ভগ্নপ্রায় শিলালিপিতে বিবর্ণ রক্ত; কাঁঠফাটা রোদে কাকের কা-কা ব্যঞ্জণায় নিথর প্রাণ; আর উদাসী ঘুঘুর কণ্ঠে ধ্বনীত হয় বিরহের তানপুরা- তানপুরার ওই সুরে আসমান জমিন যেনো একাকার, থেমে যেতে চায় জীবনের সব কোলাহল। গচ্ছিত কষ্টগুলো তখন কুয়াশার নৌকো হয়ে দীর্ঘশ্বাস ছড়ায়; ফলে কোনো আগন্তুক হয়তো বলে উঠবে– এডি কুন দ্যাশরে ভাই!
প্রশ্নটা আপেক্ষিক। কেনো না, উত্তরবঙ্গের প্রখ্যাত কৃষকনেতা মারফত আলীর স্মৃতি বিস্মিৃতপ্রায়; বৃদ্ধ-বৃদ্ধার মুখের পৌরাণিক কোনো রুপকথা; মুছে গেছে আর আর সব কৃতি। এখন নতুন নাম, নতুন পরিচয়- মালিহাদ, কুষ্টিয়া জেলার প্রত্যন্ত একটি গ্রাম; যার দু’পাশে প্রাণ জুড়ানো সবুজের স্পন্দন। পাকা ধানের শীষগুলো নুয়ে পড়েছে। মেঠোপথ ধরে সম্মুখে এগিয়ে চলি। স্মৃতির ক্যানভাসে হারানো দিনের দৃশ্যাবলী অনুভব করি।
অনেক দিনের চেনাজানা পথ, পুরাতন কর্মস্থল; জীবনের অসংখ্য স্মৃতি অযত্ন আর অবহেলায় এখানে সেখানে পড়ে আছে; অনুকুল পরিবেশে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে; রাতজাগা পাখির মতো পাখা ঝাঁপটায়; একটু-একটু করে যেনো-বা হারিয়ে যাই– পড়ন্ত বিকেল। সাদা মেঘের ভেলা। টিয়াপাখির কলতান। মাটিতে হেলান দেওয়া গাছের লম্বা ছায়া। আহা, থরে-থরে সাজানো সব ছবি! ঘণীভূত সন্ধ্যার বিশুদ্ধ তন্ময়তায় ভেসে আসে কিচির-মিচির শব্দ; হ্যাঁ, শালিকই বটে! নাম ধরে ডাক দিলেই পাখিরা ছুঁটে আসে; তখন মনে হয়, রাখালটাকে ঘিরে যেনো জলসাঘরে নৃত্যরত বাইজী সব! বিচিত্র ভঙ্গিতে অঙ্গ দোলায়, ঘাড়ের উপর নিশ্বাস ফেলে, চুলে ঠোঁট ঘঁষে আদর করে। লোকটি নাকি পাখিদের অভিমানও বুঝতে পারে! অভিমান হলে ছড়ানো ছিঁটানো খাবার রেখে ওরা তখন নির্বাক; গীতহীন মুখে ঝুঁপ ধরে আকাশ পানে চেয়ে থাকে; মৌনতার গাঢ় আবরণে বাঁশবাগানে হঠাৎই অন্ধকার নেমে আসে! একদিনের কথা স্পষ্ট মনে আছে- চায়ের দোকানে রাখাল ও তার দলবল ব্যতিব্যস্ত; তালের ঘোলাটে রস খেয়ে মাস্তি করে; হঠাৎ দলছুট একটা পাখি উড়ে আসে, তারপর ডানা ঝাঁকিয়ে কাতর স্বরে আর্তনাদ করে; করুণ আহাজারী। চায়ের পেয়ালা অসমাপ্ত রেখে আমির আলী উঠে যায়, সন্তর্পণে পাখিটা হাতের উপর তুলে নিয়ে জিজ্ঞেস করে– কি হয়িচে তোর, এরাম করি কাঁনচি ক্যান?
পাখিটার একটা পা দিয়ে তখনো রক্ত ঝরছিল। আঘাতে মাংস থেতলে গেছে। এ দৃশ্য আমির আলীর পক্ষে নিরবে হজম করা কষ্টকর; তাই গলা চড়িয়ে হুঁঙ্কার ছাড়ে– আমার পরাণের গায় হাত দিচে কুন চুদিরভাইরে! শালার কী এরাম ক্ষতি করিচে!
পাখিটাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ শেষে আমির আলী পুনরায় বলে, ওই শালা, সাহস থাকলি সামনে আয়, দেকি তোর কত বড় কলজি! আমার পাকির গায় হাত দিতি ইট্টুউ বুক কাঁপলু না! আহারে, শালী মানুষ না জানুয়ার!
আত্নপক্ষ সমর্থন করে কেউ এগিয়ে আসে না; তবে সন্দেহের তীর গেরস্থ বাড়ির বৌ-ঝিঁদের অভিমুখে। পাকশালায় চুরি করে কিছু খেতে গিয়ে বোধহয় তাদের হাতেই নাজেহাল হয়েছে।
আইলের পরে আইল তার ওপারে রাস্তা। ইচ্ছে করলে বড় রাস্তায় সিঁড়ি ভাংতে পারতাম কিন্তু ওই পথ মাড়াইনি; তাহলে বন্ধুরা বুঝতো না এই জনপদের সাথে আমার সম্পর্ক কী; দিনের পর দিন প্রত্যন্ত অঞ্চল কেমন করে প্রত্যন্ত অঞ্চল চষে বেড়িয়েছি; কেমন করে জনপদের মানুষগুলোর সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলাম! এমনিতেই পাখি নিয়ে ঝামেলায় আছি, কেউ বিশ্বাস করতে চায় না; উল্টো উপহাস করে- এসব নাকি আজগুবি গল্প; আমার রিদ্ধ ঘিলু-নির্মিত কল্প-কাহিনী! পাখির সাথে মানুষের প্রেম! এক কথায় এ যুগে অসম্ভব!
মনে-মনে ভাবি ওদের কথা হয়তো মিথ্যে নয়। পাখিদের সাথে মানুষের সম্পর্ক ইদানিং ভাল না; খুবই খারাপ। পাখি দেখলেই রক্তে নাচন ধরে; ক্ষ্যাপা কুকুরের মত বন্দুক হাতে ছুঁটে যায়, নির্বিচারে হত্যা করে; সবুজ-শ্যামল বাংলা আজ পাখিশূন্য হতে চলেছে। দোয়েলের ডাকে এখন আর ঘুম ভাঙে না; নেই কোকিলের কুহুতান, পানকৌড়ি হয়েছে অন্তরীক্ষচারী, জলার বুকেও খরা! জঙ্গিবাদ প্রসঙ্গই বা এড়িয়ে যাই কিভাবে; তাদের প্রকাশ্য মহড়া ও ফাঁটানো বোমায় শুধু মানুষ নয় পাখিরাও আতংকিত। অভিমানে এদেশ থেকে চেনাজানা হরেক পদের পাখি আত্নগোপন করেছে। বাকরুদ্ধ কাক অনাচারের নিরব স্বাক্ষী। অবশ্য মাঝে মধ্যে শকুনের ছায়া দেখতে পাই; যে ছাঁয়া একাত্তরে ঠুঁকরে ঠুঁকরে সতেজ আলো ভক্ষণ করেছিল; ধারালো নখের আঘাতে হৃতপি- ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিল; তাইতো, শকুন দেখলে আজও আঁৎকে উঠি, বুকের মধ্যে থরথরানি শুরু হয়।
আশরাফের চিৎকার শুনে ফিরে তাকাই। বেচারা অনেকখানি পিছন পড়ে গেছে। আইলপথে হাঁটার অভ্যাস না থাকলে যা হয়। সতর্কতার সাথে পা ফেলে সে। কখনো থমকে দাঁড়ায়। সামনে-পিছনে একবার তাকিয়ে পুনরায় চলা আরম্ভ করে। রক্তাত্ত এই জনপদে আশরাফ এবারই প্রথম- ভদ্রলোক প্রতিষ্ঠিত একটি দৈনিকের সিনিয়র রিপোর্টার, লেখালেখিতেও সুনাম আছে। সুনামের পরিধি ক্রমবর্ধমান। ইতিমধ্যে দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে গেছে। বস্তুত পাখি-রহস্যের কিনারা করতেই এবারের ভ্রমণ। বিষয়টির ফয়সালা হওয়া দরকার। আশরাফের পানে তাকিয়ে আরেক দফা বিস্মিত হই! আহা, বেচারা যেনো খাঁটি মাটির মানুষ! সাধারণ মানুষগুলোর সাথে খুব বেশি বেমানান মনে হয় না। আওলা ঝাঁওলা কেশবিন্যাস, ট্রাভেলস ব্যাগে কাঁদার ছড়াছড়ি, ভেজা কাপড়ে পাদুকাদ্বয় হাতে তুলে নিয়েছে! বুঝতে পারি, পা পিছলে পড়ে গেছে। হাসি হাসি মুখ করে জিজ্ঞেস করি, কি ব্যাপার, ভাইজান; এমন অবস্থা যে!
কপালের ঘাম মুছতে-মুছতে আশরাফ নিচু স্বরে খিস্তিখেউর পাড়ে, শালা কপাল; এখানে কী মানুষ বাস করে, নাকি করতে পারে! আগে জানলে কিছুতেই আসতাম না।
রসিকতা করি, ছি ছি এভাবে বলছেন কেনো, মাটির মানুষ মাটির কাছাকাছি না এলে কী চলে; তাছাড়া দেশটা তো একটু ঘুরে দেখা দরকার, কি বলেন!
চলার পথে দু’একজন কৃষকের সাথে দেখা হয়; কর্মব্যস্ত সবাই, তবু মাথাল খুলে নিকটে এগিয়ে আসে; কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে- ছ্যার আপনি; কনে আসিচেন, একেনে ফের থাকপেন নাকি!
মাথা নাড়াই, আরে না না, তোমাদের দেখতে এলাম; কতদিন দেখা নেই; তা কেমন আছো সবাই, ছেলেমেয়েরা কেমন আছে?
বিমর্ষ চিত্তে ঘাড় কাত করে, জ্বে, ভালো।
ওদের ভালো থাকার কথা শুনে নিজেরও খুব ভালো লাগে। ওরাই মাটির মানুষ; মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল ফলায়। শরীরময় মাটির সোঁদা গন্ধ। কথায় কথায় আমির আলীর কথা জিজ্ঞেস করি কিন্তু প্রথম-প্রথম চিনতে পাওে না, উল্টো আমাকে প্রশ্ন করে– কার কতা কচ্চেন ছ্যার, কুন আমীর আলী?
ওই যে ওই লোকটা, যে পাখি নিয়ে দিনরাত মেতে থাকতো।
আমির আলীকে চিনতে এবার আর বেগ পেতে হয় না; কপালে ভাঁজ ফেলে একগাল হেসে বলে, ও আমাগের মাস্তান ভাইর কতা বুলচেন; সে আবার যাবে কুতায়; পক্ষি নিয়িই ঘর বাঁন্দিচে!
পাখির কথায় আশরাফের চোখেমুখে আলোর দিশা কিন্তু দপ করেই ওই আলো নিভে যায়; তার মনে নতুন ভাবনা– এ আবার কোথায় এনে ফেললেন, লোকটি কি সত্যি-সত্যি মাস্তান!
আমির আলী থেকে মাস্তান; আমির মাস্তান। পৈত্রিক নামের শেষে কেমন করে, কিভাবে মাস্তান শব্দ যোগ হলো, কেনোই বা লোকটি সংসারী হতে পারলো না, কেনো দিনরাত গোরস্থানে শুয়ে থাকতো, কুষ্টিয়া ডিসি কোর্টের সামনে কেনো মানুষ খুন হলো; তার হাতের রং লাল না সবুজ- এসব প্রশ্নের দায়ভার আমার না ইতিহাসের; হয়তো ইতিহাসই একদিন কথা বলবে। তবে হতাশাময় মুহূর্তে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, চাচাজান, এতকিছু থাকতে পাখিদের সাথে ঘর-সংসার কেনো?
উত্তর দিতে গিয়ে আমীর আলীর দু-চোখ জলে বুজে এসেছিল– মানষির ভালবাসায় অনেক জ্বালা গো বাপ; বুক পাতি দিলি সে’ই বুকি লাত্তি মারে, বার বার স্বপ্ন ভাঙি দেয়, খালি কাঁন্দায়!
আমির চাচার দু’চোখ জলে ছলছল করে। পাখিগুলোর পানে তাকালে তার স্মৃতিতে নাকি বড় ভায়ের অবয়ব দৃশ্যমান হয়ে ওঠে; হাঁউমাউ করে কাঁদে তখন– বাপরে, আমার মার সব্বের বড় ছেলিক উরা খুঁচি-খুঁচি মারিচে; মরনকালে এক গিলাস পানি খাতি চ্যাচুলু তাউ খাতি দিইনি। আইচ্চা, উরা কী মানুষ না জানুয়ার!
রক্তাক্ত জনপদের এ আরেক চিরন্তন অধ্যায়। ফকির মোহাম্মদকে ধরতে সন্ত্রাসীরা অভিনব ফাঁদ পেতেছিল। পোড়াদহ স্টেশন ছেড়ে এসে খালমাগুরা ব্রীজের কাছে যে ফাঁকা মাঠ সেখানে ট্রেন থামিয়েছিল; চিরুনি অভিযান চালিয়ে ফকির মোহাম্মদকে খুঁজে বের করেছিল তারপর হাত-পা বেঁধে মারতে-মারতে হালসা অভিমুখে নিয়ে গিয়েছিল! রেলপুলিশ নির্বিকার, হাতের অস্ত্রটা বুকে জড়িয়ে আবালের মতো তামাশা দেখছিল! একটা অস্ত্রের জন্য ফকির মোহাম্মদ কাকুতি-মিনতি করেছিল; পুলিশ রাজি হয়নি, অস্ত্র না-থাকলে নাকি চাকরি থাকবে না! আরে বাপু অস্ত্রের জন্য মানুষ নাকি মানুষের জন্য অস্ত্র!
শকুনের মাংস নাকি শকুনে খায় না, সেদিন খেয়েছিল- জাসদ গণবাহিনী ফকির মোহাম্মদকে গিলে খেয়েছিল। ফকির মোহাম্মদ একা না, এই জনপদে এমন অসংখ্য ঘটনার কথা শুনেছি। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে জন্ম নেওয়া জনপ্রিয় দলটি আভ্যন্তরীণ কোন্দলে অমাবস্যার চাঁদের মতো ক্ষয়ে-ক্ষয়ে যাচ্ছে।
আশরাফের বিষন্নতা স্থায়ী হয় না; দিগন্তজোড়া পাখি দেখে মন উৎফুল্ল- আমির আলীর পরাণপাখি! বেচারা সহায়-সম্বলহীন মানুষ। শুধু পাখিদের জন্য ভিক্ষার ঝুঁলি কাঁধে তুলে নিয়েছে। নিজে অভূক্ত থাকলেও পাখিদের ক্ষুধা তার সহ্য হয় না; খাবারের জন্য দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে বেড়ায়। তার আঙিনায় রকমারি পাখির আনাগোনা। যার-যার মতো সংসার পেতেছে; কারো সাথে কোনো বিরোধ নেই। জলার ধার ঘেষে মাছরাঙাদের অবস্থান। নরম রোদে খয়েরি ডানা শালিখগুলো পেখম মেলে শুয়ে আছে। বাঁশবাগানের সবুজ কুঞ্জে পাখিদের বিরামহীন সূর মূর্চ্ছণা; ওই সূর আমাদের মাঝেও প্রতিধ্বনিত হয়। আশরাফ নিপূণ হাতে তাদের রূপালী ফিতায় বেঁধে ফেলে। এ-এক দূর্লভ চিত্র! রক্তাক্ত জনপদের সাথে বড় বেশি বেমানান। ছোট্ট কুঁড়ের ভিতর থেকে কেউ একজন হাঁক ছাড়ে– কিডারে ওকেনে, আমার পরাণকে জ্বালাচ্চিস ক্যান?
আমির আলী; কমরেড আমীর আলী। হাঁড় জিরজিরে শরীর। মুখ গুঁজে শুয়ে আছে। দু’টি কিডনীই নাকি ধ্বংসের পথে! মনে খটকা লাগে, চিনতে কষ্ট হয়– এ কী সেই আমির আলী, রেসের ময়দানে একদা যে লাল ঘোড়া দাবড়িয়েছে, যার জন্য বাঘে-মহিষে একঘাটে পানি খেয়েছে! আনমনে মাথা নাড়ি। দীর্ঘশ্বাস আড়াল করতে পারি না। আচ্ছা, জীবন এত ছোট কেনো; অসমাপ্ত কাজ শেষ হওয়ার আগেই কেনো পালাতে হয়!
পরিচয় পেয়ে আমির আলী খুশি হয়। তার আগে ডান হাতটা উপরের দিকে তুলে ধরে স্মৃতি রোমন্থন করে; মেঘরাজ্যে থরে থরে সাজানো জীবন নাটকের বিশেষ অংক থেকে আমার চরিত্র উদঘাটন করে। প্রতিদিনই পাখি দেখতে মানুষ আসে। তাদের সাথে কথাও হয়; সুখ-দুঃখের গল্প করে কিন্তু সবার কথা মনে রাখতে পারে না। আশরাফের পানে ইঙ্গিত করে জিজ্ঞেস করে- তুমার সাতের ছেলিডা কিডা গো বাবা, সাতে বন্দুক আনিছে নাকি?
আস্বস্ত করি, না না চাচাজান, উনি একজন সাংবাদিক; পাখিদের ওপর কিছু কাজ করবে।
আমাকে থামিয়ে দিয়ে আমির আলী তাচ্ছিল্লের স্বরে বলে, দুর বাপু পাকিগের নিয়ি আবার কুনু কাজ হয় নাকি! উরা মুনিস্যি না বাপ, আমাক জ্বালি মাল্লু; খালি খাতি চায়, তুমিই বোলো অতো খাওয়া কেরাম করি জুগাড় কোরবু?
পুনরায় বোঝাতে সচেষ্ট হই, পাখিদের দিয়ে অনেক কিছু সম্ভব চাচাজান; আপাতত আমরা একটা প্রামাণ্য চিত্র করবো। দারুন ব্যাপার হবে! বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রচার হবে! সারাদেশে আপনার নাম-কাম ছড়িয়ে পড়বে। সাক্ষাৎকার নিতে কেউ কেউ ছুঁটে আসবে! তখন দেখবেন, রাতারাতি পাখিদের ভাগ্য বদলে গেছে!
আমির আলী মুখ টিপে হাসে আর বলে, ও পক্কি নিয়িউ তালি ব্যবসা!
আশরাফের অনুরোধে আমির আলী বাইরে আসে; হাত উঁচিয়ে পাখিদের ডাক দেয়, পরাণ ও পরাণ, তুরা সব কনে, কাচে আয় দিনি, দেকি যা, তোগের দেকতি ঢাকা তিকি সায়েব আসিচে। আর চিন্তা নি’রে; আল্লা বোধায় মুক তুলি তাকায়ি; তোগের আর না খায়ি থাকতি হবেনান!
প্রথমে একটা-দুটো, তারপর ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা নেমে আসে। আশরাফ উঠে দাঁড়ায়, পাখিদের নিয়ে মেতে ওঠে। রূপালী ফিতার দৈর্ঘ্য ক্রমশ লম্বা হয়। অথচ আমি স্থির, পা তুলে দাঁড়াতেও অনিহা; চেতনার সিংহাসনে তীব্র কুঠারাঘাত- পক্কি নিয়িউ তালি ব্যবসা!
তাইতো; লোকটি মন্দ বলেনি। পাখি রক্ষণাবেক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই; যেটুকু আছে তাও মেকি, লোক দেখানো মাত্র। সুন্দরবন ঘিরে নির্মাণ হয়েছে অসংখ্য ফরেস্ট রেঞ্জ, কোস্টগার্ড বাহিনী; তারপরেও কেনো পাখি নিধন হয়? নির্বিচারে কারা হরিণ শিকার করে– কারা আবার, যারা রক্ষক তারাই তো ভক্ষক! খুবলে-খুবলে ধ্বংস করে দিচ্ছে জীববৈচিত্র! তবে আমির আলীর ব্যাপার ভিন্ন; এখানেও সে বহুমাত্রিক। রক্তাক্ত জনপদে অস্ত্রের ছড়াছড়ি; অঙ্গুলের ইশারায় মানুষ খুন হয়, লাঙলের ফলায় উঠে আসে নরকঙ্কাল, ইট-ভাটায় কাঁচা মাংস পোড়ার উৎকট ঘ্রাণ; সাজানো সুখের সংসার মুহূর্তে ভেঙে তছনছ হয় অথচ পাখিদের দিকে বন্দুক তাক করার দুঃসাহস কারো নেই।!
রূপালী ফিতায় ভর করে আশরাফের জীবনে হঠাৎ-ই সুখপাখির নিত্য আনাগোনা; মিডিয়া জগতে পাখি বিষয়ক উত্তেজনা। পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোয় নানামুখী আয়োজন; ভূয়সী প্রশংসা। পাখিদের মধ্যে কেউ-কেউ চিরায়ত বাংলার রস আস্বাদন করে। আমিও আগের মতো ব্যস্ত; দিনরাত কাজের মধ্যে ডুবে থাকি; চলমান জীবনের সাথে যুদ্ধ করি; যতবার স্বপ্ন দেখি ততবারই স্বপ্ন ভাঙার বেদনা, তথাপি ভাঙা স্বপ্নগুলো পুনরায় জোড়াতালি দিই। সময়ের স্রোতে খড়কুটোর মতো ভেসে চলি। অফিস থেকে বাসা, বাসা থেকে অফিস- জীবন যেনো বদ্ধ জলাশয়! কতদিন ভাবি বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেবো, দূরে কোথাও বেড়াতে যাবো; হয় না। সময় কোথায়! সমাজ, সংসার, অর্থনীতি, রাজনীতি, পরিবেশ, প্রতিবেশ জগদ্মল পাথরের মত কাঁধের উপর চেপে বসে। বর্ষার পানিবন্দি মানুষের মতো নিজেকে বন্দি মনে হয়। ছুটির দিনগুলোয় আরো বেশি অস্থিরতায় ভুগি। ঘরে মন বসে না, দুপুর রোদে ঢাকার রাজপথে উদভ্রান্তের মতো পথ হাঁটি। শহরটাও বদলে গেছে। আগে দেখা দৃশ্যের সাথে কিছুতেই মেলাতে পারি না। কিছুদিন আগেও রাস্তার দু’পাশে বড় বড় বৃক্ষ ছিল, পতিত জমি ছিল, অসংখ্য জলাশয় ছিল। আচ্ছা, গাছগুলোর কী হলো! জলশয়ই-বা কোথায় হারালো! খুবই অবাক ব্যাপার। ভাবতে গেলে কিনারা করতে পারি না; মনে হয় সব চোখের ভুল। বহুতল ভবনের পাশে নিজেকে বড় বেশি অসহায় মনে হয়। গ্রামের টান অনুভব করি তখন। ফিরে যেতে ইচ্ছে করে! সান-বাঁধানো ঘাট, বিস্তৃর্ণ ফসলের মাঠ, উদাস দুপুরে ঘুঘুর ডাক, ঝাক বেঁধে টিয়া পাখির উড়ে যাওয়া, সাঁঝের আলোয় রাখালের ঘরে ফেরা- আহা কতো জীবন্ত সব ছবি ! আমির আলীর কথা ভেবে হিংসে হয়, পাখিদের সাথে আমারও সংসার পাততে ইচ্ছে করে। মুক্তি চাই; মুক্তির জন্য মনে মনে অপেক্ষা করি, কিন্তু মুক্তি মেলে না। কিছুদিন পরের কথা- হাওয়ার ডানায় ভর করে একটি সংবাদ আসে, মুক্তির সংবাদ; আমির আলী আর নেই, খাঁচা শূন্য করে তার পরাণপাখি উড়াল দিয়েছে!