আদনান সহিদ
কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক এবং পেশায় শিক্ষক। জন্ম ও বেড়ে ওঠা কুমিল্লা, বাংলাদেশে। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে 'স্নাতক' এবং ইংরেজি সাহিত্যে মিডিয়া, ফিল্ম ও কালচারাল স্টাডিজ বিষয়সহ 'স্নাতকোত্তর' সম্পন্ন করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবস্থায় সম্পাদনা করেছেন কবিতার মাসিক ভাঁজপত্র 'আমরা ক'জন অথবা একা'। প্রকাশিত গ্রন্থ : অনূদিত গল্প সংকলন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের নির্বাচিত গল্প’ (বেহুলাবাংলা, ২০২০), ষোলো গল্পকারের গল্প সংকলন, ‘এলোমেলো ষোলো’ (বিবর্তন প্রকাশনী, ২০২০) এবং সম্মিলিত কাব্য সংকলন, ‘এলোমেলো ভাবনা (বিবর্তন প্রকাশনী, ২০১৯)‌ এবং সাহিত্য সংকলন, 'কথা ও কাব্য' (বিবর্তন প্রকাশনী, ২০২১)‌।
আদনান সহিদ

লকডাউনের চারটি অণুগল্প

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

ছোঁয়াচে


ডাস্টবিনে ময়লার পলিথিনটা ফেলে বাসায় ঢুকতে গিয়ে সমবয়সী একটা ছেলেকে ঠিক গেটের সামনে সিগারেট টানতে দেখলো সানী। মুহূর্তেই কেমন অস্থির লাগলো তার। ১৩ দিন আজ!

সানীর অনাকাঙ্ক্ষিত আগমনে হতভম্ব ছেলেটি দ্রুত সিগারেটটা লুকাতে গিয়েও না লুকিয়ে বললো, ‘প্রায় ১৩ দিন পর টানতেছি ভাই!’ তারপর সানীর জ্বলজ্বলে চোখে তৃষ্ণা দেখে সিগারেটটি বাড়িয়ে দিলো সে‌, ‘দেবেন একটান?’ বলামাত্রই ছোঁ মেরে সিগারেটটা নিয়ে দ্রুত কয়েক টান দিলো সানী। এমন সময় দোতলায় থেকে মা’র গলা শুনতে পেয়েই সিগারেটটা ফেলে সোজা গেটের ভেতর ছুটলো সে।

রাত দুইটা। সানীর জ্বর জ্বর লাগছে, কাশছে সমানে। কী মনে করে বিছানা ছেড়ে বারান্দায় এলো। নিচে গেটের সামনে তাকাতেই পরিষ্কার আলোতে থেঁতলানো সিগারেটটা দেখতে পেলো সে!


কী কথা তাহার সনে?


লকডাউনের পর থেকেই মনীষা খেয়াল করছে ধ্রুব প্রায়ই রাতে বিছানা থেকে উঠে পাশের ঘরে চলে যায়। ফিসফিস করে কারো সাথে কথা বলে। ব্যাপারটা সন্দেহজনক হলেও মনীষা ধ্রুবকে বিশ্বাস করে। কিন্তু আজ তার কেমন যেনো অস্থির লাগছে!

পাশের ঘরে ধ্রুবর ফিসফিসানি চলছে। সাবধানে পা টিপে সেই ঘরে এলো মনীষা। ধ্রুব উল্টোপিঠ হয়ে চেয়ারে বসা‌। মুখের কাছে মোবাইল নিয়ে কিছু বলছে। কান খাড়া করে মনীষা শুনতে চেষ্টা করলো, বুঝলো না কিছুই। ধৈর্য্যচ্যূত হয়ে দ্রুত ধ্রুবর কাঁধে হাত রাখলো সে। সচকিত ধ্রুব লাফিয়ে উঠলো। সম্বিত ফিরে মোবাইলটা দেখিয়ে বললো, ‘হঠাৎ একটা গল্প মাথায় এলো। ঘুমাচ্ছিলে বলে এখানে এসে ভয়েজ টাইপ করছিলাম।’

মনীষা বিস্ময়ে মোবাইল স্ক্রীনে গল্পের শেষ লাইনটা পড়লো, ‘আমি তোমারই থাকবো!’


দেখা মানুষ কিংবা মানুষ দেখা


ছয় তলার জানালার পর্দা সরিয়ে অপলক নিচের দিকে তাকিয়ে আছে রুদ্র।আনমনে বললো, ‘রাস্তায় মানুষ দেখি না কতদিন! কী নীরব!খা খা করছে। একটা কুকুরও নেই।খেয়াল আছে লিয়া, কুকুরের ডাকে রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেছে কতো!’

রুদ্র আর লিয়া দুজনেই প্রাইভেট ফার্মে কাজ করে– একজন অ্যাড এজেন্সিতে, অপরজন এনজিওতে। ব্যস্ত জীবনে দুজনের দেখা হয় না বললেই চলে। লিয়া সকাল দশটা-পাঁচটা অফিস করে আর রুদ্র দুপুর দুইটা-দশটা। ফিরতে আরও রাত। উইকেন্ডে প্রায়ই ফিল্ড ট্যুর থাকে লিয়ার।

রুদ্রকে হঠাৎ টেনে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয় লিয়া, ‘এসো নিজেদের দেখি। আমরাও তো মানুষ। ভুলেই গেছি। তাই না?’

অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে রুদ্র, ‘তাই তো! পুরো একটা দিন নিজেদের দেখেছি শেষ কবে? কখনো কি আদৌ…?’


শুনতে কি পাও?


ফুটপাত ধরে লাঠি হাতে হাঁটতে হাঁটতে সাতরাস্তা মোড়ে পৌঁছালেন পঞ্চাশোর্ধ আহকাম আলি। মোড় পেরোতে উদ্যত হতেই কর্তব্যরত পুলিশ পথ রোধ করলো, ‘বাইরে কেনো চাচা? খবর কিছু দেখেন-শোনেন না নাকি? বাইরে বের হলে আইন কি জানেন?’ সানগ্লাস খুলে দেখালেন আহকাম আলি, ‘আমিই আইন। অন্ধ! দেখি না। ভাতা নিতে বের হইছিলাম।’

‘সাবধানে যান।’, পুলিশটির থতমত উত্তর।

আহকাম আলির একটু পেছনেই উদ্ভ্রান্তের মতো হেঁটে আসছিল মাটি কাটা শ্রমিক তারা মিয়া। পুলিশটি তাকে ধরলো এবার।

‘চোখ-কান‌ তো ঠিকই আছে দেখি। বাইরে কী?’

পেটে হাত বুলাতে বুলাতে দুর্বল কন্ঠে তারা মিয়া বলে,
‘ঠিক নাই, স্যার! চোখ নাইম্যা গেছে এহানে। সব আন্ধার! কানে ক্ষুধা হুনতাছি। দুইদিন খাই নাই!’


 

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu