আরাফাত তন্ময়

অসমাপ্ত ডায়েরির পাতা

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

নীরা, একুশ বছরের এক যুবতী। অজপাড়া গ্রামে জন্ম। বাবা একজন স্কুল শিক্ষক। মা বেঁচে নেই। বছর সাতেক হলো গত হয়েছেন। নীরার পাঁচ বছরের ছোট একটি ভাই আছে। তিহান। সে শহরের কলেজে পড়ে। বাবার স্বপ্ন তাকে ডাক্তার বানাবে।

এক কাক ডাকা ভোরে নীরা ঘুম থেকে উঠে তার সই মীরার বাড়িতে গিয়েছে বেলী ফুল কুড়াতে। বেলী ফুল সুতোয় গাঁথার সময়ে গুনগুনিয়ে গান গাইতে নীরার খুব ভালো লাগে। তাই তো সকালের আরামের ঘুমকে ছুটি দিয়ে মীরার বাড়িতে আসা। না হয় মীরাদের গরুর দুষ্টু বাছুরটি যদি মাড়িয়ে ফেলে! তবে নিত্যদিনের মতো আজ আর ফুল কুড়িয়ে বাড়ি আসা হলো না নীরার। মীরার মা তাকে ডেকে নিয়ে গেছে গাছতলা থেকে। মেহমান আসবে, হাতের নাস্তা বানাতে হবে, শহুরে মেহমান। এই একটি শব্দেই গ্রামের মানুষদের আতঙ্ক, শহর! ভিনদেশ ভাবেন মনে হয়। নীরা সহ আরো পাঁচ-সাত জন মহিলা পিঠা বানাতে ব্যস্ত। সে কী হুঁশিয়ারি। লবণ ভুলেও বেশি হওয়া যাবে না, মিষ্টি ঠিকঠাক দিতে হবে। ভাজতে গেলে যেন ঝলসে না যায়। এতকিছুর মাঝেও মীরার মন খারাপ। ব্যাপারটি ভালো লাগলো না নীরার। ইচ্ছে করছে কাছে গিয়ে মীরার মাথাটা নিজের কাঁধে নিয়ে জিজ্ঞেস করতে, আমার সতীনের হঠাৎ মন খারাপ! কিন্তু পারছে না। ডালের পিঠায় যে নীরা খুব সুন্দর করে ফুল আঁকতে পারে। মনে মনে এই একটা উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছে নীরা। সবাই মন দিয়ে হাতের কাজ সারছে। এর মাঝে হাসেম চাচা, নীরার বাবা। এসে খবর দিলো খালের ওপারে মেহমানরা পৌঁছে গেছেন। ঊনি নৌকা নিয়ে যাচ্ছেন তাঁদের আনতে। আমাদের কাজ যেন তাড়াতাড়ি সুন্দর ভাবে করি। মেয়েদের পেটে যে কথা বেশিক্ষণ টিকে না তার প্রমাণ নীরা আজও পেল, পাশে বসা বারেক ভাইয়ের বউ বলে উঠলেন, ওলো যা স্নানটি সেরে আয়। আমার ঘরে কিছু সনু পাউডার আছে তা মাখ দিকিনি। শহুরের ব্যাটা বলে কতা।

নীরা শুধু হা করে কথাগুলো শুনে গেল। মীরার মুখ বেজার করে অনেকখানি রাগ ঝেড়ে উঠে গেলো স্নান করতে। সুযোগ পেয়ে নীরা আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো, ভাবী আসল কতা কও দেকি। সব কথার শেষ কথা হলো, মীরাকে বরপক্ষ দেখতে আসছে আজ। ছেলে কলেজ শিক্ষক। বড় ঘর, শহরে নিজেদের বাসা আছে। মহিলাদের হাবভাব এমন যে পারছে না মীরাকে ঊনাদের গলায় ঝুলিয়ে দিতে।

সবার খানাদানা ভালো মতোই হলো, কখন যে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো টেরই পায়নি নীরা। এতসব ধকল গেছে আজ। তার উপর ছেলের বন্ধু! আস্ত একটা হারামজাদা। এখনো বিয়ের খবর নেই। ঊনি আছেন বেয়াইন নিয়ে। ওদিকের সব ঝামেলা মিটিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো নীরা। আজ মন খুব খুশি সইয়ের বিয়ে ঠিক হলো। আবার মন খারাপও, এই নীরাকে শুধু ঐ একজনই ভালো মতো বুঝে। ভাবতে ভাবতে নিজের বাড়িতে চলে এলো নীরা। এতক্ষণে তার বাবাও বাড়ি চলে এসেছেন। নীরা যেই না পিছনের দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকবে, ভেতর দিয়ে আটকানো। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। এ তো মাত্র দিনের বেলা। মাঝ রাত্রিতে খেঁজুরের রস চুরি করে খেয়ে এসেও নীরা এই দরজা দিয়েই ঘরে ঢুকেছে। অথচ আজ বিকেলবেলা! এক নিমিষেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো আবার। মাথা নিচু করে সামনের দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকতে যাবে দেখে বাবা এত্তগুলো রাগ নিয়ে চেয়ারে বসে আছেন। আগের মতো নীরা মেকি হেসে বাবার কোলে ঝাপটে পড়ার আগেই কষে একটা থাপ্পড় খেলো। কাল রাতেও ঠিক ছিল সব। তবে আজ কী এমন হলো? মা মারা যাবার পর গায়ে হাত তোলা তো দূরে থাক আফজাল সাহেব কখনো নীরার সাথে ধমক দিয়েও কথা বলেনি। মেয়েটি একটু বেশি চঞ্চল। হেসে-খেলে দিন পার করে। যখন যা ইচ্ছে, ডালিম চাচার পেয়ারা গাছের পেয়ারা, নিন্নু দাদীর গাছের জামরুল, নদীতে গিয়ে গোসল। কোনো কাজেই বাধা ছিল না। পড়ালেখা ছেড়েছে অনেক আগেই। অষ্টম শ্রেণিতে থাকাকালীন স্কুলের খণ্ডকালীন শিক্ষক আতহার সাহেব।

নীরা সেই বিকেল থেকে ঘরের দরজা বন্ধ করে ভেতরে আছে। নাওয়া নেই খাওয়া নেই। অন্তরটা জ্বলে পুড়ে ছাই হচ্ছে আফজাল সাহেবের। মা মরা মেয়ে। আজ আর নিজেকে স্থির রাখতে পারেননি। মাস খানেক আগে পাশের গ্রামের মাতব্বর ছেলের বিয়ের জন্য সম্বন্ধ নিয়ে এসেছিলেন। ধীরেসুস্থে সব কাজ এগুচ্ছিল। কিন্তু ছেলের এক বন্ধু খোঁজ নিতে এসে  দেখতে পায় নীরা জামালদের আম গাছে! গ্রামের মানুষ, বোঝা বড় দায়। নীরার নাকি মাথায় গণ্ডগোল আছে। এই বয়সের মেয়ে গাছে চড়ে বেড়ায়। বিয়ে করিয়ে নিলে মানুষে কী বলবে? তাছাড়া ছেলের বাবা মাতব্বর মানুষ। বিয়েটা ভেঙে গেল নীরার। খুব ভালো ঘর ছিল। মা মরা মেয়ে, আফজাল সাহেব ভালো ঘর দেখে কন্যাদান করতে পারলেই বেঁচে যাবেন। না হলে যে পরপাড়ে গিয়েও শান্তি পাবেন না। মীরার মাকে যে কথা দিয়েছিলেন তিনি। অনেক ডাকার পরেও নীরা দরজা খুললো না। শেষমেশ আফজাল সাহেব না খেয়ে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে আছে। রাত প্রায় ন’টা। চোখে ঘুম নেমে এসেছিল হয়তো তার।

নীরা আর পারেনি দরজা বন্ধ করে রাখতে। কেঁদে এমন অবস্থা করেছে চোখের। অনেক ফুলে গেছে। গায়ে থাকা বাদামী রঙের কাপড়ে রাতের আলোতে কেমন অভাগীই মনে হচ্ছে তাকে। পা টিপেটিপে বাবার ঘরে এলো। বুকে মাথা রাখতেই আফজাল সাহেব অজান্তেই নিজের হাত বুলাতে লাগলো নীরার মাথায়। চোখের জল গাল বেয়ে পড়ছে আফজাল সাহেবের। নীরার চোখের জল তখন প্রায় শুকিয়ে গিয়েছে। মা, বাক্যটি পুরো শেষ করতে পারেননি আফজাল সাহেব। নীরা ভাবছে, বাবা তো মা রে ছাড়া বলে না। আজ কী হলো? মাথা তুলে নীরা দেখে তার বাবার হাত অসাড় ভাবে পড়ে আছে বিছানায়। এক দৃষ্টিতে উপরের দিকে তাকিয়ে আছে। বুক ফেটে যাচ্ছে নীরার। অথচ কোনো শব্দ করতে পারছে না সে। চোখ দিয়ে এক ফোঁটা পানিও পড়ছে না। বাবার লাশের পাশেই খাটে মাথা হেলান দিয়ে মাটিতে বসে আছে নীরা। পুরো রাতে ঘুম তার চোখ বুঝতে পারেনি।

পাখির কলকাকলি শোনা যাচ্ছে। মসজিদ থেকে মোল্লার আযানের শব্দ ভেসে আসছে। সকল শক্তি এক করেও নীরা উঠে দাঁড়াতে পারেনি। নামাজ পড়েই হাসেম চাচা রোজ সকালে নীরাদের বাড়ি যেতেন। ছোট বেলার অভ্যাস। প্রতিদিনের মতো আজও তিনি নীরার বাবার ঘরের দিকে যাচ্ছে। জানেন যে নীরা এতক্ষণে ঘুম থেকে উঠে সারা গ্রাম বেড়াচ্ছে না হয় ছেলে মেয়েদের সাথে দুষ্টুমি করছে। হাসেম চাচা নীরার বাবার ঘরে ঢুকলেন, তিনিও যেন দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেলেন। হাতে থাকা তছবিহ পাশে পড়ে রইলো। কেটে গেলো অনেকক্ষণ। হাসেম চাচা বাইরে গিয়ে সবাইকে খবর দিলেন। পুরো গ্রামে কান্নার রোল পড়ে গেলো। থমথমে পরিবেশ। সবসময় হাসি-খুশি থাকা শুধু নীরার কোনো সাড়া শব্দ নেই। নেই কোনো আহাজারি।

বিকেল হলো আফজাল সাহেবের জানাজা দিয়ে কবর দিতে। নীরা এখনো নিশ্চুপ। মীরার মা এসে নীরাকে নিয়ে গেলো ঊনাদের বাড়ি। দুদিন পর মীরারও বিয়ে হয়ে গেলো শহরে। নীরা এখনো নির্বাক। অনুভূতি আর চোখের পানিই তার একমাত্র সাথী। সেদিনের সব কান্না বোধহয় সারা জীবন কাঁদবে মেয়েটি।

পুরোনো দিনের ডায়েরি, স্পষ্ট করে পড়তে আব্রারের খুব কষ্টই হয়েছে। টুপ করে দু’ফোঁটা পানি ডায়েরির পাতায় পড়ে একটি শব্দ বড় হয়ে দেখ গেলো, নীরা।

ডায়েরি হাতে নিয়ে দাঁড়ালো আব্রার। তবে তিহান কোথায়? নীরা এখন কেমন আছে? সে কি কথা বলতে পারে? এসব উত্তর একমাত্র মীরাই দিতে পারবে। হ্যাঁ, ডায়েরিটি যে তার স্টিলের বাক্সে মধ্যেই ছিল। আব্রার রওনা হলো পাবনার মানসিক হাসপাতালের দিকে। বহুদিন দেখা হয় না মায়ের সাথে। বাবাও এখন তেমন খোঁজ নেয় না। পাবনায় আসতে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা লাগলো আব্রাবের। তাকে দেখেই হাসপাতালের কেয়ার টেকারর বুকে জড়িয়ে নিলো। তাকে আব্রার মামা বলে ডাকে। এবার বললো, হুম বড় হয়েছ অনেক তাই তো আর মায়ের খবর রাখো না। বলেই হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন তিনি।  আব্রার চোখের পানি মুছে ভিতরের দিকে ঢুকলো, ডেস্কে থাকা একটি লোককে জিজ্ঞেস করলো, মীরা চৌধুরী কত নাম্বার রুমে? লোকটি একবার মুখের দিকে তাকালো আব্রারের। কিছুক্ষণ নিরব থেকে ডাক্তারের কক্ষে যেতে বললো। এবার বেশ বিরক্ত হলো আব্রার। অনেক দিন পরে এসেছে তাই মাকে কোন রুমে রেখেছে তা জানে  না। না হয় এতক্ষণে দৌড়ে চলে যেতো। আব্রার বিরক্তির ভাব নিয়ে ডাক্তারের রুমে গেলো। আব্রারকে দেখে ডাক্তার সাহেব চোখ থেকে চশমাটা খুললেন, রুমাল দিয়ে চোখের পানি মুছলেন। কাছে এসে আব্রারকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। আব্রার খুব অবাক হচ্ছে আর বিরক্তও। আগে তো মায়ের সাথে দেখা করতে এত কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। বাবাকে সে গিয়েই বলবে অন্য কোনো জায়গায় মাকে নিয়ে যেতে। ডাক্তার সাহেব আব্রারেরর বাঁ হাতে শক্ত করে ধরে বললেন, চলো।

দুজনে কবরস্থানে গেলেন। দাঁড়ালেন তেইশ নম্বর পিলারের সামনে। কালো একটি বোর্ডে সাদা রঙে লেখা– “মীরা চৌধুরী “!


 

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu