দীলতাজ রহমান
জন্ম ১৯৬১ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জ জেলার চন্দ্রদিঘলয়া গ্রামে। কবিতা দিয়ে লেখালিখি শুরু করলেও পাঠকদের কাছে গল্প দিয়েই বেশি সমাদৃত। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: তারান্নুম (গল্পগ্রন্থ), গল্পসমগ্র-১
দীলতাজ রহমান

মা

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

নূরীর স্বামীর নাম মইনুল ইসলাম। মইনুল ইসলামদের বাড়ির একেবারে পাশ দিয়ে বড় রাস্তা চলে গেছে বগুড়া শহর পর্যন্ত। মোটর সাইকেলে মাত্র পনেরো মিনিটের পথ। মইনুল চাকরি করে বগুড়ায়, মা ও শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রে। কিন্তু থাকে গ্রামে, নিজের পৈত্রিক ভিটায়। সেখান থেকেই অফিসে যাতায়াত। মোহাম্মাদ খাইরুল বাসার যখন ও বাড়িতে জামাই হয়ে আসে, সেই বিশ-একুশ বছর আগে সে শুনেছিলো, পাশের ঘরের ছোট চাচার ছেলে মইনুল ইসলাম ঢাকায় থেকে প্যারামেডিকেল পড়ে। বাড়ির অন্য ছেলেরা যেখানে বড় বড় ডিগ্রি অর্জন করে সরকারের বড় বড় পদ দখল করে আছে, সেখানে মইনুলকে দিয়ে এরচে’ বড় কিছু করানো গেলো না। বাসার যখন মইনুলকে দেখে, তখন তাকে দেখার আগে তার বউয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। গায়ের রঙ শ্যামলা হলেও গড়ন চমৎকার। কণ্ঠটিও মিষ্টি। ইন্টার পাশ। অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে। সব মিলিয়ে নূরী সবার নজর কাড়ে।

মইনুল ঢাকায় যেখানে থেকে লেখাপড়া করেছে, নূরীর এক বড়লোক আত্মীয়ের বাড়ি তার ধারে কাছে। প্রায়ই সেখানে মইনুলের যাওয়া আসা ছিলো। সেই সূত্রে দুজনের সাথে দু’জনার পরিচয়, পছন্দ এবং বিয়ে। আর শুধু সেই কারণেই মইনুলের মা সারাক্ষণ নূরীর ত্রুটি খুঁজে বেড়াতেন। একদিন তো বাড়িতে আগত এক যুবক অতিথি মইনুলের মাকে বলেই ফেলেছিলো, ‘খালাম্মা, অধিকাংশ মায়ের এই এক দোষ, প্রস্তাব দিয়ে যে মেয়েকে বউ করে আনার ক্ষমতা থাকে না, সে মেয়ে যেচে সেরকম ঘরে এলে শ্বশুরবাড়ির কোনো কোনো সদস্য তার চৌদ্দগোষ্ঠীর শেকড় নাড়িয়ে ফেলে। পারলে সব সদস্যই তাই করে।’

পরে অবশ্য মইনুলের মায়ের শেকড় নাড়ার আরো একটি যে কারণ প্রকাশ হয়ে পড়েছিলো। নূরীর বাবা নূরীকে এক বছরের রেখে মারা যাওয়ায়, তার মায়ের অন্যখানে বিয়ে হওয়া। আর সেটাই যেন নূরীর মা এক মহাপাপ করে ফেলেছে আর কী!

মেয়ে মানুষের দ্বিতীয় বিয়ে? বিষয়টি এত নাজুক, যে মইনুলের সঙ্গে অধিক ঘনিষ্ঠতার সূত্রে নূরীর সঙ্গেও বাসারের বেশ ভাব জমে গেছে। শ্যালকের বউ বলে কথা! তবু মা’র বিষয়টি নিয়ে ওর সঙ্গে আলোচনা করতে পারেনি বাসার। কিন্তু একটা উসখুসভাব ভেতরে সারাক্ষণ কাজ করে, শুধু এই বিষয়টি নিয়ে একদিন নিরিবিলি ওর সঙ্গে কথা তোলার ইচ্ছেয়। কারণ, বাসারের নিজের জীবনটাও নূরীর মতো। সেটা অবশ্য বাসারের শ্বশুর ছাড়া শ্বশুরকুলের কেউ জানে না। বাসারের স্ত্রী শেলীও বিয়ের ক’দিন পরে বিষয়টি জানতে পারে বউ দেখতে আসা বহিরাগত মহিলাদের কানাঘুষায়। তারপর স্বামীকে নানান কথায় জর্জরিত করে শাসিয়ে বলেছে- ‘দেখো তোমার মায়ের অন্যখানে বিয়ে হয়েছে সে কথা যেন আমাদের বাড়ির কেউ না জানে। তাহলে সবার কাছে আমার মাথা হেঁট হয়ে যাবে।’ বাসারের মুখ ফসকে প্রায় বেরিয়ে এসেছিলো, ‘তোমাদের বাড়িতে দুজন পুরুষ মানুষের স্ত্রী মারা যাওয়ায়, মাঝবয়সে তারা দুজনেই কচি মেয়ে বিয়ে করে এনে সংসার করছে। তোমার বাবাও তাদের একজন। এতে মাথা হেঁট হয় না?’ না, এ নিয়ে কথা বললে যে পরিবেশ সৃষ্টি হবে, তা নিয়ে বাদানুবাদ, বাসারের দ্বারা অসম্ভব! বাসারের কণ্ঠ স্ত্রীর কাছে এমনি রোধ হয়ে গেলো। কারণ জীবনে তার এত টানাপোড়েন পোহাতে হয়েছে, সে আগুনে আর তুষ ঢালতে চায় না। সামনের দিনগুলোতে সে সুখ না হোক, যে কোনো মূল্যে স্বস্তির অবস্থা নির্মাণ করতে চায়।

নূরীর শাশুড়ির তেজ খুব একটা ফণা মেলতে পারে না নূরীর দিকে। কারণ শ্বশুর ছোট বউমার পক্ষে। বিরাট পরিবারের অন্যান্য সদস্যও বিষয়টিকে কেন্দ্র করে দুই ভাগ হয়ে যায়। এক পক্ষের কথা, মায়ের বিয়ে হয়েছে এতে বউয়ের দোষ কী? তাছাড়া নূরীর বাবা সরকারি চাকরি করতেন। নূরীর বয়স যখন একবছর তখনি তিনি রোড এক্সিডেন্টে মারা যান। বাবার অফিস থেকে পাওনা সব টাকা নূরীর দাদা নূরীর জন্য গচ্ছিত রেখেছিলেন। সুদ-আসলসহ সেগুলো ছাড়াও, কোনো ধরনের টালবাহানা ছাড়া, বিয়ের পর নূরী আরো পেয়েছে দাদার দেওয়া কিছু জমিও। আর শিক্ষা-দীক্ষা-রুচিতে সব মিলিয়ে পরিবারটি মইনুলদের থেকে ভালো। নূরীকে দেখতে আসা তার স্বজনদের দেখেশুনে বাসারের তাই মনে হয়। আর এইসব দ্বিধাদ্বন্দ্বের জের টেনেও বছর বছর ছেলেমেয়ের জন্ম দিয়ে নূরীর শেকড় সংসারটিতে গেড়ে গেছে। তার ওপর অক্ষুণ্ণ আছে স্ত্রীর প্রতি মইনুলের সমীহ, ভালোবাসা, নির্ভরতা।

একসময় শ্বশুর মারা যান। শাশুড়িরও যখন ভগ্নদশা। তখন ধারে-কাছে অন্য কাউকে তিনি পান না। তাই শেষ সময়ে এসে নূরীর স্তুতির সীমা রাখেন না তিনি। আর যাদের এখনো তেজ আছে, যে সব সদস্যের ওদের ধার ধারতে হয় না, তারাই কেবল পুরোনো বিষয়টি নিয়ে কখনো ঠোঁট চুলকোয়। তবে সবাইকে বছরে, ছ’মাসে, একবার নূরীর কাছে একবেলার জন্য হলেও এসে উঠতে হয়। কারণ পাঁচ ভাইয়ের দুই ভাই থাকে ঢাকায়। এক ভাই চট্টগ্রাম। আরেক ভাই দুবাই। তিন বোন যে যার সংসারে। মইনুল একা বাবার ভিটার এককোণে ভাগের জমিতে স্বামী-স্ত্রী দুজনের টাকায় বিরাট এক প্রাসাদ গড়ে তুলেছে। রঙও যা দিয়েছে, সাধারণ এবং রুচিশীল দুই শ্রেণীর মানুষেরই তা দাঁড়িয়ে থেকে দেখার মতো। একশ্রেণি দেখে বাহার, আরেক শ্রেণি হিসেব করে খরচের। তারপর সব শ্রেণির সেই শেকড়ের মাটিতে হাত, ‘বউয়ের টাকা না পেলে, শুধু মইনুলের রোজগারে এতো বড় দালান সম্ভব ছিলো না’। এভাবেই বউটি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে টিকে থাকে। নূরীকে আরো একটা বিষয় গর্বিত করে রেখেছে। কারণ বাবার পরিবারের সবাই যারা শহরে বা বিদেশে থাকে, তাদের সবাইকেই কখনো না কখনো গ্রামে আসতে হয়। এলে নূরী কাউকে আপ্যায়নে ত্রুটি করে না। কিন্তু তার নিজের কখনো কারো বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। চারটে ছেলেমেয়ে নিয়ে তার দিন চলে যায় কীভাবে তা সে নিজেও টের পায় না। তার জীবনের আর কোনো সাধ নৈমিত্তিক ব্যস্ততার ভিড়ে মাথাচাড়া দেয়ার অবকাশ পায় না। তাকে নিয়ে ভালোমন্দ কে কী ভাবছে, ওই একই কারণে তা ওর মনে নতুন কোনো ক্রোধ বা আগ্রহের রেশও সৃষ্টি করতে পারে না।

কিন্তু একটু খেয়াল করলে নজরে যেটা পড়ে, তা হলো নূরী নিজেও কখনো তার মায়ের প্রসঙ্গে কিছু বলে না। সবার কটূক্তির ভেতরেও সে কখনো মারমুখী হয়ে ওঠা দূরে থাক, মৃদু প্রতিবাদও করেনি। মইনুলের সেখানেই বড় রক্ষে।
মইনুল নিজেও ব্যস্ত মানুষ। নিজের নিষ্ঠা ও শ্রম দিয়ে সাধারণ মানুষের সম্মান অর্জন করেছে। গ্রামের মানুষের ভাষ্য, ‘মইনুল ডাক্তারের হাতযশ ভালো। মানুষের প্রতি দরদ আছে। ডাকলে যখন তখন পাওয়া যায়…।’ মইনুল বড় ডাক্তার না ছোট ডাক্তার, তাতে এলাকার মানুষের কিছু এসে যায় না। বরং দূরদূরান্ত থেকেও তার কাছে দূরারোগ্য ব্যাধি নিয়ে রোগীরা আসে।

নূরীর প্রতিদিনকার গল্পের ভেতর চাচা-চাচি, চাচাতো ভাই-বোন, তার শৈশব-কৈশোর, খাল, বিল, নদী-পুকুর, লতাপাতা, কেঁচো-জোঁক দেখে ভয় পাওয়ার স্মৃতি থেকে শুরু করে চাচি আম্মার বাবার বাড়ির পাড়া-পড়শির গল্পও থাকে। কেবল থাকে না নিজের মা, আর মামাবাড়ির কোনো কথা। আর এই না থাকাটুকুর চিত্রই অবচেতনে বুনন হতে থাকে বাসারের মনে। মায়ের দ্বিতীয় স্বামীকে বাসার বাবা ডাকার অধিকারও পায়নি। লোকটি আজও পর্যন্ত তাকে ডেকে কথা বলেনি। তবু মায়ের ওপর তার কোনো অভিযোগ নেই। এখনো তার চোখের সামনে ভাসে, তার পাঁচ বছর বয়সের সময়, কান্নারত যুবতী মাকে এক বৃদ্ধ মানুষের সঙ্গে পালকিতে করে কোথায় পাঠিয়ে দেওয়া হলো। আর সে একা কাঁদতে কাঁদতে রয়ে গেলো নানির কাছে। সেই যে মা গেলো, মার যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার বুকের ভেতরটা যেনো কোনো ঝড় এসে তছনছ করে গেলো। তারপর শুধু তার মানুষরূপী সাপ আর নেউলের ভেতর তার বেড়ে ওঠা। কিন্তু সে নিজেকে ও-দুটোর কোনোটাই মনে করে না!

মাঝে মাঝে যে মায়ের সঙ্গে তার দেখা হতো, সে মায়ের পরনে ঝলমলে শাড়ি, গা-ভর্তি গহনা। রাগী স্বামীকে নিয়ে সে সারাক্ষণ ভীষণ ব্যস্ত। বাসারের দিকে তখন তার অত খেয়াল নেই। আরো পরে, মা প্রায় দেড় দু বছর পরপর মামাবাড়ি আসতো একটা করে বাচ্চার জন্ম দিতে। কিছুদিন থেকে ঘটা করে চলেও যেতো। কাছে থাকলে মা বাসারকে এক আধটু আদর করতো বটে, কিন্তু কোনোদিন তাকে সঙ্গে করে নিতে চায়নি। প্রথমদিকে মায়ের সঙ্গে যাওয়ার জন্য কান্না জুড়েছে। বড় হতে হতে সব মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে বাসার। নিম্নবিত্ত, কিছুটা শিক্ষিত, কিছুটা ভদ্র মামাদের সম্মিলিত প্রয়াসে আজকে তার এটুকু প্রতিষ্ঠা। বিএ পাশ করে হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার হতে পেরেছে। সেই ঠেলা-ধাক্কা খাওয়ার দিনগুলো মনে হলে এখনো সব ঘুলিয়ে যায়। এখন যে অবস্থায় আছে, এরচে’ উচ্চাশা করবার মতো সাহস কেউ কোনোদিন তার মনে রোপণ করে দেয়নি। তার বাবারও তেমন কোনো সম্পত্তি ছিলো না। বাড়ির ভিটেয় যা পাওয়া যাবে, তা নিয়ে দেনদরবার করার মতো রুচি বাসারের নেই। তাছাড়া চাচা দু’জনের দিকে তাকালে তার নিজের বাবার কথা মনে পড়ে যায়। তারওপর আবার একজন বাবার যমজ! তাই সামান্য কিছু টাকা বা ভিটের একটি কোনার জন্য সে দর কষাকষি বা সালিশ ডাকাডাকি করবে, মানুষের বিরূপ সে নিজে টেনে বের করতে চায় না এইটুকু মূল্যের জন্য। নাই বা কোনোদিন তারা ডেকে মাথায় একটু স্নেহের পরশ না বুলিয়ে দিক।
বাসারের নিজের ছেলেমেয়ে দুটিকেও সে আরেকটু এগিয়ে যাওয়ার মতো কোনো অবস্থা এখনো তৈরি করে দিতে পারেনি। নানান ব্যর্থতার খেদ দানা বেঁধে তাকে একরকম আনমনাই করে রাখে। হীনম্মন্যতা কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। কোথাও উঁচু গলায় কথা বলতে গেলে ভেতর থেকে শব্দগুলো মিলিয়ে যায়। বন্ধুদের পরস্পরের প্রতি উচ্ছ্বসিত হতে দেখলে, সে নিজের ভেতর উৎস খোঁজে এতটুকু উচ্ছ্বাসের। যা নিয়ে সেও ওদের একজন হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু চোরাবালিতে তলাতে থাকে শুধু। স্ত্রীর সঙ্গেও সর্ম্পকটি ঠিক রাখে রয়েসয়ে। এটুকুতে ধস নামতে বুঝি আর কিছু থাকে না, ঘোলাজলে ভেসে যাওয়ার মতো।

চাচাতো ভাইয়েরা একের পর এক প্রতিদিন নূরীর খোঁজ-খবর নিচ্ছে। কখনো ফোনে, কখনো বাড়িতে এসে। নূরীর এক হাতে কোনো চাচাতো ভাইয়ের বিদেশ থেকে পাঠানো দামি মোবাইল সেট, অন্য হাতে কোনো গনগনে চুলোর মুখের জাবাখড়ি ঠেলার মতো কাজ। গলগল কথার ভেতরেই রান্না শেষে তারপর সবাইকে খাইয়ে স্বামীর জন্য অপেক্ষা। তারপর নিজেদের খাওয়া, গল্পগুজব, ভাতঘুম। ঘনঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে চার্জ লাইটগুলো সে চেক করে রাখে সন্ধ্যা নামার আগেই। যেন মাস্টার এলে ছেলেমেয়েরা লেখাপড়াটা পুষিয়ে নিতে পারে। কিন্তু বারবার তাদের কারোর স্কুলের ফলাফল তেমন সন্তোষজনক হয় না বলে এবং গ্রাম্য স্থুলতায় তাদের আচরণ দূষিত হয়ে যাচ্ছে বলে মইনুল প্রায়ই আক্ষেপ করে- ‘বাপের ভিটেয় বাতি জ্বালাতে এখান থেকে সরলাম না। যে টাকায় এখানে বাড়ি করেছি, সেই টাকায় বগুড়া শহরে জমি কিনে বাড়ি করতে পারতাম। ছেলেমেয়েগুলো তাহলে ভালো পরিবেশ পেতো। ভালো স্কুল পেতো।’

নূরীর অবশ্য এ নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য নেই। সারাক্ষণ সারামুখে তার একটা পরিতৃপ্তির হাসি লেপটে থাকে। পৃথিবীর কোনো বিষয়ে সে এতটুকু ক্ষুণ্ণ বলে মনে হয় না। ডালপালা ভেঙে আসা বৃষ্টিতেও ছাতা মাথায় নূরী উঠোন পেরিয়ে চা ভর্তি কাপটি এনে হাতে ধরিয়ে দেয় ননদাই সম্পর্কের বাসারকেও। তাতে চাচা শ্বশুরের ঘরের মানুষ সবাই উষ্ণ, মুখর হয়ে ওঠে। আবার নিজের ঘরের হাঁকডাকে পিচ্ছিল উঠোন দিয়ে টলতে টলতে দ্রুত ফিরে যায় সে। ঝাপটা রুখতেও দরজা বন্ধ করে না বাসার। চেয়ে থাকে নূরী অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পরও। ভাবে, দু’দণ্ড সময় কী ওর কারো জন্য বিষণœ রাখতে নেই? থাকতে নেই বিমর্ষ হয়ে ক’টি পলক? চোখের পাতা শিশিরের মতো ভেজাতে কোনো শীতার্ত, বা ঝড়ো কাঁপন কোনোদিনই কী ওর বুকের নিভৃত ঝরা একটি পাতা ওড়ার মত ক্ষীণ আন্দোলিতও হবে না? শুধু এইটুকু শূন্যতা যদি বাসার দেখতে পেতো, তাহলে হয়তো আর্দ্রকণ্ঠে একদিন বলে ফেলতো- ‘নূরী, তুই আমার ছোটবোন, পৃথিবীতে আমি আর একা নই!’ ওর ভাই হয়ে, দু’দণ্ড সুখ-দুঃখের কথা বলে বর্তে যতো সে। ছোট্ট এইটুকু চাওয়া পূরণ করার নেশায়ই হঠাৎ তার ঘন ঘন শ্বশুরবাড়ি আসা শুরু হয়েছিলো বাসারের এবং আজো তা অব্যাহত আছে।

বাসার ও অন্য ঘরের এক মেয়ের জামাই। কিন্তু ধরনটা দু’রকমের হলেও পেশায় যেহেতু ডাক্তার তাই মইনুলের সঙ্গে বাসারের সখ্য খুবই মজার। এই সূত্রে নূরীর সাথে সম্পর্কটা বাসার আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে নিতে পেরেছিলো। নূরীর ঘনীভূত রহস্য একদিন ওর কাছে খুলে যাবে বাসার এই অপেক্ষা করে। বিষয়টি আলোচিত বলে ওর মন কখনো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ডেকে জানতে ইচ্ছে করে, নূরীর মায়ের সঙ্গে নূরীর দেখা হয় কি না? কিন্তু মনের অবচেতন দিকটিই টেনে ধরেছে উদগ্র দিকটিকে। থাক না, সব কিছুই কি খোলাসা না হলে নয়! তার নিজের মায়ের সাথেও তো কতবার কতখানে দেখা হয়ে যায়। বাসারের ইচ্ছে করে, মা কাছে এসে জানতে চাক, সে কেমন আছে? শুধু এইটুকু তৃষ্ণা মিটে গেলে বাসার এক সাধারণ মানুষ হয়ে যেতো। তার আর অন্যকষ্ট থাকতো না!

তবে একদিনের ঘটনায় নূরীর বিষয়ে সব কুয়াশা কেটে গেলো। এবার ব্যবধানটুকু শুধু আরো দুঃসহ হয়ে ঢুকলো বাসারের মগজে। বাসার নিরবচ্ছিন্নভাবে নূরীর কাছে থেকেও কখনো এতটুকু ফুরসত পায় না, যখন গুছিয়ে বলে– কেন এই দূরত্ব জিইয়ে রেখেছো? অথবা বাসার নূরীর অন্তরের কোথাও কোনো ফাঁক খুঁজে পায়নি বলে বলতে পারেনি, যা বলে সে নিজে পরিত্রাণ চায় একটি অমীমাংসিত সত্যের মীমাংসা টেনে। ভেবেছিলো, জোর দিয়ে বলবে কেন এ মিলন সম্ভব নয়, যেখানে মাত্র কয়েক মাইলের ব্যবধানে মা মেয়ের বসবাস। বাসার শুনেছে তারা নাকি অনেক বড়লোক। শহরের নামকরা পরিবার।

কী ভাগ্য, বাসার চলে যেতে চেয়েছিলো। কিন্তু শেলীর জন্য পারেনি। নাকি বিধাতা চেয়েছেন, রহস্যটি ওর সামনেই উন্মোচিত হোক। মইনুলই ডেকে বললো- ‘কাল দুপুরে আমার শাশুড়ি আসবেন। লোক মারফত খবর পাঠিয়েছেন। বাসার ভাই, কাল শেলী আপা আর সেতু, সোহেলকে নিয়ে আমাদের ঘরে খাবেন।’ ঢাকায় চলে আসার জন্যে বাসারের সব কিছু গোছানো। শুধু কাউকে বলা হয়নি, শেলী, সোহেল, সেতু না গেলেও কাল সকালে আমি একা চলে যাবো। মইনুকেও সে আর বলে না, যে আমার চলে যাওয়ার কথা ছিলো…। বাসার কাছাকাছি থেকে দেখতে লাগলো সন্ধ্যা থেকে নূরী দ্রুত হাতে তার শোকেস থেকে শুরু করে ঘরের প্রতিটি কোণ পর্যন্ত ঢেলে সাজাচ্ছে। শরতের সকালের মতো তেমনি স্নিগ্ধ তার মুখ। বাসার ভাবতেও পারেনি, এই স্নিগ্ধতা বাসারের নিজের চোখের কোটর থেকে অন্য কেউ এসে ধুয়ে দেবে। কিন্তু কে আসছে, কেনই বা আসছে, এ প্রসঙ্গটির সে একেবারেই মুখে প্রকাশের ধারে-কাছে নেই। এতদিনে বাসার বুঝে গেছে, ওর মায়ের প্রসঙ্গে ওকে কেউ কিছু বলুক, তা সে চায় না। বাসারের চোখ তাই ওর দৃষ্টির সব প্রান্তরজুড়ে আজ আরো তন্নতন্ন করে ঘোরে।

পরদিন দুপুরের জন্য অনেক রকমের রান্না হলো। দুপুরের আগেই এসে গাড়ি থেকে নামলো তিনটি মানুষ। দু’জন মহিলা। একজন পুরুষ। সঙ্গে দু’টি ছোট ছেলেমেয়ে। বাসার ঘরে ঢুকলে মইনুলই পরিচয় করিয়ে দিলো, আমার শাশুড়ি। বাসারকে দেখিয়ে বললো, আমার চাচাতো বোনের স্বামী। পাশে বসা মেয়েটির কথা বললো, নূরীর ছোটবোন, বলেই মইনুল ঢোক গিললো। তারপর তাকেই জিজ্ঞেস করলো, তুমি যেন কে। কী যেন নাম তোমার? মহিলা মৃদু হেসে উত্তর দিলো, আমি নূরী আপার ছোটবোন রোকেয়া। রোকেয়ার পাশে বসা ভদ্রলোকের দিকে মইনুল চোখ তুলতেই সে দেখিয়ে বললো, আমি নূরী আপার ছোটভাই। তবে রোকেয়ার বড় ভাই। আর আপনি আমার দুলাভাই হন। তেমন হাসির কথা না হলেও খাবিখাওয়া দশার ভেতর সবাই একচোট হেসে পরিবেশ হালকা করতে চাইলো। মৃদু হাসলো নূরীও।

পেশাগত কারণে মইনুলকে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের সান্নিধ্যে আসতে হয়। যেতে হয়। সে তাই তার দক্ষতা দিয়ে পরিস্থিতি সরগরম করে রাখতে চাইছে, বোঝা যায়। কিন্তু বাসার দেখলো নূরীর দৃষ্টি এই প্রথম নিভে আসছে। তার সাবলীলতা খর্ব হয়ে গেছে। যেন অচেনা, অনাকাক্সিক্ষত কজন মানুষ তার সংসারে অতিথি হয়ে এসে ভারি বিড়ম্বনা তৈরি করছে। কিন্তু সত্যি অচেনা হলে সেখানে জড়তা কাটানোর ধার নূরীর ছিলো, বাসার জানে। নূরীর কণ্ঠস্বর এখন কেমন বসে গেছে। কৌতূহলী পাড়াপড়শির ভিড়ে নূরীর ভিরমি খাওয়া দশা। ভিড়ের একজন হয়ে সে শুধু দাঁড়িয়েই রইলো। বাড়তি কাজের জন্য যারা নিয়োজিত ছিলো, তারাই ততক্ষণে অতিথিদের পানীয় ও খাবার পরিবেশন করে নানান বয়সী মানুষের জটলাকে ছত্রভঙ্গ করে।

নূরী মাংসের একটি টুকরো অনভ্যস্তের মতো তার মায়ের পাতে তুলে দিতে গেলো, মা বললেন, তোমার ভাইকে দাও, বলে মাহমুদকে দেখিয়ে দিলেন। মায়ের এ অনুরোধ ভাইয়ের সঙ্গে বোনের সম্পর্কের সেতু তৈরির ক্ষীণ প্রয়াসমাত্র বোঝে বাসার। অনুরোধ পালন করতে গিয়ে নূরীর হাত কাঁপে। বাসারের নিজের চোখ তখন সাংবাদিকের ক্যামেরার মতো এইসব অমীমাংসিত বিষয়ে লেন্সের কাজ করে যেতে থাকে। পৃথিবীর তপ্ত মাটির মতো বাসার চাইছে, নূরী আজ কেঁদে-কেটে এক পশলা বৃষ্টি হোক। সঙ্গে গুমোট মেঘের পাহাড় তার মাও কাঁদুন। কিন্তু ওরা কেউই কাঁদে না। এ দুঃসহ স্বাভাবিকতা কেমন খটখটে ঠেকে। একসময়ে বাসার নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করে। সরে যায় ভিড় ছেড়ে।

নূরীর ছেলেমেয়েগুলো নিজের বাড়িতে এপাশে ওপাশে সেঁধিয়ে আছে। আর তারই সুযোগ নিয়ে নতুন বই, খেলনাপাটি ঘেটে অস্থির করে তুলছে রোকেয়ার ছেলেমেয়ে দু’টি। নূরীর মা জাহানারা বেগম নূরীর ছেলেমেয়েদের খুব যে কাছে ডাকলেন, তা নয়। তবু যাকে যেটুকু সম্ভাষণ করলেন ছেলেমেয়েরা কেউ তার দিকে এগিয়ে এলো না। একটা জরুরি কলে মইনুলকে এমন সরগরম অবস্থার ভেতর থেকে বেরিয়ে যেতে হয়েছে। কাকের বাসায় কোকিলের কৌলীন্য নিয়ে জাহানারা বেগমকে ড্রইংরুমের সোফায় একা বসে থাকতে হলো। ভদ্রমহিলা কথা বলেন খুব মেপে। দুপুরের ঝিম খুলে রোকেয়া আর মাহমুদ যখন পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখতে নেমে গেছে, নূরীও গেছে তাদের সঙ্গে। হয়তো মায়ের কাছাকাছি থাকা থেকে সরে থাকার ছুতোটি সে মাথায় করে নেমেছে। বাসার এই সুযোগে বেরিয়ে এসে বলে ফেলে, মেয়ের সঙ্গে আপনার দূরত্বটা যে কারণেই তৈরি হোক, সেটা ঘুচিয়ে ফেলুন মাঐমা! এই যে আপনার আরো দু’টি ছেলেমেয়েকে দেখলাম, আপনার ছোট মেয়ের ছেলেমেয়ে দু’টিকে দেখলাম, দেখে যা বুঝেছি, তা হলো নূরীর ছেলেমেয়েগুলো ওদের থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। আপনাদের সঙ্গে মেলামেশা শুরু হলে ওরা আপনাদের কালচার রপ্ত করতে পারবে। তাতে জ্ঞানের উন্মেষ ঘটবে। নূরীর বড় ছেলেটি এসএসসি পরীক্ষা দেবে, সে একটি সেনটেন্স শুদ্ধ করে বলতে পারে না! আপনার উত্তরসূরি হিসেবে এদের একটু আলো দান কি আপনার জরুরি মনে হয় না?

জাহানারা বেগম আঁৎকে উঠলেন না। একতরফা অভিযোগ হলেও বাসারের সবটুকু কথা তিনি শুনলেন। সুযোগ পেয়ে আরো একটু সময় নিয়ে মৃদু, কিন্তু ধারালো স্বরের প্রবল তোড়ের জোয়ারের মুখের বাঁধ ভেঙে দিলো বাসার। বললো-নূরী তো আপনারই সন্তান, অনেক মায়েরই দ্বিতীয় কেন, তৃতীয়বারও বিয়ে হয়। হলে এটা দোষের কিছু নয়, আর এখন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি কত উদায় হয়ে গেছে। এসব নিয়ে তো কেউ ভাবেই না! আমার তো মনে হচ্ছে, শুধু আপনারা মা-মেয়েই সহজ হতে পারছেন না!

এই একটি জায়গায় আমি অপারগ।

কেন বলেন তো?

মাত্র তেরো বছর বয়সে আমার বিয়ে হয়। চৌদ্দ বছর বয়সে নূরীর জন্ম। ওর একবছর বয়সে ওর বাবা মারা যায়। আমার ইচ্ছে অনিচ্ছের তখন কি-ই বা দাম থাকতে পারে, তুমিই বলো? আমার বাবা আমাকে মেয়েসহ বাড়িতে নিয়ে আসেন। নিজের কাছে রাখতে চান। কিন্তু আমার শ্বশুর মামলা করে নূরীকে নিয়ে যান। আমার তখন কি দুঃসহ দিন গেছে। আমার বাবা শেষে বললেন, তারা যদি মামলা করে মেয়ে নিয়ে যায়, তো যাক! ওইটুকু একবছরের মেয়ের জন্য আমার বিধবা পনের বছর বয়সের মেয়ে পরের বাড়ি থেকে লাঞ্ছিত হবে, এ আমি চাই না। আমার বাবা আমাকে আর যেতে দিলেন না। আর আমি ও পালিয়ে যাইনি, কারণ নূরীর চাচার বয়স আমার কাছাকাছি, তার সাথে তারা আমার বিয়ে দিতে চেয়েছিলো। অন্যখানে বিয়ে দিলে তাদের বদনাম হবে, নূরীর বাবার কিছু টাকাও ছিলো, সেগুলোও হাতছাড়া হওয়ার ভয় ছিলো ওদের। নূরীর বাবা বিএ পাশ ছিলো এবং ভালো চাকরি করতো বলে ওদের বাড়িতে আমার বাবা আমাকে বিয়ে দিয়েছিলেন। এবার চিন্তা করে দেখো আমার অবস্থা?’

চিন্তুা করে বাশার একবার নূরী হয়। আর একবার জাহানারা বেগম। নূরীর সেই চাচার স্ত্রীকে বাশার অনেকবার দেখেছে। দাসী বাঁদীদের থেকে আলাদা করে চেনা যায়, এমন কোনো বৈশিষ্ট্য তার নেই। জাহানারা বেগমের প্রাপ্তির সবটুকুই তার নিজের অর্জন। ওইভাবে ছিঁটকে সেদিন তার বাবা তাকে না বের করে নিলে পরিণতি কী হতো, পলকমাত্র ভেবে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বাসার বলে– মাঐমা, তারপর কী করলেন?

জাাহানারা বেগমের বারবার নড়াচড়া করা বা অস্থির হওয়ার অভ্যেস নেই বোঝা যায়। তিনি আগের মতই সোফায় কিছুটা কাৎ হয়ে বসে থেকে বলতে শুরু করলেন, আমার এক ফুপা আমাকে নিয়ে আবার বিয়ে দিলেন। তার আগে অবশ্য আমাকে লেখাপড়া শুরু করতে হয়েছে। মেট্রিক পাশ করেছিলাম এই বিয়ের পরে। আমার যখন আবার বিয়ে হয়, আমার এই স্বামীর কাছে গোপন করা হয়েছিলো আমার আগের বিয়ের কথা। আমার সন্তানের কথা। কিন্তু আমি আমার মেয়েকে কাছে পাওয়ার জন্য ক’দিন পরই একদিন তাকে সব কথা খুলে বলি। তখন আমার কাছে নূরীর চেয়ে আর কোনো বিষয়ই বড় ছিলো না।

‘আর আজ?’ নিজের অজান্তে প্রশ্নটি বেরিয়ে যায় বাসারের কণ্ঠ থেকে।

আজো বোধহয়! তখন ওকে টানা-হেঁচড়া করতে গেলে ওর জীবন থেকে স্বস্তির বোধটা নষ্ট হয়ে যেতো। সেটা পরবর্তী সময়ে আর কিছুতে পূরণ হতো না। নিজে সেই ক্ষতির কারণ হওয়া কি কোনো মায়ের কাজ?

– তারপর কী করেছিলেন মাঐমা?

– আমার স্বামী আমার কথা শুনে দু’দিন আত্মগোপন করেছিলেন প্রতারিত হওয়ার বেদনায়। তারপর বোধহয় নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করে ফিরে এসে আমাকে বলেছিলেন, ‘চলো তোমার মেয়েকে আমাদের কাছে নিয়ে আসি। তোমার সঙ্গে আমি নিজে গিয়ে নিয়ে আসবো।’

‘সত্যিই তিনি নূরীকে নিজেদের কাছে নিয়ে যেতে এলেন?’ বল্লমের মতো প্রশ্নটি ছুঁড়ে দেয় বাশার।

নূরীকে আমরা দু’জনই আনতে গেলাম। কিন্তু ওরা খাবারের ভেতর বিষ দিয়ে আমার স্বামীকেই মরণান্ন করে ছেড়েছে। আমার স্বামী ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। তার সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হতে লাগলো ওদের নানান ধরণের উড়ো কথায়। আর এই ঘটনার পর আমার বাবা, চাচারা আর এগোতে দিলেন না। মেয়েটি তাই ওদের ধাঁচেই গড়ে উঠেছে। সময়মতো সুযোগ পাইনি তাকে কাছে রাখার। তাকে বোঝার। আমার অবস্থা বোঝানোর । এবার আমি হজে যাবো। আমার স্বামীসহ যাবো। তিনিই বলেছেন, নূরীকে দেখে যাওয়ার জন্য। এদেরকে চেনে এমন একজনকে সাথে নিয়ে সবার জন্য কাপড়চোপড় তিনি নিজে কিনে দিয়েছেন। যেনো সবার সব ঠিকঠাক হয়।

– নূরীকে আপনি আর দেখেননি?

– দু’একটা অনুষ্ঠানে দেখেছি ওর বিয়ের আগে। কিন্তু আমাকে দেখলে সে সরে যেতো। আমার প্রতি ওর ঘৃণা বা করুণা আমি কখনোই টের পাইনি। একটা সময় চাইতাম ও আসল সত্যিটা জানুক! পরে ভাবতাম, না থাক, আমাকে বাদ দিয়ে ও ভালো আছে, তাতেও আমার স্বস্তি!

রোকেয়া আর মাহমুদ দু’জনই উচ্চশিক্ষিত। দু’জনেই ভালো চাকরি করে। মায়ের অধ্যায়টি যেমন নূরীকে বিব্রত করে, ঠিক সে অর্থে নূরীও বোধহয় তাদের তেমনি বিষয়। তাই বুঝি রোকেয়ার স্বামী এবং মাহমুদের স্ত্রীকে এ যাত্রায় যুক্ত করা হয়নি। বিদায় নেওয়ার আগে জাহানারা বেগম ‘তুমি মাঝে মাঝে আমার কাছে এসো’ বলতে বলতে নূরীকে টেনে বুকের কাছে নিলেন। অনভ্যস্ত নূরীর চোখ তখন শিশুর চোখের মত লজ্জায় মৃদু চিকচিক করে ওঠে মানুষের ভীড়ে। বাসার দেখলো, মায়ের আচরণে নূরী বিব্রত হয়েছে। তাছাড়া তার হৃদয়ের কোনো পাড়ে এক আজলা পানির ঢেউ ঢেউয়ের মতোও ঝাপটা লাগেনি। তার চোখের সে ভাষা তেমনি থাকে। আগের মতো।

গাড়িখানা কিছুদূর গিয়ে অদৃশ্য হতে না হতেই ঊর্দ্ধশ্বাসে ঘরের দিকে এগোতে থাকে নূরী। আবার হঠাৎ সে পৌঁছে যায় তার স্বাভাবিকতায়। অগোছালো ঘরে সে নিজেকে ব্যতিব্যস্ত করে ফেলতে দু’দন্ড সময় নেয় না। নিবেদনহীন এমন প্রাণকে প্রার্থনার কোনো ভাষা, কোনদিনই যে স্পর্শ করবে না বাসার বুঝে ফেলেছে। নুড়িকে হাজার বছর জলে ডুবিয়ে রাখলেও যেমন তার সাধ্য থাকে না একবিন্দু জল আত্মস্থ করার, নূরীকেও এখন সে তেমনি পাথরের চেয়ে ব্যতিক্রম কিছু ভাবতে পারছে কই!

জাহানারা বেগমকে না দেখলে হোমিওপ্যাথি ডাক্তার এই খায়রুল বাসারের যে বিষয়টি অজানা থেকে যেতো, তা হলো, সন্তান হিসেবে নূরী তার জীবনের একটি অংশ মাত্র। যে অংশের কোনো ব্যতিক্রম আভা নেই। আঁচ নেই। কিন্তু তাঁর নিজের সমগ্র জীবন যেমন সংগ্রামে কঠিন। তেমনি স্নিগ্ধতায় ঝলমলে। শুরুর যে সংঘাতটি তিনি আপন গুণে দমিয়ে অগ্রসর হতে পেরেছেন, তার জন্য যদিও তার মাতৃত্বের চেয়ে ব্যক্তিত্বই প্রবলভাবে ব্যঞ্জিত হয়ে ওঠে, কিন্তু যিনি সন্তানের বিরহে আজীবন প্রচন্ড কষ্ট পেয়েছেন, তবু সে সন্তানের মঙ্গলের জন্য, তাকে স্বাভাবিক জীবন উপহার দেয়ার জন্য, নিজে থেকে গেছেন তার চোখের আড়ালে, অপরিচিতা হয়ে। মাতৃত্বের এই কঠিন রূপ, বেদনার এই কর্ষিত দ্যুতি, বাসারের ধু ধু বুকের ভেতর একফালি চাঁদের বিরহী লাবণ্য হয়ে তার আসমান জমিন ছেয়ে থাকে।


 

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu