———-সমাপ্ত———-
সনোজ কুণ্ডু-এর গল্প: মানচিত্রের কান্নার রঙ ছিল লাল
এস্রাজের সুরের মতো জলপতনের শব্দ শিবানির কানে আসে। যদিও এ শব্দের সাথে তার পরিচয় নতুন নয়। কারণ তার স্বামী শিবু প্রতিদিন অন্তত একবার মানচিত্রের বুকে প্রেসাব করে যায়। শিবানি রুটির বাটি হাতে নিয়ে ঘরের পেছনে ছুটে আসে।
‘খাবারটা খেয়ে আমাকে মুক্তি দিয়ে যাও।’ শিবু উদ্ভ্রান্তের মতো মধুমতি নদীর দিকে ছুটে যায়। তখনও মানচিত্রের বুকে প্রেসাবের বুদবুদানি। পাশের ভাঁগাড়ে চিৎ হয়ে পড়ে থাকা মরা বিড়ালটার সাথে শিবানি নিজের জীবনের কোনো তফাৎ খুঁজে পায় না।
শিবু দাস ওরফে শিবু মুচির যে স্বাভাবিক স্মৃতিশক্তি নেই এটা সত্য, তবে যেখানেই থাকুক প্রতিদিন একবার সে বাড়ি আসে। লুঙ্গিটা উঁচু করে দাঁড়িয়ে মানচিত্রের কবরে তার প্রেসাব করা চাই। কাজটি সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত শিবু থাকে অশান্ত। চোখ দুটো হয়ে থাকে রক্ত জবার মতো লাল টকটকে। হাতের কাছে যা পায় ভাঙচুর করে। শিবানিকেও লাথি-গুতো খেতে হয়। তার স্থায়ী ঠিকানা বলতে মধুমতির ঘাট। দিনরাত নদীতে কচুরিপানা, টাবুরে নৌকা ভেসে যাওয়া দেখে। শিবুর ধারণা তার মেয়ে রূপসী একদিন এই নদীর স্রোতে ভেসে আসবে। রূপসী রূপসী বলে সে চিৎকার করে কাঁদে। আবার খলখলিয়ে হাসে। সারাক্ষণ মেয়ের ওড়নাটা বুকে জড়িয়ে রাখে। কখনো নাকের কাছে নিয়ে মেয়ের শরীরের মিষ্টি গন্ধ শোকে।
শিবুর সংসারে অভাব ছিল। অভাব নামক বেরশিক শব্দটার সাথে তার জীবনের একটা যোগসূত্র আছে, কিন্তু সুখের সীমা ছিল না। শিবু ভাবে, নিজের কাছে যে সুখি মনে করে অভাব তার সুখ কেড়ে নিতে পারে না। সুখ হচ্ছে মনের ব্যাপার। অভাব জীবনের অংশ হতে পারে কিন্তু সুখের পথের অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারে না।
গভীর বনে কাঠ কুড়িয়ে চলতো শিবুর সংসার। একসময় চামড়া বিক্রি করাই ছিল তার বংশগত পেশা। পথে-পাথারে, ভাঁগাড়ে কখনো নদীর ধারে ছুরি হাতে মৃত গরু-ছাগল খুঁজে বেড়াত। তবে এ ব্যবসা ছিল নেহাৎ পেটের দায়ে। বছরের দুটি ঈদ এলেই তার ব্যস্ততা বেড়ে যেত। এ অঞ্চলের পশুর চামড়া সে একাই সংগ্রহ করে নৌকা কখনো নছিমনে করে শহরে নিয়ে যেত।
তবে পূর্ব পুরুষের এই পেশার প্রতি শিবুর কোনোদিনই ভক্তি ছিল না। বরং মনে মনে ঘৃণাই করতো। নিচু জাত বলে এমনিতেই মানুষ অবহেলা করে, তারপর এই নিকৃষ্ট কাজ করা দেখে মানুষ থুতু ফেলতে ফেলতে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখে। শিবু ভাবে, শরীরের দুর্গন্ধের জন্য নয়, ছোট জাত বলে মানুষ তার কপালেই থুতু ফেলে যাচ্ছে। পশুর মরা-পচা চামড়া খসাতে গেলে দুর্গন্ধে শিবুর বমি আসে। নাকে গামছা বেঁধে নেয়। শরীর ঘিন ঘিন করে। ভাত খেতে গেলে যেন নিজের শরীর থেকেই পচা গন্ধ ঘরে ছড়িয়ে পড়ে।
একদিন শিবুর উপলব্দি হলো, মৃত গরু-ছাগলের খবর পেয়ে সে যখন ছুটে যায়, তার আগেই ঘটনাস্থলে পৌঁছে যেত ক্ষুধার্ত শকুনের দল। মরাপশুর খবর ওরা কি করে জানে! কারাই বা পৌঁছে দেয়? শিবু ভাবে, নিশ্চয়ই তার থেকে শকুনদের পেটের ক্ষুধা বেশি। পশু মারা গেলে হয়তো বাতাসে গন্ধ ছড়িয়ে ওদের নাকের কাছে ভেসে বেড়ায়। সে শকুনের সাথে নিজের বিন্দুমাত্র তফাৎ খুঁজে পায় না। শকুনের ক্ষুধার্ত ঠোঁট শিবু খুব কাছ থেকে দেখেছে। ওরা এতটাই হিংস্র যে শিবুকেও খাদ্য বানাতে ধেয়ে আসে। শত্রু মনে করে। সালার অজাতের দল এটুকু বোঝে না, পশুর চামড়া খসিয়ে বরং শিবু ওদের উপকারই করছে।
শিবু একদিন বাপ-দাদার সমাধিতে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে এ পেশা ছেড়ে দেয়। বনকর্তাকে ধরে বন রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেয়। সকাল থেকেই বোবা ছেলে জগাইকে সাথে নিয়ে বনের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত লাঠি হাতে ঘুরে বেড়ায়। শিবু লক্ষ করে খোদ সরকারি দলের নেতারা বন কর্মীদের সাথে হাত মিলিয়ে গাছ কেটে নৌকা ভরে নিয়ে যাচ্ছে। শিবু গোপনে বনকর্তাকে জানালে একদিন ডজনখানেক নেতা-বনকর্মীদের পুলিশ আটক করে। শিবু এই বনের দায়িত্ব নেবার পর থেকে আজ পর্যন্ত কোনো পাখি শিকারিও এ বনে ঢোকার সাহস দেখায়নি।
শিবু প্রতিদিন দুপুরে জগাইকে বনে রেখে বাড়ি খেতে আসে। উঠোনের একপাশে বকুলতলায় খেজুর পাটি বিছিয়ে শিবানিকে নিয়ে বিশ্রাম নেয়। গল্প করে। দিনরাত টুপ টুপ করে বকুল ফুলে আঙ্গিনা ভরে থাকে। শিবানি হলুদ শাড়ির আঁচল পাটিয়ে বিছিয়ে রাখে। আঁচল ভর্তি হয়ে যায় ফুলে ফুলে। শিবু ইচ্ছে করেই একমুঠি ফুল অতি আদরে শিবানির চুলের ভেতর গুজে দেয়। শিবানি খলখলিয়ে হেসে শিবুর নাক টিপে ধরে। শিবুর হাতে লাগানো শিউলি-জবা ফুল দিয়ে এপাড়ার দেবীদের অর্চনা হয়। এ ফুলেই দেব-দেবীরা তুষ্ট হয়। সকালে-বিকালে গ্রামের বৌ-ঝিরা নির্লজ্জের মতো বকুল ফুল কুড়িয়ে মালা গেঁথে নিয়ে যায়। কেবল শিবু মুচি নিচু জাত হবার কারণে গাঁয়ের মানুষ তাকে একঘরে করে রেখেছে। এবাড়ির একফোঁটা জলও কেউ স্পর্শ করে না। সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতেও তাকে কেউ নেমন্তন্ন করে না। শুধু তাই নয়, এগ্রামের সবচেয়ে হতদরিদ্র ভিখারিটিও শিবু মুচির বাড়ির পথ ভুলে গেছে।
শিবু ভাবে, যারা মানুষকে ভালবাসতে শেখেনি, তাদের কাছে কোনো ধর্ম নেই। মানুষের নিন্দাকে সে পুষ্পচন্দন করে মাথা উঁচু করে চলতে শিখেছে। সমাজের মানুষকে সে যতটা ভালবাসে, গাঁয়ের মানুষের কাছে তার দ্বিগুণ আঘাত পেয়ে এসেছে।
গত মাঘি পূর্ণমায় শিবু বৈষ্ণব সেবার আয়োজন করে। আঙ্গিনার মাঝখানের একটি জলচৌকিতে রাধাগোবিন্দকে বসানো হয়। সকাল থেকেই স্বজাতির কিছু ভক্তরা আঙ্গিনায় বসে খোল-করতাল বাজিয়ে গুরুর শানে ভক্তিমূলক গান পরিবেশ করে। আঙ্গিনার অন্য প্রান্তে ভক্তদের জন্য আয়োজন হচ্ছে খিচুড়ি প্রসাদ। যে ভক্তদের জন্য এতো আয়োজন এখনপর্যন্ত তাদের ছায়াও দেখা গেল না। শিবানি বেশ চিন্তিত। চোখে-মুখে উৎকণ্ঠার ছায়া। শিবু তাকে আশ্বাস দেয় যে, যথাসময়ে ভক্তরা আসবে। স্বামীর মৃদু ঠোঁটের হাসি দেখে শিবানি কিছুটা চিন্তামুক্ত হয়।
বেলা গড়িয়ে আসে। শিল্পীরা হরে কৃষ্ণ নাম ধরে অনুষ্ঠানের সমাপনী টানার প্রস্তুতি নেয়। শিবানির অসহায় চেহারা শিবুকে বিধ্বস্ত করে। তবুও তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে– ‘আসবে শিবানি, ভক্তরা আসবে।’
শিবু জগাইকে নিয়ে ভক্তদের জন্য সারি সারি কলার পাতা বিছিয়ে প্রসাদ বিতরণ শুরু করে। স্বজাতির কিছু ভক্তরা প্রসাদ গ্রহণ করার জন্য বসে পড়ে। শিবানি বারান্দায় দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদছে। শিবু বৌয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে–‘কেদো না শিবানি। আমার উপর বিশ্বাস রাখো। আজ আমার প্রকৃত ভক্তরাই প্রসাদ নিতে আসবে। তৃপ্তির সাথে গোবিন্দর প্রসাদ গ্রহণ করে তোমাদের আশীর্বাদ করে যাবে।’
শিবানি বড়ই সরলা। স্বামীর কথার অর্থ বোঝার সাধ্য তার নেই। কেবল বোবা ছেলে জগাইকে বুকে টেনে অঝোরে কাঁদে। শিবু তার বিশ্বস্ত প্রাণি ধলুকে গম্ভীর স্বরে কাছে ডাকে। প্রভুর গলার আওয়াজ শুনে ধলু বাঘের মতো গর্জন করতে করতে হাজির হয়। শিবুর পায়ের কাছে মাথা নুইয়ে যেন প্রভুর আদেশের অপেক্ষায় থাকে। শিবানি কিছুটা দূর থেকে স্বামীর ছলছলে চোখ দেখে নিজেও কাঁদে। শিবু আঙ্গুল দিয়ে ধলুকে কলার পাতায় সাজানো প্রসাদ দেখিয়ে কানের কাছে কিছু একটা বলে। কুকুরটি আরেক দফা হুঙ্কার ছেড়ে ছেড়ে আঙিনা ত্যাগ করে পাড়ায় বেরিয়ে পড়ে। কী অবাক কাণ্ড! বিধাতার এই লীলা বোঝার সাধ্য কার আছে! সময় গড়িয়ে যাবার সাথে সাথেই পাড়ার প্রায় সব কুকুর শিবুর আঙিনায় এসে হাজির। ওদের সম্মিলিত ঘেউ ঘেউ আওয়াজে গ্রামবাসীও অবাক। এই আওয়াজ যেন মুখোশপরা মানুষের শিক্ষা দেবার সংকেত। মানুষের মুখ থেকে অমানুষের পর্দাটা খুলে দেবার সংকেত। পাতায় পাতায় খিচুড়ি প্রসাদ সাজানো দেখে ওদের আনন্দ হয়। সবাই একসাথে লেজ নাড়িয়ে যেন শিবু মুচিকে অভিনন্দন জানায়। প্রসাদ খেতে শুরু করে। শিবু চিৎকার করে বলে, ‘খা খা, আজকের এই গোবিন্দর প্রসাদ কেবল তোদের জন্য। অমানুষের জন্য নয়!’ ভক্তরা তৃপ্তির সাথে চেটে পুটে প্রসাদ খাচ্ছে। শিবানি কোনো কোনো পাতায় হাতা দিয়ে আবার প্রসাদ দিয়ে ওদের পেট ভরে খাওয়ায়।
আঙিনায় নতুন উৎসব শুরু হয়। মহিলারা আনন্দে উলুধ্বনি দিতে থাকে। শিল্পীরা খোল-করতাল বাজিয়ে নতুন ভক্তদের বরণ করে নিতে কৃষ্ণনাম শুরু করে। স্মৃতির অথৈ সমুদ্রে ডুব-সাঁতার খেলতে খেলতে শিবুর ঠোঁট ভেদ হয়ে উচ্চারিত হয়-‘জয় হোক ভক্তদের!’ শিবানি নিজের আঁচলে জমে থাকা একমুঠ ফুল শিবুর চোখে মুখে ছিটিয়ে ধ্যান ভাঙাতে চেষ্টা করে– ‘কি হলো তোমার?’
না, গতবার বৈষ্ণব সেবায় ধলুর কাণ্ডর কথা মনে পড়েছিল! শিবানির মনটাও কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে। শিবুর হাত ধরে বলে-চলো না আমরা আজ ধলুর সমাধিতে ফুল দিয়ে আসি। শিবু ফাঁত করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। বকুল গাছে পিঠ ঠেসান দিয়ে কত কী ভাবে! একসময় অতি আবেগে বকুল গাছটিকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। গাছটি যে অনেক বড় হয়ে গেছে। মেয়ে বকুল জন্মানোর দিনেই স্মৃতিস্বরূপ শিবু এই বকুল গাছটি লাগায়। মেয়ের নাম রাখা হয় বকুল। কাকতালীয়ভাবে বকুল ওদের মাঝখানে এসে দাঁড়ায়। বকুলের দাঁড়িয়ে থাকা ছায়াটি শিবানিকে আষ্টে-পিষ্টে বেঁধে রাখে। বকুলের চোখে-মুখে উচ্ছ্বাস। শিবু মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে। গাছটি জড়িয়ে ধরতে না পাবার কষ্ট মুহূর্তেই ম্লান হয়ে যায়। শিবুর মনে হলো গাছটি থেকেও বকুল যেন বড় হয়ে গেছে। মেয়ের কথা শুনে শিবুর গর্ব হয়। তার মেয়ে শহরের কলেজে পড়তে যাবে। তার তিন পুরুষের কেউ স্কুলের গণ্ডি পার হতে পারেনি। বকুল শহর থেকে মানুষ হয়ে একদিন গ্রামে ফিরবে। গোটা গ্রামের মানুষ বকুলকে নিয়ে অহংকার করবে। জাত-পাত নিয়ে কেউ আর তাদের কাছে ফুঁসফাঁস করবে না।
বেলা গড়িয়ে যাবার সাথে সাথেই আকাশে মেঘের ঘনঘটা শুরু হয়। শিবানি গোয়ালঘরের শতছিদ্র চালের উপর পলিথিন বিছাতে ব্যস্ত। সন্ধ্যা থেকেই টিনের চালে ঝুম ঝুম শব্দে বৃষ্টি দাপিয়ে বেড়ায়। শিবানি বকুলের মাথায় তেল মেখে চুল আঁচড়িয়ে দিচ্ছে। জগা বকুলের সামনে এসে দাঁড়ায়। বোনের জন্য সে খয়েরি রঙের ভ্যানিটি ব্যাগ, আয়না, চিরুনি, লিপস্টিক কিনে এনেছে। বোন তার শহরে পড়তে যাবে, এ কি চারটি খানেক কথা। দাদার হাতের জিনিস পেয়ে বকুলও খুশিতে ডগমগ। বোনের সাথে কথা না বলার কষ্টে তার বুক ভেঙে চৌচির হয়ে আসে। ইশারায় বোনকে বুঝিয়ে দেয় তোকে অনেক বড় হতে হবে।
বৃষ্টির তোড় বেড়েই চলেছে। ঘরের মাঝে টিনের চালের ছিদ্র দিয়ে টপটপ করে বৃষ্টির ফোটা পড়ছে। শিবানি একটা গামলা পেতে দেয়। বাইরে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। সাথে সাথে মতিন হুজুরের গলা শিবানি টের পায়। ‘শিবুকাকা, দরজা খোলো, দরকারি কথা আছে।’ শিবু কিছুই শুনতে পায় না। তার কানে ভেসে আসে কেবল বৃষ্টির শব্দ আর জং-ধরা ছুরিটাকে বালিকেচা করে শান দেবার ক্যাচ ক্যাচ আওয়াজ। শুধু কিছুই শুনতে পায় না। শিবু বালিকেচা দিয়ে জং-ধরা ছুরিটা শান দিতে ব্যস্ত। চামড়ার ব্যবসা অনেকটাই সে ছেড়ে দিয়েছে। তবে মাঝে মধ্যে অন্য অঞ্চলে চামড়া খসাতে যায়। ইচ্ছে করলেই তো সব ছেড়ে দেয়া যায় না। জাতি ব্যবসা বলে কথা। তাছাড়া দুপয়সা বাড়তি আয় হলে তো আর ক্ষতি নেই। মেয়ে তার শহরে পড়তে যাচ্ছে, সামনে কত খরচ! জগা চৌকির নিচ থেকে বটিদাও হাতে নিয়ে দরজার কাছে দাঁড়ায়। শিবানি বকুলকে হোগলায় মুড়িয়ে আড়াল করে। মতিন হুজুরের দ্বিতীয় ডাক শিবুর গলায় আসে। ইশারায় সে জগাকে দরজা খুলতে বলে।
মতিন হুজুর পান খাওয়া ঠোঁটে শিবানির দিকে তাকিয়ে হাসে। ভেজা ছাতাটা মেলে বারান্দায় জল ঝরাতে দেয়। শিবানি আঙিনায় দাঁড়িয়ে থাকা একাধিক লোকের অস্তিত্ব টের পায়। মতিন হুজুর ঠোঁটে লেগে থাকা পান চেটেপুটে আয়েশি ভঙ্গিতে বলে–‘শুনলাম, আমাদের বকুল নাকি শহরে পড়তে যাবে?‘
‘হ্যাঁ, যাবে তো! কালই আই এ ক্লাসে ভর্তি হতে যাবে। মেয়েটার বড় হবার অনেক স্বপ্ন। মা-কালির দয়ায় লেখাপড়ার মাথাও বেশ ভাল। তাছাড়া আমিও চাই না, মেয়েটা গ্রামে থেকে মাথা নিচু করে চলুক। শহরে ছোট জাত বলে কেউ নিন্দা,ধীক্কার দেবে না।’
মেয়েকে শহরে পড়ানোর চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো শিবু কাকা, চেয়ারম্যান সাব ভারি কষ্ট পাবেন। গ্রামের ছেলে-মেয়েদের কল্যাণের কথা চিন্তা করেই তো তার বাবার নামে কলেজ করেছেন। আর আমাদের বকুল যাবে শহরে পড়তে। এ বড় অন্যায়।
শিবুর ঝাঁঝাঁল কণ্ঠ–‘এসব বাহানা ছাড়েন হুজুর। কী বলতে চান ছাপ ছাপ বলে ফেলুন।’
মতিন চেয়ারে রাখা গামছা দিয়ে ভেজা চুল মোছে। গলায় তার আরষ্ঠ–‘শোনো কাকা, আজগর চেয়ারম্যান তোমাদের রক্ষক। তার ছেলে শিহাব বকুল মাকে ভালবাসে। জানোইতো, চেয়ারম্যানের পরপর দুটি ছেলে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। সেই শোক আজও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। শিহাব তার কলিজার টুকরা। ক্ষমতা থাকলে আকাশের চাঁদ ছেলেকে এনে দিত।’
‘মুখে লাগাম দেন মতিন হুজুর। তিনি আজগর না অজগর চেয়ারম্যান আমাকে চেনাতে আসবেন না। আর তিনি আমাদের রক্ষক হতে যাবেন কেনো? রক্ষক তো স্বয়ং ঈশ্বর! দুনিয়ায় এত মেয়ে থাকতে হিন্দুগো ঘরের মাইয়ার দিক নজর পড়লো কেনো? তারপর আমরা ছোট জাত।’
‘এমন কথা বলে আমাদের কষ্ট দিও না শিবু কাকা। ভালবাসার কাছে কি আর জাত-পাত আছে। আমাদের বকুল মায়ের মতো এই তল্লাটে একটা মেয়ে খুঁজে দেখাও তো!’
শিবুর আক্রমনাত্মক গলা। ‘আমার মেয়ে সম্পর্কে একটা কথা বললে—-’
‘এত উত্তেজিত হবার দরকার নেই কাকা। বিষয়টা ভেবে দেখো। সবার জন্য মঙ্গলই হবে। চেয়ারম্যান সাহেব তোমাদের আত্মীয় হলে সমাজে বুক ফুলিয়ে চলতে পারবা। মানুষ গর্বের সুরে বলবে, ঐ দেখো, চেয়ারম্যান সাহেবের বিয়াই যাচ্ছে! তাছাড়া আমাদের দেশে থাকতে হলে আজগর চেয়ারম্যানদের খুশি করেই তো তোমাদের থাকতে হবে!’
শিবুর হাতের শান দেয়া ছুরিটা হারিকেনের আলোতে চকচক করে ওঠে। ছুরিটা হাতের তালুতে থুতু দিয়ে ঘঁষে আরও ধারালো বানাতে চেষ্টা করে–‘চুপ করুন আপনি। এই শিক্ষা দেন ছাত্রদের? আমার দেশ, তোমার দেশ আবার কি ভাষা? এটা কি শুধু তোমাদের দেশ? আমার বাবা রাধাকান্ত দাস মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। তার লাশটাও আমরা দাফন করতে পারিনি। আর এ দেশের স্বাধীনতা কারো স্বার্থ প্রতিষ্ঠা করার জন্য হয়নি। আপনি আমার বাড়ি ছাড়বেন কি না তাই বলুন?’
মেঘের গর্জনে যতটুকু না হুজুরের বুক কেঁপে ওঠল তার দ্বিগুণ কেঁপে ওঠে শিবুর হুঙ্কারে।
শিবানি সকালে মাদ্রাসার ঘাটে গিয়ে দেখে, সাইনবোর্ড টাঙানো–‘অমুসলিমদের এই ঘাটে আসা নিষেধ।’
কালকের ঘটনার পর মতিন হুজুর এই আদেশ জারি করল। সে এখন এই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ। ক্ষমতাবান। সবাই তার আদেশ মেনে নিতে প্রস্তুত। শিবু প্রতিদিন এই ঘাটে স্নান করার সময় ওঁ গঙ্গা কখনো শ্রীবিষ্ণু বলে চিৎকার করে প্রথম ডুব দেয়। শিবুর ঐ গলা শুনেই মতিন হুজুরের প্রতিদিনের ঘুম ভেঙে যায়– তা সে চাইবে কেনো। ঐ মন্ত্র উচ্চারণ করে মাদ্রাসার পানিটাই যে অপবিত্র করে দিচ্ছে। এসব মেনে নেবার পাত্রটি যে সে নয়!
অথচ শিবুর বাবা রাধাকান্ত দাস এই মাদ্রাসা নির্মাণের সময় নিজের পাঁচকাঠা জমি দান করে গেছে। তখনকার দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ঘটনাটি বেশ প্রশংসিত হয়েছে। অথচ অকৃতজ্ঞের দল রাধাকান্ত হিন্দু হওয়ায় মাদ্রাসার দাতাগণের তালিকা থেকে নাম বাদ দিয়েছে।
সেরাতেই শিবুর মনসা মন্দিরে আগুন জ্বলে। একদল মুখোশধারী গুণ্ডা দরজা ভেঙে শিবুকে ঘরের খুঁটির সাথে বেঁধে এলোপাথারি পেটাতে থাকে। শিবানি চিৎকার করে লোক জড়ো করার ব্যর্থ চেষ্টা করে। সুযোগ বুঝে বকুলের মুখে গামছা পেঁচিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যায়। চারিদিকে ফর্সা হয়ে আসে। জগা খবর পেয়ে বন থেকে ছুটে এসে দেখে মা-বাবা দুজনেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। জগা বাবার বাঁধন খুলে দিলে শিবু কিছুটা চেতন ফিরে পায়। সাথে সাথেই আরেকটি লোমহর্ষক ঘটনার জন্ম দেয় শিবু। মেয়ের পড়ার টেবিলের উপরে টাঙানো বাংলাদেশের মানচিত্রটা ছিঁড়ে-ফিরে থুতু নিক্ষেপ করে। পায়ের সাথে পিশতে থাকে। উন্মাদের মতো একপর্যায় ঘরের পেছনে কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়ে মানচিত্রটাকে কবর দেয়। উন্মাদের মতো হাসতে হাসতে মানচিত্রের বুকে প্রথম প্রেসাব করে।
শিবানি জগাইকে নিয়ে থানায় যায়। মতিন হুজুর ও চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে চায়। দোষীদের বিরুদ্ধে মৌখিক জবানবন্দি দেয়। কিন্তু ওসি সাহেব অত্যন্ত কৌশলে মামলা না করে সাধারণ ডায়েরি করতে বলেন। যাতে লেখা হয়– অজ্ঞাতনামা একদল গুণ্ডা কর্তৃক বকুলকে গুম এবং মুচিবাড়ির মন্দিরে অগ্নিসংযোগের কথা। ওসি সাহেব সাংবাদিকদের সামনে চব্বিশ ঘণ্টার ভেতর বকুলকে খুঁজে বের করার প্রতিশ্রুতি দেয়।
দুদিন পর কালিসন্ধ্যায় সদানন্দ মালোর ভেঁসালে একটি নিল রঙের ওড়না উঠে আসে। খবর পেয়ে শিবানি ভেঁসালের কাছে ছুটে যায়। বকুলের ওড়না চিনতে তার অসুবিধা হয় না। পেছন থেকে শিবু চিলের মতো ছোঁ মেরে মেয়ের ওড়না গলায় পেচিয়ে দৌড়ে যায়। সেই থেকে মেয়ের ওড়না সে গলায় পেচিয়ে রাখে। কখনো বুকে চেপে ধরে। নাকের কাছে নিয়ে মেয়ের শরীরের গন্ধ নেয়। প্রতিদিন ওড়না নিয়ে নদীর ঘাটে এসে বকুল বকুল বলে চিৎকার করে। ঐ গগণবিদারী চিৎকার নদীর ওপারে গিয়ে প্রতিধ্বনি হয়। শিবুর ধারনা তার বকুল ঠিক এই নদীর জলে একদিন ভেসে আসবে।
শিবু মানসিক স্মৃতিশক্তি হারানোর পর জগাই বন দেখাশুনা করে। একদিন বনকর্তা অফিসের লোকজন নিয়ে বন পর্যবেক্ষণে আসেন। তারা বনের ভেতর ঢুকে দেখেন, তাদের বিশ্বস্ত শিবু মুচির ছেলে জগাই একটি আমগাছ কেটে কাঠ খণ্ড খণ্ড করছে। এ দৃশ্য দেখে বনকর্তা ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়। জগার হাত বেঁধে থানায় নিয়ে যাবার প্রস্তুতি নেয়। কর্তার পায়ের ওপর লুটে পড়ে জগা। অনুনয়-বিনয় করে অনেককিছু বোঝাতে চেষ্টা করে। কিন্তু তার বোবাভাষা কেউ বুঝতে পারে না। শিবানি ওদের চলার পথে আগলে দাঁড়ায়। একপর্যায় বনকর্তার পায়ের ওপর মাথা ঠুঁকে–‘দোয়াই কর্তা, আজকের দিনে অন্তত জগাকে ধরে নিয়ে যাবেন না। আমার জগাকে আজ যে বড় প্রয়োজন। এই কাঠগুলোও আমাদের দিতে হবে!’
শিবানির কথা শুনে বনকর্তা হেসে ওঠেন। রাগে তার শরীর যেন জ্বলে যাচ্ছে–
‘এসব কী আজগুবি কথা বলছো তুমি? তোমার ছেলে বনের গাছ কেটে অপরাধ করেছে। তাকে শাস্তি পেতেই হবে। তুমি আবার নির্লজ্জের মতো চুরি করা কাঠগুলোও চাইছো-ছি! ছি! এ কী মামাবাড়ির আব্দার হে? রক্ষক যখন ভক্ষক হয় তার শাস্তি কতটা ভয়ংকর হয় তা তুমি নিজ চোখেই দেখবে। তোমরা যে ছোট জাত, তার পরিচয়টা সত্যিই আজ দিলে!’
‘হ্যাঁ কর্তা, আমরা ছোট জাত ঠিকই, তবে চোর নই। মিথ্যাও বলি না। ছেলে এবং কাঠ দুটিই আমার প্রয়োজন। কারণ বাবার মুখাগ্নি করার জন্য ছেলেকে যেমন চাই, তেমনি শিবু মুচির সৎকার করতে ঐ কাঠেরও দরকার। মানুষটি মৃত্যুর আগে একটাই শেষ কথা বলে গেছে– শিবানি, যে সমাজে মানুষ নেই, সেখান থেকে তোমরা বহুদূর চলে যেও।’
বনকর্তা জগার হাত থেকে বাঁধন খুলে শিবানি বৌদির কাছে হাত জোর করে ক্ষমাপ্রার্থনা করে ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেলেন।
———-সমাপ্ত———-