আশরাফ পিন্টুর দুটি অণুগল্প: “লাশ”, “বিধির লিখন”
লাশ নিয়েই সে ব্যস্ত থাকে সব সময়। প্রতিদিন লাশ আসে পাঁচ-সাতটা করে। কখনো বেশি; যখন অ্যাকসিডেন্ট হয়– ফাটা, থেতলে যাওয়া বহু লাশ আসে। কখনো বস্তাবন্দী গলিত দুর্গন্ধময় লাশ। সম্প্রতি করোনায় মারা যাওয়া দুই-একটা লাশও যোগ হচ্ছে।
বুদ্ধ ডোমের প্রতিদিন লাশ নিয়েই কারবার। ডোমগিরি তার পেশা। অন্যান্য পেশাদারের মতোই নিজ দায়িত্ব পালন করে সে। লাশ নিয়ে কোনো রূপ ভাবোদয় হয় না তার। মৃত্যু যেন তার কাছে এক বোতল ভরা বাংলা মদ; নেশায় চুর হলে একরকম, আবার নেশা কেটে গেলে অন্যরকম।
সেদিন সন্ধ্যা অবধি কোনো লাশ আসেনি মর্গে। সারাটা দিন বাংলা খেয়েছে আর ঝিমিয়ে কাটিয়েছে বুদ্ধ ডোম। হঠাৎ রাত ন’টার দিকে একটা লাশ আসে। এক কিশোরীর লাশ। পরনের পাজামায় কেমন ছোপ ছোপ লাল রক্তের দাগ। লাশটির মুখ দেখেই সে চমকে ওঠে– এ যে তারই মেয়ে বেলারানি!
কেমন করে এমন হলো?
মেডিকেল রিপোর্ট থেকে জানা যায়– বেলারানিকে কতিপয় যুবক ধর্ষণের পর হত্যা করেছে।
বুদ্ধ ডোম নিথর হয়ে যায়। নিজেকে লাশ ছাড়া আর কিছু মনে হয় না ।
মৃতদেহটি এখনো হাসপাতালে পড়ে রয়েছে। লাশ গ্রহণের জন্য ছেলেকে খবর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার দেখা নেই।
জুয়েল জামা-কাপড় পড়ছে। দ্রুত যেতে হবে। সুমনা অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে পার্কে। আগেই যেতে পারত কিন্তু হঠাৎ করে বাবার মৃত্যু সংবাদটা ফোনে শুনতে পেলো। সিদ্ধান্ত নিতে এক ঘন্টা দেরি হয়ে গেল। সুমনা হয়তো আজকে বিয়ের ডেট ফাইনাল করবে। এমন শুভক্ষণে বাবার লাশ গ্রহণ করে মরবে নাকি ও?
জুয়েল পার্কে পৌঁছেই সুমনাকে জড়িয়ে ধরে। ঠোঁটে-মুখে চুমু খায়। আহ্লাদের স্বরে বলে, একটু দেরি হয়ে গেল লক্ষ্মীটি! বলো কী বলবে?
এমন সময় সুমনার হাঁচি চলে আসে। হাঁচির সর্দিকণা ছিটকে এসে জুয়েলের নাকে-মুখে পড়ে। জুয়েল পকেট থেকে রুমাল বের করে সর্দিকণাটুকু মুছতে মুছতে বলে, শরীর খারাপ করছে নাকি?
– হ্যাঁ। শ্বাসকষ্টও হচ্ছে মাঝে মাঝে। সুমনা জোরে জোরে নিঃশ্বাস টেনে বলে।
– কবে থেকে।
– এই তো সপ্তাহখানেক।
– ডাক্তার দেখিয়েছ?
– হ্যাঁ।
– কী বলেছে?
– ঠিক বলতে পারছে না। তাই ভাবছি তোমাকে নিয়ে হাসপাতালে যাবো। চারিদিকে যা অবস্থা। করোনা-টরোনা হলো…
– ছি! এমন কথা বলতে নেই। তোমার স্বাভাবিক সর্দিকাশি হয়েছে। জুয়েল সুমনার ঠোঁটে আঙুল রেখে ওকে থামিয়ে দিয়ে কাছে টেনে নেয়।
সুমনা ফিসফিসিয়ে বলে, তাই যেন হয়। চলো এখন। সুমনা জুয়েলের বাহু থেকে মুক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়।
সুমনাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা পর ডাক্তার ওকে করোনা রোগী বলে সনাক্ত করেন। জুয়েলকে বলেন, আপনিও হয়তো আক্রান্ত হয়েছেন। কাল আপনারও টেস্ট হবে। এখন থেকে আপনারা দুজন হাসপাতালে থাকবেন।
ডাক্তারের কথা শুনে জুয়েল নির্বাক হয়ে যায়। মনের অজান্তে চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে। ভাবে–নিজেকে নিরাপদ রাখার জন্য জন্মদাতা পিতার লাশ গ্রহণ করলাম না। অথচ…