মাহির তাজওয়ার
জন্ম চুয়াডাঙ্গায়। ছোটগল্প লেখক এবং ছড়াকার।
মাহির তাজওয়ার

মা

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

মাহির তাজওয়ার রচিত গল্প:

মা


মেয়েটির নাম জানি না। এক পাগলীর গর্ভে জন্ম। পাগলী জন্ম দিয়ে পালিয়েছে। শিশু মেয়েটির কান্নায় আকাশ বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। কেউ এগিয়ে আসে না। শুকনো মাটির উপর শিশুটির লাল মুখ কেমন যেন নিলাভ হয়ে যায়। প্রৌঢ়া আধবয়সী একজন মহিলা এগিয়ে আসে। কিছুক্ষণের মধ্যে লোকজনের জটলা বেধে যায়। সবাই ছিঃ ছিঃ করতে থাকে। এমন কাজডা কিডা কইরলো? কিডা কইরলো? সকলের মুখে একই প্রশ্ন। এত সুন্দর মেয়িডা ফেলি রেখে গেছে কিডা? হদিস পাই না। প্রৌঢ়া সকিনা বেগম মেয়েটিকে কোলে জাপটে ধরে। সকিনা নিঃসস্তান। সকিনা আঠাশ বছরের তীব্র প্রতিক্ষার প্রতীক হিসেবে মেয়েটিকে মানুষ করতে চায়। বুকে আগলে রেখে নিজের সন্তানের অভাব পূরণ করতে চায়। সকিনা বলে ওঠে, ওরে আল্লা আমারে দিছে। আমিই মানুষ ক’রবো।

সকিনা বেগম যখন মেয়েটিকে নিয়ে ফিরে আসতে চায় ঠিক তখন একজন বোবা আধবয়সী পাগলী মেয়েটিকে ছো মেরে কেড়ে নেয় তার কাছ থেকে। সকিনা বেগম কিছু বলতে পারে না। পাগলী পরম আদরে মেয়েটিকে বুকে জাপটে ধরে। মেয়েটির কান্না তখনও বন্ধ হয়নি। পাগলী ক্ষেপে যায়। ক্রোধে হাত পা ছুঁড়তে থাকে? কৌতূহলী দর্শকের মনে তখনও কৌতূহল ভর করে। পাগলীর এরাম সর্বনাশ কইল্লো কিডা? সকিনা দূরে দাঁড়িয়ে হাঁ-হুতাশ করে। কেউ কেউ বলে, পাগলীরে ধরে চুল কেটে গ্রাম ছাড়া করে দে। কেউ বলে থাক পাগলী নেড়ে আর কী লাভ হবেনে? কিন্তু মেয়িডার কি গতি হবেনে? ভিড়ের মধ্যে এমন কথাও শোনা যায়। পাগলীর কাছে থাকলি মেয়িডা নির্ঘাত মরে যাবেনে। পাগলী ক্ষেপে যায়। সকিনা বেগম কী করবে কিছু বুঝে উঠতে পারে না। সে একটু দূরে সরে যায়। পাগলী মেয়েটিকে আবার মাটিতে শুয়ে রেখে একটা ইট নিয়ে উৎসুক জনতার উপরে হামলে পড়ে। তাড়া করে। তারপর ঘন্টার পর ঘন্টা পার হয়ে যায় পাগলীর আর খোঁজ থাকে না। সকিনা বেগম আবারও মেয়েটিকে কোলে তুলে নেয়। পাগলী আসার আগেই তাকে এখান থেকে পালাতে হবে। সে প্রাণপনে পা চালায়। তার সমস্ত শক্তি দিয়ে সে দৌড়াতে থাকে।

***

পাগলীর গোঙানীর আওয়াজ ক্রমেই বাড়তে থাকে। তার গোঙানীর আওয়াজে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। কোথাও তার মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যায় না। বোবা পাগলী নিজের বুক চাপড়ে কাঁদে। তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে তার মেয়েকে। মুখ দিয়ে আও আও আওয়াজ বের হয়। পাগলীর মাতৃত্ববোধ আরও প্রবল হতে থাকে। পাগলী আর নিজেকে সামলাতে পারে না। উদভ্রান্ত হয়ে দ্বিগবিদিক ছুটে বেড়ায়। চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামে। এলোমেলো দৌড়াতে থাকে। হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। লোকজন হা হা শব্দে হেসে ওঠে। যেন মজার ব্যাপার দেখছে সবাই। পাগলী উঠে আবার দৌড়াতে থাকে। পাগলী এখন জীবনের কাছে সম্পূর্ণ পরাজিত। দিনের আলোয় পাগলীকে আর দেখা যায় না। রাতের বেলায় পাগলীর অস্পষ্ট কান্নার আওয়াজ শোনা যায়। কিন্তু তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।

***

যেদিন ফুলমতিকে নিয়ে সকিনা বেগম কুলচারা গ্রামে এসে নতুন বাসা বাধে, ঠিক তার উনিশ দিনের মাথায় তার স্বামী মারা যায়। সকিনা বেগম অকুল পাথারে পড়ে মেয়েকে নিয়ে। সংসারে অভাব অনটন। স্বামী মরে যাওয়ার আগে কিছু রেখে যায়নি। বাধ্য হয়ে ভিক্ষায় নামে সকিনা বেগম। বয়সও অনেক হয়েছে। মেয়েকে নিয়ে ভিক্ষে করে। হ্যারে ফুলমতি, আমার সাথে ভিক্কে করতি কষ্ট হয় না তোর? ফুলমতি ঘাড় নাড়ে। তার কষ্ট হয়। ক্ষুধা লাগে। সকিনা বেগম মেয়েকে নিয়ে বিষ্ণুপুর, হরিপুর, ইব্রাহিমপুর ভিক্ষা করে। দিন শেষে ভাল আয় হয় তার। মেয়েকে শুকনো পাওরুটি কিনে দেয়। ফুলমতি পাওরুটিতে একটা কামড় দিয়ে বলে, গলা আটকে আসচে মা। একটা কলা কিনে দেও না? সকিনা বেগম বলে, নারে মা, কলা কাঁচা। পাকিনি। কি দোকানদার ভাই কলা কাঁচা না? দোকানদার কিছুই বলে না। মেয়েকে একগ্লাস পানি এগিয়ে দেয়, এই নে পানি দিয়ে ভিজিয়ে খা। ফুলমতি পানি দিয়ে ভিজিয়ে পাওরুটি খায়।

ছোট্ট একটা খুপড়ি ঘরে থাকে সকিনা বেগম আর ফুলমতি। রাতের অন্ধকার নামার সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়ে। কোনো বেলা খাবার জোটে, কোনো বেলা জোটে না। সকিনা বেগম কষ্ট করে। টাকা জমায়। অন্য খাতে টাকা খরচ করতে চায় না। মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করে দিতে চায়। মেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে সে টাকা জমানো কৌটাটা ঘরের এক কোণের খুপড়ি থেকে বের করে। টাকা গোনে সকিনা। তাতে দেখে আটশ টাকা জমেছে। সকিনা বেগম চিন্তা করে কালই সে যাবে কুলচারা স্কুলে। মেয়েকে ভর্তি করাবে। মেয়েকে সাথে নিয়ে আর ভিক্ষা করতে বের হবে না সে। তার মেয়ে এখন থেকে স্কুলে যাবে। ভাবতেই খুব ভালো লাগে সকিনার। স্বপ্ন দেখে সকিনা। মেয়ে স্কুলে যাবে। পড়াশোনা করবে। চাকরি করবে। তাকে আর কখনও ভিক্ষা করতে হবে না। চাকরি? তাকে তো পরের ঘরে যেতে হবে। চারপাশের যে অবস্থা মেয়েকে আগলে রাখবে কিভাবে? অল্প কিছু পড়িয়েই বিয়ে দিয়ে দেবে ফুলমতিকে। তারপর বাকিটা জীবন সকিনা বেগম ভিক্ষা করবে।

ফুলমতিকে কুলচারা স্কুলে ভর্তি করিয়েছে সকিনা বেগম। তার জমানো টাকা থেকে বই, খাতা কিনে দিয়েছে। কিনে দিয়েছে স্কুলের পোশাক। ফুলমতি খুশি। সে স্কুলে যায়। গল্প করে। পড়াশোনা করে। সকিনা বেগম মেয়েকে বুকে জড়িয়ে আদর করে। দুই গালে চুমু খেয়ে বলে, তোকে যে ফাস্ট হতে হবে মা। অনেক ভাল করে পড়তে হবে। ফুলমতি বানান করে করে পড়ে আর তার মাকে শোনায়। রাতে ফুলমতি যখন ল্যাম্পের আলোয় পড়ে, সকিনা বেগম তার পাশে চুপ করে বসে থাকে। সারাদিন ভিক্ষে করে ঘুমে তার চোখ আটকে আসতে চায়। তাকাতে পারেনা। তবুও জোর করে তাকানোর চেষ্টা করে। ঘন ঘন উঠে জগ থেকে পানি নিয়ে চোখে দেয়। তবুও ঢুলে ঢুলে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। ফুলমতি দেখে আর হাসে। ফুলমতিও একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। মা মেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। টিপ টিপ করে জ্বলতে থাকে ল্যাম্পের আলো। একসময় বাইরের হাওয়া এসে আপনা আপনিই নিভে যায়।

***

পাগলী এসেছে গ্রামে। পাগলী রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। পাগলীর বয়স হয়েছে। বৃদ্ধা পাগলীর পাগলামী আবার বেড়েছে। সে ছোট ছোট বাচ্চা দেখলে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে চায়। ছেলেমেয়েরা ভয় পায়। ঘৃণা করে। পাগলীর শরীর দিয়ে তীব্র দুর্গন্ধ বেরোয়। ছোট ছোট বাচ্চারা অতীষ্ঠ পাগলীর অত্যাচারে। পাগলীর গলা দিয়ে আও আও আওয়াজ বেরোয়। তার ভেতরে মাতৃত্ববোধ জেগে ওঠে। কিন্তু কেউ তার কাছে যেতে চায় না। গ্রামের লোকজন ক্ষেপে যায়। তার কারণে বাচ্চারা বিদ্যালয়ে যেতে ভয় পায়। শেষ বয়সে পাগলীর মাতৃত্ববোধ চরমে উঠেছে। সে তার সন্তানকে খুঁজে পেতে মরিয়া। সবাইকে তার সন্তান ভেবে আদর করতে চায়। একটু বুকে জড়িয়ে ধরে পূর্ণ তৃপ্তিতে মাতৃত্বের স্বাদ নিতে চায়। কিন্তু পারে না। বাচ্চারা পাগলীকে ঢিল ছোঁড়ে। হৈ হৈ শব্দে পাগলীর দিকে তেড়ে যায়। পাগলী দৌড়ায়, বাচ্চারাও পাগলীর পিছে পিছে দৌড়ায়। বাচ্চারা হাসে। অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। পাগলী পড়ে যায়। বাচ্চারা হাত তালি দেয়। পাগলী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। বাচ্চারা তাকে ঘিরে ধরে।

বেশ কিছুদিন ধরে ফুলমতিকে লক্ষ করছে পাগলী। পাগলীর তীব্র বাসনা ফুলমতিকে একটু জড়িয়ে ধরবে। একদিন আচমকা পাগলী কোথা থেকে ছুটে এসে ফুলমতিকে জড়িয়ে ধরে। ফুলমতি তখন স্কুলে যাচ্ছিল। ফুলমতি ভয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করে। পাগলী ফুলমতির হাত শক্ত করে ধরে রাখতে চায়। ফুলমতি হাত ছাড়িয়ে নেবার তীব্র চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। ফুলমতি কাঁদে। ছাড়, ছাড় পাগলী কোথাকার! পাগলী হাত ছাড়ে না। পাগলী কেমন কুই কুই আওয়াজ বের করে গলা দিয়ে। পাগলীর চোখেও কেন জানি জল চলে আসে। ফুলমতির চেঁচামেচি আরও বেড়ে যায়। বাচ্চাদের জটলা বেঁধে যায়। সবাই এসে পাগলীকে জাপটে ধরে। পাগলী চুপ হয়ে যায়। বাচ্চারা এসে ঢিল ছুঁড়তে থাকে আবার। লাঠি নিয়ে তাড়া করে। ফুলমতি স্কুলের এককোণে দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকে। ভীষণ ভয় পেয়েছে সে। সে পাগলীর দৌড়ে চলে যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। বাচ্চারাও পিছনে পিছনে দৌড়াতে থাকে। ফুলমতি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। একসময় চোখের আড়াল হয় তারা। বাচ্চারা পাগলীকে গ্রাম ছাড়া করেছে।

***

বেশ কয়েক বছর কেটে যায় পাগলীকে আর এ গ্রামে দেখা যায় না। সময়ের হাওয়া পরিবর্তনের সাথে সাথে গ্রামের অনেক কিছুই বদলে গেছে। বদলে গেছে ফুলমতির জীবন। সখিনার চলাফেরা করার শক্তি সামর্থ্য কমেছে। নানান অসুখ বিসুখে ভেঙ্গে গেছে তার শরীর। এখন আর আগের মত ভিক্ষা করতে পারে না। সংসারে অভাব অনটন বেড়েছে। মেয়ের স্কুলের খরচ চালানোও অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। এদিকে স্কুলের বন্ধু বান্ধবীরা জেনে গেছে ফুলমতি সকিনার মেয়ে নয়। কোনো এক পাগলীর মেয়ে। এখন তার সাথে আর কেউ বন্ধুত্ব করতে চায় না। সবাই তাকে এড়িয়ে চলে। কারণে অকারণে মারে। জারজ বলে ক্ষ্যাপায়। ভালো লাগে না ফুলমতির। সে কাঁদে। সে আর সকিনার কাছে থাকতে চায় না। মায়ের কাছে যেতে চায়। সে তার গর্ভধারিণীর কাছে যেতে চায়। সকিনা বেগম দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। সেও আর এ গ্রামে থাকতে চায় না। সে অন্য কোথাও আশ্রয় নিতে চায়। এ গ্রামে থাকলে সে এবং তার মেয়ে ভালোভাবে বাঁচতে পারবে না। সে ভাবে পাগলীকে খুঁজে পেলে তার কাছে তার মেয়েকে ফিরিয়ে দেবে। ফুলমতি কিছুটা বড় হয়েছে। আস্তে আস্তে নিজের খেয়াল নিজেই সে রাখতে পারবে। সে দায়মুক্ত হতে চায়। পাগলীর মেয়ে চুরি করে যে পাপ সে করেছিল সে পাপ থেকে মুক্ত হতে চায়। মরার আগে মেয়েকে ফিরিয়ে দিয়ে চিরকালের মতো শান্তিতে ঘুমুতে চায়। সকিনার শরীর খুব খারাপ হতে থাকে। কিন্তু কোথায় পাবে সে পাগলীকে!

এক সকালে সকিনা বেগম মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। ভিক্ষা করতে করতে অনেক দূরে কোথাও চলে যাবে। গন্তব্য তার ঠিক নেই। শরীরটাও বেশি ভালো না। ফুলমতি মায়ের সাথে সাথে হাঁটে। সকিনা বেগম ফুলমতির হাত শক্ত করে ধরে রাখে। ফুলমতি বলে– মা, আমার আসল মা কনে? সকিনা বেগম থমকে যায়! কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। আমি মা’র কাছে যাবো, ফুলমতি তার হাতটা একটু ঝাকিয়েই বলে। যাবাই তো মা। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে সকিনা বেগম। অবশ্যই যাবা। আমি তোমাকে নিয়ি যাবো। ফুলমতি খুশি হয়। আমার মা কি পাগলী? ফুলমতির কথায় সকিনা বেগম হাসে। মারে, মা কখনো পাগল হয় না রে মা! মা সবসময়ই মা হয়! ফুলমতি সকিনা বেগমকে জড়িয়ে ধরে। তুমিই আমার আসল মা। সকিনা বেগম পা চালিয়ে হাটে। হাতে তার একটা ভিক্ষার থলি। আরেক হাতে কাপড়ের থলি। সকিনা বেগম হঠাৎ বলে ওঠে, চল্ মা, তোর আসল মাকে খুঁজে বের করি। ফুলমতি খুশী হয়। সে তার মায়ের হাত ধরে দুলে দুলে হাটে। তা দেখে মজা পায় সকিনা বেগম। মেয়ের গাল টিপে বলে, অত ঢং করা লাগবে নাকো, জোরে পা চালাও নইলে রাইত হৈ যাবেনে।

বিকেলের সুর্যটা প্রায় ডুবু ডুবু্। পশ্চিম আকাশে লাল হয়ে হেলে পড়েছে। জমিনে সবুজ মাঠ। সবুজ আর সবুজ। উপরে লাল সূর্য। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে নদী। নদী পার হলে শহরের রাস্তা। আজ সারাদিন হেটেছে তারা। ভিক্ষা করেছে। খুব ক্লান্ত। ফুলমতি একটু বসে জিরিয়ে নিতে চায়। তার পা আর চলতে চায় না। সকিনা বেগম মেয়েকে সান্ত্বনা দেয়, মারে ঐ যে নদীটা দ্যাখছো, ঐডি পার হলিই শহর। আর বেশি দূরে না। ফুলমতি দ্রুত পা চালানোর চেষ্টা করে। কষ্ট হচ্ছে। সে তার আপন মায়ের কাছে ফিরে যাবে এ আনন্দের কাছে কষ্টটা অতি তুচ্ছ। মাকে দেখার তীব্র আকাঙ্খা তাকে দ্রুত পা চালাতে সাহায্য করে। দ্রুত পা চালায় সে। নদী পার হয়। কিছুদির এগুতেই শহরের দেখা মেলে। গাড়ি ঘোড়া। হর্ন। মানুষের ব্যস্ততা। দ্রুত ছুটে চলা। সকিনা বেগম রাস্তার ধারে বসে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। চিন্তা করে। রাতটুকু মেয়েকে নিয়ে কোথাও কাটিয়ে দেবে।

সারাদিন পথে ভিক্ষা করতে করতে শহরের পথ ধরেছে তারা। সকিনা বেগম মেয়েকে নিয়ে কাছের একটা সস্তা খাবার হোটেলে ঢোকে। মুরগির মাংস দিয়ে মেয়েকে খেতে দেয়। নিজে অল্প একটু খাবার নেয়। না খেয়ে খেয়ে পেট প্রায় শুকিয়ে গিয়েছে তার। অল্পতেই পেট ভরে যায়। সকিনা বেগম বসে বসে মেয়ের খাওয়া দেখে। খুব তৃপ্তিতে ভাত খাচ্ছে ফুলমতি। সকিনা বেগমের খুব ভাল লাগছে। সে যদি সারাজীবন এমন তৃপ্তিতে মেয়েকে খাওয়াতে পারতো? সে অসুস্থ না হলে মেয়েকে ফিরিয়ে দেবার চিন্তাও করত না! কিন্তু পাগলী কি পারবে ফুলমতিকে আগলে রাখতে? দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় সকিনা বেগম। সে মরবে, মরার আগ পর্যন্ত কখনোই ফুলমতিকে পাগলীর কাছে ফিরিয়ে দেবে না। সকিনা বেগমের খুব ইচ্ছে করছে ফুলমতিকে জড়িয়ে ধরে বুকে আগলে রাখতে।

খাওয়া শেষে ফুলমতিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সকিনা বেগম। বুঝে উঠতে পারে না সে কোথায় রাত কাটাবে। মেয়েকে নিয়ে অন্ধাকার রাতে হাটতে থাকে। হাটতে হাটতে রাস্তার ধারে একটা বাজার দেখতে পায় সকিনা বেগম। এটা সেই বাজার, যে বাজার থেকে সকিনা ফুলমতিকে তুলে এনছিল। সকিনা বেগমরে শরীরের আরও অবনতি হতে থাকে। সে আর হাটতে পারে না। খুব ক্লান্ত। শরীরটা কেমন অসাড় হয়ে আসে। এই বাজারে রাতটুকু মেয়েকে নিয়ে কাটাতে চায় সকিনা বেগম। অন্য কোথাও যাবে না। যাওয়ার তার শক্তিও নেই। সে একটা দোচালা ছাপড়ার মতো দেখতে পায়। তার নিচে গিয়ে থলে থেকে একটা চাঁদর বের করে পেড়ে দেয় মাটির উপর। তারপর মেয়েকে নিয়ে শুয়ে পড়ে। শরীরে প্রচণ্ড ক্লান্তি। মুহূর্তেই ঘুমিয়ে পড়ে সে।

ফুলমতির ঘুম আসে না। সে তার মাকে দেখতে পাবে। তার কাছে যাবে। তার আসল মা। ভাবতেই অন্যরকম লাগে ফুলমতির। মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে তার চোখ দুটো কেমন বুঁজে আসে। সে স্বপ্ন দেখে। একটা কুকুর তাকে তাড়া করেছে। অনবরত দৌড়াচ্ছে ফুলমতি। কুকুরটি ঘেউ ঘেউ করতে করতে তার দিকে এগিয়ে আসছে। সে প্রাণপনে দৌড়াচ্ছে। হঠাৎ তার মা সকিনা বেগমকে দেখতে পায় ফুলমতি। কুকুরটি এখন সকিনা বেগমকে তাড়া করছে। সকিনা বেগম দৌড়ানোর চেষ্টা করছে। প্রাণপণে দৌড়ানোর চেষ্ঠা করছে। পারছে না। হাফিয়ে গেছে। হাফাতে হাফাতে বসে পড়েছে মাটিতে। কুকুরটি তাকে কামড়ে কামড়ে ক্ষত বিক্ষত করছে। ঘেউ ঘেউ করে হিংস্র দাত দিয়ে কামড় বসাচ্ছে গলাই, গালে পিঠে, বুকে, পেটে। রক্ত ঝরছে সকিনা বেগমের শরীর দিয়ে। উঠে দাড়াতে পারছে না সে। ফুলমতি দৌড়ে আসে কুকুরটির কাছে। এখন আর তার ভয় করছে না। সে কুকুরটিকে তাড়ানোর চেষ্টা করছে। যাচ্ছে না কিছুতেই। ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদছে ফুলমতি। এমন সময় আজানের আওয়াজ কানে এলো ফুলমতির। ঘুম ভেঙ্গেই ভয়ে মায়ের শরীরে হাত রাখে ফুলমতি। শরীরটা ঠান্ডা। নিথর। ফুলমতি মুখ গুঁজে শুয়ে থাকে কিছুক্ষণ মায়ের বুকে।

ফুলমতি সকিনা বেগমকে ডাকে। মানুষজন আসার আগেই উঠে পড়তে চায় সে। সেখান থেকে চলে যেতে চায়। মাকে খুঁজে বের করতে চায়। কিন্তু সকিনা বেগমের কোনো সাড়া শব্দ নেই। ডাকতে ডাকতে ভোর হয়ে আসে। ওঠে না সকিনা বেগম। কিছুতেই ওঠে না। ফুলমতি নাকের কাছে হাত রাখে। নিশ্বাসের সাড়া শব্দ পায় না। বুকে মাথা রাখে। হার্ট বিটের কোনো সাড়া শব্দ পায় না। বুঝতে বাকি থাকে না ফুলমতির। সকিনা বেগম আর কখনোই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে পারবে না। বসে বসে কাঁদে ফুলমতি। কী করবে কিছুই বুঝতে পারে না সে। কে, কোথায়, কারা দাফন করবে তার মাকে? ফুলমতি ভাবতে পারে না কিছুই! সে তার মায়ের থলে হাত নেয়। কী যেন ভেবে সকিনা বেগমকে রেখেই বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। সকিনা বেগমের লাশ পড়ে থাকে সেখানেই।

ফুলমতি দ্রুত পায়ে পা চালাই। কান্না তার বন্ধ হয়নি। সে কাঁদছে। দ্রুত পায়ে হাটছে। এবার সে তার আসল মাকে খুঁজে বের করবে। কিন্তু একা একা কিভাবে করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। সারাদিন সে এলোমেলো ঘুরেছে। খুঁজেছে তার মাকে। রাস্তার যার সাথে দেখা হয় তাকেই জিজ্ঞেস করে সে তার মাকে দেখেছে কিনা? বলে, তার মা পাগলী। কোনো পাগলীকে দেখলেই তাকে জানাতে বলে সে। ফুলমতি তার মাকে খুঁজতে খুঁজতে রাত নেমে আসে। তার মাকে খুঁজে পায় না। হাতে তার সকিনা বেগমের থলে। ফুলমতি এখনও খুলে দেখেনি তাতে কী আছে? খুব বেশি ভারি না ব্যাগটা। ফুলমতি ব্যাগের মধ্যে হাত দিয়ে দেখতে চায় তাতে কী আছে। সে থলেতে হাত দিয়ে কৌটাটা বের করে। ফুলমতি কৌটাটা খুলে দেখে তাতে কৌটা ভর্তি টাকা। সকিনা বেগম প্রতিদিন ভিক্ষা করে করে মেয়ের জন্য জমিয়েছে। ফুলমতি কৌটার মুখটি আবার আটকে রেখে কৌটাটা আবার থলেতে রেখে দেয়। তার চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে বৃষ্টি নেমে আসে। সে ভাবে এতক্ষণ হয়তো লোকজন এসে তার মাকে দাফন করে দিয়েছে। ফুলমতি কাঁদে। আজ সে একা। ভীষণ একা। খুব ভয় করছে তার। কাঁদতে কাঁদতে ফুলমতি থলেটা মাথার নিচে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

পরদিন সকালে আবার বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। পাগলীকে খুঁজে পাওয়াটাই লক্ষ্য। ফুলমতি শহরের রাস্তা দিয়ে হাটতে হাটতে ভিক্ষা করতে থাকে। থলেতে তার অনেক টাকা। সে টাকা সে খরচ করতে চায় না। সে ভিক্ষা করবে আর তার আসল মাকে খুঁজে বের করবে। ফুলমতি হাটতে হাটতে হাইওয়ের দিকে চলে যায়। এদিকেই ভিক্ষা করবে সে। কাল রাতে তার খাওয়া হয়নি। খুব ক্লান্ত লাগছে। হাইওয়ের ফুটপথের উপরেই বসে পড়ে ফুলমতি। সে দেখে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলেছে বাস, ট্রাক, জিপ, মোটর বাইকসহ নানান গাড়ি। ফুলমতি চুপচাপ বসে শুধু গাড়ি দেখছে। চলন্ত গাড়ি। হঠাৎ তার চোখ চলে যায় রাস্তার ওপাসে একটা পাগলীর দিকে। হ্যা পাগলীই। ওই পাগলীই হতে পারে ফুলমতির মা। ফুলমতি কোনো কিছু চিন্তা করে না। সে দৌড়ে রাস্তা পার হতে থাকে। সে কোনো দিকে খেয়াল করে না। হঠাৎ খুব কাছেই একটা ট্রাক চলে আসে। হাতের থলেটা ছিটকে গিয়ে পড়ে একটু দূরে। কৌটাটা ভেঙ্গে তছনছ। উড়তে শুরু করেছে টাকা। এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়। ফুলমতির রক্তাক্ত দেহটি পড়ে থাকে মাটিতে। একটু আগেই তার শরীরের উপর দিয়ে ট্রাক চলে গেছে। শরীরের উপর দিয়ে চালিয়ে পালিয়েছে ট্রাক। পাগলী আচমকা চমকে ওঠে বিকট শব্দ শুনে। দ্রুত ছুটে আসে মেয়েটির কাছে। লোকজনের জটলা বেধে যায়। ফুলমতি ক্ষত বিক্ষত দেহে ঝাপসা চোখে পাগলীর মুখের পানে চেয়ে থাকে এক দৃষ্টিতে। কিছু একটা বলার চেষ্টা করে। পারে না। শুধুমাত্র অস্পষ্ট স্বরে একবার বলে ওঠে, মা রে! পাগলীর মুখ দিয়ে কুঁই কুঁই আওয়াজ বের হয়। পাগলী হা-হুতাশ করে। বুক চাপড়ে কাঁদে।

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu