হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

মৃতদেহ

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

পরিতোষ বারান্দা থেকে দেখল রাস্তায় এখানে ওখানে দু’একটা জটলা। পরিতোষ বুঝতে পারে ওরা অলোকেশকে নিয়ে কথা বলছে। আরও কয়েক ঘন্টা হয়ত চলবে। তারপর আবার যা তাই। সবাই চলবে নিজের ছন্দে।

খবরটা পরিতোষ পেয়েছিল বেলা তিনটেয়। প্রথমটায় বিশ্বাসই করতে পারে নি। তারপর ভেবেছিল, এরকম খবর তো মিথ্যে ছড়াতে পারে না।

বুকের ওপর কে যেন একটা পাথর চাপিয়ে দিল পরিতোষের। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। বারান্দায় বেরিয়ে এসে চেয়ারটা টেনে বসেছিল। সেই থেকে বসে।

অলোকেশকে নিয়ে এলো। তখনও পরিতোষ নড়েনি। শেষ দেখাও দেখেনি বন্ধুকে সহ্য করতে পারবে না বলে।

ঘড়ির দিকে তাকাল পরিতোষ। ছ’টা বেজে গেছে। গতকাল এখনও তারা একসঙ্গে। সমরেশ, পরিতোষ, গীতানাথ, উদয়ন, অলোকেশ। জমিয়ে আড্ডা। স্টেশনের একেবারে শেষ মাথায়। কোলাহল এখানে অনেকটা হালকা হয়ে যায়।

অলোকেশ এমনিতেই চুপচাপ। তবে গতকাল যেন একটু বেশিই চুপচাপ ছিল। পরিতোষ তাকে অনেকবার জাগাতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু পারেনি।

অলোকেশ সব কথাই বলত পরিতোষকে। একমাত্র পরিতোষকেই বলতো। কিন্তু গতকাল বলেনি একটি কথাও। হয়ত ছেলে বৌমার কাছে ভীষণই আঘাত পেয়েছিল। জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ অলোকেশ তাই পরিতোষকে কাছে ডাকেনি। দেখে মনে হয়েছিল ভীষণই ক্লান্ত সে।

পরিতোষও একই পথের পথিক। বুকের রক্ত জল করা পরিশ্রমের টাকায় তৈরি বাড়িতে সে একা। একঘরে। প্রায় অন্ধকার একতলার একটা ঘর। বরাদ্দ সকালের চা আর দুবেলা ভাত।

পরিতোষ নিজের নিয়ে কখনও ভাবিত নয়। তার সকল ব্যস্ততা ছিল অলোকেশকে নিয়ে। বেঁচে থাকার এ এক অসাধারণ কৌশল। অলোকেশকে সামনে আনলেই তার দুঃখ হাওয়া।

আজ পরিতোষ সবদিক দিয়ে সত্যিই একা। আড্ডার আরও অনেকেই আছে। কিন্তু অলোকেশের সঙ্গে মিলত ভালো। তাকে সংসারে বাঁচাবার জন্য কত রকমের বুদ্ধি বার করতে হয়েছে পরিতোষকে।

আড্ডায় আসাটা অলোকেশের বাড়ির লোকেরা একেবারেই পছন্দ করত না। বিশেষ করে বড় ছেলের বউ। তাই সন্ধ্যে উত্তীর্ণ হয়ে গেলেই অলোকেশের মধ্যে একধরনের অস্থিরতা লক্ষ্ করত পরিতোষ। কাউকে কিছু বলত না, কিন্তু পরিতোষ ঠিক বুঝতে পারত। আর তখনই পরিতোষ কোনো একটা কারণ দেখিয়ে মাঝপথে থামিয়ে দিতে আড্ডা। অলোকেশকে কোনো কথা বলতে দিত না। পরিতোষ এমন আচরণ করত যে, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার প্রয়োজনটা যেন তারই।

একদিন মাত্র পারেনি পরিতোষ। সেদিন অবশ্য তারা স্টেশনের আড্ডায় ছিল না। গীতানাথ আড্ডার সবাইকে তার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। নাতির বউ দেখাতে। নাতি সদ্য আমেরিকা থেকে ফিরেছে।

সবই ঠিকঠাক চলছিল। বউ দেখে চা খেয়ে উঠতে যাবে এমন সময় গীতানাথের বউ বলে বসল, “নাতবউ দেখতে এসেছেন, না খাইয়ে ছাড়ছি না।” পরিতোষ নিজের অনেক অসুবিধার কথা জানিয়েও রেহাই পেল না।

রাতের খাবার খেয়েই ফিরতে হল। রিক্সায় একটাও কথা বলেনি অলোকেশ। গলিতে রিক্সা ঢোকে না তাই গলিতে ঢোকার মুখেই ওরা নেমে গিয়েছিল। মিনিট চারেকের বাকি পথ হেঁটে।

সদর দরজাতেই অলোকেশের বড় ছেলের বউ কার সঙ্গে যেন কথা বলছিল। এমনভাবে শুরু করেছিল পরিতোষ যে অলোকেশও বুঝতে পারেনি, “বৌমা, আজ অলোকেশকে রাতের খাবার দেবে না। সকালে ইলিশ মাছ এনেছিলাম। খুব ইচ্ছা হলো ওকে খাওয়াই। তাই একটু দেরি হয়ে গেল।” বাড়িতে এসে বউ সবিতাকে বলে দিয়েছিল, অলোকেশের বড় ছেলের বউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে কী বলতে হবে।

খুব চিন্তায় ছিল পরিতোষ। পরদিন আড্ডায় অলোকেশের মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছিল তেমন কিছু হয়নি। পরিতোষ জানে এ শুধু তারই জন্য। শুধু তার বাড়িতেই সময় কাটিয়েছিল বলে অলোকেশের ওপর দিয়ে কোনো ঝড় যায়নি।

বাড়ির সীমাহীন অবহেলা পরিতোষ একমুহূর্তে ভুলে যেতে পারত অলোকেশের পাশে দাঁড়িয়ে। প্রায় বাতিল হয়ে যাওয়া মানুষটার নিজেকে দরকারি মনে হতো অলোকেশের কাছে এলে। কিন্তু আজ আর কারও কাছে তার কোনো মূল্য নেই।

পরিতোষের বাড়িটা এমন একটা জায়গায় যেখান থেকে গোটা পাড়াটা দেখা যায়। বিশেষ করে অলোকেশের বাড়িটা। আজ যেন সেখানটা একটু বেশি অন্ধকার।

বৌমা রাতের খাবার দিয়ে গেছে। পরিতোষ খায়নি। তার খিদে নেই।

খবরটা শোনার পর থেকে পরিতোষ একভাবে বারান্দার চেয়ারে বসে আছে। একেবারে রাস্তার গায়েই বারান্দাটা। কত রাত হল কে জানে। হঠাৎ চমক ভাঙল।

“এত রাতে এখনও বারান্দায়? কি করছেন জেঠু? ”

পরিতোষ তাকিয়ে দেখল। উদয়নের মেজো ছেলে। অফিস থেকে ফিরছে। পরিতোষ বলল,”মৃতদেহ আগলে বসে আছি বাবা!”


 

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu