ব্যাপারটার সূত্রপাত কোনো এক মধ্যরাতে।
মধ্যরাত নাকি সেটা ছিল রাতের শেষ প্রহর— এতদিন পরে সে কথা আর স্পষ্ট মনে পড়ে না আবিদ চৌধুরীর। তবে সেদিন রবিবার, রবিবার দিনগত রাতের ঘটনা, সেই অর্থে সোমবারও ধরে নেয়া যায়, কিন্তু শুক্রবার নয় কিছুতেই— এটা খুব ভালোই মনে আছে তার। শুক্রবার, সপ্তাহের এই একটি দিন তার কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ দিন। যুক্তির নিরিখে যে যা-ই বলুক, এই দিনটির প্রতি যুক্তির অধিক দুর্বলতা আছে আবিদ চৌধুরীর। সেই কবে দূর অতীতে আবেগময় বালকবেলায় দাদুর মুখে নানান কেচ্ছা শুনতে শুনতে শুক্রবারের প্রতি এই দুর্বলতার জন্ম।
দাদুর ছিল প্রখর স্মৃতিশক্তি। স্মৃতি থেকেই সোনাভান হাতেম তাঈয়ের পুঁথি শোনাত নাতিকে। লাইলী মজনু, শিরি ফরহাদের প্রণয়োপখ্যান, কারবালার জঙ্গনামা… আরো কত কী! গ্রাম্যবালক আবেদ অপার কৌতূহলে নায়ক-নায়িকার রূপবর্ণনা শুনত, লোমহর্ষক যুদ্ধ বিবরণ শুনে রোমাঞ্চিত হতো, দাদুর বুকের মধ্যে ঢুকে প্রশ্ন করত,
তারপর?
তারপর আবার কী! জঙ্গ শেষ। লাখে লাখে মরে লোক কাতারে কাতার শুমার করিয়া…
কিন্তু এভাবে শেষ হলে যে আবেদের চলে না। তার মাথায় কত রকম পোকা ঠোকরায়,
কিয়ামত কী দাদু?
ঘন দাড়ির মধ্যে হাত বুলিয়ে দাদু একটুখানি সুর ভেঁজে ওঠে,
এ দুনিয়া ফানা হবে, কিছুই রবে না। ভয়ে এবং কৌতূহলে দু’চোখ গোল গোল করে, তাকিয়ে থাকে দাদুর মুখের দিকে। ভেতরে ভেতরে তার কী যে হয়, এক সময় হঠাৎ ফুঁপিয়ে ওঠে, কিছুই রবে না?
দাদু বুড়ো হাসে। পার্থিব এ জীবনের কিছুই জানে না যে বালক, তবু তার এ কি তীব্র প্রতিক্রিয়া! নাতির কাঁধে হাত রাখে পরম মমতায়, রহস্যময় গলায় ডেকে ওঠে,
আবেদালি!
আজকের আবিদ চৌধুরীর গ্রাম্য নামটি শৈশবে ওই ভাবেই উচ্চারিত হয়েছে। যেনবা রূপকাহিনীর কিম্ভুতকিমাকার দৈত্যদানবেরা এসে আবেদালির কাঁধে ভর করে। কাঁধে হাত বুলায় দাদু, তবু তার ভয় কাটে না। সে কেবলই অস্পষ্ট গুনগুনানি শুনতে পায়… এ দুনিয়া ফানা হবে…।
দাদুকে জড়িয়ে ধরে সে বলে, আমার যে খুব ভয় করে দাদু।
কেয়ামত হবে শুক্রবারে, মনে রাখিস। গোটা দুনিয়া চোখের পলকে শেষ হয়ে যাবে। দাদু খুব গম্ভীর গলায় জানিয়ে দেয়।
বালক আবেদালি সেই থেকে শুক্রবারকে অন্য চোখে দেখে। সত্য-মিথ্যা প্রমাণের সময় এখনো হয়নি বটে তবু শুক্রবার তার কাছে আলাদা কিছু। দৈবক্রমে সেই গপ্পবাজ দাদুর মৃত্যুর দিনটিও ছিল শুক্রবার। দাদু চলে গেছে, পৃথিবী ঠিকই বহাল আছে নির্বিকার দৃঢ়তায়। দাদুর মৃত্যুর পর একদিন তার খুব জানতে সাধ হয়— পৃথিবীর জন্ম হয়েছিল কবে, মানে কী বারে? দাদু নেই, কাকে শুধাবে এ প্রশ্ন? বড় হয়ে লেখাপড়া শিখে গূঢ় এই প্রশ্ন নিজের কাছেই এক সময় অর্থহীন হয়ে ওঠে। কিন্তু অন্তরের খুব গভীর থেকে বেয়াড়া এই প্রশ্নটির শেকড় একেবারে উপড়ে ফেলতেও পারে না। তবে জগৎ সংসারের অসংখ্য ব্যস্ততার মাঝে এ প্রশ্নও এক সময় বেশ চাপা পড়ে যায়। মেধাবী ছাত্র আবেদালি ছাত্রজীবন শেষ করেই ঢুকে পড়ে প্রশাসনিক ক্যাডারে। সর্ব প্রকার আনুগত্য এবং বুদ্ধিমত্তা দিয়ে নিজের ক্যারিয়ার গঠনে মনোযোগী হয়। তখন শুক্রবার বিষয়ক দার্শনিক ভাবনা কোথায় নিভৃতে মুখ লুকায় কে জানে! দীর্ঘদিন রোগ ভোগের পর একদিন হঠাৎ তার বৃদ্ধ পিতার জীবনাবশেষ ঘটলে, মানে অনতিক্রম্য এই ঘটনাটি ঘটে যাবারও দু’দিন পর অবসন্ন এক বিকেলে নতমুখী সেই প্রশ্ন এসে চৈতন্যের দরজায় কড়া নাড়ে— কী বার ছিল যেন সে দিন!
শুক্রবার?
আগের দুটোদিন তো গেছে ঝড়ের মতো, বারের হিসাব রাখবে কখন! দেশের প্রেসিডেন্ট স্বয়ং আসছেন মানউন্নীত থানা ঘোষণা করতে, সেই থানার নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে তার কি চোখে ঘুম আছে নাকি মাথায় ঠিক আছে? বুড়ো বাপের মৃত্যুর সময়ও হলো কি না এই ঝামেলার মধ্যে! গ্রামের বাড়িতে বিছানায় গড়িয়ে গড়িয়ে বেশ তো চলছিল, আর দুটো দিন রয়ে সয়ে গেলে এই কেলেঙ্কারির মধ্যে পতিত হয়! গ্রামের মানুষ তো জানলো— লেখাপড়া শিখে আবেদালি এমনই অমানুষ হয়েছে যে মরা বাপের কবরে এক মুঠো মাটি দেওয়ার অবকাশও হয় না তার। ডাঙায় মুর্দা রেখে কতক্ষণ অপেক্ষা করবে গ্রামের মানুষ! কাফনের কাপড় ফুটো করে করে পিপঁড়ের সারি উঠে পড়ছে লাশের গায়ে। কোথায় সিলেটের বড়লেখা আর কোথায় কুষ্টিয়ার আলমডাঙ্গা, যোগাযোগ কি সোজা কথা! একেবারে সন্ধ্যার আগে আলমডাঙ্গা থানার ওয়্যারলেসে খবর আসে— আবেদালি আসতে পারছে না। তখন আবেদালির ভাই সবেদালিই লাশ কবরে নামিয়ে ফেলার জন্যে গ্রামবাসীকে আহ্বান জানায় এবং দীর্ঘশ্বাসমথিত কণ্ঠে উচ্চারণ করে— আমার ভাই কত বড় অপিছার বোঝো তা হলি, বাপকে মাটি দিয়ারও সুমায় নি।
বাপের কবরে মাটি দেওয়া বলে তো শুধু নয়, বস্তুতপক্ষে জন্মগ্রামের সঙ্গে আবেদালির সব রকমের যোগযোগই দিনে দিনে কমে আসে। বছরে অন্তত একটা ঈদের উৎসবে বৌবাচ্চা বেঁধে ছেঁদে গ্রামে এসে জংলি মশার শিবিরে আত্মসমর্পন করতে ভয়ানক অনাগ্রহী আবেদালির শহুরে স্ত্রী। ছেলে মেয়ে দুটোও হয়েছে মায়ের বাড়া। কাজেই সবমিলিয়ে আবেদালির গ্রামে আসা এক রকম বন্ধই হয়ে গেছে। চাকরিতে প্রমোশন পাওয়ার সঙ্গে ব্যস্ততাও বেড়েছে কয়েক গুণ, গ্রামের দিকে ফিরে তাকাবার ফুরসৎ কোথায়? তবে এ দিগরের দুদশটা গ্রামের লোকজন আবার ঠিকই জানে— আবেদালি তাদেরই ছেলে, সত্যি বলতে কি আবেদালিকে নিয়ে তারা খানিকটা গর্বই অনুভব করে, বিরাট বড় অফিসার যে! বিরাট মানে যে কত বড়, সে হিসেব আবার জানে না তারা। ওই যেবার জামালপুরের এডিসি থেকে নারায়নগঞ্জের ডিসি হয়ে আসছে, এলাকার মানুষ সে খবর জানার পর থেকে এই পরিচয়টাকেই খুব বড় বলে গন্য করে। চাকরি জীবনে আবেদালির আরো প্রমোশন হয়েছে, প্রায় মগডাল ছুঁয়ে ফেলার পূর্বলগ্নে তাকে অবসরে যেতে হয়েছে তবু নিজ এলাকায় তার ডিসি পরিচয়টাই বেশ পোক্ত হয়ে যায়। অতিরিক্ত সচিব কিংবা এ্যাডিশনাল সেক্রেটারি— এ সব ভারি ভারি শব্দের কতটুকুই বা বোঝে সাধারণ মানুষ! ডিসির উপরে একমাত্র এমপি সাহেবকেই উঁচু পদের মানুষ বলে তারা জানে। কিন্তু ওই রাজকীয় আসনেও যে আবেদালিকে দেখা যাবে, এ কথা কে কবে ভেবেছিল!
মজার ব্যাপার হচ্ছে এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ যত ক্ষীণই হোক, চাকরিতে অবসর গ্রাহণের পর সম্ভাবনাময় এক বড় দলে যোগ দিয়ে নোমিনেশন বাগিয়ে আবেদালি বহু বছর পর গ্রামে ফিরে এলে সবাই প্রথমে অবাক চোখে তাকায়, কেউ কেউ আড়ালে আবডালে মুখ নামিয়ে প্রশ্ন করে— এই আমাদের আবেদালি ডিসি?
না, তখন আর সেই আদ্যিকালের আবেদালি নয়, ঢাকা থেকে ঝকঝকে তকতকে অফসেটে ছেপে আনা পোস্টার দেয়ালে দেয়ালে সাঁটা হলে দেখা গেল পিতৃপ্রদত্ত নামের কিঞ্চিৎ সংস্কার ঘটিয়ে রাখা হয়েছে আবিদ চৌধুরী। কিন্তু নামের পাশের ছবিটা দেখতে হবে না? সে তো ওই সবেদালির ভাই আবেদালিই বটে। সবেদালির মুখমণ্ডল শ্মশ্রুমণ্ডিত, তবু সহোদর ভাইয়ের চেহারার সঙ্গে কী সাংঘাতিক সাদৃশ্য। বৈসাদৃশ্য তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে এবং সেটা বেশ প্রকটই বলা যায়। আসন্ন সংসদ নির্বাচনে আবেদালি ডিসির মতো যোগ্যপ্রার্থী পেয়ে এলাকাবাসী তো আবেগের জোয়ারে ভেসে রাতারাতি অপরিচয়ের দেয়াল টপকে ছুটে আসে, কেউ হ্যাণ্ডসেক করে, কেউ বুকে বুকে কোলাকুলি করে, আবেদভাই বলতে সবাই অজ্ঞান। বিশেষত, তার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়টা এ সময়ে খুব কাজে লেগে যায়। বিগত নির্বাচনে এই দলের যিনি প্রার্থী ছিলেন, বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি যথেষ্ট দৌড়ঝাঁপ করতে পারেননি বটে, তবে তার চেয়ে অনেক বড় হয়ে দাঁড়ায় তার একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকার ব্যাপারটা। বাপরে বাপ! প্রতিপক্ষের সে কী প্রচারনা! কবেকার বস্তাপচা ছবি আবিষ্কার করেছে, পিসকমিটির মিটিঙের ছবি, রাজাকার বাহিনীর স্যালুট গ্রহণের ছবি দিয়ে ঢাউস পোস্টার ছেপে চারিদিকে ছড়িয়ে বেইজ্জতির একাকার। এবার আসুক তো দেখি কার ঘাড়ে কটা মাথা! আবেদালি মুক্তিযোদ্ধা, হ্যাঁ! বিস্মৃতপ্রায় ধূলিধূসরিত এ পরিচয়টাও যে এভাবে খাপে খাপে কাজে লেগে যাবে, প্রথমে আবেদালি তা ভাবতেও পারেনি। বরং জোটের অন্যতম শরিক দলের কর্মী সমর্থকদের সঙ্গে হাত মেলাতে গিয়ে সারা গায়ে প্রবল ঝাঁকুনি অনুভব করে, উপজেলা আমীর হাতেম আলীর সুরমাটানা চোখে চোখ পড়তেই শিউরে ওঠে শরীর, লোম খাড়া হয়ে যায় সজারুসজাগ। হায়, এই সাক্ষাৎ এই মোলাকাত যদি একাত্তর-বাহাত্তরে ঘটে যেত, তাহলে বর্তমানের হিসেব নিকেশটাই অন্যরকম হতো হয়তো। হাতেম আলী এক ঝটকায় নিজেকে প্রস্তুত করে ফেলে, পানখাওয়া মুখে জর্দার সুরভি ছড়িয়ে একগাল হাসিতে আশ্বস্ত করে— এবার আমরা জিতবই।
হ্যাঁ, সত্যিই জিতেছে। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে আবিদ চৌধুরী এমপি নির্বাচিত হয়েছে। জনগণের অন্তরজোড়া সাগরজলের উচ্ছ্বাস। সেই আবেগপ্রবণ জনগণকে দেখার জন্যে একদিন ঢাকা থেকে গাড়ি হাঁকিয়ে আবিদ চৌধুরীর স্ত্রী-পুত্র-কন্যা এই নিভৃত পাড়াগাঁয়ে আসে। তাদের অন্তরের খুব গহীন থেকে হয়ত অস্পষ্ট এক প্রশ্নের উদয় হয়— মানুষগুলো এতই বোকা! এত সহজেই এরা ধেই ধেই নাচে! এমন উন্মত্ত হয়ে ওঠে!
কেবল সবেদালির চোখমুখের ভাও দেখে তার অন্তকরণের সঠিক পাঠ কিছুতেই উদ্ধার করতে পারে না আবেদালির স্ত্রী। এমনিতে কিছুই বুঝার উপায় নেই। বড় ভাবী, ভাইপো, ভাইজি বাড়ি এসেছে বহু বছর পর, এ জন্যে সে খুশি। যতটুকু খুশি হওয়া উচিত তার চেয়ে মোটেই কম নয়, কিন্তু একটুখানিও বেশি নয় কেন? এইখানেই সংশয়-চারিদিকে, মানুষজনের চোখেমুখে এত আবেগ উচ্ছ্বাসের ঢেউ খেলছে, এ সময়ে সবেদালি এত স্বাভাবিক থাকে কী করে? সে কি এ তলাটের অন্যসব মানুষের চেয়ে আলাদা ধাতুতে গড়া? কৌতূহল চাপতে না পেরে এক সময় এক ঝলক নিরিবিলিতে দেবরকে জিগ্যেস করেই বসে,
তোমার ভাই এমপি হয়েছে, তুমি খুশি হওনি ছোটমিয়া?
বিস্ময়ে সবেদালির চোখ কপালে,
কেন ভাবী, এ কথা বলছেন কেন?
বলছি কি আর সাধে! তুমি বলাচ্ছ তাই বলছি। তোমার চোখমুখ বলছে— কোথায় যেন গোলমাল আছে।
ঠোঁটের কোনায় এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে সবেদালি বলে—
সে কী ভাবী, আমার ভাই এমপি হয়েছে, আমি খুশি হব না?
না না, এমপি বলে তো কথা নয়, নতুন ক্যাবিনেটে মন্ত্রী-টন্ত্রীও হয়ে যেতে পারে।
বেশ তো! সে তো আমাদের আনন্দের খবর ভাবী।
হ্যাঁ আনন্দ পাবে এলাকার লোকজন! শুনেছি তুমি নাকি ভাইয়ের দলকেই পছন্দ কর না।
বাব্বা! এত কথা কোথায় শুনলেন?
শোন ভাই, এতদিন পর আর রাজাকার টাজাকার বলে বিভ্রান্ত করার মানে হয়? স্বয়ং মুজিবই তো ওদের ক্ষমা টমা করে গেছেন।
সবেদালি ঝট করে ভাবীর সামনে থেকে সরে দাঁড়ায়, মুখ ঘুরিয়ে বলে, এ সব থাক ভাবী। রাজনীতি নিয়ে তো আমি বড় ভাইয়ের সঙ্গেই তর্ক করিনি, আপনার সঙ্গে কী কথা বলব!
কথা বলতে হবে না। ভাইয়ে ভাইয়ে যেন ঝগড়াঝাটি করো না, তাহলেই হবে।
আচ্ছা।
সুবোধ বালকের মতো ঘাড় নেড়ে সাঁয় দিয়েছে সবেদালি। তারপর হো হো করে হাসতে হাসতে ভাবীর সামনে থেকে সরে গেছে। তার বিশ্বাস— মৌসুমী পাখির মতো ভাই ভাবী বহু বছর পর গ্রামে এসেছে, আবার চলেও যাবে ঢাকায়, তাদের সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হবার কোন মানেই হয় না।
না, শেষ পর্যন্ত এলাকাবাসীর মনের স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে যায়।
মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রী মিলিয়ে আজদাহা সাইজের নতুন মন্ত্রীসভা গঠন, শপথ গ্রহণ, দায়িত্ব গ্রহণ.. সব সম্পন্ন হয়ে যাবার পর দেখা গেল ওই তালিকায় আবিদ চৌধুরীর নামটি আদৌ নেই। পার্টির ভেতরে আছে মিনিপার্টি। সেখানে মহাসচিবই মুখ্য সঞ্চালক। এই ধারণা থেকে আবিদ চৌধুরী মহাসচিবের লবিটাই আঁকড়ে ধরেছিল। পরে জানা গেল যুবরাজের লবিই অধিক শক্তিশালী। তবে এই লবিতে খরচাপাতি একটু বেশি হলেও রিস্ক নেই বললেই চলে। সব কিছু জানার পর কপালে করাঘাত করে নিজেকেই সান্ত্বনা দিয়েছিল সে— আবেদালি ডিসি আর কতদূর যাবে! জনগণের ভোটে নির্বাচিত এমপি আবিদ চৌধুরী হয়ে ওঠা কি কম কথা? সচিব হওয়ার অন্তর্জালা তো জুড়িয়েছে! এখন সে মাননীয় সংসদ সদস্য, প্রজাতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পদ। জাতীয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ রকম নানান যুক্তিতে নিজেকে বুঝানোর পরও জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনের দিনই আবিদ চৌধুরীর হার্টস্ট্রোক হয়। হঠাৎ হৃদযন্ত্র বন্ধ হবার যোগাড়। বুকের কপাট বন্ধ হয়ে আসে। চোখে অন্ধকার। সারা শরীরে ঘামের স্রোত। তড়িঘড়ি করে ডাক্তার-হাসপাতাল ওষুধ পত্তর সেবা-যত্নের পর সে যাত্রায় রক্ষা পায়। মাইল্ড স্ট্রোক। কয়েকদিনের মধ্যেই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। পুনর্বার পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ডাক্তাররা জানিয়ে দিয়েছে— এখন সম্পূর্ণ আশঙ্কামুক্ত।
আবিদ চৌধুরীর তবু ঘোর কাটে না। তার এই গোটা জীবনে এ রকম কোনো ধাক্কা সে খায়নি। অসুখ বিসুখ যে মোটেই হয়নি তা নয়, সে দৌরাত্ম্য ওই জ্বরজ্বালা সর্দি কাশির পাঁচিল পর্যন্তই সীমিত ছিল। কিন্তু এ যে একেবারে মুত্যুর দুয়ারে কড়া নাড়া। কী বার ছিল সেদিন? ছোটবেলায় দাদুর মুখে শোনা শুক্রবার— মাহাত্ম্যের কথা মনে পড়ে যায়। কিন্তু স্ত্রী তাকে আশ্বস্ত করে— সেদিন ছিল সোমবার। যেন সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে— যাক বাবা, বাঁচা গেল!
সে ধাক্কা বাঁচা গেল বটে, তবু মৃত্যু ভীতিটা যে ভেতরে ভেতরে শেকড় গেড়ে বসে— তাকে কিছুতেই নিঃশেষ উপড়ে ফেলতে পারে না আবিদ চৌধুরী। সম্পূর্ণ সংশয়মুক্ত হবার জন্যে মাসখানেকের মাথায় ব্যাংককের প্যারাডাইস হসপিটালে গিয়ে থরো চেক আপ করানো হয়। সেখানকার বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদেরও অভিমত— কোয়াইট ওকে, আবিদ চৌধুরী সম্পূর্ণ সুস্থ। বছর দুয়েক পরে প্রধানমন্ত্রীর সফর সঙ্গী হয়ে আমেরিকা যাবার সুযোগ মেলে। আবিদ চৌধুরী সে সুযোগেরও পূর্ণ সদ্বব্যবহার করে। সরকারি খরচে স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় বসে সর্বোচ্চ চিকিৎসা সেবা শ্মশ্রুষা, পরীক্ষা নিরীক্ষা— এ কি চাট্টিখানি কথা! কিন্তু ফলাফল কী? যাহা বাহান্ন, তাহাই তিপান্ন। দেশের ডাক্তার যা বলেছে বিদেশে ও সেই একই কথা। এই পাংশুটে কথা শোনার জন্যে কি মানুষ এখানে আসে? খুব নিভৃতে নিজেকেই শুধিয়েছে— ডাক্তারদের কাছে আসলে কী শুনতে চায় সে? এই ষাটোর্দ্ধ বয়সের শরীরে যেকোনো রোগবালাই তো বাসা বাঁধতেই পারে অলক্ষে। তবে কি সেই মুখ লুকানো অদৃশ্য রোগটির অস্তিত্বের ঘোষণা শোনার জন্যে উৎকর্ণ হয়ে আছে সে?
আবিদ চৌধুরীর নির্বাচনী এলাকার লোকজন যেমনটি আশা করেছিল— নির্বাচনের পর এমপি সাহেবের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক তেমন মুধরতম হয়নি, নিকটতমও হয়নি। তবু জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনের দিনে নবনির্বাচিত এমপি সাহেবের আকস্মিক অসুস্থতার খবরে তারা খুব মর্মাহত, তার আশু রোগমুক্তি কামনা করে নিকটতম শুক্রবারে এলাকার মসজিদে মসজিদে বাদ জুম্মা বিশেষ দোয়া মাহফিলের আয়োজন করে। সেই দোয়ার আসরে বেশ দুচারজন হা-হা করে কেঁদেও ফেলে।স্থানীয় সংবাদদাতার বরাত দিয়ে এসব খবরে ঢাকার দুতিনটি কাগজের মফস্বল পাতায় ছাপাও হয় কয়েকদিন পর। তখন আবিদ চৌধুরীর অন্তরের ভেতরটা কৃতজ্ঞতায় নুয়ে আসে। মাস খানেক বিলম্বে হলেও অন্তরধোয়া সেই কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে সে নিজ এলাকায় আসে। জেলা শহর থেকে দশ মাইল দূরে পৈত্রিক ভিটেয় না উঠে সেবার ওঠে সার্কিট হাউজে। জেলাপ্রশাসককে টেলিফোনে সেই রকমই বলা ছিল। ডিসি লোকটা যে যথেষ্ট করিৎকর্মা তার প্রমাণ পাওয়া গেল পরদিনই। নিজের নির্বাচনী এলাকার যেসব গুরুত্বপূর্ণ নেতা কর্মীর সঙ্গে তার সাক্ষাতের ইচ্ছে, সেই ইচ্ছের কথা জানিয়ে একেবারে সংক্ষিপ্ত নোটিশে তাদের সবাইকেই সার্কিট হাউসের হলরুমে হাজির করেছে। এসব একেবারে কম কিসে? ডিসি এসব করবে না কেন? এমপি বলে তো শুধু কথা নয়, বর্তমান ডিসির চাকরি জীবনও শুরু হয়েছিল আবিদ চৌধুরীর অধীনে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে। তারপরও তো কৃতজ্ঞতা বলে একটা ব্যাপার আছে! সে-ই বা এ সুযোগ ছাড়বে কেন?
বলা যায় এই ডিসি লোকটির পীড়াপীড়িতেই এরপর প্রতিবার ঢাকা থেকে এসে সোজা সার্কিট হাউজে উঠতে হয়। বছরে দুতিনবারের বেশি নির্বাচনী এলাকায় আসার সুযোগ হয় না তার। এলেই সার্কিট হাউজের ভিভিআইপি রুম। আগে এসির ব্যবস্থা ছিল না, এমপি সাহেবের কথা বিবেচনা করে অচিরেই সে ব্যবস্থাও হয়েছে। আবিদ চৌধুরীর বেশ মনে পড়ে— এই ডিসি লোকটা চাকরি জীবনের শুরু থেকেই ভারি চৌকস, ধারাল মেধাবী। এমপি সাহেবের কখন কী প্রয়োজন, কোনটা ইচ্ছা-অনিচ্ছা সব কেমন সহজেই বুঝে ফেলে। সত্যি বলতে কি, এমপি হবার পর প্রথম তিন বছর দলের স্থানীয় লবিং গ্রুপিং, অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কদাকার বিবরণ, এমপির নামে গোপনে বা প্রকাশ্যে কে কী মন্তব্য করে— সেই কুৎসিত খবরও আবিদ চৌধুরী নিয়মিত পেয়েছে ডিসির সূত্র থেকেই।
কিন্তু ডিসি করে সরকারি চাকরি। তার প্রমোশন আছে, বদলি আছে। আবিদ চৌধুরী আর কতদিন স্টে করিয়ে রাখবে বদলির আদেশ। নতুন ডিসিও যথারীতি সেলাম কুর্ণিশ করে, খাতির সম্মানের ঘাটতি নেই মোটেই, তবু আগের মতো আর কিছুই যেন পাওয়া যায় না। দলের ভেতরে বেশ কিছুদিন থেকে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের নেতৃত্বে একটা গ্রুপিং খুব জোরদার হয়ে উঠেছে, যেখানে সেখানে যাচ্ছেতাই বলে বেড়াচ্ছে, সামনের কাউন্সিলে সে নাকি এমপিকে ধোলাই দেবে— কানে আসে সবই। নতুন ডিসিকে একটু ট্যাক্টফুলি ব্যবস্থা নিতে বললে সে কৌশলে এড়িয়ে যায়— এ সব হচ্ছে দলীয় সিদ্ধান্তের ব্যাপার স্যার। আমার হস্তক্ষেপ করা কি ঠিক হবে?
দাঁতে দাঁত পেষে আবিদ চৌধুরী। মনে মনে তড়পায়— আমাকে ডিসিগিরি শেখাচ্ছে। আবার তলে তলে মন্তব্য করে— ডিসি অফিসকে রাজনৈতিক দলের অফিস বানাতে পারবে না। এতবড় দল গোটা দেশ চালাচ্ছে, আর একটা অফিস চালাতে পারবে না! তোমার ডিসি অফিসের ঘাড়ে পেচ্ছাপ ফিরতে আসবে! শালা চশমখোর।
আজকাল সে এরকমই বেসামাল হয়ে যাচ্ছে। এতকাল কেতাদুরস্ত জীবন যাপন করেছে। মুখ ছিল লাগামবাঁধা। ওই মুক্তিযোদ্ধা মস্তানটার চেহারা মনে পড়লে আর মুখের আব্রু তখন থাকে না। কেন, আমি কি মুক্তিযুদ্ধে যাইনি? ট্রেনিংও নিয়েছি ঠিকই। বিহার চাকুলিয়া— ওসব বোগাস! অস্ত্র চালাতে পারলেই হলো। না, বাস্তবিক পক্ষে আবিদ চৌধুরীদের ব্যাচের কাউকে যুদ্ধে নামতেই হয়নি। তার আগেই যুদ্ধ ফিনিশ। এতদিন বাদে ওই শালা মস্তান এসেছে মহাসমাবেশ করতে। তা সেই সমাবেশে এমপিকে চীফ গেষ্ট করা যায় না? ঘাড় বাঁকা করলেই হলো! ডিসি এ গুলো ম্যানেজ করতে পারে না? খুব পারে। এমপি-মন্ত্রীদের কত রকম খায়েশ খাসলত পূর্ণ করে ডিসিগিরি সামলাতে হয়, সে জানে না? জানে, কিন্তু করবে না। উনি ন্যায়বান যুধিষ্ঠির সেজেছেন। হুঁ। খাগড়াছড়ির বাঁশ খেয়ে এখন তো বেশ সোজা হয়েছ বাছাধন। এখন চিনেছ আবিদ চৌধুরীকে! সংস্থাপনের মগডালে এখনো আমার লোকজন ঠাসা, তুমি কতদূর বাড়তে পারো দেখি।
মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে আমন্ত্রণ জানিয়েছে ঠিকই, অতি সাধারণভাবে দায় সেরেছে মাত্র। কার্ডে কোথাও এমপি’র নাম গন্ধ নেই, কেবল খামের উপরে লেখা মোঃ আবেদালি, বীর মুক্তিযোদ্ধা। ব্যাস। এইটুকুই মাত্র। এতখানি উপেক্ষাও গায়ে পেতে হজম করেছে। নির্দিষ্ট সময়ে অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হয়েছে। এমপি সাহেবকে দেখে সবাই অবাক। তার উপস্থিতিই যেন অস্বস্তির কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু বিষয়টাকে চ্যালেঞ্জিং মুডে গ্রহণ করেছে আবিদ চৌধুরী। সামনে আবার নির্বাচন এগিয়ে আসছে। অনেক অপপ্রচার সহ্য করা হয়েছে, এবার মুখোমুখি দাঁড়াতে চায়, অপপ্রচারের মোকাবিলা করতে চায়। মূলত সে জন্যেই এই সমাবেশে আসা। এখান থেকেই শুরু করতে চায় ঘুরে দাঁড়ানোর পালা।
আয়োজকদের মনের ভেতরে যা-ই থাক আর যেভাবেই আমন্ত্রণ জানানো হোক, এমপি সাহেব অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হলে তাকে মঞ্চে আহ্বান না জানিয়ে পারা যায়! আবিদ চৌধুরীর অবশ্য উদার চিত্তে সাহাস্য ঘোষণায় বলে— না না আমি এখানে এই সামনের সারিতে বসছি। মঞ্চে যাবার দরকার নেই। এই উদারতায় অনেকে মুগ্ধ হয়। তার পক্ষ নেয়। মঞ্চে উঠাতে তৎপর হয়। ব্যাস! এই নিয়ে শুরু হয় তর্কাতর্কি, ঠেলাঠেলি ধাক্কাধাক্কি এবং অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নেয়। সবার আগে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধান কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় এমপি সাহেবের যথেষ্ট নিরাপত্তা বিধান করা। সেটা নিশ্চিত করতে গিয়েই পুলিশের মৃদু লাঠি চার্জ, টিয়ার শেল নিক্ষেপ অপরিহার্য হয়ে ওঠে। এর ফলে দুচারজন আহত বা জখম হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তাই বলে নূর মোহাম্মদ একেবারে মারাই যাবে!
সার্কিট হাউজ যতই নিরাপদ হোক, এদিন এসপি ডিসি কেউ বিশেষ ঝুঁকি নিতে চায়নি। পুলিশ প্রটেকশনে ঢাকায় ফিরে যাবারই পরামর্শ দিয়েছে সবাই। আবিদ চৌধুরী সে পরামর্শ মেনেও নিয়েছে। কিন্তু এলাকা ছেড়ে যাবার আগে নূর মোহাম্মদের মুখটা একবার দেখার খুব বাসনা হয়। এ বাসনার কথা শুনে ডিসি তো তেড়ে ওঠে, এটা করা ঠিক হবে না স্যার। ওরা লাশ নিয়ে মিছিল বের করার আয়োজন করছে। এর মধ্যে আপনি গেলে
কী হবে আমি গেলে?
এসপি সাহেবই আগ বাড়িয়ে জানায়,
দপ করে জ্বলে উঠবে স্যার। পুলিশ কিংবা ফায়ার সার্ভিস সে আগুন নেভাতে পারবে না।
কী যা-তা বলছেন! নূরু আমার শৈশবের বন্ধু। প্রাইমারিতে একসঙ্গে পড়েছি। খেলাধুলা করেছি। এই পর্যন্ত বলার পর আবিদ চৌধুরীর চেহারায় আরো গাম্ভীর্য নেমে আসে। চোখ থেকে চশমা নামিয়ে রুমালে চোখের কোনা মুছে আফসোস করে— নূরুকে এক নজর দেখব না?
ডিসি সাহেব সাফ জানিয়ে দিয়েছে— না, বন্ধুর মুখ দেখবেন না। সেই সুযোগ নেই।
ঢাকার উদ্দেশে রওনা হবার পর সারা পথ নূরুর চেহারা মনে পড়েছে। জীবনযুদ্ধে পরাজিত মুক্তিযোদ্ধা নূর মোহাম্মদ। বন্ধুই তো! পাশাপাশি গ্রামের বাড়ি। একই স্কুলে প্রাইমারি পর্যন্ত পড়েছে। দারিদ্রের কারণে লেখাপড়া হয়নি কিন্তু বোধবুদ্ধি অত্যন্ত তীক্ষè। করুণার ধার ধারে না। ভিন্নধারার রাজনৈতিক বিশ্বাস তার বুকের গভীরে, তবু আবেদালি বলতে অজ্ঞান, ছায়ার মত অনুসরণ করে বন্ধুকে। খুব খটকা লাগে মনে— তবে কি আমার জন্যেই নূরুর মৃত্যু হলো!
পথিমধ্যেই মোবাইলে নানান রকম খবর আসে। নূর মোহাম্মদের মৃত্যুতে শহরে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। ডিসির কথায় বেশ বুঝা যায়, পুলিশের লাঠিচার্জেই এই মৃত্যু ঘটেছে। ওদিকে এসপির দৃঢ় বিশ্বাস— ঘটনাটি হার্টফেলের! দুর্বল মানুষ, দৌড়াদৌড়ির ধকল সইতে পারেনি। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত শেষ কথা বলা যাচ্ছে না। তবে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি পরিবেশন করে শরিকদলের আমীর হাতেম আলী মিয়া। নূরমোহাম্মদের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাগাভাগি ফাইনাল হয়ে গেছে। এখন সামান্য ছলছুতা পেলেই ফাটাফাটি মারামারি চলতেই থাকবে।
কিন্তু রাতে ঘুমাতে যাবার আগে এসপি টেলিফোনে আশ্বস্ত করে— উভয় পক্ষের চারজনকে আটক করা হয়েছে। এখন সব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। লেজ গুটিয়ে আপনার পায়ে পড়ল বলে স্যার! আপনি ঘুমান স্যার। গুড নাইট।
কোথায় গুড নাইট?
হঠাৎ মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেলে আঁতকে ওঠে আবিদ চৌধুরী। প্রচন্ড ভয়ে শক্ত কাঠ হয়ে যায় পুরো শরীর। বিছানায় উঠে বসার উদ্যম পায় না। গা ছমছম করা ভাব। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ। মাথার কাছেই ঢাকা আছে পানির গ্লাস। কিন্তু হাত বাড়াতেই সাহস হয় না। মনে হয় হাত ফস্কে পড়ে যাবে সব। শেষ পর্যন্ত কোনক্রমে হাত উঁচু করতে পারে এবং সেই হাত আছড়ে পড়ে স্ত্রীর বুকের উপর। কিন্তু তাতেও ঘুম ভাঙে না স্ত্রীর। অগত্যা কী আর করা— বিস্ফারিত দুচোখ মেলে কাঠ হয়ে পড়ে থাকে আবিদ চৌধুরী।
অবাক কান্ড হচ্ছে— সকালে যখন আবিদ চৌধুরীকে অসুস্থ অবস্থায় তার স্ত্রী আবিষ্কার করে, তখন সে দিব্যি হাসছে, কথা বলছে— এখন তার কোনো কষ্টই নেই। কষ্ট হয়েছিল মধ্যরাতে। খুব কষ্ট। সেই কষ্ট কাউকে বুঝাতে পারেনি। এখন কষ্ট নেই।
কষ্ট নেই বললেই বা স্ত্রী-পুত্র শুনবে কেন? তারা ঢাকা মেডিকেল, পিজি-বারডেম কিছুই বাদ রাখে না। বড় বড় ডাক্তার বিরাট সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করে, কোনো প্রকার রোগের লক্ষণই খুজে পায় না। অবশেষে দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করে— আবিদ চৌধুরী সম্পূর্ণ সুস্থ। হ্যাঁ, অসুস্থ সে নয়, কিন্তু স্বস্তিও যে হয় না। অবশেষে সি. এইচ. এম. এর এক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার— আবিদ চৌধুরীর খুব বন্ধুস্থানীয় সুহৃদ মানুষ, ব্রিগেডিয়ার খালিকুজ্জামান দেখে শুনে অভিমত ব্যক্ত করেন— তোমার তো স্পাইনাল কর্ডে সমস্যা বন্ধু! মেরুদণ্ডের ভেতরে কিছুই নেই। কবে বাধিয়েছ এ রোগ?
রোগীর বিছানায় শুয়ে আবিদ চৌধুরী নাটুকে গলায় হো-হো করে হেসে ওঠে। তারপর দুহাতে বিছানা হাতড়ায়, যেন অবোধ শিশু তার হারানো খেলনা খুঁজছে। ডাক্তারের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বলে— আমার মেরুদণ্ড কই ডাক্তার? আবার অট্টহাস্যে ফেটে পড়ে— ‘যা নেই তার আবার অসুখ কিসের বলো দেখি!’