ঢাকার মানুষদের সম্পর্কে জাহিদের ধারণাটা এমন: সেখানে দুই ধরনের মানুষ বাস করে। প্রসঙ্গত বলে রাখা উচিত জাহিদ কিন্তু তার সমবয়সীদের নিয়েই এ ধারণা পোষণ করে। যাদের বয়স আঠারো থেকে বিশ বছর। এদের একটা শ্রেণী স্কুল-কলেজ-ভার্সিটিতে পড়ে। আরেকটা শ্রেণী কাজ করে দোকানে বা কারখানায়। যারা কাজ করে তারা বাস করে পুরান ঢাকায়। তারা একটু চালাক-চতুর। আর যারা পড়াশোনা করে তারা বাস করে নতুন ঢাকায়। এরা মূলত বলদ শ্রেণীর। এই বলদদের মধ্যে একটা গ্রুপ বই নিয়া পড়ে থাকে- এরা কবি বা লেখকদের বানানো কল্পনার জগতে বাস করে। আর অন্য গ্রুপটা দিনরাত কম্পিউটার নিয়া পড়ে থাকে ওরা প্রোগ্রামারদের বানানো ভার্চুয়াল জগতেই ঘুরপাক খায়। এরা কেউই সমাজবাস্তবতা বোঝে না।
ঢাকা থেকে কেউ বেড়াতে এলে জাহিদ ও তার বন্ধুরা এই স্কেলেই তাদের সাথে আচরণ করে। ছাত্র হলে দূরত্ব বজায় রেখে চলে। আর দূর থেকে ওদের বলদামি দেখে আর হাসাহাসি করে। আর পুরান ঢাকার কর্মজীবী কেউ এলে তাকে নিয়ে ঘুরতে বেরোয়। কেমন করে কাজ করে বড়লোক হওয়া যাবে সেপথ নিয়ে আলাপ করে।
শিক্ষিত পোলাপানরা মাঝে মাঝে আসে। এই খালটা দেখে ওরা মনে করে নদী। ‘ওয়াও’ করে চিৎকার দেয়। এই বলদেরা জোয়ারভাটার খাল দেখলেই নদী মনে করে। কোনো গোরস্থানে বা ছাড়াভিটায় তিরিশ-পঁয়তিরিশটা কাঠগাছ দেখলেই বন মনে করে ‘হাউ ফানি’ করে চেঁচিয়ে ওঠে। কারো বাড়িতে দালান দেখলে বিরক্ত হয়। দিনমজুরদের ভাঙ্গা ঘর দেখলে মুগ্ধ হয়। ওরা বুঝি এদের জীবনে পরিবর্তন দেখতে চায় না। এদের উন্নতি চায় না। সারাজীবন ওদের চোখের তৃষ্ণামেটানো ‘কুঁড়েঘরে’ বা ‘কুটিরে’ই বাস করুক এটাই হয়ত চায়। এই সব ভাঙ্গা ঘরে যারা থাকে তাদের যে কত সমস্যা তা কি ওই বলদেরা জানে?
জাহিদদের বাড়ি খালের ওই পাড়ে। আসলে বাড়ি বলে ওদের কিছু নাই। শুধু ঘর আছে। বাড়ি নাই কিন্তু ঘর আছে- এটা কি সম্ভব? এই দেশে অনেকেরই বাড়ি নাই কিন্তু ঘর আছে। পদ্মার পাড় থেকে নদীভাঙ্গা মানুষেরা এদিকে সরে এসে জায়গা ভাড়া নিয়া ঘর তুলে থাকে। জাহিদদের অবস্থা তেমনও না। তাদের আসলে মাটির সাথে সম্পর্ক নাই। পানির ওপরেই তাদের সব কিছু। জাহিদের দাদা নূরু সরদার বলতেন, “মাটির বিশ্বাস নাইরে। পানির নামই জীবন। এক মাহফিলে হুজুরের কাছে শুনছিলাম আল্লাহ কোরানে বলেছেন নাকি, তিনি এক ফোঁটা নাপাক পানি থিকা মানুষ সৃষ্টি করছেন। তাই আমরা মাটির সাথে সম্পর্ক রাখি না। পানির ওপরেই ভাইসা ভাইসা চলি। আল্লাহর দুনিয়াতে তিনভাগ পানি আর মাত্র এক ভাগ মাটি। আর সেই মাটি নিয়া কী মারামারি-কাটাকাটি। দেশে-দেশে যুদ্ধ, ভাইয়ে-ভাইয়ে শত্রুতা। মাটিতে বাস করতে হলে প্রথমেই ধারালো কোদাল দিয়া তারে আঘাত করতে হয়। এই কারণেই তো মাটির মানুষেরা ভয়ংকর আর নিষ্ঠুর হয়। কিন্তু যারা পানিতে বাস করে তারা জানে জগৎ কত বড়। ভাসতে থাকো, ভাসতে ভাসতেই টিকে থাকতে শেখো। তাদের মধ্যে হিংসা নাই।”
দাদা মারা গেছেন তিন বছর আগে। জাহিদ তখন স্কুলে পড়ে। তখন তার মাঝে মাঝেই মন খারাপ হতো। দাদা তাকে বুঝাতেন। স্কুলে অনেকেই তাকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখত। ছেলেরা তার সাথে মিশতে চাইত না। মেয়েরা তো দূরের কথা। পানির জগতের মানুষদের নিয়া ওদের মনে এক ধরনের ঘৃণা দেখতে পেয়েছে জাহিদ। ওর গায়ে মাছের বা সাপের গন্ধ লেগে থাকে বলে মনে করত ওরা। এটা জাহিদ বোঝে।
এখন ভরা বর্ষা। শ্রাবণের শেষ সপ্তাহ। খালে-বিলে সব একাকার। অনেক বছর পরে এবার পানি বেড়েছে অনেকখানি। এখন তো বর্ষায় পানিই আসে না। খাল-বিল-নালা-পুকুর এমনকি বড় বড় দিঘিগুলোও মাটির মানুষেরা দখলে নিয়া বালু দিয়া ভরে মাটির রাজত্ব বাড়ায়। বর্ষার পানি আসতে পারে না। আবার কোথাও জমিনে পানি ঢুকলে আর বের হতে পারে না। কার্তিক মাস শেষ হয়ে গেলেও আলু লাগাতে পারে না। দেখা যায় তখনো জমিন ভাসে নাই। এবার পানি বেশি হওয়াতে জাহিদদের গোত্রের সবাই ভেবেছে এবার বোধ হয় মাছ বেশিই ধরা যাবে।
কোনো কোনো পুকুরে আবার কোথাও কারো জমিনে বর্ষার পানি আটকে রেখে ক্ষমতাবান লোকেরা সারা বছর মাছের চাষ করে। বর্ষায় পানি বেশি হলে সেসব মাছ-পোনা বেরিয়ে পড়ে। খালে-বিলে ছড়িয়ে যায়। এবার তাও হয় নাই। এখন যারাই মাছের চাষ করে পানি বেশি হয়ে গেলে পুকুর বা মাছের জমিনের চারপাশে চিকন সুতার মশারি জালের বেড়া দিয়া রাখে। তাই এবার খালে মাছ নাই।
এই খালটাকে অনেকেই নদী বললেও এই এলাকার কেউ বলে না। শহরের শিক্ষিত লোকেরা বলে। দাদার কাছে জাহিদ শুনেছে এইটা কোনো নদী না। জোয়ারভাটা থাকলেও ঢেউ নাই। পুরান কোনো দলিল-পর্চায় এই নামে কোনো গাঙ নাই। মাকুহাটির খাল নামে একটা চিকন রেখা আছে মাত্র। নূরু সরদার পানির লোক হলেও হাট-বাজারে মাটির মানুষদের সাথে খাতির ছিল। আইনের লোকেরাও তার কাছে আসত। ভোটার নয় বলে এলাকার মেম্বার-চেয়ারম্যানদের কাছে তারা অবহেলিত কিন্তু থানা-পুলিশ আর কোট-কাচারিতে তাদের দাম আছে। তবে এই এলাকার অনেকেই তাকে সরদার বলে ডাকত। কিছুটা সম্মানও করত। মানুষটা ছিলেন ছয়ফুটের বেশি লম্বা। আয়ুতেও কম ছিলেন না। নব্বই বছর বেঁচেছেন। দেশ-বিদেশের অনেক কিছু তার দেখা ছিল, শেখা ছিল, জানাও ছিল। তার অনেক কথাই বিশ্বাস করে জাহিদ। এখন তিনি নাই; জাহিদ শুধু তার স্মৃতি থেকে কথা তুলে আনে।
এই খালটা মাকুর হাট থিকা শিমুইল্লা দিয়া মোকামখোলার দিকে গেছে। শ শ বছর আগে এই দেশে আলু চাষ ছিল না, পাটচাষও ছিল না। তখন ছিল তুলা চাষ। কেউ কেউ কার্পাস তুলার চাষ করত। কেউ করত শিমুল তুলার চাষ। এইসব এলাকায় বেশির ভাগ লোকই শিমুল তুলার চাষ করত। মোকামখোলা থেকে নাও বোঝাই তুলা নিয়া বিদেশি সওদাগরেরা এই খাল দিয়াই যাতায়াত করত। এই শিমুল তুলা দিয়া লেপ-তোশক-গদি-বালিশ বানানো হতো। হাতির হাওদায়, ঘোড়ার জিনে ব্যবহার করা হতো শিমুল তুলা। এই তুলায় ওম বেশি। তঁাঁতি-জোলারা গরম কাপড়ও বুনত। এইসব কথা জিজ্ঞাসা করে জানা যাবে কারো কাছ থেকে এমন কেউ আর এখন নাই। ইতিহাসে এসব ঘটনা পাওয়া যায় না। সেখানে শুধু রাজা-বাদশাদের কথা দিয়ে ভরা। যে দেশের ইতিহাসে জনগণের কথা নাই তরোয়ালের ঝনঝনানিই বেশি, সেখানে এই পানির মানুষদের কথা কোথায় পাওয়া যাবে! জাহিদ জানে না তাদের পূর্বপুরুষরা ঠিক কত বছর আগে থেকে এখানে বাস করে।
চারদিক পানিতে থই থই করছে। খালে স্রোতও বইছে। এপার থেকে জাহিদ ওপারে যাবে। এখানে খেয়া নাই। পরের গ্রামে আছে। এখানে বাজার বরাবর ওপারে শুধু তাদের পল্লীর বাস। প্রত্যেকের নিজেদের নাও আছে। দিনের বেলা ভরা জোয়ারে তাদের পাটাতন ঘরগুলো দেখা যায় ভেসে আছে। শুকনাকালে দেখা যায় ন্যাংটা দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের উঠান নাই। প্রত্যেকের ঘরের দরোজা খুললেই টলটলে পানি। নাওয়ের গলুই দরোজায় ঠেকিয়ে তারা ওঠে-নামে। সবার ঘরেই হাঁস-মুরগি-কবুতর এমনকি ছাগলও আছে। হাঁসগুলো পানিতে ভেসে চলে। সন্ধ্যার আগেই তারা নাওয়ের ছৈয়ার পাশের খোঁয়াড়ে গিয়ে ঢোকে। মোরগ-মুরগিগুলো নাওয়ের ছৈয়ার ওপরে ওপরেই কঁক কঁক করে ঘোরে। কখনো নাও থেকে রান্নাঘরের চালের ওপর উড়াল দিয়া ওঠে। ছাগলগুলো নাওয়ের গলুইতে বসে থাকে। সেখানে বসেই ঘাস-পাতা খায়। কখনো ছৈয়ার ওপরে হাঁটাহাঁটি করে। নাওয়ের দুলুনিতে পা সামলেই চলে। এখানে বোধহয় ওদের বন্দিদশা মনে হয় না। কোনো কোনো নাওয়ে কুকুর-বিড়ালও আছে। ছৈয়ার ওপরে কবুতরের টঙঘর। কুকুর-বিড়াল-ছাগল একত্রে বসে টলটলে পানির দিকে চেয়ে থাকে। এমনকি ছৈয়ার ওপরে কবুতর আর বিড়াল একত্রে বাস করে। কেউ কাউকে শত্রু ভাবে না। ভাদ্র-আশ্বিন মাসে কুকুরগুলো সঙ্গীর সন্ধানে নাওয়ে চড়ে বাজারে যায়। সেখান থেকে নানা গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। ভালো খাবার পেলে খেয়ে দেয়ে বিকালে আবার নাওয়ের আশায় বাজারের প্রান্তে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ হয়ত পার করে নিয়ে যায়।
পল্লীর শেষ প্রান্তে জাহিদদের নিজেদের প্রতিষ্ঠিত একটা মসজিদ। এটাও মাটির ওপর ভিটিতে গড়া হয় নাই। তাদের ঘরের মতোই পাটাতন; পিলারে দাঁড়ানো। নামাজ পড়তে যেতে হলেও মসজিদের দুয়ার পর্যন্ত নাও নিয়া যেতে হয়। নাও ছাড়া অন্য উপায় নাই। এই মসজিদে অন্যেরা নামাজ পড়তে আসে না। জাহিদের দাদা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। সবার ঘর থেকেই টাকা দেওয়া হয়েছে পাকা করার জন্য। সরদারের ছেলেরা- জাহিদের বাবা ও দুই চাচাই বেশির ভাগ টাকা দিয়েছেন। বাবা হাটবারে বড় বাজারে দোকান নিয়া বসে। বড় বাজার এখান থেকে দুই-আড়াই কিলো দূরে। অন্য সময় ফেরি করে। চাচারা বিদেশে আছে। দুবাই থেকে পাঠানো টাকা দিয়াই নির্মাণ করা হয়েছে এই মসজিদ। মাটির মানুষেরা এই মসজিদে নামাজ পড়তে আসে না। তাদের অনেকে বলেন, এখানে নাকি জুমা নামাজ পড়া জায়েজ হবে না। মসজিদের জায়গা ওয়াক্ফ করা না হলে সে মসজিদে জুমার নামাজ পড়ার নিয়ম নাই। মাটির মসজিদ নিয়া ফতোয়া আছে কিন্তু পানির মসজিদের বিধান কী তা নূরু সরদার খোলাসা করে যান নাই। তারা এখন একজন অল্পবয়সী হুজুর রেখে দিয়েছে। কোন দেশের সেই হুজুর ফতোয়ার ধার ধারেন না। পাঁচ ওয়াক্ত আজান দেন, নামাজ পড়ান। সপ্তাহে জুমা পড়ান। সবার ঘরেই তার খাওয়ার ব্যবস্থা। তিরিশ দিনে তিরিশ ঘরে খেতে হয়। সকালে কিছু পোলাপানকে আরবি হরফ ও কোরান পড়ান। বিকালে ওপারে বাজারে গিয়া চায়ের দোকানে বসে চা-পান খান। কারো সঙ্গে বিবাদে জড়ান না। তিনিও পানির মানুষদের মতো শান্ত এবং নিরীহ। অনেকে উস্কানিমূলকভাবে জিজ্ঞাসাও করে, তিনি যে জুমা পড়ান তা জায়েজ কি না। হুজুর যা বলে পার পাওয়া যায় বুদ্ধি করে তা বলেই কেটে আসেন।
এখন ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ আছে। বাজার থেকে লম্বা তার টেনে খালের ওপর দিয়া স্যাটেলাইট টিভির সংযোগও গেছে। ঘরে ঘরে টিভি আছে। অনেকের নায়েও আছে। অনেকের ঘরের বারান্দায় সোফা আছে। পাটাতনের নিচে যেমন পানি ছলাৎ ছলাৎ করে তেমনি দরোজা-জানালা দিয়া কম্পমান রোদের জলবিম্ব ঘরের বেড়ায় তিরতির করে। জাহিদদের ঘরের অবস্থাও ভালো। বলা যায় এখানকার সবার ঘরের চেয়ে ওদের ঘরটাই ভালো। বারান্দায় ওরা কাঠের নৈচা দিয়ে রেলিং লাগিয়ে নিয়েছে। মাঝ বরাবর দরোজায় নাও ভিড়ায়। অন্য সময় বারান্দায় বসে পড়াশোনা করে।
গতবার জাহিদ উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছে। কলেজ এখান থেকে অনেক দূর। নিজেদের নাও দিয়া খাল পার হওয়ার পরে বাজার থেকে ইজিবাইকে বজ্রযোগিনী পর্যন্ত গেলে সেখান থেকে আরেক গাড়িতে কলেজ। এই দূরের পথ যাওয়ার মতো গাড়ি ভাড়া যে সব মা-বাবা দিতে পারে না তাদের সন্তানের জন্য কলেজের পড়া না। জাহিদ তাদের পল্লীর প্রথম কলেজ পাস ছেলে। তার মাঝে মাঝে দুঃখ লাগে দাদা নূরু সরদার তার কলেজ পর্যন্ত পড়া দেখে যেতে পারেন নাই।
এইচএসসি পাস করে জাহিদ ঢাকা চলে গিয়েছিল। এলএমএফ নাকি আরএমপি কোর্সে ভর্তি হয়েছিল। তাদের পল্লীতে একজন ডাক্তার প্রয়োজন। জাহিদ প্রথম শিক্ষিত বলে তার ওপর কিছুটা দায়িত্বও আছে। অন্যদের ছোট ছোট পোলাপানকে পড়াতে বসতে হয়। এজন্য কেউ তাকে টাকা-পয়সা দেয় না। এখন সে দেখছে তাদের নিজেদের মধ্যে একজন ডাক্তার থাকলে অনেক উপকার হবে। এখনো তাদের চিকিৎসা চলে তাবিজ-কবজ আর পড়াতেল ও পড়াপানিতে। এজন্যই সে ঢাকা গিয়া রুরাল মেডিক্যালের কোর্সে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু কী কারণে যেন কয়েক মাস পরেই ফিরে এল। বাড়িতে এসেই জাহিদ কিছুদিন ঝিম মেরে পড়ে রইল। তার পরে তার মধ্যে এক ধরনের পরিবর্তন দেখা গেল। সে শুকনায় থাকার অভ্যাস করতে লাগল। বন্ধু-বান্ধবদের বাড়িতে রাত কাটানোর অভ্যাস। বাড়ির কারো কাছেই বিষয়টা ভালো লাগল না। জাহিদের মা অনুমান করেছে ছেলে বুঝি কোনো মেয়ের প্রেমে পড়েছে। কিন্তু কারো কাছ থেকে তিনি কোনো তথ্য পান না। পাবেন কীভাবে, তাদের বাড়িতে তো কেউ আসে না!
কলেজে থাকতে জাহিদ রোভার স্কাউট করত। দলনেতা ছিল। সুনামের সঙ্গেই সে দায়িত্ব পালন করেছে। অনেক কিছু শিখেছে। তখন থেকেই সে দায়িত্ববোধ অর্জন করেছে। মা-বাবার কথায় সে বড় বাজারে একটা ওষুধের দোকানে বসা শুরু করল। এখানে ‘সেলসম্যান’ শব্দটাই চলে। ‘কম্পাউন্ডার’ শব্দটা মাঝে মাঝে মুরুব্বিরা বললে- সে অবাক হয়ে চেয়ে থাকত-এখন বোঝে। সে যে দোকানে বসে সেখানে কোনো ডাক্তার নাই। শুধু ওষুধ বিক্রি হয়। এখানে ডাক্তারি শিখার সুযোগ নাই। তাই কম্পাউন্ডার, ডিসপেনসারি বা ফার্মেসি শব্দগুলো অপ্রচলিত এখন। সবাই বলে ওষুধের দোকান।
জাহিদ তার ছোট ভাই শহিদকে মাদরাসায় ভর্তি করে দিয়েছে। সে ঠিকমতো স্কুলে যায় না। সারাদিন বল খেলা আর খেলা নিয়া মারামারিতে ব্যস্ত থাকে। আবার তাদের মধ্যে একজন ধর্মীয় শিক্ষিত লোকও প্রয়োজন। বেতন করা বিদেশি হুজুর দিয়া মসজিদ চালাতে সমস্যা। সমাজ-জমাত নিয়া বসবাস করতে হলে নিজেদের পক্ষে কথা বলবে এমন শক্ত লোক দরকার।
জাহিদ ভেবে পায় না শত শত বছর ধরে তাদের এখানে বাস; অথচ তার ওপরেই এত দায়িত্ব অর্পিত হল কেন। সরদারের নাতি বলে? সরদার পদবিটা কোনো লাভজনক পদ না। শুধু সম্মানের বিষয়। এখন অনেকেই তাকে সরদার হতে বলে। লেখাপড়া জানা- এ ছাড়াও ঝাড়-ফুঁ-তেলপড়া-পানিপড়ার জন্য অনেকেই তার কাছে আসে। অনেকে তার কাছে পাঠায়। এসব তার ভালো লাগে না। এসবই সরদারি আলামত। আগে সরদারদের সংসার পল্লীর সবাই মিলে চালাত। এটাওটা তারা উপহার দিত। সারা পরগণায় পানিতে যারা বাস করে সবার বিয়া-শাদি এখানেই সম্পন্ন হতো। সে বিয়াতে সরদারই বেশির ভাগ সময় কনে পক্ষের উকিল হতেন। তার ক্ষমতা ছিল এক ধরনের রাজার মতো। এখন জাহিদ দেখছে উপার্জন না করলে তাদের না খেয়ে মরতে হবে। বাবার ফেরি করে বেড়ানোতে আয় নাই। খালে-বিলে মাছ নাই। সব কিছু এখন কিনে খেতে হয়। টাকা হাতে থাকলে সব অভাব মেটানো যায়। সংসারে এখন টাকাটাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয়।
জাহিদের মা অনুমান করেন তার ছেলে ঢাকা থেকে ফিরা আসছে কোনো মেয়ের টানে। রাতে মোবাইলে কার সাথে যেন কথা বলে। কথার ধরনেই তিনি অনুমান করেন এটা। এছাড়া তার মেজ দেবরের মেয়ে আঁখি কয়েকদিন আগে দিন বলল, “জাহি ভাই কলেজের একটা মাইয়ার লগে রিকশায় রথের মেলায় গেছিল।”
জাহিদের মা আঁখিকে দেখতে পারেন না। বাপে বিদেশ থাকে তাই সে দেমাগে বাঁচে না। জাহিদের ব্যাপারে কেমন যেন একটু বেশিই নাক গলায়। তবে এই কথাটা তিনি অবিশ্বাস করতে পারলেন না।
বিষয়টা আসলে সত্যই ছিল। আঁখি টেটন মাইয়া। জাহিদের বন্ধুদের কাছ থেকে সব খবর বের করেছে। সে জেঠির কাছে বলেও দিয়েছে। রোভার মুটে পরিচয় অন্য এক মেয়ের সঙ্গে খাতির জাহিদের। সে মেয়ে জেলা সদরের সরকারি কলেজে অনার্সে পড়ে। তার নাম মৌ। তার শর্ত হল জাহিদকে শুকনায় উঠতে হবে। এইদিকে কোথাও জমি কিনে বাড়ি করতে হবে। হয়ত বিদেশে যেতে হবে, না হয় ব্যবসা করতে হবে। এ জন্যই জাহিদ ঢাকা থেকে চলে এসেছে। তার যে এখন কেন পানিতে ভালো লাগে না তা মায়ের বুঝতে বাকি রইল না। সে একারণেই সরদার হতে চায় না। ছোট ভাইকে মাদরাসায় পড়াতে চায়, মসজিদের ইমাম বানাতে চায় আবার তাকেই সরদার করার ইচ্ছা তার।
খালের ওপারের পিছনের গ্রামের বিলপাড়ে কোন বন্ধুর বাড়িতে মাঝে মাঝেই রাত কাটায়। বিলের উত্তর পারে জমি ভরাট করে একহাঁটু দেয়াল তুলে প্লট করে রাখা জমি দেখতে যায়। কেনার স্বপ্ন দেখে। কত টাকা হলে কেনা যাবে খোঁজ খবর নেয়। কার কাছ থেকে কত টাকা ধার নিলে বিদেশে যেতে পারবে। কোন কোন দেশে এখন ভিসা খোলা আছে নানা জনের কাছে জিজ্ঞাসা করে। বড় রাস্তা চওড়া করার পর থেকে এদিকের জমির দাম কেবল বেড়েই চলেছে। জাহিদ ভাবে কথা দিয়ে রাখলে বিদেশ থেকে এসে কিনে বাড়ি করতে পারবে।
তার এসব স্বপ্নের কথা আঁখি একদিন জিজ্ঞাসা করেছে। জাহিদ সম্পর্কে তার কৌতূহল বেশি তাই সে কথাগুলো পেটে চেপে রাখতে পারে নাই। জাহিদ সব স্বীকার করেছে। তবে মায়ের কাছে জানাতে নিষেধ করেছে। কিন্তু আঁখির পেটে কথা থাকে না। সব কথা সে জেঠির কাছে বলে দেয়। জাহিদ পরে একদিন আঁখিকে জিজ্ঞাসা করে রাগারাগি করেছে। আঁখি অবশ্য পালটা একটা আবেদন জানিয়ে রেখেছে। সে বলেছে, “আপনে বিদেশ যাইবেন, কইলে তো আব্বায় ভিসা পাঠাইতে পারে। আপনে আব্বারে ফোন করেন। নাইলে আমি কথা কই?”
জাহিদ আঁখিকে আর পাত্তা দিতে চায় না। তার মনে অনেক দুশ্চিন্তা। প্রথমে তাকে শুকনায় উঠতে হবে। এর পরে তাকে হয়ত বিদেশে যেতে হবে, যাওয়ার আগে দুইটা কাজ করতে হবে। মৌয়ের সঙ্গে কোর্টে বা কাজির অফিসে গিয়ে কাজটা সেরে ফেলতে হবে। আর জমির বায়না করে রাখতে হবে। আর যদি বিদেশে না যেতে পারে তাহলে বড় বাজারে একটা দোকান নিতে হবে। তার এখন কোনটা করা উচিত সে ভাবতে পারছে না। অতিকল্পনায় সামর্থ্যের কথা মনেই থাকে না।
রাত অনেক হয়েছে। বাজারের কুকুরগুলো জাহিদকে দেখে চিনে পিছে পিছে সিঁড়ি ঘাটের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। জোছনা রাত। আকাশে বড় চাঁদ। জোয়ারে পানি ফুলে আছে। কচুরি পানাগুলো দ্রুত ধেয়ে যাচ্ছে পদ্মার দিকে। খালের ওপারে তাদের ঘরগুলো অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অধিকাংশ ঘরেই লাইট নেভানো। কেমন নীরবতা চারদিকে। শুধু জোয়ারের পানির কল কল শব্দ। আর কচুরি পানাগুলোর কেমন মৃদু গুমড়ানো শব্দ।
তিন দিন পরে আজ জাহিদ বাড়ির দিকে এসেছে। মনে হয় কয়েক দিন, কয়েক মাস এমনকি কয়েক বছরও হতে পারে। কেমন যেন একটু অচেনা লাগে। ঘরগুলো ঠিক মতো আছে তো! নাকি মাঝখান থেকে কোনোটা উড়ে গেছে?
উড়ে যাবে কেন? সব কিছুই যেন উড়ে যাচ্ছে আজকাল। খালের ওপারের সবকিছুই ঠিক আছে কিন্তু কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলে তার কাছে ঝাপসা লাগে। “শহিদ! শ-হি-দ!” বলে সে ডাকতে লাগল।
ওপার থেকে কোনো সাড়া শব্দ আসে না। নিজের কণ্ঠই তার কাছে ফ্যাসফ্যাসে লাগে। শহিদ কি বাড়িতে নাই? মাদরাসায় চলে গেছে নাকি? এবার সে পাশের ঘরের হালিমকে ডাকতে থাকে। “হালু! হালুরে নাওডা লইয়া আয়।”
এবারও কোনো সাড়া নাই। দূরে একটা নাও খালের কিনার ধরে চলছে। টেঁটা আর টর্চলাইট নিয়া মাছ ধরতে আছে কেউ। মনে হয় হালিম। অনেকক্ষণ পরে দেখা গেল অন্য একটা নাও ছলাৎ ছলাৎ করে এপারের দিকে আসছে। জাহিদ চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কে রে?”
কোনো শব্দ নাই দেখে অনুমান করল আঁখিই তাকে পার করে নিতে আসছে। আরেকটু কাছে আসার পরে তাকে চেনা গেল। সিঁড়িতে নাও লাগানোর পরে উঠতে গেলে মাথা টলে উঠল জাহিদের। আঁখি বলল, “সাবদানে ওডেন ভাই।”
হাত বৈঠায় ভর দিয়া নাও ঘোরানোর সময় মুখে চাঁদের আলো পড়ায় আঁখিকে অন্যরকম লাগল। ও বুঝি বড় হয়েছে। মুহূর্তেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে জাহিদ দূরে তাকিয়ে উদাস হয়ে গেল। কেউ কোনো কথা বলে নাই। ঘরের কাছাকাছি আসতেই আঁখি মুখ খুলল, “জহু ভাই, তিন দিন ধইরা আপনেরে ফোন দিয়া পাওয়া যায় না-বন্ধ। জেটির পেটকামড়ি। অনেক ব্যাথা। সন্ধ্যাবেলা ফকিরবাড়ি নিয়া গেছে মায়। এহনও আহে নাই।”
জাহিদ এখন আর অবিচলিত থাকতে পারল না। জিজ্ঞাসা করল, “কখন থিকা পেটের বেদনা?”
“পরশু থিকা অল্প অল্প। আজকাই বেশি।”
জাহিদ ভাবল গ্যাস্ট্রিকের। তবুও জিজ্ঞাসা করল, “কোনখানে ব্যাথা?”
আঁখি যেখানে দেখাল তাতে জাহিদ বুঝতে পারল ব্যথাটা এপেন্ডিসাইটিসের হতে পারে। সিরিয়াস বিষয়। তিনদিন ধরে চলছে। এই রোগ তো ফকিরের না। তাড়াতাড়ি অপারেশন করাতে হবে। সদর হাসপাতালে নেওয়া দরকার। আঁখিকে সে বলল, “তুই নাও ঘুরা। ফকির বাড়ির দিকে যা।”
বিনা সঙ্কোচে আঁখি নাওয়ের মুখ ঘুরাল পুব দিকে। দ্রুত যাওয়ার জন্য বৈঠা রেখে লগি হাতে নিল। খালের পাড় ধরে ভর দিয়া দিয়া দ্রুত চালাতে লাগল। যদিও এখন আর খালের কূল-কিনার নাই। চক-বিল-খাল সব একাকার হয়ে গেছে। বন্যার পানি নেমে আসায় এখন লগি প্রায় ডুবে যায়। একহাত পরিমাণ ওপরে থাকে। ফসকে গেলে লগি আর পাওয়া যাবে না। তখন হাতবৈঠাই ভরসা।
ফকফকা জোছনার আকাশ হঠাৎ ঘোলা হয়ে যাওয়ায় তারা আকাশের দিকে তাকাল। মেঘ জমতে শুরু করেছে। থুতানিবৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। নাওয়ে কোনো পলিথিন নাই, ছাত্তিও নাই। তবে বৃষ্টি নামল না। থুতানি বন্ধ হয়ে গেল একটু পরে। আকাশও আবার পরিষ্কার হয়ে গেল একটু পরে। আঁখি জাহিদের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে নাও বাইছে। সে গত তিন দিনের ইতিহাস জানে। জাহিদ কোথায় ছিল, কী করেছে সব জেনে সে জেঠির কাছে বলেছে। সে জানে জাহিদের চোখে এখন গাঁজার নেশা। নাওয়ে ওটার সময় সে সাবধানে উঠতে বলেছিল। পড়ে গেলে পানি থেকে টেনে তোলা কঠিন হবে। গত শুক্কুরবারে মৌয়ের বিয়া হয়ে গেছে। এই ধাক্কাটা জহুভাই সইতে পারে নাই। ধামারণের বিলপাড়ে রাকিবদের বাড়িতে তিনদিন ধরে জাহিদ গাঁজা খেয়ে পড়ে পড়ে খালি ঘুমাইছে।
আঁখির চোখে আগে মৌ ছিল সম্মানের কিন্তু শত্রুতুল্য। এখন তাকে শত্রু বলে ভাবতেও অযোগ্য মনে হয়। মৌয়ের এই কাজটা ঠিক হয় নাই। কেমন শিক্ষিত মাইয়া! কলেজে নাকি পড়ে! কেমন চোদার মাগি কে জানে! তুই পোলাডারে কথা দিয়া ঘুরাইতাছোত কয় বছর ধইরা। এখন বিয়া বইয়া গেলি চুপচাপ। জামাইর লগে হোওনের লাইগা কবুল কইতে দেরি করোছ না। ছেমড়াডারে শেষ কইরা থুই্য়া গেলি বজ্জাত মাগি! তগো মতন মাগিগো মোহে মুইত্তা দেওন দরকার।
আঁখির এসব ধারণার পেছনে একটু আনন্দ থাকতে পারে কারণ জাহিদের ওপর থেকে কালোমেঘ সরে গেছে। কিন্তু এই যে বাড়িছাড়া হওয়া, গাঁজার নিশা ধরা এগিলি কি সহজেই বন্ধ হইব? আজ জেঠির কী অবস্থা কে জানে! যুদি জেঠি মইরা যায় কেমুন অবস্থা হইব? দুইডা ভাই এতিম হইয়া যাইব! জহুভাই শুকনা থিকা আর হয়ত পানিতে নামব না। শহুভাইও শুকনায় থাইকা যাইব, মাদরাসায় পউড়া বেশি বেতনের আশায় কোন দেশের কোন মসজিদে গিয়া নামাজ পড়াইব কে জানে। সরদারের ফেমিলির এই অবস্থা হইলে আমাগ কী হইব?
আকাশে যান্ত্রিক গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল কিছুক্ষণ ধরে। পরে দেখা গেল বড়সড় একটা বিমান বিকট শব্দ করে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে দক্ষিণ-পুব দিকে চলে গেল। জাহিদ কিছুক্ষণ আকাশের দিকে চেয়ে রইল। বিমানের শব্দ মিলিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত কারো মুখে কথা শোনা গেল না। আবার আকাশ ঘন আলোতে ফ্যাকাশে হয়ে উঠল। জাহিদ দেখছিল আঁখি কেমন করে নাওটা টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের পল্লীর সবাই নাও বাইতে পারে। বায়ও। তার মাও নাও বেয়ে বড়শি দিয়া মাছ ধরে, বিলে শাপলা তুলতে যায়। মাঝে মাঝে ওপারে গিয়া ছোট বাজার থিকা সদাই-পাতিও কিনে আনে। কিন্তু আঁখির আজকার নাও বাওয়ার মধ্যে কেমন যেন একটা মোহ আছে। জাহিদ জিজ্ঞাসা করল, “এখন কয়টা বাজে রে?”
আঁখি উত্তরে বলল, “ঘর থিকা বেরোনোর সময় দেখছিলাম রাইত সাড়ে এগারোটা।”
“ওরে বাবা। তুই এত রাইতে নাও বাইয়া আমারে লইয়া ফকির বাড়ি যাইতাছোত, আমি তো মায়রে লইয়া হেই দিক দিয়া গাড়ি লইয়া সদরে যামু। তুই একলা ফিরা আইবি ক্যামনে?” জাহিদ জিজ্ঞাসা করল। আঁখি বলল, “আমার সমস্যা হইব না। যারে লইয়া ডর, হেয় তো আপনেরই বন্ধু। রাকিবই তো লুচ্চা স্বভাবের। এই পাড়ার মাইয়াগো দিকে হের নজর। দিনের বেলা বাজারের ঘাটলায় বাইয়া থাকে। মাঝে মাঝে নাও লইয়া আমাগো ঘরের দিকে ঘোরে।”
জাহিদ অবাক হল। “কস কী? কেউ তো আমারে অর ব্যাপারে কিছু কয় নাই।”
“কে কইব? হেয় নেতার পোলা। আপনের আবার বন্ধু। আপনে মৌয়ের বিয়ার দিন রাকিবের দলবল লইয়া গিয়া ডিব্বা ফুটায়া বিয়া ভাইঙা দেন কিনা, অস্ত্র দেখায়া ওরে তুইল্লা নিয়া যান কিনা এই চিন্তাও অনেকেই করছে।”
জাহিদ আঁখির গোয়েন্দাপনা দেখে অবাক না হয়ে পারে না। সে জিজ্ঞাসা কর, “তুই এত কথা কই থিকা জানোছ?”
আঁখি যেন রহস্য করার সুযোগ পেল। সে সামান্য হাসি দিয়া পরিস্থিতিটা ঘোলাটে করে রাখতে চাইছে। উত্তর দিল না। সে বলল, “আপনে এত রাইতে গাড়ি পাইবেন? জেঠিরে সদরে নিয়া গেলে কাইল সকালে ভাত লইয়া যাইতে অইব না? আর মায়রেও তো লগে নিতে হইব, না?”
জাহিদ দেখে আঁখির শরীরের বিভিন্ন বৃত্ত আর উপবৃত্তগুলো চাঁদের আলোতে বেশ জোয়ারের মতো উদ্ভাসিত হচ্ছে। সে সাতহাতি নাওয়ের গলুইতে বসে পাছায় দাঁড়ানো আঁখির শরীরের ঘামের গন্ধ পাচ্ছে। লগি ঠেলতে ঠেলতে মেয়েটি ঘামিয়ে উঠছে। চোখে দেখা না গেলেও জাহিদ তা বুঝতে পারছে। মেয়েটা এত রাতে একা আবার নাওটা নিয়া একলা আসব? ডর ভয় ওর একটু কমই। ইতর-বজ্জাত পোলারা যারা ক্ষতি করার জন্য কাছাকাছি ঘোরে সে তাদের সাথে মুখে মুখে কথা দিয়া খাতির করে। অনেক কথাই ওদের কাছ থিকা জানে। নাহলে মৌয়ের ব্যাপারে এত কথা ও জানল কেমনে? রাকিব যে ওর বিয়াই ছলমানরে ঢাকা থিকা তিনটা মালসহ নিয়া আসছিল, মৌয়ের বিয়া ভাইঙা দিয়া ওরে উঠায়া নেওনের জন্য-তা মিথ্যা না। কিন্তু ঘটনাটা ঘটে নাই। রাকিবরে বিশ্বাস করা গেলেও ছলমানরে জাহিদ বিশ্বাস করতে পারে না। ঢাকাইয়া পোলা। বেশি চালাক। শয়তানের গোয়া দিয়া যাতায়াত করে। মৌরে যদি বিয়া বাড়ি থিকা তুইল্লা ছলমান নিজেই ভাগাইয়া নিয়া যাইত? মাইক্রোবাসে তুলতে পারলে জাহিদের মৌ আর জাহিদের থাকত না, ছলমান ঢাকায় নিয়া লুকাইয়া রাখত। এলাকায় কথা ছড়াইত তো জাহিদের নামে। থানা-পুলিশ সব তার নামেই আসত। বিপদের সময় নেতার পোলা রাকিবরে কি পাওয়া যাইত? নূরু সরদারের কথা মনে পড়ে জাহিদের। দাদা বলেছিলেন, “মাটির মানুষরে মাটির অন্য কোনো জীব-জানোয়ারেও বিশ্বাস করে না। মাটির দুনিয়া যখন বন্যার পানিতে ডুইবা গেছিল, তখন নুহু নবির কিস্তি সবাইরে আশ্রয় দিছে। সেদিন পানি যদি মানুষরে আশ্রয় না দিত, খোদার দুনিয়াত মানুষ বইলা কিছু থাকত না। সেই মাটির মানুষ বড় বেঈমান আর নিমকহারাম।”
অবিশ্বাসের মাটির ওপর মৌও দাঁড়িয়ে আছে। মৌয়ের কথা ভাবতে গিয়া জাহিদের কান্নার ভাব ওঠে। কিন্তু কান্না আসে না। সমস্ত কান্না একটা বায়ুচাপ হয়ে শ্বাসনালী দিয়া ঠেলে ওঠে। তিনদিনের গাঁজার ধোঁয়ায় হয়ত অশ্রু শুকিয়ে গেছে।
ফকিরবাড়ি গিয়া মাকে বের করে আনে জাহিদ। বড় বাজারে গিয়া দেখে কোনো গাড়ি নাই। পুলিশের গাড়ি থামানো। গ্রামের ভিতরেও রাত-বিরাতে পুলিশ আসে। ফেন্সিডিল-ইয়াবা নাকি ধরা পড়ে আরো ভিতরের গ্রামেও। জাহিদের গাঁজার নেশা একেবারে কেটে গেলেও সে একটু চিনচিনে ভয় পেল যদি তাকে ডেকে কিছু জিজ্ঞাসা করার সময় মুখে গন্ধ পায়! দোকানপাট প্রায় সব বন্ধ হয়ে গেছে। দুয়েকটা চায়ের দোকান খোলা শুধু। জাহিদ পরিচিত একটা গ্যারেজে গেল। ভেতর থেকে গেটে তালা লাগানো ছিল। সমস্ত ইজিবাইকে চার্জার লাগিয়ে ভিতরে কর্মচারীরা নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিল। ওর ডাকে উঠে গেট না খুলে ফাঁক দিয়া কথা বলল। “সব গাড়িতে চাজ দেওয়া হইতাছে। ফুল চাজ কোনোটায় হয় নাই। এত রাইতে কই যাবি?”
জাহিদ তার মায়ের কথা জানাল। শুনে তার পরিচিত লোকটা বলল, “রাস্তায় তিনটা বিরিজের গোড়ায় পানি উঠছে। আমাগো কয়েকটা গাড়ির ব্যাটারিতে পানি ঢুইকা ভিজা গেছে। বিরাট ক্ষতি হইছে। এখন মনে হয় চান উঠছে। জোয়ারে পানি বাড়তাছে। এখন কেউই গাড়ি দিতে চাইব না। তুই রিকশা পাস কি না দেখ।”
রাস্তার পাশে দঁড়িয়ে পেটের যন্ত্রণায় কাঁতরাচ্ছিল জাহিদের মা। পাশে অসহায়ভাবে দাঁড়ানো তার জা-আঁখির মা। কাতরকণ্ঠে জাহিদ জিজ্ঞাসা করল তাহলে আমি এখন কী করমু? রিকশা দিয়া সদরে যাইতে যাইতে রাইত পোহায়া যাইব। মারে বাঁচামু কেমনে?”
মরণ এবং বাঁচন শব্দগুলো এইসব মানুষের কাছে অসহনীয় ওজনের। ভার বইতে না পেরে লোকটা মশারির ভিতরে গিয়া ডাকাডাকি করে একজনকে তুলে বলল, “জহুর মায়রে সদরে হাসপাতালে দিয়া আয় তো।”
উত্তরবঙ্গের ড্রাইভারটি চোখ কচলাতে কচলাতে একটা গাড়ির চার্জার খুলে স্টার্ট দিল। গেট খুলে রাস্তায় আনার পরে জাহিদ মা আর চাচিকে বসিয়ে উল্টাদিকে নিজে বসল। পুরানা ইঞ্জিনের ইজিবাইকটা বিমানের মতো শব্দ তুলে শ্রাবণের রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে সদরের দিকে ধেয়ে চলল।
রাতের কালো রাস্তায় ঝাড়ুর মতো আকারের আলো ফেলে যখন গাড়িটি এগিয়ে যাচ্ছে তখন জাহিদের মনে পড়ছে অনেক কিছুই। মৌয়ের স্মৃতি ঢেকে দিচ্ছে প্রতারণা, আঁখির শরীরের বৃত্ত আর উপবৃত্ত, ছলমানের নাকের আগায় অদ্ভুত আলো, মায়ের যন্ত্রণাকাতর-বেঁকেচুরে যাওয়া শরীর। সে কী করবে এর পরে?
পকেটে মোবাইল নাই। ওটা কেথাও পড়ে যায় নাই। সম্ভবত রাকিবদের বারান্দায় বালিশের নিচে রয়ে গেছে। মানিব্যাগ খুলে দেখল টাকাও বেশি নাই। সদরে নিয়াই বা সে কী করবে? ওষুধ, অপারেশন কেমন করে করাবে? সকালে আবার আসতে হবে। কিন্তু রাতে ওষুধ লাগলে কী করবে? একের পর এক ভাবনার শিলাবৃষ্টি জাহিদের মাথায় আঘাত করতে লাগল।
দাদার কথাও মনে পড়ছে জাহিদের। সরদার হতে গেলে কি এত ঝামেলা সইতে হয়! জাহিদের বাবা, চাচারা কেউ প্রেম করে বিয়া করে নাই। দাদাও করে নাই। কিন্তু তাদের জীবনে কি এমন বয়সে প্রেম আসে নাই? আসতেও পারে। কিন্তু তারা কেউ তাদের মনের মানুষরে পায় নাই। তারাও অনেক কষ্ট পাইছে। কিন্তু পালায়া তো কোথাও যায় নাই। জাহিদ যে ভাবছে কাল সকালে বন্ধুদের কাছে মৌ সম্পর্কে কী উত্তর দিবে- তার উত্তর তো তার বাপ-চাচা-দাদা এবং তাদেরও আগের মানুষ কারো কাছেই ছিল না। কিন্তু তারা সবাই ব্যর্থ ছিল প্রেমে। তবে তারা কি ভেঙে পড়েছিল? না, তারা শক্তভাবেই পানিতে ভাসতে চেষ্টা করছে। নাহলে আজকার সবাই জন্ম নিল কীভাবে? ব্যর্থতা নিয়া পালাইলে তো এই পল্লী এতদিন সাফ হইয়া যাইত।
গাড়ির ঝাঁকুনিতে জাহিদের একটু ঝিমানি আসছে। এই ঝিমানিটা ভালো লাগছে। মনে হয় না যে এটা প্রতারক ঘুম- উঠেই দেখা যাবে কে যেন ফাঁকি দিয়া চলে গেছে। এই ঘুম কিছুটা প্রশান্তির। গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্যই যেন এই ঝিমানি। আগে আগের কাজ, পরে পরেরটা। কাল সকালেই হয়ত অনেক ব্যবস্থা হয়ে যাবে।