কালা মিয়া তার ছাতাটা ডান দিকে একটু কাত করে দেয়, বৃষ্টির ছাটটা যাতে একটু কম লাগে। সামনে গোটাকতক পাকা তাল নিয়ে বসেছে সে। সাদা একটা পলিথিন দিয়ে যতটুকু ঢাকা যায় ঢেকে রেখেছে। তার পাশেই গনি মিয়া বসেছে, কাঁচা পাকা কিছু পেয়ারা, দুধ কচুর পাতা, কয়েক আঁটি পুঁইশাক নিয়ে। বিড়ির শেষ টানটা দিয়ে দূরে ছুঁড়ে দেয় গনি মিয়া। রহিম কাজি হাঁক ছাড়ে, ও মিয়ারা কত কি বেচলা? কালা মিয়া এক মুখ থুথু ফেলে উত্তর দেয়, “না রে ভাইজান, আইজ বেচাকিনা নাই। দেওয়ার যা ভাব দেখতাছি আইজ, তাতে তো বাড়ি যওয়াই দুশকর অইব।” হ হ ঠিক ই কইছ, পালটা জবাব দেয় গনি মিয়া।
ফুলসুতি বাজার। মেইন রোডের দুইপাশে বসেছে এই বাজার। প্রতি মঙ্গলবার আর শুক্রবার হাট বসে। আজ মঙ্গলবার। অন্যান্য দিনের মত আজও প্রচুর জিনিস এসেছে হাটে। তবে লোকজন তুলনামুলকভাবে কম। দুপুর থেকেই আকাশে মেঘ ছিলো, কিছুক্ষণ আগেই শুরু হয়েছে বৃষ্টি।
ছাতা মাথায় কেউ কেউ প্রয়োজনীয় জিনিস কিনছে। ছোট ছোট টিনের চালার নিচে বসেছে বিস্কুট আর চানাচুরের দোকান। দোকান গুলোর সামনে বসেছে মিষ্টি কুমড়া , কাঁচকলা, বরবটি, পটল, কাঁচামরিচ আর ঝিঙের দোকান। একটু সামনে বসেছে কয়েকটা আখের দোকান, আখের রস বিক্রি করছে ছাতা মাথায় দিয়ে দুজন লোক। রাস্তার ওপাশে লাউ আর শীমের চারা নিয়ে বসেছে অনেকে। পাকা কলার দোকান এসেছে প্রচুর, বসে বসে নিজের দোকানের কলা খাচ্ছে কেউ কেউ। মুশুড়ি, সরিষা, গমের বস্তাগুলো মোটা পলিথিন দিয়ে ঢেকে রেখে বড় দোকানগুলোর নিচে বসে গল্প করছে কিছু লোক। বৃষ্টির তীব্রতা বেড়ে যায় হঠাৎ করেই। খোলা দোকানগুলো যে যার জিনিপত্র কাগজে ঢেকে রেখে নিরাপদ জায়গায় গিয়ে বসে। মুহূর্তেই অন্ধকার ঘনিয়ে আসে চারপাশে, ঝড়ো বাতাসে উড়িয়ে নিতে চায় সবকিছু। বিদ্যুৎ চমকাতে থাকে ঘন ঘন। হঠাৎ করেই ভয়ংকর অবস্থা তৈরি হয়ে যায়। বড় দোকানগুলোর চালার নিচে আশ্রয় নেয়া মানুষগুলো সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করতে থাকে। এক হুজুর দাঁড়িয়ে মোনাজাত ধরে দোয়া পড়তে থাকে জোরে জোরে। রাস্তায় হাঁটু পানি জমে গেছে এরই মধ্যে। রিক্সাওয়ালারা হুট টেনে দিয়ে কাগজ মুড়িয়ে সীটের উপর বসে আছে। সন্ধ্যা নেমেছে, মাগরিবের আযান ভেসে আসছে মোড়ের মসজিদ থেকে।
অন্ধকারের সাথে বৃষ্টির শব্দ একাকার হয়ে কেমন যেন থমথমে একটা পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। দোকানে দোকানে মোমবাতির আলো সেই থমথমে পরিবেশে যোগ করছে নতুন মাত্রা। দুএকটা দূর পাল্লার গাড়ি হেড লাইট জ্বালিয়ে নিমেষে উধাও হয়ে যাচ্ছে।
ঠিক সেই মুহুর্তেই একটা বাস এসে দাঁড়ালো বাজারটার একটু সামনেই। সব লাইট বন্ধ করে তিন চারজন লোক কি একটা ধরাধরি করে ফেলে দিল বাস থেকে। আর সাথে সাথেই সাই করে বের হয়ে গেল সেখান থেকে, সবার অলক্ষে। বৃষ্টি একটু কমে এলে যে যার মতো বাড়ির দিকে রওনা দেয়, দোকানপাট সব বন্ধ করে। বৃষ্টি বাড়তে থাকে রাত বাড়ার সাথে সাথে।
ফুলসুতি বাজারের পাশে ছোট ঝোপটার ভেতরে পড়ে থাকে রক্তাক্ত একটা মানুষ, না একজন নারী… একটা মেয়ে! সারারাত বৃষ্টির পানিতে ভিজে কাঁপতে থাকে, শীত করতে থাকে মেয়েটার। চোখ মেলে তাকায় একবার, শুধুই অন্ধকার দেখে চোখ বন্ধ করে সে। কিছুই মনে পড়ছে না তার, কে সে, কোথায় আছে এখন? শূন্যতা শুধু মাথার ভিতরে, হাওয়ায় ভাসতে থাকে যেন। হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে মেঘেদের কাছে চলে যায়, মেঘেরাও লুকোচুরি খেলে ওর সাথে। এক ঝাঁক পাখি এসে ভাসতে থাকে ওর সাথে সাথে, একটা পাখি রংধনু থেকে এক মুঠো রঙ এনে মাখিয়ে দেয় মেয়েটার সারা শরীরে। কেমন যেন গন্ধ সে রঙ-এ, তীব্র আর আঁশটে। বমি আসতে চায় ওর। আবার একটু চোখ মেলে তাকাতে চায়, পারে না তাকাতে। আঠালো কিছুতে আটকে আছে চোখ। আবার চোখ বন্ধ করে ফেলে। হারিয়ে যায় অসীম শুন্যতায়।
এবার চোখ খুলে দেখে সাদা ধবধবে বিছানায় শুয়ে আছে সে। পাশে একটা চশমা পরা সুন্দর মহিলা বসে আছে। সে কি স্বপ্ন দেখছে? চোখ বন্ধ করে আবার তাকিয়ে ওই মহিলাকেই দেখতে পেয়ে ভাবে, না সে স্বপ্ন দেখছে না। উঠতে গিয়েও পারে না, শরীরে প্রচন্ড ব্যথা। চশমা পরা মহিলা মাথার কাছে এসে পরম মমতায় হাত বুলাতে থাকে। নাম কি তোমার? জানতে চায় । আঁখি আমার নাম, মনে পড়ে যায় আঁখির সব একের পর এক। চশমা পরা মহিলাকে সে জানায় সব।
আঁখি গ্রামের মেয়ে, দশ ভাইবোনের সংসারে যখন পড়ালেখা বন্ধ হতে বসেছিল, কি পরিশ্রম করে যে সে এইচ এস সি পাশ করেছে! তা এক দমে বলে যায়, বলেই হাঁপাতে থাকে। চশমা পরা মহিলা ওকে পানি খেতে দেয়, পানি খেয়ে আবারও বলতে থাকে আঁখি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে যাচ্ছিল আঁখি, পথে একটা ডাব কিনে খেয়েছিল গাড়িতে বসে, তারপর… তার যখন জ্ঞান, ফিরে তখন দেখে গাড়ির সিটের সাথে হাত পা বাঁধা। একটার পর একটা লোক ওকে ছিঁড়ে খেয়েছে যেন। অনেক কেঁদেছে আঁখি, ছাড়েনি ওরা। বৃষ্টি থাকায় ওর কান্নাও কেউ শুনতে পায়নি। বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে উঠে আঁখি। চশমা পরা মহিলা একটা হাত আস্তে করে ধরে ওর, তুমি কেন কাঁদছ? এতে তোমার তো কোনো দোষ নেই। অন্যায় যারা করেছে কাঁদবে তারা, তুমি নও। আমি এখানকার একটা স্কুলে পড়াই। জেসমিন নাম আমার। তুমি আমার বাড়িতেই আছো। ভয় নেই তোমার। সকালে হাঁটতে গিয়ে তোমাকে দেখি আমি, গ্রামের মানুষের সাহায্যে তোমাকে নিয়ে আসি আমার বাড়িতে, ডাক্তার এসে দেখে গেছে, ভয় নেই আর।
আঁখি এসব কথা ভ্রুক্ষেপ না করে আপনমনে বলতে থাকে, আমাকে কেন বাঁচালেন আপা? এর থেকে মরে যাওয়া অনেক ভাল ছিল। আমি কী করে সবার সামনে গিয়ে দাঁড়াব? কেউ মেনে নেবে না আমায়, সবাই ঘৃণা করবে আমায়। আমার পরিবারকেও আমার জন্যে সমাজে ছোট হতে হবে। আমার মরে যাওয়াই ভাল ছিল।
জেসমিন উঠে আঁখির কাছে গিয়ে বসে। বলতে থাকে, তুমি মরে যেতে চাও? যাও, আমি বাঁধা দেব না তোমায়। শুধু এটুকু বলতে চাই, তুমি ইচ্ছে করে যা করনি তাতে তোমার কোন দোষ নেই। তোমার ঘরে কেউ চুরি করলে সেই দায় তোমার নয়, চোরের। জোর কোরে কারো অসহায়ত্বের সুযোগে কেউ যদি কারো ক্ষতি করে, তবে দোষটা কার বলতো? তুমি কি সত্যিই নিজেকে অপবিত্র মনে কর? মরে গেলেই কি সব সমস্যার সমাধান হবে? তুমি মাথা উঁচু করে বাঁচবে, যারা তোমার সাথে অন্যায় করেছে তারা ঘৃণিত হবে সমাজে, আজ তুমি মরে গেলে কাল অন্য কারো সাথে এটা হবে, পরশু আরো একজনের সাথে। তুমি, আমি, আমরাই পারি রুখে দাঁড়াতে, নিজেকে অপবিত্র না ভেবে ওদের অপবিত্র ভেবে ঘৃণা কর, যারা মেয়েদেরকে অপবিত্র করার এ নোংরা খেলায় মেতেছে। চিহ্নিত কর ওদের… যাতে সমাজে ওরা সবার ঘৃণা নিয়ে বাঁচে।
আঁখি উঠে দাঁড়ায়, সোজা হাঁটতে থাকে দরজার দিকে, জেসমিন জানতে চায় কোথায় যাচ্ছ? থানায় যাব, উত্তর দেয় আঁখি। ওর কথায় এতটা আত্মবিশ্বাস ছিল যে চমকে উঠে জেসমিন। দরজায় দাঁড়িয়ে ওর চলে যাওয়া দেখতে থাকে…