সাকার মুস্তাফা
সাকার মুস্তাফা, জন্ম সাতক্ষীরা জেলার কাটুনিয়া গ্রামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা শেষ করে তিনি এখন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকসংস্কৃতি বিভাগে নিযুক্ত। লোকসংস্কৃতি, আদিবাসীগোষ্ঠী ও বাংলা সাহিত্য তিনি গবেষণা করে চলেছেন। সাহিত্যের বিভিন্ন লিটলম্যাগে  এবং জাতীয় দৈনিকে তিনি নিয়মিত লেখালিখি করেন। উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত গ্রন্থ: "ভাঙা ইতিহাস" (গল্পগ্রন্থ, ২০১৩), নজরুলের শ্যামাসাধনা ও শ্যামাসংগীত (গবেষণাগ্রন্থ, ২০১৯)।
সাকার মুস্তাফা

মায়াহরিণীরা!

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

হরিণ মায়াময় প্রাণী! হরিণের প্রতি হরিণীর মায়া, বাচ্চার প্রতি মা হরিণের, বাবা হরিণের, আর সব হৃদয়ের বোন। এইভাবে হরিণের মায়ার সংসার। একসাথে দলবেঁধে চলে। বিশ্রামের সময় রসুনের মতো বসে, মুখ-মাথা চারদিকে ছড়িয়ে রাখে! শত্রুর প্রতি সতর্ক পাহারা! একটা আওয়াজ হলে উল্টো দিকে দেয় ভৌঁ দৌড়! এমনকি কারো পেটের মধ্যে যদি গুড়গুড় আওয়াজ দেয় তবুও। আবার ফিরে খবর নেয় সাথীরা সব ঠিকঠাক আছে কিনা। মা হরিণীকে ঘিরেই থাকে হরিণের সংসার। শিকারীর টার্গেট থাকে মা হরিণের প্রতি। সুন্দরবনের সর্বত্র কমবেশি হরিণ চোখে পড়ে। এখান থেকে ত্রিশ চল্লিশ বছর আগেও নদীর কিনার ধরে লোকালয়ে চলে আসতো ঝাঁক বেঁধে হরিণের দল। এখন আর আসে না, কারণ মানুষের বসবাস বেড়েছে, উৎপাত বেড়েছে। সুন্দরবনের গহীন অরণ্যে প্রচুর হরিণ দেখা যায়, সব জায়গায় না। অথচ, যৌবনের দিনগুলোতে কি দাপট ছিলো! ঝানু শিকারী সে! বনের পাখি, হরিণ, বাঘ, সাপ কোনোকিছুর রেহাই ছিলো না! নজর পড়লেই আজরাইল তার জন্যে বরাদ্দ! আহা! হরিণের মাংস কি সুস্বাদ! বাটাং, ডাহুক, বক আরো কত নাম জানা, না জানা পাখি! ৬ নং ডিশে ভুনা করে রাতের আসর, সাথে খেজুরের চোয়ানো রসের বাংলা। ফূর্তি শেষে চার পাঁচ জনের একটা দল নিয়ে বনে নামতো শমসের গাজী!  হরিণ শিকারে! কচিমুখময় সুন্দর হরিণীর দিকে তাক! লক্ষ্যভ্রষ্ট হবার সুযোগ নাই। তারপর রক্তে ছড়িয়ে পড়ে এক ধরনের বুনো উল্লাস!  যেভাবে বালিকাবধূকে রাস্তা থেকে ধরে ঘরে নেয়ার মধ্যে রয়েছে! কথাগুলো মগজে ভাটার জলের মতো বইতে থাকে শমসেরের! ভাটার জলই!

কিন্তু আজ! কিছুই নাই। দেহে বল নাই! মনে জোয়ার নাই! পেটের যন্ত্রণায় মুখে রক্ত উঠে থাকে সর্বক্ষণ! পাকস্থলীতে ক্যান্সার! ধরা পড়েছে ছমাস আগে। শুরুতে দাপট ঠিকঠাকই ছিলো! কিন্তু মাস ঘুরতেই বোঝা গেলো! মৃত্যু তার বুকে শুধু নয়, পেটেও বাসা বেঁধেছে! দিনের পর দিন যন্ত্রণা বাড়ে, জ্বালা বাড়ে। খাবারে অরুচি, সমস্ত শরীরে যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়েছে! চোখের সামনে ভেসে ওঠে সোনালী অতীত!

বছরের অধিকাংশ সময় বনবাঁদায় শিকারে ঘোরাঘুরি! গ্রামে ফিরলে মানুষের সাথে ঝগড়াঝাঁটি আর মারপিটে সময় পার! মহা বিরক্ত মানুষ! বাপ রমিজ গাজীর এক্তিয়ারের বাইরে শমসের! বাপের অবাধ্য! সাত পুরুষ পূর্বে এক বর্ষার রাতে ধুমঘাটে এসে বসত গেড়েছিলো শমসেরের পূর্বপুরুষ! তখন জলাজঙ্গলে ঘেরা সমগ্র অঞ্চল!  রমেশ বাবু তার পরদাদা জহির গাজীর বন্ধু। দুই বন্ধু ছেলেপিলে আর সংসার নিয়ে এ অঞ্চলে পাড়ি জমিয়েছিলো!

ধুমঘাট বাংলার রাজধানী!  রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজধানী!  ভাবা যায়! সেই ৫/৭ সাতশ বছর আগে কি রওনক ছিলো! আজ তার কিছুই  নাই। না একটা ইটের দেয়ালও অবিশিষ্ট নাই রাজবাড়ির! ধুমঘাটের ছোট্ট এলাকা হেতালখালি। কিছুকাল যেতে না যেতেই বিভিন্ন দিক থেকে কিছু কিছু মানুষ এসে সুন্দরী কাঠের পাড়াং করে ঘর বাঁধতে শুরু করে উঁচু কোরে, বাঘের নাগালের বাইরে। দিনে দুপুরে বাঘ আসলে সবাই মিলে লাঠিশোটা নিয়ে হাক ডাক করে, গাজী গাজী বলে চিৎকার দেয়, কালু কালু বলে হাতের লাঠি সপাটে সামনে যা পায় সেখানে আঘাত করে! বাঘ চলে যায়। তারা বোঝে গাজীকালুর কেরামতি কতো শক্ত! কি বিপদ থেকে যে তারা রক্ষা পেলো! তারপর দিনভর চলে গাজীকালুর গুণবর্ণনা, ইতিহাস বর্ণনা। একদা এক আরব দেশ থেকে গাজীর পিতা এসেছিলো ধর্ম প্রচারে! কালু তার মাায়ের পেটের ভাই। দুভাই মিলে বনে যেতো বাঘ শিকারে। বাঘ একবার আক্রমণ করলো কালুর উপরে গাজী ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঘের উপরে। বাঘ কালুকে ছেড়ে ধরে গাজীকে। কালু তখন ঝাপিয়ে পড়ে বাঘের উপরে। এ লড়াই বেশ কিছুক্ষণ চলার পর ছেড়ে চলে যায়। সেই থেকে এ অঞ্চলের মানুষের ভরসার বিশেষ স্থান গাজীকালু। কিন্তু সব সময় বাঘ খালি মুখে ফেরে না। কখনো হয়তো কারো ধরে নিয়ে যায়। মড়া কান্না চলে কয়েকদিন ধরে, তারপর লাঠিশোটা নিয়ে আবার বাঘ তাড়ায়! নিদেন পক্ষে একটা ছাগল, গরু তো খাবেই। রাত তাদের জন্য ভয়ের আধার! সেজন্য মাচাং ঘরই নিরাপদ!পেটের ভিতরে কি ভয়ানক যন্ত্রণা! পোকাগুলো কিলবিল করছে, মনে হয় মাথা ঠুকছে বাইরে আসবার জন্যে! গত ছমাসে তারাও বিরক্ত হয়ে গেছে! আচ্ছা, একি হরিণের অভিশাপ! যে হরিণকে মেরেছিলাম তার হরিণীর সামনে? তারপর ছুটে গিয়েছিলো হরিণী! পরক্ষণে ফিরে এসে নিজেই ধরা দিয়েছিলো দোনলা বন্দুকের বাটের সামনে! নাকি সেই মা হরিণীর অভিশাপ! যার পেট ফাড়ার পর দেখা গেলো বাচ্চা, মনে হয় এখনই দৌড় দেবে পৃথিবীর পথে! ভাবনাগুলো শাখাপ্রশাখা ছড়ায়, আর এক একটা শূলোর মতো ফুটতে থাকে!

শফিক বলেছিলো, “আর হরিণ মারবো না! চল বাড়ি যাই। হরিণ এমন নিরীহ পেরানী, আমাগো অভিশাপ লাগবেনে”। হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিলো শমসের! কিসের এতো আবেগ! কিসের অতো মায়া!  বন করতে গেলে ওতো মায়া থাকলে চলে না! কই যখন বন্যা আসে তখন তো কে মরে কে বাঁচে কোনো ইয়াত্তা থাকে না! সেবার আয়েলার পানিতে ডুবে গেলো সব। বিলের মধ্যে বারো বছরের ছেলের সাথে মাছের ঘেরে আটল ঝাড়ছিলো সে। হঠাৎ দূরে দেখা গেলো সাদাপাহাড় যেন ছুটে আসছে তীব্র গতিতে। আর সেই সাথে গর্জন, অমন গর্জন আগে কখনো শোনেনি শমসের! মুহূর্তে পানির তোড়ে হারিয়ে যায় বার বছরের ছেলে তোতা! যখন নিজেকে জীবিত আবিষ্কার করে সে, দেখে নিম গাছের  গুলতির ছড়ের মতো একটা ডালে বেঁধে আছে চিংড়ির মতো খোলস দেহটা। অনেক কষ্টে গাছে উঠে বসেছিলো সারাদিন, সারারাত! রাতভর পানির গর্জন! এর আগে সিডর গেলো, সে রাতও কী ভয়ঙ্কর! সেই গভীর রাতে মা উঠোনে পিড়ি পেতে রেখে এসেছিলো! ঝড়ের ঠাকুর তবে শান্ত হবেন। কিন্তু কই আর শান্ত হলেন, উল্টো ঝড়ে মা উড়ে গিয়ে পড়েন পাশের ব্যাড়ের মাথায়। সাথে সাথে খেয়াল না করলে হয়তো আর জীবিত পাওয়া সম্ভব হতো না! বেঁচে থাকলেও মাজার চোটের ব্যথাটা আমৃত্যু মায়ের ছিলো! প্রতি গনমুখে চাঁদ বাড়বার সাথে সাথে ব্যাথা চাগাতো, আর ভাটায় পানি না নামা তক কি কষ্ট যে পোহাতো! ভোরের দিকে বাতাসের গতি কমে আসে। তার মনে হয়, ঝড়গুলো রাতে আসে, আবার দিনেও আসে তবে, বাড়ে রাতে। যতো রাত গভীর হয়, ততোই ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে রাতের ঝড়! আশাপাশে কোনো গাছ ছিলো না সকালে। চারদিকে ধ্বংসের লীলাভূমি! অধিকাংশের ঘরের চালার খবর নাই, উড়ে কোথায় গিয়ে পড়েছে! ঝড়ে ঘরের চাল ওড়া স্বাভাবিকভাবেই নেয় তারা, কিন্তু সিডরের আঘাতে চাল যে কোথায় গেছে, খুঁজে পাওয়া দায়! সুন্দরবনের বড় সব গাছ পড়ে ছিলো মুখ থুবড়ে! বাপ দাদার মুখে তো এমন সব বন্যা আর ঝড়ের গল্প শুনেই বড় হয়েছে সে! ছোটবেলাতেও অনেক ঝড় বন্যা দেখেছে। নদীর বাঁধ ভাঙলেই বন্যা আসে! কিন্তু সিডরের ক্ষতির চিহ্ন তাদের বহুকাল ছিলো, এ ঝড় আগের সব গল্পকে হারিয়ে দেয়!

সারারাত আল্লাহরসুল আর গাজীকালুর নাম জপতে জপতেই ভোর হয়েছিলো তার! ভোরের আলো ফুটতেই দেখা গেলো পাশের ডালে ঝুলে আছে শামুকভাঙা কেউটে সাপ! এ এলাকার যতগুলো ভয়ঙ্কর সাপ আছে তার মধ্যে অন্যতম। গোখরা, কালাছ, লাউডগাসহ অনেক সাপই ভয়ঙ্কর, কামড়ে মানুষের মৃত্যু হয়! তারা মানুষকে দেখে পালাবার চেষ্টা করে। কিন্তু শামুকভাঙা কেউটে মানুষ দেখলে তাড়া করে কামড়াতে আসে! তাই মানুষও প্রস্তুত থাকে, হাকডাক শুনলেই লাঠিশোটা নিয়ে বের হয়! কারো সামনে পড়লে সে ভয়ে চিৎকার করে, কিন্তু সাপের নাম তারা ধরে না, তাদের বিশ্বাস সাপের নাম ধরলে সাপ অদৃশ্য হয়ে যায়। বাঘেরও তারা নাম ধরে না, বরং মামা বলে ডাকে, তাতে বাঘ খুশি থাকে, আক্রমণ কম করে। বাঘ সাপের সাথে তাদের নিত্য লড়াই, তাই তারা ডরায় না! এটাকে  তারা ভাগ্য বলে মেনে নিয়েছে। এমন বাড়ি একটিও খুঁজে পাওয়া দায়, যে বাড়ির অন্তত একটি ছেলেকে বাঘে খায় নি! এমনও আছে তিন ভাইয়ের তিনজনকেই বনের বাঘে খেয়েছে! বাঘের মুখ থেকে ফিরেছে হাতের একপাশ রেখে, অথবা কয়েকটা দাঁতের চিহ্ন আছে কাঁধ বরাবর! তবুও তারা বাঘ শিকারে যায়, হরিণ শিকারে যায়, মধুর চাক ভাঙে, কাঠ সংগ্রহ করে, কেঁওড়া পাড়ে, গোলপাতা, হোগলা কাটে। তারপর বোঝাই করে এলাকায় ফিরে আসে। ভেটখালী, গঙ্গার মোড়, যাদা, কালীগঞ্জের হাটে চালান দেয়।

এমন ঝুঁকিপূর্ণ জীবনে তাদের একটিই ভরসা! গাজীকালু পীর! বনে ওঠার মুখেই গাজীকালুর পুজো করে। প্রার্থনা শেষে বনে ওঠে! আবার, বনের মধ্যেও বিভিন্ন স্পটে গাজীকালুর থান আছে, প্রতিমা আছে! পাশাপাশি দুটো প্রতিমা! একটা গাজীর অন্যটা কালুর! একটি সাদারঙে শ্মশ্রুমণ্ডিত, মাথায় টুপি! অন্যটি বিশাল বাহু, বিশাল বপু সমন্বিত নীলচে গাঢ় কালো রঙের কালু। দেখলেই শ্রদ্ধায়-ভয়ে মাথা নোয়ায়, সালাম ঠোকে! সেসব জায়গায় ভোগ দেয়, পুজো দেয়। আবার, কেউ কেউ আলী-ফাতেমা-হনুফার নামে দোয়া পড়ে, স্মরণ করে! এসব বিষয়ে কে বা কারা হিন্দু-মুসলিম তারা তা খেয়াল রাখে না! বনে গেলে সবাই ভাই ভাই। তাছাড়া, আপন মায়ের পেটের ভাই ছাড়া তারা একসাথে বনে কমই ওঠে। কারণ, বিপদে বাঘের মুখে সবাই পালালেও ভাই কখনো ভাইকে ছেড়ে পালায় না। হয় আহত হয়ে, বাঘের সাথে লড়াই করে দুজনেই ফিরবে, না হয় দুজনেই মরবে, এভাবে তাদের বাদাজীবন কেটে যায়!

সাপটা কিন্তু ডালের সাথে জড়িয়ে মাথাটা নিচু করে একমনে তাকিয়ে আছে শমসেরের দিকে, সেও তাকিয়ে আছে সাপটার দিকে, দুজন দুজনকে পরখ করে নিচ্ছে। একবার ভাবে, “একটা ডাল ভেঙে সাপটাকে আক্রমণ করি”, কিন্তু পরমুহূর্তে মনে হয়, না সেও আশ্রয় নিয়েছে জীবন বাঁচাতে! সকালে পানি একটু কমলে সাঁতরে বাড়ি পৌঁছেছিলো শমসের। ছেলের লাশাটা আর পাওয়া যায়নি! অবশ্য চারদিকে পানি থৈ থৈ, খোঁজবার জায়গা নেই। সবাই বড় ঘরের মধ্যে অবস্থান নিয়েছিলো। পানি উঠেছিলো ঘরের বারান্দার কানাকানি। অবশ্য তুফানের সময় ঘরের মেঝে পার হয়েছিলো, ছোট ঘর দুটোর বুক বরাবর তিনদিন পানির মধ্যেই ছিলো! পানি উঠোনের নিচে নামতে সপ্তাহ কেটেছিলো। চারদিকে কাঁদা, জঞ্জালে পূর্ণ। ছাগলগরু মরাপচা গন্ধে বাতাস ভারি। মানুষও মরেছিলো বন্যায়, সাপ-বিছের কামড়ে। সেই ভয়াল সময় মনে পড়তেই গায়ের পশম দাঁড়িয়ে যায় শমসেরের।

এইসব ঝড়ঝাপটায় নদীপাড়ের জীবন থেমে থাকে না! এসব কিছুর মধ্যেই গ্রামে বিদ্যুত আসে, ডিশ লাইনে রাত জেগে খেলা দেখে ফুটবল বিশ্বকাপের! আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের দর্শকরা পতাকা টানায় পাল্টাপাল্টি! খেলা শেষে একদল বাজি পোড়ায়, উল্লাস করে, তর্ক চলে দিনের পর দিন! কখনো ঝগড়া বেঁধে যায় তুমুল হারে! মারামারি করে, মাথা ফাটায়! হাসপাতাল থেকে ফিরে একই চায়ের দোকানে বসে খেলা দেখে!

অথচ! কি দশা ছিলো এই অঞ্চলের! শমসের পরদাদার মুখে গল্প শুনেছে! প্রথম দিকে জমিদাররা জোর করে জমি ইজারা দিতো! বছর শেষে জমিদারের পাইক খাজনা নিতে আসতো! তখন বাঁধতো বিপত্তি। ঘরে খাওয়ার চাল নেই। খাজনা কিভাবে দেবে! নিষ্ফলা জমি! কোনো ধরনের ফসল হয় না! তার উপর যার আওতায় যতটুকু জমি সেই জমি বরাবর রাস্তা তৈরি করতে হবে জমির মালিকের! সারাবছরে বন্যার তোড়ে কয়েকবার রাস্তা ভাঙে! কে নিজের খেয়ে বারবার বনের মোষ তাড়াবে! তাই পাইক এলে বাড়ি ছেড়ে পালাতো পুরুষেরা! যারা ধরা পড়তো খাজনা দাও নতুবা বেতের আঘাত সহ্য করো, গামছা পরে ছোটো জমিদার বাড়ি! কিছু টাকা, মুচলেকা, গতরের খাটুনি দিয়ে মুক্তি মিলতো সে বছরের মতো! ওদিকে পুরুষ শূন্য বাড়িতে পাইক-পেয়াদারা কোনো কোনো গৃহবধূকে বেইজ্জতি করে বলে শোনা যায়! নিজেদের অসহায় অক্ষমতাকে হেতালখালীর লোকজন ভুলে থাকতে চায়।

সারাবছরই পথঘাট ডুবে থাকতো, তবে বর্ষার মরশুমে শুধু নিশানাই থাকতো। সেই নিশানা ধরেই মানুষ সপ্তায় একদিন হরিনগরের হাঁটে উঠতো, যার পয়সা কিছু বেশি সে যেতো মুন্সিগঞ্জের হাঁটে। নদীর বেশি কোলের লোকেরা যেতো ভেটখালীর হাটে!

গামছা পরেই বাজারে যেতো! লুঙ্গি-ধুতি তখন অতো সুলভ না, কেনার ক্ষমতাও সবার ছিলো না! সারাসপ্তার হাঁটবেসাতি করে ফিরতো তারা! তরিতরকারি আর চাউল! মাছ তাদের বাড়ির পুকুরে, পাশের ডোবায়, নদীর জলেই থাকতো! বরং এসব মাছ ধরে তারা হাঁটে নিতো, বেঁচে বাজার করে ফিরতো। পানসুপারি তাদের আয়েশি খাবার, ওটার জন্যে দরিদ্রতম একটা বাজেট প্রায় থাকতো! নিমের দাঁতের মাজন মাঝে মাঝে কিনতে হয়! মাজন বাড়ির বাচ্চাদের জন্যে। বড়রা কাঠের কয়লা, আর গনিগুলের ওপরই নির্ভর করে। কাপড়কাচার খার আর শোডার গুড়ো অবস্থাপন্নরা কেনে। গরিব পরিবারের লোকজন কলার বাঁশনা পুড়িয়ে ছাই করে কাপড় কাচে আর মাথা পরিষ্কার করে একটু লালচে মাটি দিয়ে। অবশ্য, লালচে মাটি সব পুকুরে মেলে না।

মাজার ব্যথার তেল, গ্যাসের টনিক, ভয়ভীতি, ভূতের ভয় থেকে মুক্তি পেতে ব্যবহার করে মাদুলি। অবশ্য, যেসব ছোট ছেলেপিলে ঘুমের মধ্যে বিছানা নষ্ট করলে তাদের জন্য মাদুলির পাশাপাশি আজমীর শরীফের লালসুতো বাহু বা গলায় বাঁধলে বিশেষ কার্যকর ফল পাওয়া যায়! এসবই মেলে হাঁটবারে, হাটের বিশেষ কোনো কর্নারে। সেখানে এক এক হাটে একাধিক হকার জড়ো হয়। তারপর তারা ক্রমাগত বর্ণনা করতে থাকে বনবৃক্ষেরর গুণাগুণ। “বৃক্ষ তোমার নাম কি, ফলে পরিচয়! মানুষ বেইমানী করে, জঙ্গলের গাছ বেইমানি করে না, এই গাছের গুণাগুণ জানতে কজনই বা পারে! কিন্তু শুনে রাখেন ভাই, এই বনের গাছ কথা শুনতো লোকমান হেকিমের! গাছ লোকমান হেকিমকে ডাক দিয়ে বলতো, হে লোকমান শোনো! আমার মধ্যে রয়েছে মৃতসঞ্জীবনী!” তারপর ব্যাখ্যা চলতো কী সেই মৃতসঞ্জীবনী! লোকমান হেকিম কিভাবে মরা মানুষ জিন্দা করে, কিসব অলৌকিক কেরামতি দেখাতেন, সেসব মায়াবি গল্পে মশগুল হতো সহজসরল মানুষগুলো, একসময় একবোতল, দুবোতল সালসা নিয়ে ঘরে ফিরতো তারা। শমসেসের দাদা ছিলো, মাদুলির ভক্ত! বেচারার কোমরে ব্যথার জন্য সব ধরনের তেল, মলম, টরিকের পর বাকু বিশ্বাসের মাদুলির ওপর নির্ভর করেছিলো! একদল হকার গানাবাজনা আর সাপ খেলা দেখাতো! তাদের পসারই ছিলো বেশি। ছোটবেলায় বাপের হাত ধরে যখন শমসের বাজারে যেতো, তখনও এমন হকারদের সাপ খেলা আর গানের জগতে হারিয়ে যেতো সে। বাপ বাজারসদাই শেষে মজমায় যোগ দিতো! সাপুড়ে কিন্তু বিষম চালাক! বেশকিছু সাপ বাইরে বের করতো! কতোসব বিচিত্র নাম তার! কতো সব বিচিত্র বিষের অধিকারী! কোনটির বিষ ঠাঁস করে মস্তকে ওঠে, আর মুখে গ্যাজা উঠে ছটফট করে মরে যায় রোগী! কোন সাপের বিষ ধীরে ধীরে পা থেকে মাথায় ওঠে এমন সব কথা! লালচে, সোনালী, খইরঙা, কুচকুচে কালো, তসবিকালো, চখরাপখরা কতো রঙের যে সাপ দেখাতো ঝাঁকড়া চুলের লোকটা! সবচে আকর্ষণীয় গল্প ছিলো দুধরাজমণিরাজ সাপের! একটা বন্ধ বাক্সের দিকে আঙুল তুলে লোকটা বক্তৃতা শুরু করতো! “এর মধ্যে আছে! দুধরাজ-মণিরাজ সাপ! ভয়ঙ্কর! খুব ভয়ঙ্কর! কেউ কোনো দিন দেখেনি! একমাত্র এই আলতাফ সাপুড়ের কাছে আছে একটা সাপ! একসময় থাকতো বাংলাদেশের জঙ্গলে জঙ্গলে! অবশ্য, আপনার আমার চৌদ্দপুরুষের আগের কথা! এখন আর কোথাও দেখা যায় না, এটা আনা হইছে সাইবেরিয়ার জঙ্গল থেকে! আমি আনছি! এই আলতাফ সাপুড়ের ক্ষমতা দেখে আপনারা তাজ্জব হয়ে যাবেন। সাপটা আর পাঁচটা সাপের মতো না! এর থাকে দুটো মুখ, একটা মামা, অন্যটা ভাগ্নে! গায়ের রং দুধের মতো সাদা, মাথায় বিশাল দামের মণি! তাইতো নাম দুধরাজমণিরাজ! কিন্তু মণির দিকে কেউ যদি লোভ করেছো তো ঝাড়েবংশে নিপাত হয়ে যাবে! কিন্তু মণি পাবে, যদি অমাবস্যার ঘোর অন্ধকারে কেউ মণি টার্গেট করে সাপটারে একবাড়িতে মারতি পারে, তবে তার ভাগ্য খুলে গেলো! আমার দাদা পেরেছিলো মণি উদ্ধার করতি! কিন্তু এই লোভে লোভে হরেন বাগ্দি যেই খুঁজে খুজেঁ একরাতে আঘাত করলো! সাপ গেলো ফঁসকে! সকালে বাড়ির পাশের শ্মশানে দেখা গেলো হরেন বাগ্দির লাশ! দুপুর গড়াতে না গড়াতেই হরেনের সাত ছেলের মুখে রক্ত উইঠে মইরে গেলো! হায় রে! সে কি নির্মম দৃশ্য! সেই থেকে আর কেউ কখনো মণিধরার সাহসে যায় নি!” জটাধারী মজমার লোকদের মুখগুলো একটু পরখ করে নেয়! তারপর জটাধারী মুখে হাসি টেনে বলে চলল, “ভয়ঙ্কর, ভয়ঙ্কর সাপ! কিন্তু মজার কথা কি জানেন তো! সাপটা জাতে ভালো আছে, হুটহাট কাউরে কামড়ায় না। কাউরে দেখলে মা বলে ভাগ্নে তু কামড়া, ভাগ্নে বলে না মামা তুমি! এই ঝগড়া চলতে চলতে আর কামড়ানো হয়ে ওঠে না!” বলেই হো হো করে লোকটা হাসতে হাসতে এগিয়ে বন্ধ থাকা বাক্সটার দিকে! অনেকগুলো লালনীল সুতো-ফিতেয় জড়ানো বাক্সটা! চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে, “আর দেরি নয়, এখনই দেখাবো দুধরাজমণিরাজ!” কথা না ফুরাতেই একদিক থেকে ঝাঁকড়া চুলে ওস্তাদ ঢুকে পড়ে, তারপর জটাধারীকে একটা ধমক দিয়ে লেকচার শুরু করে ওস্তাদ! শমসের ছোট মানুষ হলেও মেজাজ বিগড়ে যায়। এই বদমাইশ লোকটা ঠিক এই মুহূর্তে হাজির হয়! আর শুরু করে সাপের তেল আর মাদুলির গুণগান! কিভাবে একবার মালিশেই হারানো যৌবন ফিরে আসে, পোড়া, ব্যথা নিমিষেই শেষ হয়ে যায়, মাদুলি কিভাবে সর্বরোগ নিরাময় করে তার গুণগান! একসময় মাদুলিতেল বিক্রি করে ঝুপ করে বাক্সপেটরা গোছাতে শুরু করে লোকগুলো!

দুধরাজমণিরাজ আর দেখা হয় না মানুষের! সন্ধ্যা নামে। ঘরে ফেরে হেতালখালীর মানুষেরা! ডোবানালার পথে এখন পিচঢালা! একদিন তো শমসের ধুম করে ছুটে এসে এক বক্সিং লাগিয়ে দেয় লোকটার নাক বরাবর! অল্পের জন্যে বেঁচে যায় ওস্তাদ! সবাই ধরাধরি করে ফিরিয়ে নেয় এই ঘোরতর দুঃখময় জীবনেও শমসেরের হাসি পায়! কিন্তু পরমুহূর্তে হাসি উবে যায়! হায়, ওই লোকটার অভিশাপে কি তার এমন হলো! সারারাত ঘুম আসে নি শমসেরের! কতো সুখ দুঃখের স্মৃতি মনে পড়ে! “আচ্ছা, মানুষের মরার আগে কি এমন স্মৃতি মনে জাগে!” এসব প্রশ্নের উত্তর সে জানে না! এর আগে এমন করে ভাববার অবসর তার হয়নি! শমসেরের মনে হলো, ওই সাপুড়ে লোকটার ঘুষি লাগানোর অভিশাপেই তার এমন হয়েছে! কিন্তু কোথায় পাবে সেই শৈশবের যাদুকরী সাপুড়ের! যার প্রতিটা কথা ছিলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো! কিভাবে তার থেকে মাফ চেয়ে নেবে! মাফ বিনে তার তো রোগের শাস্তিও কমবে না, মউতের পর নিশ্চিত দোজখ! কিছুদিন ধরে শমসেরের মনে হচ্ছে, নিশ্চয় কারো অভিশাপে তার এই দশা! যার সাথে জীবনে কোনো ধরনের অপরাধ করেছে মনে হচ্ছে, তাকেই বাড়িতে হাত ধরে মাফ চাইছে। কারো প্রতি সত্যিই অন্যায় করেছে মনে হলে পা জড়িয়ে মাফ চাইতো। যতক্ষণ তার মনে হতো মাফ ঠিকমতো হয়নি, ততক্ষণ পা জড়িয়ে হাউমাউ করে কান্না করতো।

কিন্তু সাপুড়েকে আজ সে পাবে কোথায়? তবু দুদিন ছেলেকে হরিনগর হাঁটে পাঠিয়েছে! কিন্তু কোথায় পাবে সেইকালের সাপুড়েকে! না পেয়ে মনটাই খারাপ কয়েকদিন ধরে!

গত শনিবার থেকে আকাশে মেঘ, ঝির ঝির বৃষ্টি! কয় বছর ধরে প্রায় প্রায় ঝড় বেড়েছে, বৃষ্টি বেড়েছে। মাছের ঘেরের কারণে চতুর্দিকে নোনাপানির তীব্রতা! খাবার পানিতে আর্সেনিক বেড়েছে, আয়রন বেড়েছে! আগে ২০/৩০ ফুট নিচে টিউবওয়েল বসালেই সুস্বাদু পানি পাওয়া যেতো, এখনও যায়, তবে ডিপকল বসায় এসজিওগুলো, ২/৩ হাজার ফুট নিচে গেলেই তবে বিশুদ্ধ খাবার পানি মেলে! কিন্তু নোনাপানির বিরুদ্ধে অভিযোগ করা চলে না। এই নোনাপানিতেই তো সোনার চিংড়ি ফলে! মানুষের অবস্থা যে আগের থেকে ভালো হয়েছে তার পিছে চিংড়ির অবদানই বেশি! শমসের শুনেছে পৃথিবীর উত্তরের বরফ নাকি গলে যাচ্ছে, মানুষের অত্যাচারের ফল এই জলবায়ু পরিবর্তন! একদিন নাকি সমুদ্রের তীরবর্তী এইসব অঞ্চল একদিন ডুবে যাবে! কথাগুলো শমসেরের মতো হেতালখালীর মানুষেরা বিশ্বাস করতে চায় না। চায়ের দোকানে তারা যুক্তি খোঁজে, তর্ক করে, নিজেদের শান্ত্বনা খুঁজে নেয় নিজেরা! কিন্তু মনের মধ্যে একটা অস্পষ্ট খসখসে দাগ নিয়ে তারা ঘরে ফিরে যায়!

আচ্ছা, যদি সত্যি ডুবে যায় এসব অঞ্চল তবে সরকার কেন মানুষ সরিয়ে নেয় না! হেতালখালীর লোকজন শহরে যায় না! যে দুএকজন যায় তারাও পড়তে, না হয় ছোটখাটো চাকরিতে। কিন্তু যারা যায় তারা চিরস্থায়ীভাবে চলে যাবার কথা কেউ ভাবে না। ইদেপুজোয় বাড়ি আসে, ওই দু চার জনের আগমনেই হেতালখালীর ছোট গ্রামে আনন্দ নেমে আসে। শমসের যৌবনে মথুরার এক অর্ধনগ্ন পুরুষের ঘাড়ে দায়ের কোপ দিয়ে পালিয়েছিলো! মথুরা পাড়ায় নিম্নবর্ণের কিছু হিন্দুর বাস। মরা কালিনীর দুপাশেই দুচালা ঘর বেঁধে তারা থাকে। মজা করে, সবাই এলাকটারে বৃন্দাবন বলে ডাকে, আশপাশের দু চার গ্রামের কিছু মানুষের আগমন সেখানে রাতবিরেত ঘটে। তাগড়া জোয়ান মেয়েমানুষ তাদের লক্ষ্য! গায়ের রং কুচকুচে কালো বটে কিন্তু পুরুষের তুলনায় নারীদের দেহের বাঁধন শক্ত, হৃষ্টপুষ্ট! বিনিময়ে কিছু কিছু রোজগারও করে তারা। ঝুরির দিকে নজর পড়েছিলো শমসেরের! বেঁটেখাটো সাইজের বউ, পায়ের মোটা গোছায় শক্তির ছাপ, খাড়া মাই, গায়ে কাপড় রাখে কচিৎ, চলনে বলনে একটু অভিজাত। তাকে কেউ বশে আনতে পারে না। কিন্তু শমসের নাছোড়বান্দা!  একদিন কগাছি চুরি, একদিন একটু লিপিস্টিক এভাবেই বশে আনে। কিস্তু সুবিধে করতে পারে না ঝুরির ঘাড়ত্যারা স্বামীর জন্যে। একদিন হাতেনাতে ধরা পড়ে শমসের! কিন্তু আক্রমণের আগেই চালের বাতা থেকে ভোঁতা দা দিয়ে এককোপ বসায় ঘাড় বরাবর। অবস্থা বেগতিক বুঝে, সেখান থেকে হরিনগরের পথ ধরে, রাতেই শ্যামনগর থেকে ঢাকার গাড়িতে চাপে। তারপর কোম্পানির চাকরি নেয়। ইনকাম ভালো। কিন্তু সাতআট বছর পর একদিন হুট করে হেতালখালীর বুকে আগমন ঘটে শমসেরের! সবার মধ্যে একটা চাপা ভয় অথবা উত্তেজনা কাজ করে। দুচারদিন ফিসফিসানি চলে, তারপর সবাই অন্যসব ঘটনার মতো ভুলে থাকে।

সুখ ফেলেই কিন্তু শমসের বাড়ি ফিরেছিলো!

বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। সামনে বড় ডিশে হরিণের মাংস। আব্বা হরিণের গোশত পছন্দ করে, ছেলে জানে। তাই বহুবছর পরে বাপের দোনালা বন্দুকটা নিয়ে বনে উঠেছিলো সমীর। একটা হরিণ মেরেই ফিরেছিলো। বাপের হাতের নিশানা সে পেয়েছে। কিন্তু হরিণ মারতে তার মন সায় দেয় না। আবার, এখন হরিণ মারা বিপজ্জনক! কঠিন মামলা। সরকারের পক্ষে বিশেষ সতর্ক পাহারায় থাকে কোস্টগার্ড! ধরা পড়লেই জেল! কিন্তু সমীর ঘাগু মাল। সে জানে বেড়ায় খোন্দ সর্বনাশ করছে। তাই কাকে কোথায় বশ করতে হবে, সেভাবেই বনে ওঠে।

শমসের কিন্তু একটুকরো মাংসও মুখে দিলো না। একবার শুধু তাকায়, মুখটা তার পাংশু হয়ে যায়। সে রাতে কিছুই খেলো না সে।

রাত বাড়ছে। বাইরে ঝড় জলের শোঁ শোঁ আওয়াজ। নয় নম্বর বিপদ সংকেত চলছে। বাপের মাথা বরাবর বসে কালেমা পড়ছে সমীর। চারদিকে অন্ধকার, ঘরে টেমির জ্বলে থাকা সম্ভব নয়। তাছাড়া শমসেরের ইচ্ছা, ঘরটা অন্ধকারই থাকুক। একসময় আবছায়া কণ্ঠে সমীরকে আরো কাছে ডেকে নেয় শমসের। বলে “বাবা, একটা গল্প শোনো! হরিণ শিকারের গল্প! আমরা তিনবন্ধু বনে উঠছি। তিনজন তিন গাছে। আমার হাতে বন্দুক। শুকর আলী মাঝে মাঝে হরিণের স্বরে ডাকছে। গোপেন চৌকি দিচ্ছে আশপাশে বাঘ আসে কিনা! তার হাতেও বন্ধুক আছে। কিন্তু সে হরিণ মারবে না। পড়ন্ত বিকেল। জায়গাটায় হরিণের পরিমাণ ভালই দেখা যায়। কিন্তু হরিণেরা গাছের পাতাগুলো এক বরাবর খেয়ে রেখেছে। যাতে অনেকদূর পর্যন্ত নজরে শত্রু দেখা যায়। আমরা তো গাছে, হরিণের কি আর সেই বুদ্ধি আছে, যে সব গাছ খেয়াল করে পথ এগুবে!!”

সমীর বাইরের ঝড় জলোচ্ছ্বাসের আওয়াজে কথা শুনতে পায় না। মাথাটা ঝুঁকিয়ে বাপের মুখের কাছে নেয়।

“অনেক্ষণ বসে আছি, হরিণের দেখা নাই। মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে আছে! হঠাৎ দেখি সাতটা হরিণের একটা সীমানায় ঢুকেছে। আর দেরি করবার মতো অবস্থা ছিলো না। মা হরিণটার মাথা বরাবর গুলি ছুঁড়লাম। একটা চিৎকার করে ধুম করে মাটিতে পড়ে গেলো। মুহূর্তে অন্যগুলো হাওয়া হয়ে গেলো! একটু পরে বড় আরেকটা হরিণ ফিরে এলো, পুরুষ হরিণটা। তারপরের গুলিতে ধরাশয়ী। এভাবে একটার পর একটা ফিরে আসলো! সাতটা নিথর দেহ পাশাপাশি পড়ে আছে! রক্তাক্ত! দেখেছো আব্বা, কতো মায়া হরিণগুলোর! কেউ কাউকে রেখে বাঁচতি চাইলো না। এই হরিণগুলোর অভিশাপেই আমার ক্যান্সার হয়েছে। আমরা একসাথে যারা হরিণ মারতাম, তাদের সবার মরণ হইছে ক্যান্সারে। শুধু আমি বাকি ছিলাম।” কথাগুলো বলেই একদম শান্ত হয়ে গেলো। সমীর জানে হরিণেরা এভাবেই শিকারে পরিণত হয়। তবু তারা প্রিয় বোনদের ফেলে চলে যায় না। দুএকটা কথা বলে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলো সমীর। কিন্তু ততক্ষণে অন্য ভাবনায় ডুবেছে শমসের! ঝড়ে গতি বাড়ছে, পানি বাড়ছে। এই প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়-জল হয়তো সকালে থাকবে না। কিন্তু নড়বড়ে গরিবি ঘরগুলো পড়ে যাবে। বানের পানিতে বাচ্চা ভেসে যাবে, সাপের কামড়ে অপঘাতে মৃত্যু হবে। ডায়রিয়া, কলেরা, মহামারি আসবে। তবুও তারা হেতালখালী ছেড়ে যাবে না। শোক ভুলে দ্রুতই ঘর গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করবে। যাদের ঘর পড়ে গেছে তারা পানি কমতেই গরান কাঠের ঘর তুলবে, সুন্দরী কাঠে বেড়া সাজাবে, গোলপাতার ছাউনির জন্যে বনে উঠবে। শমসেরের মনে হয়, “হেতালখালীর মানুষেরা মনে হয় এইসব মায়াহরিণীদের বংশধর!”


 

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu