ক্র্যাচে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ান নুরুল আমিন। জেল কর্মকর্তা ডেকে পাঠিয়েছেন। সেন্ট্রি এসেছে সাথে করে তাকে নিয়ে যেতে।
তিনি ভেবে পান না হঠাৎ তার ডাক পড়লো কেন। বরাবরের অন্তর্মুখী নুরুল আমিন জেলে এসে আরো গুটিয়ে গেছেন। তার সেলে আর যে দু’জন কয়েদি আছে তাদের সাথেও খুব একটা কথা বিনিময় হয় না। শৃংখলা ভঙ্গেরও কোনো অভিযোগ নেই। তবে তার ডাক কেন?
তিনজন কয়েদির এই সেলে তার সাথী বলতে এই ক্র্যাচ আর বিভিন্ন সময়ে অন্যান্যদের দিয়ে আনিয়ে নেয়া কিছু বই। কবিতা কিংবা গল্প উপন্যাসের বই নয়। মার্ক্সবাদ, ইউরো সোশ্যালিজম আর ল্যাটিন আমেরিকার সমাজ বিন্যাস নিয়ে কিছু বই। সংখ্যায় তেমন কিছু নয়। এই কয় বছরে এই বইগুলো বারবার পড়তে পড়তে প্রায় মুখস্ত হয়ে গেছে। এধরনের বই তার সাথী সেই কিশোর বয়স থেকেই। তবে ক্র্যাচের সাথে ভাব হয়েছে জেলে আসার আগে। দেশে তখন এরশাদের স্বৈরশাসন। বড় বড় দলগুলোর সাথে ছোট ছোট অনেক দলও স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলনে লিপ্ত। কেউ জোট বেঁধে আবার কেউবা একক ভাবে। ঠিক তেমন একটি ছোট বামদলের মুক্তাগাছা এলাকার মাঝারি পর্যায়ের সংগঠক নুরুল আমিন। সেদিন শহরে সর্বদলীয় বিক্ষোভের কর্মসূচি। নুরুল আমিনের দলও একটি ছোট মিছিল নিয়ে উপজেলা প্রশাসন কার্যালয় ঘেরাও করতে যাচ্ছিল। সেই মিছিলে পেছন থেকে ব্রাশফায়ার করলো একদল ভাড়াটে সন্ত্রাসী। সবাই যে যার মতো দৌড়ে পালালো। নুরুল আমিন পারলেন না। তার বাঁ পা ঝাঁঝরা হয়ে গেছে কয়েক ডজন গুলির আঘাতে। পুলিশ এসে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেল। এরপর পুলিশ পাহারায় এক মাস হাসপাতালে কাটাতে হয়েছে। ডাক্তাররা সেই পা বাঁচাতে পারলেন না। হাঁটুর উপর থেকে কেটে ফেলতে হয়েছে। সেই থেকে এই ক্র্যাচের সাথে তার সখ্য। উপজেলা প্রশাসন অফিসে সশস্ত্র হামলার মিথ্যা অভিযোগে নুরুল আমিনের দশ বছরের কারাদন্ড হয়ে যায়। শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় সশ্রম কারাদন্ড থেকে রেহাই পেয়েছেন অবশ্য। তিন বছর আগে সরকার পতন হলেও তার সাজা বহাল রয়ে গেছে। কেউ খবর নিতে আসেনি নতুন সরকার আসার পরও।
গত কিছুদিন ধরে তিনি বইগুলোকেও দূরে ঠেলে দিয়ে আরো গুটিয়ে গেছেন। সম্প্রতি জানতে পেরেছেন তার দল দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একগ্রুপ অন্য গ্রুপকে গালি দিচ্ছে সংশোধনবাদী বলে আবার অন্য গ্রুপ তাদের গালি দিচ্ছে হঠকারি বলে। কেউ কেউ আবার প্রতিপক্ষ গ্রুপের নেতাদের ব্যক্তিচরিত্র নিয়েও নানা মুখরোচক কাহিনী শোনাচ্ছে। হতাশ হয়ে অনেকে নাকি সরকারী দলেও যোগ দিয়েছে। কে সঠিক আর কে বেঠিক নুরুল আমিন বুঝতে পারেন না। জেলে ঢোকার পর থেকেই দলের সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ নেই তার। শুধু এইটুকু বোঝেন, স্বপ্নটা বুঝি শেষ হয়ে গেল। কী হবে আর মার্ক্সবাদের বই পড়ে!
তবে একটা বই প্রতিদিন একবার খুলে দেখেন। না, পড়ার জন্য নয়। ওই বইয়ের মাঝখানে তিনি যত্নে রেখেছেন খুব প্রিয় একটা ছবি। দু’জন প্রিয় মানুষের ছবি। একজনের সাথে কোনোদিনও দেখা হয়নি নুরুল আমিনের। এক ছবিতে দু’জন মানুষ। তার স্ত্রী শিউলি দাঁড়িয়ে আছে তিনমাসের সন্তান বিপ্লবকে কোলে নিয়ে। বিপ্লবকে কোনো দিন দেখেননি নুরুল আমিন। তিনি গ্রেফতার হওয়ার দুই সপ্তাহ পরে বিপ্লবের জন্ম। শিউলি যেদিন দেখা করতে এসেছিল সেদিন বিপ্লবকে আনতে পারেনি। সে তখন হাসপাতালে ভর্তি জন্ডিস নিয়ে। বলেছিল, পরের বার যখন আসবে তখন নিয়ে আসবে। এতো ছোট বাচ্চাকে মুক্তাগাছা থেকে ঢাকায় নিয়ে আসাও কম ঝামেলার ব্যাপার নয়। ফিরে গিয়ে কিছুদিন পর শিউলি এই ছবিটা পাঠিয়েছিল। বিপ্লবের সাথে নুরুল আমিনের এই ছবিতেই পরিচয়। এখন ওর বয়স পাঁচ। এই বয়সের কোনো ছবি নেই। এই ছবির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে তিনি কল্পনায় পাঁচ বছরের বিপ্লবের ছবি এঁকে নেন আর সবার অলক্ষ্যে কয়েক ফোঁটা অশ্রু ঝরান।
বিপ্লবের সাথে আজও দেখা হয়নি। কারণ, শিউলি আর আসেনি। শেষ দেখার ছয় মাস পরই শিউলি জেলখানায় তালাকের কাগজপত্র পাঠিয়ে দিয়েছিল। নুরুল আমিন শুনেছেন সে এখন আরেকজনের ঘরনী। শিউলির উপর কোনো রাগ নেই তার। কোনো আশায় একজন মধ্য বিশের যুবতী দশ বছর পথ চেয়ে থাকবে! শুধু আক্ষেপ হয় বিপ্লবের জন্য। আহা! যদি ছেলেটাকে এক নজর দেখতে পারতেন! যদি জড়িয়ে ধরে কোলে তুলে নিতে পারতেন!
শিউলিকে তিনি বিশ্বাসঘাতক মনে করেন না। বিশ্বাসঘাতক নিজের তিন ভাই। জেলে বসেই খবর পেয়েছেন ভাইয়েরা পৈতৃক সম্পত্তি সব ভাগ করে নিয়েছে। ভাবীরা নাকি শিউলিকে ফুঁসলিয়েছে অন্য জায়গায় বিয়ে করতে। যার দশ বছরের জেল হয়েছে তার জন্য বসে থেকে কি করবি? বয়স চলে গেলে বয়স পাবি? আর শিউলির এই প্রস্থানে লাভ হয়েছে ভাইদের। এখন নুরুল আমিনকে সম্পত্তি বঞ্চিত করলেও সমস্যা নেই। তিনিতো জেলে। তার আবার সম্পত্তির কি প্রয়োজন! দল নেই, স্ত্রী নেই, সম্পত্তি নেই। এই জগতে দেখা না হওয়া পুত্র ছাড়া নুরুল আমিনের আর কিছুই নেই।
এ সব ভাবতে ভাবতে তিনি এসে পরেন জেল কর্মকর্তার অফিসে। ভদ্রলোক সজ্জন মানুষ। ছাত্রজীবনে একটি বাম ছাত্র সংগঠনের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। রাজবন্দিদের প্রতি সব সময় ভালো ব্যবহার করেন বলে জনশ্রুতি আছে জেলখানার ভেতর।
নুরুল আমিন সাহেব, আপনার জন্য একটা সুসংবাদ আছে।
জ্বী স্যার!
আপনার নেতার সুপারিশে মহামান্য রাষ্ট্রপতি আপনার সাজা মওকুফ করেছেন। আমাদের কাছে রিপোর্ট চেয়েছিল। আপনি দেশপ্রেমিক মানুষ, আমি জানি। আমরা ভালো রিপোর্ট দিয়েছিলাম। কাল সকালে আপনাকে মুক্ত করে দেয়া হবে।
আমার নেতা?
জ্বি! আপনাদের দলের সভাপতি আজমত খান সাহেব। উনিতো প্রতিমন্ত্রী হিসাবে কিছুদিন আগে সরকারে যোগ দিয়েছেন, জানেন মনে হয়।
শুনেছি।
এতো দিন যে মুক্তির প্রত্যাশায় পথ চেয়ে ছিলেন আজ সেই মুক্তির সংবাদে তিনি নির্বিকার। সেলে ফিরে বইয়ের ভেতর থেকে ছবিটা বের করে নুরুল আমিন হু হু করে কেঁদে উঠেন। এই ছেলেটাকে একটু জড়িয়ে ধরার আকাংখা না থাকলে তিনি জেলেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেয়ার আবেদন করতেন। বাইরের পৃথিবী তার কাছে নিতান্তই অচেনা।