ফজরের আজানের সাথে সাথেই ঘুম ভাঙে আবদুস সামাদের। নামাজটা পড়েই যান গোয়াল ঘরে। গরুগুলোকে বের করে গোছালী ঘরে রাখেন। তারপর এক মুষ্টি চাল মুখে দিয়ে এক গ্লাস পানি খেয়ে বের হন চাষের উদ্দ্যেশ্যে। প্রতিদিনের মতই সকালে তিনি হাল চাষ করেন। তারপর অন্য সব কাজ।
গ্রামের অন্য সকল কৃষক থেকে জমির প্রতি, মাঠের প্রতি তার ভালোবাসা ও প্রেম একটু অন্যরকম। তিনি প্রেমিকার মতো ভালোবাসেন জমিকে। আদরে সোহাগে আগলে রাখেন চাষের জমি আপন বউয়ের মতো। দিন যায় ধান ক্ষেতে, পাট ক্ষেতে। দিন শেষে ঘরে আসেন। সারাদিনের ঘটনাগুলো খেতে খেতে বলেন প্রাণপ্রিয় বউকে। বউ আগ্রহ নিয়ে শুনেন। এভাবে কাটালেন ৪৩ বছরের সংসার। ঝগড়া-বিবাদ-ভালোবাসার সংসার।
দুপুরে প্রচন্ড রোদে ফিরে আসেন বাড়ি। বিশ্রাম করেন। বিশ্রামের ফাঁকে ফাঁকে জমে উঠে খেয়াল খুশির নানান আলাপ। সেই আলাপে উঠে আসে তার ভিন্ন দৃষ্টির কৃষি আলোচনা। কেউ কেউ বুঝে মাথা নারান আর কেউ কেউ তন্ময় হয়ে শুনেন। গ্রামের অন্য সকলের জমি থেকে তার ক্ষেতে পাট, ধান ও সবজি বেশিই হয়। সেই জন্যে গ্রামের অন্য কৃষকেরা প্রায়ই তার নিকট আসে। তিনি প্রয়োজন অনুযায়ী পরামর্শ দেন।
বিশ্রামের ফাঁকে করেন নিজের গল্প। করেন নানা-নানী, দাদা-দাদীর গল্প। বিভিন্ন গাল-গল্পে মেতে উঠে তার বিশ্রামের আসর। তিনি তার মধ্যমণি। এভাবেই হয়ে উঠেন গ্রামের সকলের প্রিয়। জমতে থাকে তার নিকট আসা মানুষের জীবন। একজন কৃষক দেখেন সমাজ পাল্টানোর স্বপ্ন। সমাজকে আমাদেরই ধরে রাখতে হবে। আমাদেরই পাল্টাতে হবে সমাজের রোগ। এভাবেই বলতে থাকেন। শুনতে থাকে নানান বয়সি মানুষ। নিজ গ্রাম, পাশের গ্রাম ও দূর থেকেও আসেন অনেকেই। আলাপের ফাঁকে ফাঁকে চলে খাওয়া-দাওয়া। পানেই খুশি থাকেন সবাই। মাঝে মাঝে চলে চা। আর গল্প করেন। গল্প শেষ হলে আবার কাজে যান।
তার নিকট আসে ছোটরাও। তাদের সাথেও খাতির জমান। খাতিরে খাতিরে ছোটদের সাথে জুড়েন তার যৌবনের গল্প। কোথায় কি হতো সেই গল্পই করেন বেশি। বাউল গান, জারি গান, গাজী-কালুর কিচ্ছা, পুঁথি পাঠ, কবিয়াল গান থেকে গীত, সব। সবই গুছিয়ে নিজের চাষাবাদের মতই যত্ন করেই পাতেন এই সব আলাপ। মাঝে মাঝে উঠে আসে ঘৌড়দৌড়, নৌকা বাইচ ও হাডুডু থেকে কুস্তি খেলার আলাপ। সেই সব রঙিন দিন।
আমি ছোট থেকেই ছিলাম দুষ্টু। অনেক দুষ্টু। গ্রামের অনেক বন্ধুর সাথেই মারামারি করা ছিলো আমার নিত্যদিনের কাজ। একদিন তাঁর হাতে খেলাম ধরা। ভাবলাম এই বুঝি উনি আমাকে মারলেন। কিন্তু না উনি আমাকে মারলেন না। আদর করে বললেন চলো তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাবো। আমার তখনো বোঝার বয়স হয়নি। বললাম যাবো না। ভয় পেলাম। উনি বুঝালেন– তোমাদের মামা বাড়ি যাবো। সেখানে বাউল গান আছে। তুমি চল মামা বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসবে।
আমি রাজি হয়ে গেলাম। মাকে বলে একটা রঙিন শার্ট পরে রওনা দিলাম তার সাথে। যাচ্ছি আমরা দুজন। গ্রামের মাথায় দেখা ছোট চাচার সাথে। চাচা বললেন— কই যাও? আমি ভয় পেয়ে চুপ মারলাম। আমার ছোট চাচাকে (বাবার আপন ভাই) উনি বোঝালেন। ওকে নিয়ে যাচ্ছি বাউল গানের আসরে। আর কী করার। চাচা আর কিছুই বললেন না। আমরা গেলাম। গ্রাম ভেঙে মানুষ রাস্তা ধরে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে বাউল গান দেখতে। আমিও যাচ্ছি। আমার জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা।
সেই দিন সেই আসরে এসেছিলেন বাউল শিল্পী সালাম সরকার ও সুনীল সরকার। আমি তো বাচ্চা মানুষ, লম্বায় খাটো। পড়ি ক্লাস ফোরে। ফলে বাউল গান আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না। উনি আমাকে কাঁধে নিলেন। আমি প্রায় চার ঘন্টা তার কাঁধে চড়েই বাউল গান দেখেছি। এরপর নানু বাড়ি খেয়ে চলে আসলাম। তারপর আর কোনো দিনই আমি উনার সাথে বাউল গান দেখতে যাতে পারিনি। সুযোগ হয়নি।
তবে আজকে মনে হয় সেই দিনের সেই বাউল গানের আসর আমার জীবনের চিন্তাকে পাল্টে দিয়েছে। আমি বাড়ি এসেই রাতে পড়তে বসলাম। খুব ক্লান্ত। বসেই ঘুম আসলো চোখে। আমি ঘুমিয়ে গেলাম। পর দিন মা বললেন রাতে ঘুমে কী বকছিলি? আমি অবাক হলাম। এখন বুঝি আমি সেই গানই গাইছিলাম ঘুমের ঘোরে।
যার কথা বলছি উনি আমার বাবার চাচাতো ভাই। আমার চাচা। প্রিয় ছমেদ চাচা। গ্রামে সামাদকে উচ্চারণ করে ছমেদ। পরদিন সকালে আমি আবার গেলাম চাচার কাছে। উনি বললেন, কী? আমি বললাম, গান লিখছি। উনি বললেন, তাই? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি গানটি দেখলেন। হাসলেন। বললেন, যাও, আরো লিখে নিয়ে এসো। আমার হয়তো সেইগুলো কোনো গানই ছিলো না। কিন্তু লেখালেখির শুরুটা সেখান থেকেই। তারপর জীবনে যেখানে যত বাউল গান হয়েছে আমি কোনোটাই বাড়ি থাকাকালীন মিস করিনি।
আজকে ছমেদ চাচা বেঁচে নেই। উনি হার্ট এট্যাক করে মারা গেছেন কিছু দিন আগে। আমার খুব কষ্ট হয়েছে। চাচা যেদিন মারা গেলেন সেই দিন আমি বাগেরহাট। খাজা খান জাহান আলীর দরবারে। বাবা ফোন করে বললেন– ছমেদ ভাই আর নেই। আমি আর কিছুই বলতে পারিনি। চুপ করে ছিলাম। বাড়ি থেকে অনেক দূরে থাকায় আমি আর তাঁকে দেখতে যেতে পারিনি। পরে বাড়ি গিয়ে উনার কবরের সামনে দাঁড়িয়ে ক্ষমা চেয়েছি। চাচা আমাকে মাফ করে দিও।
তোমার নিকট থেকে আমার জীবনে অনেক কিছু শিখেছি। শিখেছি মানুষের প্রতি ভালোবাসা, যুক্তি ও প্রেম। তৈরি হয়েছে কৃষক ও কৃষির প্রতি আগ্রহ। বাউল গানসহ বাঙালির সকল সংস্কৃতির প্রতি জানার ইচ্ছেটাও তোমার থেকেই পেয়েছি। তুমি শুধু একজন কৃষকই ছিলে না। তুমি ছিলে কৃষক ও চিন্তক। যে গ্রামের অন্য সকলের থেকে সমাজ নিয়ে ভিন্নভাবে ভাবতে। সমাজকে পরিবর্তন করার প্রবল ইচ্ছে তোমার ছিলো। কৃষি নিয়ে ছিলো স্বপ্ন। তুমি চাইতে কৃত্রিম চাষাবাদ মানুষ না করুক। বরং বাঙালির যে কৃষি ঐতিহ্য মানুষ তা যথাযথ জানুক, মানুক ও পালন করুক। এই ছিলো তাঁর স্বপ্ন। তাতে কৃষক ও কৃষির উন্নতি হবে বলেই তিনি মনে করতেন। তুমি সেই পথেই সারা জীবন হেঁটেছো। জীবনের শেষ অবধি তুমি ছিলে বিপ্লবে অনঢ়। তোমার পথে হাঁটছে ভাটি বাংলার অনেকেই।
আজ তুমি নেই। গ্রামটাও আমার ফাঁকা লাগে। বাড়ি গেলে আমার মোটেও ভালো লাগে না। যখন ভাবি তুমি বারান্দার চেয়ারে বসা থাকবে না তখন বুকটা হা হা করে উঠে। ভাবি কার সাথে আমি উকিল মুন্সীর গান নিয়ে কথা বলবো? কে আমাকে করিমের গানের সবক শিখাবে? তার থেকেই আমি উকিল, হাসন ও করিমের গানের মানবতাবাদী পাঠ পেয়েছি। তাকে দেখতে পাবো না এই ভয়ে বাড়ি যাই না।
কয়েক দিন আগে মা অসুস্থ ছিলেন। বাড়ি গেলাম। বাড়িতে ঢোকার আগেই মসজিদের সামনে তোমার কবর। দেখেই বুকটা ধুক ধুক করে উঠলো। চাচা তুমি কী আমাকে শুনতে পাচ্ছো?
দেখ তোমার এই ছোট্টো ছেলেটা আজকে কবিতা লিখে, গান লিখে, গল্প লিখে। তোমার মত সে সাচ্চা কৃষক হতে পারেনি। কিন্তু তোমার ভিতরের চিন্তা তাকে তাড়া করে। সে তোমার চিন্তাকে বয়ে চলেছে। আরেকটা কথা চাচা– কবিতা আমি সেই ক্লাস ফোর থেকেই শুরু করেছি। দুটো বইও আমার বের হয়েছে। কিন্তু সাহস করে তোমাকে কখনো শুনানো হয়নি। যদি ভুল হয় সেই ভয়ে। আমি ভালো লিখতে পারি না। তোমার মতো এতটা মানবতাবাদী হতেও পারি না। তবে তোমাকে ভেবে একটা আপসোস হয়– হায়! আমি যদি তোমার মতো একজন কৃষক হতে পারতাম? যে আধুনিক সময়েও কৃত্রিম সার ব্যবহার না করে, কোনো রাসায়নিক বিষ ব্যবহার না করে পাট, ধান, সবজি চাষ করবে। যে লালন ও পালন করবে বাঙালির হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস ও ঐতিহ্য।
চেষ্টা থাকবে জীবনভর। দোয়া করো আমার জন্যে, আমাদের জন্যে। যেন আমরা বাঙালি হতে পারি তোমার মতো।