কী মামা, আবার চা খাইতে আইছেন নাকি?
তাচ্ছিল্যপূর্ণ কথা যদি কোনো সম্মানিত ব্যক্তি কিংবা উঁচু দরের লোক বলে, তখন কথাগুলোকে খুব কষ্টসাধ্য মনে হলেও গিলে ফেলা যায় অনায়েসে। অথবা একাজ করতে আমি বাধ্য। কিংবা এতটুকু বলে সান্ত্বনা দেয়া যায় যে, যা করার মুখ দিয়েই তো করে ফেলেছে, ভাগ্যিস হাতের ব্যাবহার করেনি! করলে লজ্জায় মাটি ফাঁক করে ঢুকে যেতে মন চাইতো তখন।
কিন্তু এই নামকরা জুরাইন রেলগেট, গন্ধমাখা মাছের বিশাল আড়ত আর তার পাশেই অত্র এলাকার নামকরা “টিপটপ হোটেল” এর একজন ওয়েটারের এমন সুগন্ধযুক্ত কথা যে কারো শোনার সাথে সাথেই মেজাজ খারাপের ডিগ্রি বেড়ে যাবে।
***
আমাদের ব্যাচমেট যে শিবু আছে, ওর বাসা এখানে। ক্লাসের ফাঁকে কোনো দিন খাবারের কথা উঠলেই শিবু বলতো চল আমাদের ওখানে একটা হেব্বি হোটেল আছে, নান খাওয়ার পর যদি তুই বলিস ভালো হয় নাই তাইলে পুরো বিল আমি দিয়ে দেবো। ওর প্রচুর আগ্রহ থাকলেও আমরা ঠিকই রাস্তার জ্যামের কথা ভেবে এমনিতেই দমে যেতাম। সাথে এই জগন্নাথের ক্লান্তিভরা ক্লাস শেষে বাসায় কিংবা মেসে না গিয়ে রেস্টুরেন্টে যাবে? কেউ ভাবে না এসব। তাই আর যাওয়াও হয়ে ওঠে না। অথবা গেলেও কেউ কাউকে না বলেই চলে যায়। আর না বলে চলে যাওয়ার বিষয়টা সবাই বুঝেছিলো যেদিন, সেদিন সবাই চুপচাপ থেকে সময়টা পার করেছিল। কারণ কথা বলতে গেলেই টিপটপ হোটেলে না বলে যাওয়ার ব্যাপারটা উঠে আসবে। সাথে ঠাট্টা তামাশার ব্যাপারটা তো আছেই!
শিমুল ব্যাগে একটা পার্সেল তেহারি এনে রেখেছে। ক্লাসের ভেতর স্যার যখন সবাইকে নোট করতে বললো তখন পার্সেল খাবারটা পাশে রেখে তারপর খাতা বের করছিল শিমু। ঘ্রাণের ঝড় ধীরে ধীরে বাড়ছে। আমরাও সমান তালে অস্থির হচ্ছি। আর প্যাকেটের গায়ে যে সুন্দর করে “টিপটপ হোটেল” লেখা ছিল সেইটা হয়তো বেচারা শিমুল খেয়ালই করেনি! আর এর ফাঁকেই কেল্লা ফতে! ক্যাপ্টেন ইমুর ইশারা পেয়ে সবাই চুপচাপ শান্ত বালকের মতো বসে ক্লাস শেষ করলো। শিমুল বাসায় যাওয়ার পথ ধরার পর পরই শুরু হলো জমিয়ে রাখা হাসির পাত্র খুলে আকাশে ছুঁড়ে দেবার পালা।
এই চুপচাপ শিমুলকে কখনো কিছু বলি না আমরা। কেন? এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। ওকে শুধু দেখি আমরা। মোটা গ্লাসের কালো চশমাটা ওর বয়সকে খানিক বাড়িয়ে দিয়েছে কিনা!
***
রাগ কিংবা জিদ চেপে থাকলে শরীরের শক্তি নাকি এমনিতেই বেড়ে যায়। আমারও তাই হয়েছিল মনে হয়। ওয়েটারের তাচ্ছিল্য মার্কা কথা শুনে ‘ঐ কুত্তার বাচ্চা এত্ত কথা বলিস ক্যান?’ বলেই কষে একটা থাপ্পড় মেরে দিলাম! জিদে শরীরের কাঁপাকাঁপি তখনো কমেনি।
হোটেল মালিক এসে যখন ঠান্ডা মাথায় বলল, “দেখো বড়দের গায়ে হাত দেয়া কিন্তু ঠিক না, তারপরে আবার অপরিচিত জায়গায় এসে অপরিচিত একজনের গায়ে হাত এগুলা কিন্তু কেউ সহ্য করবে না, ভালো লাগেনি এই হোটেলে খাবে না– কেউ তো তোমাকে জোর করে ধরে রাখেনি!” মালিকের কথা শুনে মনে হলো– গমগম করে জ্বলতে থাকা চিতায় কেউ হয়তো অভিমানে গঙ্গাজল ঢেলে সব ঠান্ডা করে দিল! হালকা ধোয়া, পুরুট সাদা ভাব হুট করেই ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলেন তিনি!
কী মনে হলো, হঠাৎ মাথা নিচের দিকে করে, সরি কাকু! হেব্বি ভুল হয়ে গেছে বললাম। এখন আবার লজ্জা পাচ্ছে! থাপ্পড় দেয়া ওয়েটারকে কাছে ডেকে হাত ধরে যখন “সরি কাকু!” আরেকবার বললাম, মুহূর্তেই সব ফিনিশড। আরে না, এমন হয় মাঝে-মধ্যে! বাইরে রাগারাগি হয়েছে নাকি কারো সাথে?
এবার আমি চুপচাপ। যেন অনুগত কোনো দাস তার বিশ্বস্ত মনিবের সামনে আদেশের অপেক্ষায় অপেক্ষারত। সময় গড়াচ্ছে। সামনে গ্রিল আর নান রুটি। একটু একটু করে ছিড়ে মুখে দেয়ার চেয়ে “কেন এমন হলো?” এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমি আরও ব্যস্ত হতে থাকি, সময়ে সময়ে আরো নিদারুণ অধৈর্য হই।
***
হাসিব কান্তনু। কোনো এক অপরিচিত মাসিক পত্রিকার সম্পাদক। হাসিখুশি প্রাণচঞ্চল এই মানুষটি কবিতা লেখেন। গদ্য কবিতা। আমি এযুগের কবিতার আগামাথা কিছু বুঝি না। তারপরেও এই লোকটার কবিতা পড়তে পড়তে অন্য কিছু মাথায় আসে। সেটা হলো সম্পাদনার মতো প্রশস্ত একটা ময়দানে তার কতো সহজ পদছায়া। সহজলভ্য কথা বলে সবাইকে কতো সুন্দর মাতিয়ে রাখেন তিনি। আমি অবশ্য কখনো কোনো সম্পাদকের স্বভাব চরিত্রের বিষয়টাকে প্রাধান্য দিইনি। এইযে এই হাসিব শান্তনু, তার ব্যাপারেও না।
— সম্পাদকদের বেশিরভাগই কেন কবি হয়?
— আর যারা কবি বা সাহিত্যিক তাদের রুচিভেদই বা এত নিম্নমানের হয় কেন?
গল্প করতে করতে রাস্তায় যখন হাঁটছি তখন এই প্রশ্নগুলো ছাড়াও আরো ভিন্ন ধরণের কথাবার্তাতেও মশগুল হচ্ছি। হাসছি, পায়ে সুড়কি নিয়ে লাথি দিয়ে অনেক দূরে কোথাও সরিয়েও দিচ্ছি এর ভেতরে। কিন্তু শেষ কথা কিংবা মূল সাবজেক্ট হিসেবে সম্পাদক সাহেব আমার উপরোক্ত প্রশ্নগুলোকেই মূল ভেবে নিয়েছেন ; ব্যাপারটা এতক্ষণে সুস্পষ্ট হলো আমার।
ভাই, হোটেলে ঢুকেন! হাতের বামে আন্ডারগ্রাউন্ডে যে হোটেল আছে ওখানে গিয়ে বসব আমরা। ওকে?
বাধ্য মানুষের মতো মাথা দুলিয়ে বসে গেলাম। এবার “কী খাবেন, বলেন?”
আরে না, আপনি অর্ডার দেন। আবারো তাড়া দিলেন, বলেন কী খাবেন?
হালকা কিছু নেন ভাই, বলে চুপচাপ থাকলাম। লেখক সাহিত্যিকদের পেছনে টাকা খরচ করা, ব্যাপারটা একদম ফালতু এবং এগুলো করলে করতে হয় একদম নিঃস্বার্থ। স্বার্থ বা কোনো উদ্দেশ্য পূরণের জন্য এদের পেছনে টাকা ঢাললে যে শুধু কিছু অর্থকেই জলে ফেলা হবে আর অপচয়ও করা হবে সেটা আমি এতদিনে বুঝে হাড্ডিসার হয়ে গেছি।
মনে মনে এসব ভাবতে ভাবতে চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়েই দেখছি কাপে লেখা “টিপটপ হোটেল”। পিরিচেও সেইম লেখা।
উন্মুখ হয়ে থাকা পত্রিকাটা হাতে দেয়ার সাথে সাথে লেখক সূচিতে চোখ বুলাতে শুরু করলাম। অবশ্য শেষ করার আগেই “আপনার লেখাটা এ মাসে দিতে পারিনি ভাই” কথাগুলো শুনতে হলো। এগুলোতে আমার কোনো বিকার কিংবা অদ্ভুত আচরণের নিয়মগুলো মাথায় আসে না। আবার চুপচাপ বসে অন্য কথায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ি।
ওয়েটারকে যখন শুধু চায়ের অর্ডার দেয়া হয়, মনে হলো সূর্যকে কেউ লাঠি দিয়ে দৌড়ানি দিয়েছে। না হলে হঠাৎ এই মেঘের দলা ওয়েটারের মুখে সে পড়বে কীভাবে? এই সাধারণ একটা খাপছাড়া বিষয়কে ভুলে গিয়ে সম্পাদককে বিদায় দিয়ে আসি।
রাগে এখন নিজের উপরেই; সব জিদ ঝাড়তে ইচ্ছে করছে। ক্লাস মিস দিয়ে কারো সাথে চা খেতে আসার লোক আমি না। তারপর আমার লেখা যেখানে আসেনি, সেই পত্রিকা হাতে তুলে দেয়ার জন্য এত সম্মানের সহিত আমাকে ডাকারও কোনো প্রয়োজনবোধ আমি অন্তত করি না।
***
দ্বিতীয়বার যখন হোটেলে ঢোকার সাথে সাথে “কী মামা, আবার চা খাইতে আইছেন নাকি?” এই কথা বলল তখনই এই উদ্ভট কান্ডটা ঘটে গেল। একজনের উপরের রাগ কিংবা অসম্পর্কীয় আচরণ অন্যজনের উপরে ওঠানোতে আমার মাথা এখনো নিচু। শিরদাঁড়াহীন কোনো জড় বস্তুতে নিজেকে পরিণত মনে হচ্ছে!