাল, ফ্ল্যাটের দালালরা বাসার ড্রইং রুমে ভিড় জমায়। দামী দুটো মোবাইল ফোন নিয়েছে জহুরুল। যতক্ষণ বাসায় থাকে ঘন ঘন বাজতে থাকে ফোন দুটি। নানান প্রসঙ্গে নানান কথা বলে জহুরুল। ফাতেমা কিছু বোঝে কিছু বোঝে না। সে শুধু আল্লাহকে ডাকে। বুকের ভেতরের হাহাকারটা থামে না ফাতেমার।
অফিসে বড় বসদের সাথে বেশ দহরম মহরম জহুরুল এর। আজকাল নানান পার্টিতেও ওর ডাক পড়ে। যেতে হয় ওর। সবাইকে হাতে রাখা প্রয়োজন। সেকশনে ওর সাব-অর্ডিনেটরা তাকে বেশ সমীহের দৃষ্টিতে দেখে। দুএকজন বেয়াড়া যে নেই তা নয়। ঐ যেমন অনন্ত রায় নামে যে হিসাব রক্ষক এসেছিলো। কঠিন জিনিষ। অনন্ত রায় এর ব্যক্তিত্ব ওকে মুগ্ধ করেছিলো। কিন্তু যখন দেখা গেলো ও বেটা আপাদ মস্তক সৎলোক তখনই হিসেবে প্যাঁচ লাগলো জহুরুল হকের। ও বেটা যেমন কাজ বুঝে তেমনি ভয়াবহ রকমের সৎ। ব্যক্তিগত কাজ তো দূরের কথা কোন ধরনের অন্যায় ও বেটা সহ্যই করতে পারে না। একদিন ব্যাংকের একটা ছোট্ট কাজ দিয়েছিলো জহুরুল। সরাসরি ডিনাই করলো অনন্ত। জহুরুল বলেছিলো– কাজটা ভালো হলো না বাবু।
– খারাপ যে হয় নাই এটা আমি জানি। আর এটা মনে রাখবেন কারো ব্যক্তিগত কাজ করার জন্য অফিস আমাদের অ্যাপয়েন্ট করেনি।
গা টা জ্বলে গিয়েছিলো জহুরুলের। কিন্তু কিছু বলার সুযোগ ছিলো না। অনন্তর যে সাহস দিব্যি অপমান করে বসে থাকবে সারা সেকশনের সকলের সামনে। তবে শোধ নিয়েছিলো জহুরুল। ডিরেক্টর এর নিকট নানান মিথ্যা লাগিয়ে অনন্তকে অন্য সেকশনে ট্রান্সফারের ব্যবস্থা করেছিল জহুরুল। ট্রান্সফার অর্ডার হাতে নিয়ে অনন্ত এসেছিলো ওর কাছে আর দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বলেছিলো– সীমা লংঘনকারীকে নাকি আল্লাহ পছন্দ করেন না। কথাটা মনে রাখবেন মিঃ জহুরুল।
অনন্তর সামনে চুপসে গিয়েছিলো জহুরুল হক।
পারচেজ সেকশনে চার বছর সাত মাস কাটিয়ে দিলো জহুরুল হক। পরিবাগ আর এলিফ্যান্ট রোডে দুটো ফ্ল্যাট, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় প্লট। এখানে ওখানে বেশ কটি দোকান, গ্রামের বাড়িতে জমি-জমাসহ অনেক সম্পত্তির মালিক জহুরুল হক। সম্প্রতি সিএনজি চালিত বেশ কটি গাড়িও বিভিন্ন রুটে চালু হয়েছে ওর। সংসারে সময় দেবার মতো সময় নাই জহুরুলের। দুটো ফ্ল্যাটের একটাতে উঠে এসেছে পরিবারসহ। ফাতেমার সাথে খুব কম কথা হয় ওর। বাচ্চারাও খুব একটা ধার ঘেষে না ওর। অনেকগুলো প্রাইভেট শিক্ষক বাসায় পড়াতে আসে। প্রতিমাসে ওর সংসার খরচ যে কতো এটা জানে না জহুরুল হক। অনেক দামী গাড়িতে বউ-বাচ্চা চড়ে। তবে নিজে অফিসের মাইক্রো আর সিএনজি স্কুটারই ব্যবহার করে জহুরুল হক। দাড়ি-টুপিসহ গেটআপ সেই আগের মতোই। ক্ষমাতাসীন দলে বেশ বড় অংকের চাঁদা দিয়ে লাইন ক্লিয়ার করার চেষ্টা করছে। এলাকায় গিয়েও কিছু দান খয়রাত করে এসেছে সে। এলাকায় কিছু নিজস্ব চামচাও তৈরী হয়েছে। ভবিষ্যতে রাজনীতিতে যে যেতেই হবে। রাজনীতির মতো এতো ভালো ব্যবসা কি আর আছে? পত্র-পত্রিকায় চোখ বুলায় আর ভাবে জহুরুল হক।
নিজের মেধা আর লক্ষ মেগাবাইট ধান্দা ক্ষমতার প্রশংসা নিজেই করতে বাধ্য হয় জহুরুল হক। মাত্র চার বছর সাত মাস সময় কিভাবে তাকে জিরো থেকে হিরো বানিয়ে দিলো এটা ভাবতেই নিজের জন্য গর্ব হয় ওর। ভাবে একটা ভালো সেলিব্রেট পার্টি দিলে কেমন হয়। যাক নির্বাচনটা হয়ে যাক। ভালো কিছু ব্যবসা-পাতি শুরু করে চাকুরীতে ইস্তাফা দেবে জহুরুল। শিল্পপতি, ব্যাংকার ইত্যাদি অলংকার নামের সাথে লাগিয়ে আদি ও অকৃত্রিম রাজনৈতিক ব্যবসায় নিজেকে জড়িয়ে নেবে। সামনের খোলা পথের কথা ভেবে স্বস্থির নিশ্বাস ফেলে জহুরুল হক।
রাজনৈতিক অবস্থা তখন তুঙ্গে। হরতাল, অবরোধ, মিছিল, মিটিং এ সরগরম সারা দেশ। লাশও পড়েছে নিয়মিত। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলো, সে সরকারের ভাঙ্গন ও হলো। ২২ তারিখ এর নির্বাচনের দিকে পুরো নজর জহুরুলের। অফিসে এ নিয়ে অনেকের সাথেই তার তুলকালাম হয় ওর। হাড্ডি খায়ের ছাড়া ওকে আর কেউ সাপোর্ট করেনা। ক্ষমাতসীন দলের প্রতি যাদের সিমপ্যাথী ছিলো ওরা এখন ২২ এর নির্বাচনের বিপক্ষে। মনে মনে ওদের গালা-গালি দেয় জহুরুল। এ নির্বাচনটা না হলে জহুরুলের অনেক স্বপ্নই মাটি হয়ে যাবে। তবে জহুরুল আশাবাদী মানুষ। তার স্বপ্ন সফল হবে এ আশাই করে জহুরুল।
১১ জানুয়ারী । চরম অবস্থায় এলে দাড়িয়েছে সারা দেশ। অফিস থেকে ফিরে টিভির সামনে বসে এ চ্যানেল থেকে ও চ্যানেল এ দৌড়ায় জহুরুলের চোখ। আজ একটা কিছু হবে। এভাবে সময় যেতে যেতে রাত এগারোটায় ভয়াবহ একটা শক্ পেয়ে চমকে উঠে জহুরুল হক। তার স্বপ্নের বেলুনে একটা পেরেক গাঁথা হয়ে যায়। তারপর বড় দ্রুত সময় যায় জহুরুরের। স্বপ্নগুলো রঙ পাল্টায়, উজ্জলতা হারিয়ে নিরেট কালোর গহ্বরে প্রবেশ করে। এরকম এক কালোরাতে বাড়ীর সব বাতি জ্বলে উঠে। সামরিক যান ঘিরে ফেলে তার বিলাস বহুল ফ্ল্যাট। ছেলে মেয়েরা ঘুম ভাঙ্গা চোখে অবাক হয়ে তাদের পিতাকে দেখে। পিতার চলে যাওয়া দেখে। শুধু মাত্র জহুরুলের স্ত্রী ফাতেমা বেগমকে বড় নিষ্পৃহ দেখায়। এ ঘটনাটা ঘটার অপেক্ষায়ই ছিলো যেন সে!
প্রিজন ভ্যানের তীব্র হর্নের শব্দে চমক ভাঙ্গে জহুরুল হকের। গাবতলী ব্রীজ অতিক্রম করে তীব্র বেগে কাসিমপুর কারাগারের দিকে ছুটছে প্রিজন ভ্যান। কালবোশেখের গাঢ় কালো মেঘ পুরো আকাশ ছেয়ে আছে। জহুরুল হকের চোখে পলক পড়ে না।