আতিকুর ফরায়েজী
সহযোগী সম্পাদক, দর্পণ। জন্ম ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে। চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার নওদাবন্ডবিল গ্রামের দোয়ারপাড়াতে তার জন্ম। তিনি একজন তরুণ কথাসাহিত্যিক, কবি এবং ওয়েব ডেভলপার।
আতিকুর ফরায়েজী

অসম

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

আমার ভবিষ্যতের ভাবনায় গ্রামের মানুষের কৌতুহলের সীমানা অনেক বড় ছিল। তারা প্রায়ই আমাকে নিয়ে অতিবাস্তবপ্রসূত বাণী নিসৃত করত। বড় হয়ে ডাক্তার হবো, কেউবা বলত ইঞ্জিনিয়ার, আবার যারা একটু বোদ্ধা ছিলেন তাদের কেউ কেউ বলতেন– আমি নাকি একজন সমাজ সংস্কারক হবো; আমার মধ্যে তারা সে গুণগুলো দেখতে পান। কিন্তু আমি জানতাম, আমি ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার কোনোটাই হতে পারব না। কারণ আমি যখন নবম শ্রেণিতে তখন মানবিক শাখার একজন ছাত্র ছিলাম। তবে ইচ্ছা করলে আমি সমাজ সংস্কারক হতে পারতাম। কিন্তু সেটাও হইনি। যেটা হয়েছি, সেটা কখনো কেউ অনুধাবন করেনি; আমাকে কখনো কেউ পরামর্শও দেয়নি। সবাই ভাবত, আমি সমাজটাকে পরিবর্তন করতে পারব। আমার মতো তরুণরা যদি সমাজ সেবা করে, তবে আমাদের সমাজ অনেকদূর এগিয়ে যাবে। তাই মুরুব্বিরা আর্শিবাদ দিত– বাবা, মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া কর, বড় মানুষ হতে পারবে; ভালো একটা চাকরি পাবে, আমাদের সমাজে আলো জ্বালাতে পারবে।

মানুষের আকাঙ্ক্ষা স্থির নয়। এর কোনো শেষ নেই। যত দিন যাই তা পরিবর্তন হতে থাকে। সকলের আকাঙ্ক্ষা এবং উদগ্রীবতা দেখে আমার মনে ধীরে ধীরে সমাজ সংস্কারক হবার প্রতি একটা প্রবল আকর্ষণ মাথা উচিয়ে দাঁড়াতে শুরু করে। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি আমাকে ক্রমাগত ডাকতে আরম্ভ করে। সে অদৃষ্ট আহ্বানকে আমি এড়িয়ে যেতে পারিনি। ভাবনা, উদগ্রীবতার মাঝ থেকে আমি একসময় ডিসাইড করে ফেলি, তবে সমাজ সংষ্কারকই হই।

আমার এই ভাবনাটাকে স্কুলের শিক্ষকেরাও সাধুবাদ জানিয়েছিলেন। তাদের মতে একটা সমাজকে সুন্দর করে সাজাতে পারে কেমলমাত্র তরুণ সমাজই এবং আমার মধ্যে নাকি তারাও সেই ছাপ দেখতে পায়। তখন বন্ধুদের মধ্যেও অনেকের উৎসাহ পেয়েছিলাম। মানুষের মন পারস্পার্শিক বিষয় দ্বারা প্রভাবিত হয়। আমারও হয়েছিল। তাই ইচ্ছাটা আরও প্রবল হয়ে হৃদয়ে দানা বাঁধতে শুরু করে।

আমাদের স্কুলে তিনটা বিল্ডিং আছে। আমরা যে বিল্ডিংটাতে ক্লাস করি, সেটা টিনের চারচালা। পিছন দিয়ে কদমের কয়েকটা গাছ কীসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তখন তা আমার অজানা। বর্ষার সময় এই ক্লাস রুমকেই আমার একান্ত সঙ্গী হিসেবে মনে হয়। কদমের ঘ্রাণ রুমময় এক মাতাল আবহ তৈরি করে। টিনের চালে বৃষ্টি পতনের যে মধুর শব্দ ঝুম ঝুম শব্দ আর কদমের ঘ্রাণ, তা বার বার আমার মনে শিহরণ জাগিয়ে যায়। যেটা আমার অনেক পছন্দের। এই মধুর শব্দে কদমের ঘ্রাণ যে কী অনবদ্য ঢেউ তোলে আমার প্রাণে তা আমিই একমাত্র জানি। তা ভাষায় প্রকাশের বস্তু নয়। আমি সারা জীবনে যা কিছু উপভোগ করেছি তাদের মধ্যে এই মূহুর্তগুলো সবার উপরে একটা পাকাপোক্ত স্থান দখল করে রেখেছে।

এমনই এক বর্ষার দিনে ক্লাস নেই। রুমের জানালা দিয়ে বৃষ্টি পতনের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করছি। দমকা বাতাশে যেন কার চুলের ঘ্রাণ উড়ে এলো। উচ্চস্বরে যুবতী কণ্ঠ বলছে– আর দুইটা, তারপরে আর বলব না। আগ্রহ নিয়ে সেই দিকে মুখ ফিরালাম। আজ পর্যন্ত আমি যত সৌন্দর্য দেখেছি, এই সুন্দরের কাছে যেন তা সবই ম্লান হয়ে গেল। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ যেন কোথায় হারিয়ে গেল। জানালার বাইরে বৃষ্টিতে ভেজা চুল পিঠে লেপ্টিয়ে আছে, রাঙা আচলে কদমের মাখামাখি। আমার মনে রঙের মাতম লাগিয়ে গেল। বিশ বাইশ বছরের যুবতি কাকে যেন বার বার অনুরোধ করছে আরও কিছু কদম দেবার জন্য। আর উপর থেকে কে যেন বিরক্তির ছলে তার অনুরোধকে বারবার অবজ্ঞা করছে। সে তেতো কণ্ঠে এড়িয়ে যায়– আর পারব না, অনেক পেড়েছি। আমি নেমে আসছি। তবুও অনুরোধ প্লিজ আর দুইটা দে, ভাই। লক্ষ্মী ভাই আমার। সত্যি বলছি দুইটা দিলে আর বলব না। তারপর গাছ বেয়ে সড়াৎ করে দশ বারো বছরের ছেলে নেমে আসলো। তারপর দুজনে মূহুর্তের মধ্যে মিশে গেল বৃষ্টির ফোয়ারার মাঝে।

এক দিন, দুই দিন করে এক সপ্তাহ চলে গেল। আমি মেয়েটিকে আর একবার দেখার জন্য অপেক্ষা করে আছি। ভাবি– আজ হয়ত কদম নিতে আসবে। আসে না। ভাবি– তাহলে কাল আসবে। আসে না। তারপর আবার একদিন প্রবল বারিধারা শুরু হলো। ভাবলাম– আজ হয়তো আসবেই। চাতক হয়ত বা বৃষ্টির অপেক্ষায় থাকতে থাকতে একদিন ঠিকই বৃষ্টির দেখা পায়। কিন্তু এই বাদলঘন শ্রাবণে আমার চাতকি এলো না। মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি বাসা বাঁধতে বাঁধতে পাহাড় সমান হয়ে গেল। তবুও বালিকার দেখা নেই। কোনো কিছুতেই মন স্থির করতে পারছিলাম না।

যখন আশা ছেড়ে দিলাম– হয়তো আর আসবেই না। তখন আবার লক্ষ আমাকে হাতনাড়া দিয়ে আহ্বান জানাল। আমাকে তো সমাজ সংস্কারক হতে হবে।

আমাদের তৃতীয় শ্রেণির সমাজ। এটাকে ধুয়ে মুছে পরিবর্তন করতে হবে। এখানে সমস্যার অন্ত নেই। প্রতি পদক্ষেপে সমস্যা। বর্ণ প্রথায় সমস্যা, ধর্ম প্রথায় সমস্যা, বিবাহে সমস্যা, মাদক আধিপত্যের সমস্যা। সমস্যা সমাজের প্রতিটি কোণায় কোণায়।

স্কুলে কিছু ছেলে মিলে সামাজিক সংগঠন তৈরি করলাম। আমাদেরকে এই কাজে স্কুলের শিক্ষকেরা অভিবাদক জানিয়েছিলেন। সহযোগিতাও করেছিলেন তারা যতটা পারে। গ্রামের অনেক যুবক অনুপ্রাণিত হয়ে আমাদের সাথে যুক্ত হতে থাকে। তখন চোখে মুখে সমাজ পরিবর্তনের প্রবল আত্মবিশ্বাস ছিল। একটা রঙিন সমাজের স্বপ্ন আমাদের মতো কিছু সম্ভবনাময়ী তরুণের মুখে দেখে গ্রামের অনেকেই সেদিনও বলেছিল– এই ছেলেই হবে আমাদের আগামী দিনের পথ প্রদর্শক।

দুই.

প্রতিদিন যে কণ্ঠের জন্য অপেক্ষা করেছি, সে কণ্ঠ আমার কানে আর একদিনও বাজেনি। যে ঘ্রাণের জন্য অপেক্ষা করছি, সেদিনের পরে তাও আর বিকশিত হয়নি; সে ভেজা চুলের কলিও আর দেখা দেয়নি। তাই ধীরে ধীরে সেই একদিনের কদমওয়ালীর কথা তখন ভুলতে বসেছি। হয়ত ভুলেই যেতাম, যদি সেদিন কদম তলায় বন্ধুদের আড্ডার মাঝে কানে ভেসে না আসত গানের দু’কলি– বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল, করেছ দান।

বর্ষা আসেনি, কিন্তু আমার প্রাণে শ্রাবণধারা এসেছে। ভুলে যাওয়া সেই কলির কণ্ঠ আবার জেগে উঠেছে। সেই তৃণভাষীর সন্ধানে মন উতলা হয়ে উঠেছে। মনে হলো, এই তো পেয়েছি। যা, শ্রবণ করলাম, তা আমি আজও শুনিনি। যে সুভাষিনী আমার মনে বাদল আনল, তার মুখ আমার আজও দেখা হয়নি। সে বর্ণ দর্শন না করলে মনের মধ্যে যে সমাজ রয়েছে, তাকে পরিবর্তন করব কি করে! সে সমাজের প্রতি আমার দায়িত্ব অবহেলিত হবে যে। একজন সমাজ সংস্কারক হিসেবে আমি কখনোই এটা করতে পারি না।

পরের দিন স্কুলে আসার পথে অনুসন্ধান করলাম– সেই কদমবালিকার নাম অরুণী। স্কুলের পাশে সাদা রঙের যে দোতলা বাড়িটা আছে, সেখানেই থাকে। মনে আমার পুলক দিয়ে গেল। বৃষ্টিভেজা কাকতাড়ুয়ার মতো থমকে দাঁড়ালাম। তারপর ধীরে ধীরে স্কুলের দিয়ে ফিরে এলাম।

তারপর থেকে প্রতিদিন স্কুলে আসা আর যাওয়ার মাঝখানে ওই বাড়ির জানালাই তাকিয়ে থাকি। যদি কোনো দিন অরুণীর সাথে দেখা হয়ে যায়। যদি দুটো কথা বলতে পারি– তাহলে তাকে বলবো– আমাকে বলো, আমি তোমাকে আচল ভরে কদম এনে দেব। অবশ্য একদিন দেখাও হয়েছিল। সেদিন মনমরা হয়ে অরুণী জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল ওই কদম গাছগুলোর দিকে। মনে খটকা লাগল, এখনো তো বর্ষা আসেনি, তাহলে কদম গাছের দিকে এভাবে তাকিয়ে আছে কেন? ভাবলাম, এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করি– তর কি আর সইছে না? হৃদয়ে ধুকধুকানি সেদিন যে কতটা বেড়েছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সাহস করে এক পা এগিয়েও গেলাম। হৃদয়ে আমার তখন মাত্রাতিরিক্ত কম্পন চৈত্রের দুপুরে ধু-ধু শ্মশানে তৃষ্ণার্ত শাবকের মতো অবস্থা করে তুলল। তারপর আর সাহস পেলাম না। মনে মনে বললাম– আজ থাক, অন্যদিন বলব। বর্ষা আসুক, কদম পেড়ে নিয়ে গিয়ে বলব।

তারপর অনেকগুলো বর্ষা এসেছে, কিন্তু তাকে কদম দেওয়া হয়নি। সেও আর কদম গাছের দিকে তাকিয়ে থাকেনি; কদম তলায় ভেজা চুলে এসে দাঁড়ায়নি। আমি লেখাপড়া শেষ করেছি। সমাজ পরিবর্তন করতে পারিনি কেননা, আমার অবহেলায় সংগঠনটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। হুম, একটা চাকরি পেয়েছি, তবে বড় নয়। মাধ্যমিক স্কুলের অফিস সহকারি কাম কম্পিউটার অপারেটর। সকাল ৯ টায় স্কুলে এসে দুপুর আড়াইটাই বের হয়ে যাই। মাস শেষে হাজার পনের টাকা বেতন পাই। আর অবসরে রুমের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকি। সেখানে আর কদমগাছগুলো নেই। সেগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। ওইখানটাতে কয়েকটা বাড়ি উঠেছে। তবু জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আমি সেই ভেজা চুলওয়ালীর রাঙা আচল ভর্তি কদমের ঘ্রাণ পাই। দুচোখ ভরে সেই দৃশ্য অবলোকন করি।


 

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu