আকু ছোট সোতাটার(নালা) জল ছপ ছপ ডিঙ্গিয়ে তাড়াহুড়ো করে ঢিবির উপর গাঁওয়ের পথ ধরে। ঢিবির গাঁওয়ের শেষ কুড়িয়াটা কাঁঠালীয়া গোত্রমাতা গাঁওবুড়ী ঝুলুমির। এক কুড়ি কুড়িয়া বা ঘর নিয়ে কাঁঠালীয়া গোত্রের গাঁও-নরগোষ্ঠীতে আদিমতর নিষাদ(অস্ট্রালয়েড)। কালো রঙের-ঠোঁট উল্টানো, চওড়া চ্যাপ্টা বোঁচা নাকের আকৃতি। পশমের মতো কোঁকড়ানো চুল। বাঁকা কুতকুতে চোখ, লম্বাটে চ্যাপ্টা মাথা নেগ্রিটো বা নিগ্রোবটুদের মতো দেখতে কাঁঠালীয়াদের গায়ের রঙ প্রায় তাদের মতো কালোবর্ণ, দেহ খর্বকায়, চ্যাপ্টামুখো। আদিম আবহে প্রথম বসতি গড়া ও শিকারের পাশাপাশি কৃষি কাজে ভূমিতে নেমে আসা প্রথম নরগোষ্ঠী। কাঁঠালীয়ারা এই ডিহির সংখ্যাগরিষ্ঠ, গোত্র টোটেম বা কূলকেঁতু কাঁঠাল। কাঁঠালে তাদের ভজন-পূজন, ভক্ষণে নিষেধাজ্ঞা। অনেক দ্যাওয়ের এক দ্যাও। পড়নে লেংটি, কাঠের মাথায় পাথর গোঁজা তাগলটা(কুঠার) হাতে চেপে আকু গাঁওবুড়ীর জটালের ডাল পুতে উপরে ডাংরা বা গরুর চামরার ছাওনি দেয়া কুড়িয়ার দিকে এগিয়ে যায়। বুড়ীর পোষা খেমী(কুকুর)খেকিয়ে ওঠে। রাতের গভীরতা মেঘে ঢাকা। কুড়িয়ার ডালপালার ঝাপে জোরসে কালো হাতের থাবায় থপ থপ শব্দ করে । সে সাথে ভয় মেশানো কন্ঠের ডাক- ‘আইয়ো, আইয়ো?’ বুড়ি জেগেই ছিল। বেশির ভাগ বেলা জাদু টোনা করে কাটায়। এই জংলা জীবনে অনেক দ্যাও-দ্যাওনি তার দখলে, সময়-অসময়ে তারা বুড়ির উপড় ঝুপার(ভর) হয়। ঝাপ খুলে বুড়ী কুড়িয়ার বাইর হয়। ডাইনীর মতো দেখতে। পড়নে বুনো মরমুর ছাল, গলায় বাদুরের নখের সাথে নেউলের মাথার খুলি ঝোলে। দড়ির মতো পাকানো জটা চুলে অসংখ্য আঁকিবুঁকি কাটা মুখ ঢাকা। তার সামনে দিয়ে এই ডিহির(ঢিবি) জীবনে অনেক হড়পাবান বা বন্যা পার হয়েছে। কতগুলো তা বুড়ীরও মনে নেই। আকুকে পাত্তা না দিয়ে ঢিবিটার উত্তরে নড়বড় করে এগিয়ে যায়, হাতে জটালের প্যাঁচানো লাঠি। আকু শুনেছে মন্ত্রপূত এই লড়ের(সাপের) লাকান লাঠি বুড়ির হুকুমে লড় হয়। ঢিবির শেষ মাথায় যেয়ে বুড়ি মাথা উঁচিয়ে শ্বাস টানে, বিড়বিড় করে। ঢিবির নিচে গাঁঢ়ার জল তরতরিয়ে যায়। ওপাড়ে দূরে প্যাঁচা গোত্রের গাঁওয়ে চিৎকার- হুল্লোড় শোনা যায়। পায়ের কাছ থেকে সড়সড় করে কোন প্রাণী গাঁঢ়ার জলে নামে। আকু এগিয়ে যায় বুড়ির কাছে। বুড়ি চোখ মেলে তাকায়, আন্ধারে চোখের লাল তবুও ধক ধক করে জ্বলে ওঠে, আরো জোরে মন্ত্র আউরিয়ে হাত পা নাচিয়ে ঢিবির মাঝখানে এসে চিৎকার করে বিধান দেয়– মারিয়া(নরবলি) দে, অক্কে(এখনই) মারিয়া দে! ঝেটুনি গোসা হইচে, মারিয়া চায়। সলজংদ্যাও(সূর্য) ঘুম ভাঙ্গার আগেই চায়। দূরের কুড়িয়া থেকে এতক্ষণে গাঁওসোখা(ওঝা)নাদু বেড়িয়ে আসে। পহান গাঁওয়ের একমাত্র পুজার থানে হুতার(আগুন)জ্বালে। বুড়ির পোষা খেমী ‘ভুকভুক’ একটানা চেঁচিয়ে যায়।
দুই।
গাঁঢ়ার উজানে কিরাত নরগোষ্ঠী খাট্টাস গোত্রের আহিল আকুর সমবয়েসী সখা। গায়ের রঙ মেটে বাদামী। বড়গাঁঢ়া(ত্যাড়চাবেঁকী/যমুনা) যেখান থেকে ছোট ভাগ নিয়ে এই ডিহিতে ঢুকেছে, তার পাড়ের জংলায় অনেক মরমু, বাঘডাস, দাঁতাল পাওয়া যায়। দুই দিন আগে ছোট একটা বাঘডাস মেরে আহিলদের গাঁওয়ের পাশ দিয়ে আসার সময় জংলার নিচে আহিলের সাথে দেখা হয়। চোখে মুখে ভয়। জানা যায় আহিলদের গাঁওয়ে সকালে কয়েকজন মনু ও মরদ হায়জায়(কলেরা) মরে যায়। আরো কয়েকজনের ভাব যখন তখন। বিকাল হতে হতে দুই চারটা পাটা(লাশ) গাঁঢ়া দিয়ে ভেসে যায় বটুদের গহীন জংলার দিকে। সন্ধ্যা হতে হতে কিরাতিয়াদের জ্ঞাতিগোষ্ঠী নেউলিয়াদের গাঁও থেকেও হল্লা উঠলো। আকুর ছোট বয়েসী পবা উটকি(বমি) দিতেই গাঁওবুড়ী কুড়িয়া থেকে বের হয়। ঢিবিটা ঘুরে এসে ঘোষণা করে গাঁঢ়ার জল মুখে দেয়া বারণ, জলে লাশ ভাসছে, একে একে আসছে। বুড়ী কিছু আন্দাজ করে, ভর সন্ধ্যায় তার কুড়িয়ার সাথে লাগোয়া মাটিতে অর্ধেক পুতে রাখা কালো পাথরের সামনের মন্ডপে ভজনে বসে। কিছু পরে সড়কি হাতে আকুদের গাঁয়ে ঢোকে বিমর্ষ আহিল। ঝুপ করে পরে যায় বুড়ীর সামনে। বুড়ী তাকে ছুঁতে না করে। মন্ত্রপূত জল তাকে পান করায় বুড়ী, সবার থেকে আলাদা রাখতে বলে। জানা যায়-আহিলদের গাঁও প্রায় শুন্য হয়েছে হায়জায়। দুপুরবেলা পবা গাঁঢ়ার ধারের জঙ্গলে পাখি ধরা অভিযান শেষে তিন চারটা মেটে ইঁদুর ধরে গাঁওয়ের পথ ধরে। মনে সাধ একদিন পলার মতো যোদ্ধা হবে, পলা তার গোত্রের সবচেয়ে সাহসী শিকারী। আকুর মতো দূরন্ত হবে। আকু একদিন কাঁঠালীয়াদের মুখিয়া(গ্রামপ্রধান) হবে।এই ভাবনায় মেটে আলুর গাছ দেখে খুঁড়ে বের করে, কাঁচা খেয়ে গাঁঢ়ার জলে তিয়াস মেটায়। বিকাল হতে হতে তার হায়জা শুরু হয়। পবাকে আলাদা করার আদেশ দিয়ে বুড়ী উঠে দাঁড়ায়। ক্ষীণ চোখে ঢিবির নামায় গাঁঢ়ার জলে লাশ আটকে থাকতে দেখে, দু’একটা ভেসে যেতে দেখে। বুড়ী ঘটনা আন্দাজ করে ফিরে এসে কয়েকটা জংলা পাতা আর ফলের সাথে শকুনের হাড়ের গুড়া মরার খুলিতে ফেলে দিয়ে ধোঁয়ায় অন্ধকার করে বিড়বিড় করে। মন্ত্রপড়া শেষ হবার আগেই পলা শব্দ করে টং থেকে ঝুপ করে পড়ে যায়। বমি করে দু’একটা খিঁচুনী দিয়ে স্থির হয়ে যায়। আকু আগ বাড়াতে গেলে তাকে থামিয়ে বুড়ী এগিয়ে গিয়ে লাঠির খোঁচা দিয়ে দেখে মাথা নাড়ে। আকু বিমর্ষ হয়ে পড়ে। বুড়ী আর সোখা দেখে বুঝতে পারে দ্যাওনী ওলাই এসেছে। তাদের মুখ চাওয়া চাওয়ি অনেকের মতো আকুও বোঝে। সহসা ঢিবির চারদিকে ভয় নামে। প্রত্যেক হড়পাবান বা বন্যার পর ওলাইরা আসে, একেকবার একেকজন। কাউকে সামান্যতে তুষ্ট করা যায়, কাউকে যায় না। প্রতিবার বেশ কিছু মনু মরদ সাবাড় হয়। ভালুকিয়া গোত্র এইভাবে নাই হয়েছে। এইবারের হড়পাবান শেষ হবার আগেই ওলাইদের আগমনের আশংকায় বুড়ী ভীত।সোজা হয়ে আসনে এসে বুড়ী ডুকরে ওঠে–‘ক্ষ্যামাঘেন্না দে, ক্ষেমতি দে। এক্ক কুড়ি কৈতর পাবি, এক্কুটা চাইড়(পাঁঠা)’।থামে বুড়ী। ঢীবির সবাই একে একে জড়ো হয়েছে। সোখা নাদুর তত্ত্বাবধানে পবাকে খেতি ভুঁইয়ে পুতে ফেলার আয়োজন হয়। খেতি ভুঁই উর্বরা হবে। আকুর মুখ ফ্যাকাসে। রুদ্রানী ওলাইদের বাছ বিচার নাই। কাঁঠালীয়া, নেউলিয়া, বটু বোঝে না। ভজন পূজনে তুষ্ট করতে হয়। ওলাইরা সাত বোন– সাত নম্বর জন আহলাদী আর কাঁচা নরখেকো। কোথাও কু নজর পড়লে ঝেটিয়ে সব প্রাণ নিয়ে যায় বলে তার নাম ঝেটুনি। বুড়ীর বুঝতে কষ্ট হয় কে এবারের দ্যাওনী– ওলাই, ঝোলাই, আজগই, ছেন্দুনি, বাহৈড়, সনকিনী না নরখেকো ঝেটুনি। আকুর দিকে লাঠি তোলে নির্দেশ জারি করে আহিলদের গাঁও দূর থেকে দেখে আসার। সর্বক্ষণের সঙ্গী তাগলটা হাতে নিয়ে দৌঁড়ায় আকু, সাথে আহিল। সন্ধ্যার মুখে কোন জন্তুর মুখে একা পড়তে চায় না। আহিলদের গাঁওয়ে ঢোকার মুখে গা ছমছম করে ওঠে। যেখানে সেখানে পড়ে আছে লাশ। জটালের ডালে মরা খেকো শক্কুন বসে আছে। এদিক ওদিক ঘোরে শিয়ালু আর শিবা(বন কুকুর)। মনু মরদের প্রাণের সাড়া নেই যেন। আহিল গাঁওয়ে ঢুকতে গেলে আকু বাঁধা দেয়। জোর কদমে ফিরে আসে বুড়ীর কাছে। সব শুনে বুড়ী আর্তনাদ করে ওঠে-
‘ঝেটুনি, ঝেটুনি’।
‘হবিষ দে, ভজন দে, মা আইয়ো’। গাঁওয়ের কয়েকজন ভয় পাওয়া গলায় বলে। মা আইয়ো, গাঁও বুড়ী চুপ। ঝেটুনি জেদি, তাকে তাড়ানোর কোন মন্ত্র নেই। তাকে ভজনে-পুজনে তুষ্ট করতে হয়।
তিন।
কাঁঠালীয়া গোত্র পহান(পুজারি) মুহিবা ঝুলুমির এককালের স্বামী ও সহোদর। তাদের এক্ক কুড়ি সন্তান আছে এই গোত্রে। কাঠালীয়া ভাটিতে দুই হাতের আঙ্গুলের পরিমাণ ঘর উদবিলাইদের। কাঠালীয়া ও উদবিলাইরা গোত্রবন্ধু । নিয়ম অনুযায়ী তারা বড় বিপদ-আপদে একত্রিত হয়। এহেন বিপদ জংলার সকলের, তাই গোত্রবন্ধু উদবিলাইদের ডাক আসে। মা আইয়ো, সোখা ও পহানের মিলিত গণনায় ও আগের অভিজ্ঞতায় গাঁওয়ের একমাত্র থানে কৈতর ও চাইড়(পাঁঠা) বলির সিদ্ধান্ত হয়। জংলী পাতা মড়ার খুলিতে মড়ার হাড়ে ডলে রস করে, তার সাথে মানতের কৈতরের বুকের রাল(রক্ত) মিশিয়ে তিন জন পান করে। শুধু মা আইয়োর উপড় দ্যাও ঝুপার হয়। গাঁওয়ের মুখে হুতারের(আগুন) পাহারা বসে। অন্য কোন গোত্রে মনে হয় এখনো ঝেটুনির খবর পৌঁছায়নি। মরমুর চামড়ার ঢাকে শব্দ ওঠে দ্রিম দ্রিম। কাঁপে রাতের জঙ্গল, পশু পাখি ছোটে শব্দ করে। বুড়ী এইসময় মুখে গ্যাঁজলা উঠে জ্ঞান হারায়। খানিক পর উঠে রক্ত চক্ষু করে, থরথর কেঁপে বসা গলায় বলে–‘মাদাং(ভুল)হইচে,ঝেটুনির গোসা হইচে, এই হবিষে পুজা হইবে লয়।মারিয়া(নরবলি) দে মারিয়া, অপোক্ত জোড়া মারিয়া। নইলে উচ্ছন্নে যাবি, সাবাড় হবি।’ আরেক দফা জ্ঞান হারিয়ে বুড়ী ঝুপ করে পড়ে যায়। পূজার থানকে ঘিরে জটলায় হুল্লোর ওঠে। এই আদিম জীবনে অনেক দ্যাও-দ্যাওনীকে তুষ্ট করে হিংস্র জানোয়ারের সাথে যুঝে তাদের চলতে হয়। অচেনা –অদেখা দ্যাও-দ্যাওনীকে হিংস্র জানোয়ারের চেয়ে বেশি ভয়।তাদের ক্ষমতার সীমা অজানা। পহান মুহিবা উঠে দাঁড়ায়, মন্ত্রপূত পানি ছিটিয়ে মা আইয়োর জ্ঞান ফেরার অপেক্ষা করে। যেহেতু ঝেটুনি নরবলি চায়, সে রুদ্রানি হবার আগেই নরবলির হবিষ(নৈবেদ্য) সংগ্রহ করতে হবে। গাঁঢ়ার চৌধারে নরগোষ্টীগুলো্র দু’একটি ছাড়া পরস্পরের মিত্র না হলেও শত্রু না। খুব আঁতে ঘা না লাগলে কাজিয়ায় জড়ায় না গোত্রগুলো। তারপরেও তাদের কোনটা থেকেই নরবলির হবিষ জোড়া এরন্ডি(কিশোর) ধরে আনতে হবে, গোপনে। না হলে কাজিয়ায় হায়েজার চেয়ে অনেক বেশি মনু মরদের লাশ পড়বে। গোত্র সাবার হবে। মা আইয়ো জ্ঞান ফিরে উঠে বসে। পলার ডাক পড়ে, ডাক পড়ে আরো কয়েকজনের, সাথে আকু ও আহিল। সিদ্ধান্ত হয় তারা সকলে যাবে পলার নেতৃত্বে জোড়া(কিশোর)ধরে আনতে কালকের দিন সলক থাকতে থাকতে। ঝেটুনির মারিয়ায় দেরি করা মহাপাপ।
চার।
বুড়ি ভুকভুককে লাঠির বাড়ি দিয়ে থামাতে চায়। কুঁই কুঁই করে সরে যায় ভুকভুক। আকুর পর পলার সাথে অন্যান্যরা আসে গাছের ডালের সাথে বাঁধা দুই অজ্ঞান কিশোরকে সাথে নিয়ে। ওদের ধরা হয়েছে বটুদের ঘন জংলার প্রান্তের অগভীর এলাকা থেকে। জংলার এপাশটা বটুদের ও ভেদিয়া বা ভেদ্দাদের(দ্রাবিড়) এলাকা। পুরো জংলি বটুদের হিংস্রতার জন্য আকুরা এড়িয়ে চলে। ওরা ভেদ্দাদের ছাড়া কাউকে তাদের গাঁওয়ে ঢুকতে দেয় না। ভেদ্দাদের পূর্বপুরুষ এক হড়পাবান শেষে জটালার(গাছ) ডালে করে ভেসে আসে এই ডিহিতে। আকুদের গোত্রের পূর্বপুরুষ হুরু বাঁচিয়ে তোলে, থাকতে দেয়। মনুটির হাতে অদ্ভূত একটা ছুররা বা চাকু। কালো, পাতলা, পাথরের চেয়ে মজবুত, পড়ে গেলে ঝনঝন করে। এক কোপে কদলি গাছ, জটালের ডাল দু’ভাগ হয়। হুরু ভয় পেয়ে যায়। অপয়া বলে ভেদ্দা মনুটিকে তাড়িয়ে দেয়। কিন্তু গাঁওয়ের এককোণে তাকে আশ্রয় দেয় বটুরা, যুবতি দেয় সাথে। উপহার পাওয়া ছুররাটি দ্যাও মেনে বটুরা পুজা করে। ছুররাটি আকুর দেখার খুব ইচ্ছা ছিলো। সর্বপ্রথম ও সর্বশেষ আগতদের অদ্ভূত কারণে পাশাপাশি সহাবস্থান। হুরু বটুদের একজন গাভূরানী(যুবতি) জঙ্গলা থেকে ধরে এনেছিলো। তাদের অনেক সন্তানের একজন মা আইয়ো ঝুলুমি। বটুদের রক্ত আকুদের রক্তে মিশেছে। মাঝে মাঝে তাদের গাভূরানী ধরে আনার কারণে কাজিয়া হতো। শেষ কাজিয়া হয় পলার কারণে। এটা সেই জায়গা। আকু আর আহিল গাছের উপড় ভাবছিলো আর তক্কে তক্কে ছিলো কখন কমবয়েসী কোন এরন্ডি গভীর জঙ্গল থেকে শিকার বা খেলায় মত্ত হয়ে এদিকে আসে। তাদের কাউকেই তারা ধরে আনবে। হলও তাই। দেখতে একই রকম তিনজন কিশোর যখন লাফারুর(খরগোশ) পিছে তাড়া করে জংলা ছেড়ে খেতি ভূঁইয়ের ধারে চলে আসে তখন গাছের উপর থেকে আকু পক্কির ডাক নকল করে সবাইকে সংকেত দেয়। পলকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে কাবু করে ফেলে। কি তেজ তাদের, আকুদের একজনকে বিষমাখা কাইড়(তীর) মেরে ঘায়েল করে পালিয়ে যায়। তাদের পহানের দেয়া শিকড়ের রস খাইয়ে অজ্ঞান করে অন্যদের আড়ালে তিনটা জংলা, দুইটা বড় আর একটা ছোট গাঁঢ়া পেড়িয়ে কাঁঠালীয়া গাঁওয়ে ফিরতে রাত হয়ে যায়। বুড়ী এগিয়ে এসে দেখে কালো রঙের, ঠোঁট উল্টানো-চওড়া চ্যাপ্টা বোঁচা নাক, পশমের মতো কোঁকড়ানো চুলের দুইজন নিগ্রোবটু কিশোর। তাদের পহানের ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। সাজ সাজ রব পড়লো গাঁওয়ে। পঁচুই আর হাড়িয়া খাইয়ে নেশায় বুদ করে রাখা হলো তাদের। মউলের তেলের সাথে করঞ্চার তেল, নেউলের রক্তের সাথে পহানের রক্ত মিশিয়ে সারা দেহে মাখিয়ে তাদের প্রস্তুত করা হলো। গলা মোলায়েম করার জন্য মাখা হলো পিতরাজের ঘোলা তেল। খেমটা লম্ফ ঝম্ফ নাটাই(নাচ) আর ঢাকের দ্রিম দ্রিমের মধ্যে কিশোর দুজন ফ্যালফ্যালে তাকিয়ে ঝিমাতে লাগলো। পুজার থানে পহান পাথরে কুঠার ঘষে ধার করে তোলে। নিজের আঙ্গুলের রক্তের তিলকা পড়ায় কিশোর দুইটার কপালে। সহসা উরন্তি দ্যাও(মেঘ)গুর গুর করে ওঠে, হুতার চিলিক মারে উরন্তির পেটে। শ্যাওড়া কাঠের গ্যাঁড়ায় গলা ঢুকিয়ে দুর্বোধ্য মন্ত্র পড়ে তাগলের এক্ক কোপে মুন্ডুটা আলাদা করে পহান। ধরটা রক্ত ছিটাতে ছিটাতে তড়পাতে থাকে। মুন্ডুটা হাতে খাঁমচে ধরে জটলার দিকে তাকিয়ে পহান উল্লাসে চিৎকার করে ওঠে। সবাই যখন কোরাস মেলায় তখন উরন্তি দ্যাও থেকে জলঝড়ী নামে। একে একে আগুনের মশাল নিভতে থাকে। পহান অন্য কিশোরকে বলির গ্যাঁড়ায় নিতে গেলে বুড়ী তাকে থামিয়ে দেয়। ঝেটুনি তুষ্ট হয়েছে, তুষ্ট হয়ে উরন্তি দ্যাও দিয়ে জলঝড়ী পাঠিয়েছে। বলির দেহ থেকে রক্ত জলঝড়ীতে মিশতে থাকে, অন্য কিশোরকে মুক্ত করা হয় অন্ধকার জঙ্গলে ঝেটুনির নামে। বেঁচে যাওয়া হবিষ বা নৈবেদ্য ছেড়ে দেওয়া কাঁঠালীয়াদের বৈশিষ্ট্য। এ যাত্রায় বেঁচে গেল। তাদের বিশ্বাস ঝেটুনির পুজার মানতে মুখ লাগানোর সাহস অন্য কোন জানোয়ারের নেই।
পাঁচ।
আকু আর আহিল দাঁতালের(বুনো শুকর) পিছে ছুটছে। ঘন জঙ্গলার মধ্যে জলঝড়ীর সাথে অন্ধকার মিশে জমাট বেঁধে আছে। এক বেলা ধরে কয়েকটা তিতির আর ঝুমঝুমি(সজারু) মারতে গিয়ে নিজেদের জঙ্গলের সীমানা পেড়িয়ে যায়, খেয়াল করে না। ফিরে আসবে এই সময় দাঁতালটাকে দেখতে পায়। আকুর হাতে তাগল আর আহিলের হাতে ধারালো হাড়ের সড়কি। সড়কিতে রক্ত মাখা। দাঁতালটা আহিলের সড়কির ঘা খেয়ে জংলার গহীনে ঢুকছে ঘোঁত ঘোঁত করে। আকু তাগলটা ছুঁড়ে মারে। একটা ছাইতান গাছে লেগে ছিটকে গিয়ে পাশের কদলি(কলা) ঝোপে আটকে থাকে তাগলটা। দাঁতালটা সাঁই করে পাশ কেঁটে এগিয়ে যায়। পিছে ধাওয়া করে আহিল। আকু তাগলটা সংগ্রহের ব্যাবধানে আহিল বেশ এগিয়ে যায়। তাগলটা নিয়ে আকু ঘুড়ে দাঁড়াতেই ঝুপ করে শব্দের সাথে আহিল আর দাঁতালের যুগপৎ চিৎকার শোনা যায়। উৎস লক্ষ্য করে হাঁপড়ের মতো হাঁপাতে হাঁপাতে এগিয়ে গিয়ে আকু দেখে চোরা ফাঁদগর্তে পড়ে আছে আহিল। পাশে নিথর পড়ে দাঁতালটা। সড়কিটা এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে আছে। হাত বাড়ানোর আগেই মাথার পিছনে আঘাতে চোখে জুনিপোকা(জোনাকি) দেখে আকু। আহিলের ভয়ার্ত চিৎকার অর্ধেক কানে ঢোকার আগেই জ্ঞান হারায় আকু ।
ছয়।
চোখের উপর একটা কিরিঞ্চার(তেঁতুল) জটাল। চেনা যায়, আবার চেনা যায় না। চোখে ঝাপসা মারে। চারিদিকে ছোপ ছোপ আন্ধারের ছমছমে কালো ছায়া। এবার কানে শব্দ আসে, আবার মিশে যায়। ও ঢাকের দ্রিম দ্রিম। আকু জায়গাটা চেনার চেষ্টা করে, পারে না। চোখ কচলানোর জন্য হাতটা তুলতে যেতেই দেখে পিছে বাধা। সে উলঙ্গ পড়ে আছে ভূঁইয়ে। ধীরে ধীরে তার সব মনে পড়ে। আহিলকে কোথাও দেখা যায় না। এটা বটুদের গাঁও। চারিদিকে খর্বকায় কালো বটুরা প্রায় উলঙ্গ ঘুরে বেড়ায়। তার দিকে সিংস্র তাকায়। কোথাও হু হা চিৎকার হচ্ছে। এরা তাকে নেশা করিয়েছে। তার দেহে বিচিত্র আঁকাজোঁকা। মাথা ঝাকিয়ে সোজা করে আবার তাকায় আকু। কয়েকটা দাঁতালের বাচ্চা ঘুরে বেরাচ্ছে একটা বড় লতায় বাধা দাঁতালের আসেপাশে। সর্বনাশ এদের কূলকেতু তাহলে দাঁতাল। তাদের পাতা ফাঁদগর্তে তাদেরই টোটেম মৃত দাঁতাল নিয়ে তারা তাদেরই এলাকায় আটকা পড়েছিলো! টোটেম শিকারীদের তারা ভয়ঙ্কর শাস্তি দেয়।পরিনাম ভেবে আকুর ভিতর আরো শুকিয়ে যায়। আহিলের খোঁজে এদিক অদিক তাকায়। কিরিঞ্চার তলায় জট পাকানো উলঙ্গ বটু মনু মরদ। ট্যাঁটা হাতে কয়েকজন বটু তার দিকে এগিয়ে আসে। এদের কি আজ কোন উৎসব? কিসের? আকু দাঁড়াতে পারে না নেশার ঘোরে। কিরিঞ্চা তলায় একটা থান। কয়েকটা পশুর খুলির সাথে কয়েকটা নরখুলি কিরিঞ্চার ডালের সাথে ঝোলানো। একটা তাজা রক্তাক্ত মুন্ডু বড় দন্ডে লাগিয়ে পুতে রাখা থানের পাশে। দন্ড গড়িয়ে রক্ত ঝড়ছে। থানের উপড় বড় একটা পাথরে মুন্ডু ছাড়া একটা দেহ পড়ে আছে, এখনো কাঁপন থামেনি। একটা কচ্ছপের খোলে রক্ত জমা হচ্ছে। অনেকে হাতে সেই রক্ত নিয়ে গায়ে মাখছে। কেউ বলে না দিলেও নেশার ঘোরে আকু বোঝে এটা কার। পাশে দাঁড়ানো কিশোর তার দিকে হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। তার মুখটা চেনা মনে হয়, কোথায় দেখেছে মনে করতে পারে না। আকু উটকি(বমি) দেয়। বটুরা হই হই করে ওঠে। মারিয়ার আগে হবিষের উটকি দেয়া মঙ্গল। বটুদের পহান চুপ করে রক্ত মাখানো অদ্ভূত একটা ছুররা হাতে ধরে আছে। আকু মনে করতে পারে না কোথায় এটার কথা শুনেছে। মুখে বিরিবির মন্ত্র, গলায় প্যাঁচানো হাড়ের মালা পহানের বুক ছাড়িয়ে নেমেছে। সময় মতো ছুররাটা নেমে আসার আগে আকু তাই ভাবছিলো আর ঝেটুনির নামটা শুনে বোঝার চেষ্টা করছিলো বটুগাঁও থেকেও ঝেটুনি খুশি মনে বিদায় হবে কি না!