হামিরউদ্দিন মিদ্যা

অবলা

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

হামিরউদ্দিন মিদ্যার গল্প

অবলা


ও জামিলা বুবু, টপটপ ফাঁকে বেরিন এসো। দেখে যাও তুমাদের গোব্বিন ছাগলটা কেমন করছে। ছা’ হবেক মুনে হচ্ছে।

সরাফত মন্ডলের বাড়ির চারপাশ কঞ্চির বেড়া দিয়ে ঘেরা। বেড়ার গায়েই বসানো আছে বাঁশের বাখারি দিয়ে বানানো একটা দরজা। বাড়ির আঙিনায় প্রবেশ করতে গেলে ওই বিশেষ দরজাটি খুলতে হয়। রাত হোক কিংবা দিন, সবসময় ভেতর থেকে দরজাটা ঠেসিয়ে দড়ির ফাঁস গলিয়ে রাখে জামিলা। কেন না উঠোনের ধারে ধারে কয়েকটি ফলের গাছ লাগানো আছে। কলতলার পাশে হাত খানেক জায়গায় মাটি দিয়ে উঁচু করে কয়েকঝাড় কাঁচালঙ্কার চারা বসানো। চারিধার আড়াল-আবডাল না রাখলে গোটা রাজ্যের মুরগী ঢুকে মাটি আঁচড়ে একাকার করে। আবার পরের গোরু-ছাগলের দৌরাত্ম্যও তো কম নয়।

বেড়ার পাশ দিয়ে যেতে যেতে ছাগলটার ছটফটানি দেখে থমকে দাঁড়াল নামোপাড়ার হাসুনির মা। বাড়ির দিকে মুখ করে গলা ফেঁড়ে সরাফতের বউকে ডাক পাড়ল।

জামিলা সকালে উঠেই দরমার হাঁস-মুরগীগুলোকে খেতে দিয়ে ছেড়েছে। তারপর গোয়াল থেকে ছাগলগুলো বের করে ফাঁকে বেঁধে সবে রান্নার তোড়জোড় শুরু করছিল। সরাফত বাড়িতে নেই। চা-মুড়ি খেয়ে বেরিয়েছে, ফিরবে সেই দুপুরবেলা। গঞ্জের মোড়ে মুড়ি ভাজার কল আছে তাদের। হাসুনির মায়ের বাজখাঁই গলা শুনে পড়িমরি করে ঘর থেকে বেরিয়ে এল জামিলা।

হাসুনির মা বলল, হা দ্যাখো বুবু, ল্যালানি গড়াচ্ছে। ছাগলটার ছা’ হবেক লাগছে।

তাই তো রে গুলেনুর। কই সকালে কিছুই তো বুঝা গেল নি!আজ মাসের কত তারিখ হল বলদিনি?হিসাবের কুনু ভুল ছিল নাকিন!

তা আমি কি করে জানব? কবে পাল খেয়েছিল, তুমরাই ভালো করে জানো।

বেড়ার পাশ দিয়েই একটা মোটা পগার মন্ডলপাড়াকে ডাইনে ফেলে চলে গেছে নামোপাড়ার দিকে। সরাফতের জায়গার শেষ সীমানাতেই একটা ঝাঁকর-ঝুমর ডালপালাওয়ালা কাঁঠালগাছ। হাত খানেক চলাচলের রাস্তা ছাড়ার জন্য বেড়ার ভেতর গাছটাকে ঢোকানো যায়নি। তবে দখল রাখার জন্য গাছটার চারপাশে কোদাল দিয়ে চেঁছে পরিস্কার করে ছাগলের বাঁথান করেছে। সারাদিন ছাগলগুলো কাঁঠালতলাতেই বাঁধা থাকে। এখন কোথাও দিগদড়া দেবার জো নেই। মাঠে মাঠে সরষের চাষ। সরাফত আসার পথে কোনওদিন ঘাস ছিঁড়ে আনে। কোনওদিন বট, আকাশমণি, শ্যাওড়ার ডাল-পালা এনে কাঁঠালগাছের সঙ্গে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে দেয়।

কিছুদিন আগেই পাইশে রঙা ছাগলটার দু-দুটো হালোয়ান ছানা হল। জামিলা মনে মনে হিসাব করতে থাকে। ওই ছাগলটির পাল খাওয়ার একমাসের মাথাতেই তো ‘গরম’ হল। এত তাড়াতাড়ি ছানা হবে ভাবতেও পারেনি।

ছাগলটা ব্যাথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। এই প্রথম বিয়োনি হবে। মুখ ঠেলে বেরিয়ে আসছে একটা কষ্টকর আওয়াজ। এর আগেও তো অন্য ছাগলগুলোর ছানা হয়েছে। এমন কষ্ট পেতে জামিলা কখনও দেখেনি।

ছাগলটার কষ্ট দেখে হাসুনির মা আর থাকতে পারল না। কোলের মেয়েটাকে নামিয়ে বলল, একবার ধরো দিনি বুবু। মেয়েটাকে জামিলার কোলে দিয়ে ছাগলটার গায়ে-পিঠে হাত বোলাতে লাগল। জিভ চুকচুক করে বলল, আহা গো!অবলা জীব মুখে কিছু বলতে পারছেনি। মানুষ হলে এতক্ষণ হাসপাতালে ঠাঁই পেত।

ছেলে বিয়োনোর কষ্ট কেমন, তা জামিলা জানে না। তার পোড়া কপাল। খোদা তাকে ভালো খেতে, পরতে, মাখতে দিয়েছে–কোলটাই করেছে খালি। সরাফত এ নিয়ে কম টাকা ঢালল!কোথাও তো দেখাতে কসুর করেনি। শুনপুরের কবিরাজ বলো, বুড়োপীরের দরগা বলো, শহরের বড় পাশ করা ডাক্তার বলো–কিছুতেই কাজ হয়নি। জামিলার বুকের পিঞ্জরের কোনও গোপন কুঠুরিতে কোথাও যেন একটা শূন্যতা রয়ে গেছে। ভেতরটা জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যায়। এত খেয়ে পরে ঘুমিয়েও মনে শান্তি পায় না সে।

জামিলা জিজ্ঞেস করে, প্রথম বিয়োনিতে খুব কষ্ট লাগে, তাই না গুলেনুর?

হ্যাঁ গো বুবু। কষ্ট বলে কষ্ট!এখন তো তাহলেও ডাক্তার-ওষুধের কত সুবিধা হয়েছে। একটু ব্যথা উঠলিই ‘হ্যালো’ করি দিলে ভোঁ করে গাড়ি ছুটে চলে আসছে ঘরের দুয়ারে। হাসুনিকে যখন প্যাটে ধরলাম, কী আর বলব গো বুবু! জবাই করা গোরুর মতন ছটফট করতি ছেলম। ধাইবুড়ি মুখে কাপড় গুঁজে দিলেক। তারপর এত প্যাটে ধরলাম, আর কুনু কষ্ট লাগেনি।

হাসুনির মা গাঁ বুলতে যাচ্ছিল। বড়ই অভাবের সংসার। ঠিক মতো দু-বেলা পেটের ভাত জুটে না, পিন্ধনের কাপড় জুটে না, মাথার ছাউনির নেই কোনও ভরসা। নজর আলীর হাতে মার খেয়ে খেয়ে পিঠে কালসিটে দাগ পড়ে গেল–তবুও দেখো, মেয়েটা কত ছল জানে! হাসির আবরণে ঢেকে রাখে মনের দুঃখ-কষ্টগুলো।

সকাল হলেই এ বাড়ি সে বাড়ি ধর্ণা দেয় হাসুনির মা। কারও বাড়িতে মুড়ি ভাজা, ঘরে মাটি লেপে ছুঁই দিয়ে দেওয়া, ধান-চালের মরসুমে কুলো ধরা–বিভিন্ন কাজ করে দেয় সে। বিনিময়ে পোয়াটাক চাল, কোথাও আলু-পেঁয়াজ, দশন খানেক তেল পেয়ে যায়। পুকুরপাড়ে, খালে-ডোবায় কলমি, শুশুনি, কুলেখাড়া শাক তুলে আচল ভর্তি করে। কচুঘেঁচু যা পায় তুলে নিয়ে যায়। চার চারটে মেয়ে!

হাসুনির জন্মের পর নজর আলী পুত্র সন্তানের অনেক আশা করেছে। তারই ফসল পরবর্তী তিনটে মেয়ে। মরদটার সংসারের প্রতি কোনো মায়াদয়া নেই। নেশাভাঙ করে বাড়ি ফিরে। কী আর করবে গুলেনুর! নিজেকেই সংসারের হালটা শক্ত করে ধরতে হয়েছে। মেয়েগুলোকে তো আর বানে ভাসিয়ে দিতে পারে না। নিজে আধপেটা থাকুক, যা হোক দু-বেলা ওদের মুখে তুলতেই হয়। পরবে পালায় একটা করে ভালো জামাকাপড়ও কিনে দিতে পারে না। গাঁয়ের কোনো মেয়ের পরনের জামা খাটো হলে, তা গতে গুলেনুরের মেয়েদের গায়ে।

ঘুরতে ঘুরতে হাসুনির মা দু-একদিন জামিলার কাছেও এসে বসে। এটা সেটা করে দেয়। নিজের থেকেই আগ বাড়িয়ে কুটনোর বঁটিটা কেড়ে নিয়ে বলে, সবজিগুলো আমি কুটে দিচ্ছি বুবু, তুমি বসো তো। কোনওদিন বলে, রান্নাশালে কতদিন মাটি পড়েনি বুবু, আজ লেপে দিয়ে যাব?

হাসুনির মাকে কোনওদিন ঘুরোয় না জামিলা। বোঝে বাড়িতে চালের টান পড়েছে।

ছাগলটা এবার সামনের পা-দুটো মাটিতে গেদে বসে পড়তে চাইছে। হাসুনির মা দুই হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে রাখে। এই সময় মোটেই বসতে দেওয়া চলবে না। ছানা বেকায়দায় পড়ে গেলে, মায়ে-ছায়ে দুটোরই জীবন নিয়ে টানাটানি।

জামিলা গুলেনুরের মেয়েকে সামলে রাখে। ছাগলটার কোঁথ পাড়া দেখে বলে, আড়ে-কাটে লেগি গেল নাকিন? এখনও কিছুই বুঝা যাচ্ছেনি যে!

হাসুনির মা মুখে হাত দিয়ে হায় হায় করে উঠে, চুপ করো বুবু, চুপ করো! ও কথা মুখে আনোনি। আল্লাহ আল্লাহ করো। যেন ভালোই ভালোই নেমি আসে দুনিয়ার মাটিতে।

জামিলার কোলে চেপে গুলেনুরের মেয়েটা ছটফট করছিল। হঠাৎ কেঁদে উঠল। মায়ের কোলে যাবে। মেয়েটাকে দেখতে দেখতে জামিলা ঘোরের মধ্যে তলিয়ে যায়। বুকের ভেতর সেই শূন্য জায়গাটায় কেউ যেন পেরেক ঠুকে দেয়। এই মেয়েটা যখন হয়েছিল, তখন একদিন জামিলা কথায় কথায় বলেছিল, হ্যাঁ গা গুলেনুর, তুকে একটা কথা বলছি রাগ করিস না। এর-তার দুয়োরে খেটেখুটে তুই প্যাটের ভাত-কাপড় জোগাড় করিস। ভাতার থাকতেও তুর না থাকা। তুর যে বছর হলিই প্যাট নামানোর কামাই নাই গা?

হাসুনির মা দুঃখ প্রকাশ করেছিল, –কী আর করব বুবু! আমাদের জন্মটাই তো ছেলে বিয়োনোর জন্যি।

এমন একটা জবাব পেয়ে বিষম খেয়েছিল জামিলা। মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা সুপ্ত ইচ্ছাটা প্রকাশ করতে ভরসাও পেয়েছিল। তাও গলায় সংকোচ এনে বলেছিল, যদি কিছু মুনে না করিস, তো একখান প্রস্তাব ছিল গুলেনুর।

হাসুনির মা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, কীসের প্রস্তাব বুবু?

জামিলার বুক ঠেলে বেরিয়ে আসে একটা দীর্ঘশ্বাস। দম নিয়ে বলে, নতুন করে কী আর বলব তুকে। আমার কীসের কষ্ট সবই তো বুঝিস। যার ঘরে ছেলেপুলে নাই, তার জগৎ-সংসারে কেউ নাই!এই সোনামনীকে যদি দিতিস, তো নিজের মেয়ের মতো মানুষ করতাম। গাঁয়ের মধ্যেই রইল, তুইও দেখতে পেতিস, আমারও জানটা জুড়াত।

জামিলার কথা শুনে নিমেষে চিলের মতো ছোঁ মেরে মেয়েটাকে কোলে তুলে নিয়েছিল গুলেনুর। শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বলেছিল, এ কী আবদার করলে গা বুবু!দশমাস দশদিন প্যাটে ধরেছি। মা হয়ে প্যাটের ছেলে কাউরে দিতে পারি!–একটু থেমে বলেছিল, তুমি শুধু মুখে বললে, তাতেই দেখো বুকটা আমার কেমন হাঁকপাঁক করছে।

সেই মেয়ে আজ বড় হয়ে দাঁড়াতে শিখে গেল। পা পা করে চলতেও পারে। জামিলা ভাবে, তার কাছে এতদিন থাকলে নিশ্চয়ই আজ তাকেই মা বলে জানত।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ছাগলটির জন্মদ্বার ভেদ করে বেরিয়ে এল দুটি কালো চিকন পা। গর্ভারস ও রক্তের ধারা ভিজিয়ে দিচ্ছে শুষ্ক ধরিত্রীর বুক। ছাগলটার কী অসহ্য কাতরানী!

হাসুনির মা বলল, বাড়িতে যাও বুবু। কুলো করে মুঠোকতক চাল আর মুসুরি কলাই মিশিয়ে নিয়ে আসো। একটু সরষের তেল মাখিয়ে নিবে।

গোরু-ছাগল খালাস হলে চাল-কলাই খেতে দেওয়ায় রীতি। জামিলা আর দেরি করল না। গুলেনুরের মেয়েকে নামিয়ে ঘর থেকে চটজলদি চাল-কলাই নিয়ে এল। এসে দেখল, খালাস হয়ে গেছে। পিচ্ছিল গর্ভারসের ওপর পড়ে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে একটা কালো ছাগল ছানা। ধাড়টা জিভ দিয়ে চেটে পরিস্কার করে দিচ্ছে ছানাটার গা। গুলেনুর পায়ের ডগার কচি খুরগুলো নখ দিয়ে খুঁটে খুঁটে মিল করে দিচ্ছে।

কুলোটা ধাড়টার সামনে নামিয়ে দিল জামিলা। এখন খাবার মন নেই, বার কতক মুখে নিয়ে আবার ছানাটাকে জিভ দিয়ে চাটতে শুরু করে দিল। লেজটা আনন্দে দোলাচ্ছে।

ছানাটা নড়বড় করে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই নজর পড়ল জামিলার। ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বলল, ধুর, ধুর!পাঁঠা ছা’ হল!শুধু শুধু খাইয়ে দাইয়ে বড় করা, পালে বাড়বেনি!

হাসুনির মায়ের ঠোঁটের কোনে একফালি হাসি। সরাফতের বউটা ছাগলের পাঁঠা বাচ্চা হয়েছে বলে মনে দুঃখ পেয়েছে, আবার হাসুনির বাপ তার পর পর মেয়ে হয় বলে কত কথা শোনায়। মারধর করে। মানুষের মন যে কী দিয়ে গড়া, তা বুঝতে পারে না হাসুনির মা। জামিলার কথা শুনে খুবই ব্যাথা পেল সে। বলল, জনম-মরণের পতি মানুষের কুনু হাত আছে গা বুবু! মানুষ চাইলেই তা হবে নি, –একটু থেমে চাপা শ্বাস ছেড়ে বলল, পাঁঠা ছাগল হয়েছে খুব ভালো হয়েছে, আরও হোক। দুনিয়ায় যেন আর কুনু মেয়ের জন্ম না হয়। বলে ছানাটার কানদুটো আঙুল দিয়ে খাঁড়া করে ধরে মুখ লাগিয়ে হাসুনির মা জোরে চিৎকার করল, কান-টু-উ-উ-উ…কান-টু-উ-উ-উ…

গর্ভ থেকে দুনিয়ার মাটিতে নেমে আসার সময় বাচ্চার কানগুলো বুজে যায় অনেক সময়। তাই জোরে চিৎকার করে শোনার পথটা পরিস্কার করে দিতে হয়। এটাই নিয়ম। জন্মানোর পর ‘কান-টু’ না করলে অনেক গোরু-ছাগল বড় হলে কালা হয়ে যায়। শুনতে পায় না।

জামিলা বলল, কই গো গুলেনুর! এখনও যে গর্ভফুল পড়লনি। আরও একটা ছা’ হবে নাকিন!

হাসুনির মা জামিলার লোভের আগুনে ঘি ঢেলে দিল। বলল, তাই তো মুনে হচ্ছে গো বুবু। প্যাটটা যা ফুলে আছে, আরও একটা ছা’ হতি পারে।

ছাগলটির জন্মদ্বারের দিকে চেয়ে অপেক্ষা করে আছে জামিলা। তার আশা ছাগলটা আরও একটি বাচ্চার জন্ম দেক, পাঁঠি বাচ্চার। আর হাসুনির মা জামিলার ওই লোভার্ত জ্বলজ্বলে চোখদুটির মধ্যে তার স্বামীকে দেখল। যেন পুত্র সন্তানের আশায় তার ফুলো পেটটার পানে কটমট করে চেয়ে আছে। একটি অবলা পশুর থেকে নিজের কোনো তফাত খুঁজে পেল না হাসুনির মা।

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu