পিন্টু রহমান
১৩ অক্টোবর ১৯৭৫ খ্রি: চুয়াডাঙ্গার কুমারী গ্রামে জন্ম, পৈত্রিক ঘরবসতি কুষ্টিয়া জেলার বাজিতপুর গ্রামে। মাতা: জিন্নাতুন নেছা ও পিতা: বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিবর রহমান। তিনি একজন কথাসাহিত্যিক। গল্পের ছলে ভাষার আঞ্চলিকতায় চিত্রায়ণ করেন বাঙাল-জনপদের বহুমাত্রিক জীবনাচার। উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত গ্রন্থ: পাললিক ঘ্রাণ (গল্পগ্রন্থ), পূরাণভূমি (উপন্যাস), কমরেড (উপন্যাস), পরাণ পাখি (গল্পগ্রন্থ)
পিন্টু রহমান

কৃষ্ণকলি

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

রাভি নদীর তীরবর্তী ভগ্নস্তুপের আড়ালে রাত্রির নির্জনতায় কুঁড়ি ও পাঁপড়ি বিষয়ক আলাপচারিতায় আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হলে দু’হাত দিয়ে নিজের কান ধরে জিহ্বায় কামড় কাটে খাজানসারা– হায়, হায়, এ কী শুনছি; পিতার রক্ষিতা হবে পুত্রের স্ত্রী!

অবিশ্বাস্য! সবকিছু অবিশ্বাস্য মনে হয়; এমন কী নিজের উপস্থিতিও! শরীরে টিমটি কেটে লোকটি বিচলিত ভঙ্গিতে হাঁটাহাটি করে; দৃষ্টির প্রখরতায় অগ্র-পশ্চাতে নিরীক্ষণ করে– আড়াল থেকে কেউ দেখছে না তো! মহলে ফেরার কথা স্মরণ করিয়ে দিলে শাহাজাদা পাত্তা দেয় না, ইশারায় সরে যাওয়ার ইঙ্গিত করে। সরে আসে খাজানসারা। বুঝতে অসুবিধা হয় না, তাদের প্রণয়লীলা স্বর্গাভিমুখী! শাহাজাদা সেলিমের নিবিড় আলিঙ্গণে কলির চোখে ফোঁটা-ফোঁটা জল– হত্যা করুন শাহজাদা, এই মুহূর্তে গলা টিপে আমাকে হত্যা করুন; নদীর জলের ভাসিয়ে দিন।

হত্যার আকাঙ্খায় নারী আকাঙ্খিত হলেও পুরুষ উদ্ভাসিত; অমর প্রেমের হৈমশিখায় উদ্ভাসিত হয়ে স্বর্গের সিঁড়ি ভাঙে; বিধাতা সহায় হলে কুঁড়ি থেকে পাঁপড়িতে রুপান্তর হতে কতক্ষণ! চোখের জল মুছিয়ে দিতে-দিতে শাহজাদা সেলিম জানায়– ভুলে যেও না আনারকলি, কার রক্ত আমার শরীরে; যতো বাঁধা-বিপত্তিই আসুক, তোমার জীবন থেকে কেউ আমাকে সরাতে পারবে না।

শাহজাদার চোখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে মেয়েটি খরস্রোতা রাভির পানে তাকিয়ে আঁতকে ওঠে, স্মরণ করিয়ে দেয়– ভুলে যাবেন না শাহজাদা, আমার সম্মুখে যাকে দেখছেন সে সাধারণ কেউ নয়, মুঘল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী।

তো, কী হয়েছে আনারকলি! এমনও কী হতে পারে না, প্রিয়তমা আনারকলি ওই সাম্রাজ্যের রাণী, আমার সন্তানের জননী?

না, পারে না।

কিন্তু কেনো! কেনো আমার স্বপ্ন অধরা রয়ে যাবে! এমন কী অপরাধ করেছি যে সৃষ্টিকর্তা আমাদের এতবড় শাস্তি দেবেন?

জলের উপরিতলে নিপাতিত আলোকরশ্মির কাঁপুনি দেখে আনারকলির অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে, কাঁপা-কাঁপা গলায় বলে– অপরাধ আপনার না, আমার; সাধারণ একজন নর্তকীর এমন সৌভাগ্য থাকতে নেই! তার চেয়ে এই ভালো, আমাকে আপনি হত্যা করুন।

হত্যাপর্বের সূচনা আরো আগে, এক নওরোজের দিন; যেদিন সম্রাট আকবর তার সভাসদদের সাথে আনারকলির পরিচয় করিয়ে দেন। আনারকলির আসল নাম নাদিরা বেগম। তুরস্কের সম্রাট তাকে নজরনা হিসেবে পাঠিয়েছিল। নাদিরা বেগমের রূপে-গুণে মুগ্ধ হয়ে সম্রাট তাকে আনারকলি নামে আখ্যায়িত করেন। পরিচয়পর্ব শেষে আরম্ভ হয় নৃত্যগীত; একটি অর্ধস্বচ্ছ ওড়নায় তার দেহের উপরের অংশ আচ্ছাদিত, নিচে ঢোলা পাজামা। আনারকলি তার মোহনীয় বাহু উপরে তুলে ধরে পুরো শরীর দোলাতে আরম্ভ করে; দুলে ওঠে শাহজাদা সেলিমের পৃথিবী! তন্ময় হয়ে চেয়ে থাকে। কোনো বাদ্যযন্দ্র ছিল না, শুধুমাত্র চুড়ির সংঘর্ষে সৃষ্ট মূর্চ্ছণা ও নুপুরের কিন্নরই অবলম্বন! সর্পিল গতিতে বুনো নৃত্য মেতে ওঠে রাজনর্তকী আনারকলি। মেয়েটি শুধু নৃত্য নয় সাহিত্য ও সঙ্গীতেও সমান পারদর্শী। আপন রুপ-মাধুর্য্য ও যোগ্যতায় মুঘল হেরেমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। জলসাঘরে নৃত্যরত আনারকলি শেষ মুহূর্তে তার ওড়না যখন শাহজাদা সেলিমের গায়ের উপর নিক্ষেপ করে সামনে এসে দাঁড়ায়, মাথা নুয়ে কুর্ণিশ করে তখন মনে হয়েছিল, মর্তের পৃথিবীতে স্বর্গের অপসরা; ডিম্বাকৃতির মুখন্ডল, থুতনিতে চিড়, ছোট কিন্তু খাড়া নাক দেখে নিজের মধ্যে স্বর্গীয় সুখ অনুভূত হয়! তার চোখ সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয়, যা সেলিম আগে কখনো দেখেনি! চোখের রঙ গাঢ় নীল অথবা বেগুনীর মধ্যবর্তী বিশেষ কেনো রঙ। এক মুহূর্তের ভালো লাগা হৃদয়ে গভীর ভালোবাসার সৃষ্টি হলো। শাহজাদা সেলিম সম্পর্কের ব্যবধান ভুলে আনারকলির ভালোবাসা পেতে মরিয়া হয়ে উঠলো। প্রত্যাহিক কাজকর্ম ফেলে নানান অজুহাতে হেরেমের আশেপাশে শুরু হলো অন্তহীন পথচলা। দীর্ঘ অপেক্ষার পরেও যখন দেখা না হয়, সেলিমের পৃথিবীতে অন্ধকার নেমে আসে। প্রেমিকের ওই দুর্দিনে হেরেমের রক্ষক খাজানসারা আলোর দিশারী হয়ে এগিয়ে এলো; উৎকোচের বিনিময়ে দেখা করার সুযোগ করে দিল। মুঘল হেরেমে কঠোর নিয়ম– প্রতিটি নর্তকীর জন্য আলাদা আলাদা রক্ষক এবং কক্ষ। রক্ষক দ্বারা যাতে তারা লঞ্চিত হতে না পারে, এজন্য প্রতিটি রক্ষক খোঁজা। রক্ষক ছাড়াও হেরেমের অভ্যন্তরে আছে গুপ্তচর। কখোন কী ঘটে না-ঘটে রাজসভার নবরত্ন ভান্ডারের মাধ্যমে সম্রাট আকবরের কাছে পৌছে যায়। আনারকলি-সেলিমের প্রণয়কথাও একদিন সম্রাটের কানে গিয়ে পৌছে; নবরত্ন ভান্ডারের প্রধান আবুল ফজল বিস্তারিত অবহিত করেন। সম্রাট আকবর এই সম্পর্ক মেনে নিতে নারাজ। সন্তানকে মহলে ডেকে পাঠান, স্নেহের সুরে বলেন- শাহজাদা, তুমি কী তোমার অতীত ইতিহাস ভুলতে বসেছো?

কোন ইতিহাসের কথা বলছেন, আব্বা হুজুর!

তুমি আমার বড় সাধনার ধন! অকৃত্রিম স্নেহে লালন-পালন করেছি।

বিবাহের প্রথম পর্যায়ে জন্ম নেওয়া সম্রাট আকবরের সন্তানগুলো একে একে সবাই মৃত্যুমুখে পতিত হয়। সন্তানহারা পিতার বুকে তখন গভীর হাহাকার। সন্তানের আশায় বিভিন্ন পীর-দরবেশের মাজারে মাজারে মানত করেন, তাদের রুহানী শক্তির সহায়তা কামনা করেন। ময়নুদ্দিন চিশতির মাজার জিয়ারত করেন। তাঁর ভাগ্নে ফকির সেলিম চিশতির সাথে দেখা করে কান্নকাটি করেন, নিজের দুর্ভাগ্যের কথা বর্ননা করে অনুশোচনায় দগ্ধ হন। ফকির সেলিম চিশতির মুখে সম্রাট জানতে পারেন, তিনি তিন সন্তানের জনক হবেন। স্বভাবতই প্রথম সন্তান জন্মগ্রহণ করলে ফকিরের নামানুসারে নাম রাখা হয়, সেলিম। আনারকলির বিষয়ে সম্রাট আকবর ছেলেকে সতর্ক করে দেন– আমি যা জানি তা তুমি জানো না; তুমি কী জানো, আনারকলি নামের মেয়েটি ছদ্মবেশী।

সেলিম মুখ তুলে তাকায়– ছদ্মবেশী!

হাঁ, সে ছদ্মবেশী। তুরস্কের সম্রাটের হয়ে সে গুপ্তচরবৃত্তি করছে।

কিন্তু এমন একজন গুপ্তচরকে হেরেমে ঠাঁই দেওয়া কী অন্যায় নয়!

সম্রাট আকবরের কন্ঠের স্বর ভারি হয়ে ওঠে– ন্যায়-অন্যায় বোঝার মতো মানসিকতা তোমার নেই। আর একথাও ভুলে যেও না, তুমি শক্তিশালী মুঘল সম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী।

আনারকলিকে কেন্দ্র করে পিতা-পুত্রের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ চলমান। মহলে গুমোট পরিবেশ। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না। সম্রাট আকবর আন্দাজ করতে পারে, রাজনর্তকীর প্রেমে শাহজাদা অন্ধপ্রায়। কিন্তু যে ভাবেই হোক ওই অন্ধকার পথ থেকে ফেরানোর পথ খোঁজে; ছেলেকে চোখে-চোখে রাখে। হেরেমখানার পথ নিষিদ্ধ। শাহজাদা সেলিমও গুপ্তচর লাগিয়েছে। গুপ্তচরের মাধ্যমে হেরেমের খবরাখবর সংগ্রহ ও আনারকলির সাথে সংযোগ রক্ষা করে। নাওয়া-খাওয়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম। অজানা আশঙ্কায় দিন কাটে। নিজের পিতাকে চিনতে ভুল হওয়ার কথা নয়, হয়তো এমন কিছু করে বসবে যা অপ্রত্যাশিত।

শাহজাদা সেলিমের আশঙ্কা যে অমূলক নয়, কদিন পরে তার সত্যতা জানা যায়। গুপ্তচরের মাধ্যমে খবর আসে, আনারকলি আহত; শাহজাদার সাথে প্রেম করার অপরাধে সম্রাট আকবর তাকে চাবুক মেরে রক্তাক্ত করেছে। হতাশায় নুয়ে পড়ে সেলিম; প্রতিশোধের মন্ত্রে উদ্দীপ্ত হয়। মনে মনে ভাবে, জন্মদাতা পিতার প্রতি চরম প্রতিশোধ নেবে। তার আগে আনারকলির সাথে দেখা হওয়া জরুরি। কিন্তু কিভাবে সম্ভব! গুপ্তচরের মাধ্যমে অবগত হয়, হেরেমখানার নিরাপত্তা আগের যে কোনো সময়ের চাইতে জোরদার। সকল বাঁধা উপেক্ষা করে প্রেমিক সেলিম নারীর ছদ্মবেশে আনারকলির কাছে পৌছে যায়। প্রিয়তমা আনারকলি তখন অচেতন অবস্থায় সজ্জাগত। চাবুকের আঘাতে শরীরের বিভিন্ন স্থানে রক্ত জমে আছে। শাহজাদা সেলিমের জানা ছিল না, সামান্য অপরাধে তার পিতা এমন নিষ্ঠুর আচরণ করতে পারে! আর অপরাধ যদি হয়েও থাকে তার জন্য আনারকলি নয় পুত্র সেলিম দায়ী। শাহজাদা সেলিম অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করতে উৎগ্রীব। আনারকলির সজ্জ্যাপাশে প্রচন্ড অনুশোচনায় সে দগ্ধ হয়, জখমের চিহ্ন দেখে বুকের অতলান্তে তোলপাড় শুরু হয়; পরম মমতায় সেবাযত্ন করে, শুষ্ক ঠোঁটে পানির ছোয়া দেয়। আনারকলি চেতনা ফিরে পায়, জেগে ওঠে। শাহজাদা সেলিমকে দেখে মনে মনে হোঁচট খায়– সে যা দেখছে তা কি স্বপ্ন! স্বপ্নের ঘোরে শারীরিক যন্ত্রণা উপেক্ষা করে বিছানার উপর উঠে বসে– শাহজাদা আপনি! কেমন করে এলেন! ওরা আপনাকে আসতে দিল!

শাহজাদা সেলিম খুলে রাখা পোশাকের পানে ইঙ্গিত করে। ভয়ার্ত চোখে আনারকলি সেদিকে তাকায়– না না শাহজাদা, আপনি এক্ষুনি চলে যান, তা না হলে যে বড় ধরনের বিপদ হবে!

বিপদের ভয়ে শাহজাদা সেলিম আজ আর ভীত নয়, ভয় যা ছিল, আনারকলিকে নিয়ে; কিন্তু প্রেমিকার রক্তাক্ত শরীর দেখে তার নিজের রক্তে নাচন ধরেছে, বুকে অদম্য সাহস। খাপ খোলা তলোয়ার হাতে তুলে নিয়ে বলে– তোমাকে নিতে এসেছি কলি, এই মৃত্যপুরী থেকে আমি আমার প্রেমাস্পদকে উদ্ধার করবো; দরকার হলে দূরে কোথাও চলে যাবো, যেখানে মুঘল সম্রাটের নিয়ন্ত্রণ নেই।

মুখে হাসির রেখা টেনে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আনারকলি জানতে চায়– সেখানে গিয়ে কী করবেন, শুনি?

তোমাকে নিয়ে সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করবো।

কিন্তু এই বিশাল সম্রাজ্য; সম্রাজ্যের উত্তরাধিকার থেকে আপনি বঞ্চিত হবেন।

আনারকলির মাথা বুকে টেনে নিয়ে সেলিম বলে– তোমাকেই যদি না পাই, সম্রাজ্য দিয়ে কী করবো আমি! এই জনমে আমি শুধু তোমাকে চাই।

আনারকলি খুশি হয়, খুশিতে তার চোখের কোণ বেয়ে জল গড়ায়। আজ আর মরণেও তার দ্বিধা নেই; শাহজাদা সেলিমের ভালবাসার কথা স্মরণে এনে হাসিমুখে মৃত্যুকে আলিঙ্গণ করতে পারবে। আনারকলির ইতিহাস মর্মান্তিক। ধনী সওদাগরের কন্যা সে। জলদস্যুরা জাহাজে হামলা চালিয়ে তার পিতাকে হত্যা করে এবং আনারকলিকে ইস্তাম্বুলের কৃতদাস বাজারে এক পতিতালয়ের মালিকের নিকট বিক্রি করে দেয়। বেশ কয়েকবার হাতবদলের পরে আনারকলি ঠাঁই হয় তুরস্কের সুলতানের কাছে। যে জীবনের জন্য এতোদিন ঘৃণা জন্মাতো, সে’ই জীবনকেই আজ মধুময় মনে হয়। প্রেমিক সেলিমের মধুর আলিঙ্গণে ভুলে যায় যতোসব গঞ্জণা-বঞ্চনা, উৎপীড়ন, অভিমান!

আনারকলি-সেলিমের প্রণয় শুধুমাত্র হেরেমের চার দেওয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, অনুকূল পরিবেশে উজানমুখী হয়। শাহজাদা সেলিম অপেক্ষা করে, রাজকার্যে সম্রাট আকবর কবে বাইরে যাবে! সম্রাজ্যের ব্যবস্থাপনায় কিছুদিন বাইরে অবস্থান করলে, শাহজাদা প্রণয়লীলায় মেতে ওঠে। লোকচক্ষুর অন্তরালে গভীর রাতে রাভি নদীতে পানসি ভাসায়। জলের সান্নিধ্যে ভেসে চলে পিপাসাকাতর দুটি প্রাণ! দূর থেকে লাহোরের আলো-ঝলমলে প্রাসাদের পানে তাকালে ধাঁধার সৃষ্টি হয়। আনারকলির জীবনে প্রেমিক সেলিমও এক বিস্ময়কর ধাঁধা। ধাঁধার জট খুলতে মরিয়া হয়ে ওঠে– নিয়তি আমাদের কোথায় নিয়ে চলেছে, শাহজাদা।

জোৎস্না প্লাবিত আকাশের পানে দু’হাত বাড়িয়ে সেলিম জানায়– পরিণতির পথে!

সেলিম নিজেও কী জানতো কী তাদের পরিণতি! খাজানসারার চিৎকারে সেলিম ও আনারকলির মগ্নতা কেটে যায়। ভোর হতে বিশেষ দেরি নেই, পূর্বাকাশ ক্রমশ ফিসে হয়ে আসছে। পেছন ফিরে তাকাতেই চমকে ওঠে; সম্রাট আকবরের সৈন্য-সামন্ত তাদের ঘিরে ফেলেছে।

 

দুই.

প্রিয় পুত্রের অসংখ্য অন্যায় সম্রাট আকবর সহ্য করেছে, কিন্তু আর নয়; ন্যায়বিচার করতে আজ সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। সভাসদ এবং সাধারণ জনগণের ভিড়ে রাজসভা সরগরম। বন্দী সেলিম ও আনারকলিকের নিয়ে আসা হয়েছে। প্রেমিক যুগলের পানে তাকিয়ে সাধারণ জনগণ ব্যথিত। সম্রাট আকবরের বেদনাবিধুর দৃষ্টি শাহজাদার অভিমুখে। মুহূর্তের জন্য সেলিম চিশতির স্মৃতি আলোকিত হয়ে ওঠে। আনারকলির মনের মধ্যে রাজ্যের অন্ধকার। না, নিজেকে নিয়ে সে চিন্তিত নয়, তার আশঙ্কা প্রেমিক সেলিমকে নিয়ে। সামান্য একজন নর্তকীর জন্য মুঘল সম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী মৃত্যুর মুখোমুখি! সামগ্রিক অপরাধ বিবেচনা করে সম্রাট আকবর আনারকলিকে নির্বাসন এবং শাহজাদা সেলিমকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করেন। রাজসভায় যেনো মুহূর্তেও মধ্যে কবরের নিস্তবদ্ধতা নেমে আসে। উপস্থিত জনগণ একে অন্যেও দিকে তাকায়, নিজেদের কানকেও তাদের অবিশ্বাস! শাহজাদা সেলিম তার আনত মুখ উঁচু করে আনারকলির পানে তাকায়। এ দৃশ্য আনারকলি সহ্য করতে পারে না, হাত জোড় করে অনুনয় করে– মেহেরবান করুন, আলম্পনা; আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও শাহজাদার প্রাণভিক্ষা দিন। তাছাড়া অপরাধ যা, তা কেবল আমারই! শাহজাদা নিরাপরাধ, যাদুমন্ত্রের শক্তিতে আমি তাকে বশীভূত করেছি।

কোনো অজুহাত শুনতে সম্রাট রাজি নয়, সে তার সিদ্ধান্তে অবিচল। নিরুপায় হয়ে আনারকলি ফুঁসে ওঠে– দোহায় আলম্পনা, শাহজাদার প্রাণভিক্ষা দিন! তা না হলে আমি অভিশাপ দিব, আমার অভিশাপে মুঘল সম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যাবে।

অভিশাপের কথা শুনে সম্রাট বিচলিত হয়ে ওঠেন, রাজনর্তকী রোজিনার কথা মনে পড়ে; রোজিনার অভিশাপে রাজধানী ফতেহপুর সিক্রি বসবাসের উপযোগিতা হারিয়েছে। তাহলে! সম্রাট আকবর সভাসদদের নিয়ে আরেক দফা আলোচনায় বসে। নতুন করে সিদ্ধান্ত নেয়– হে নারী, শাহজাদার প্রাণভিক্ষার জন্য দুটি পথ খোলা আছে; হয় তোমাকে নির্বাসনে যেতে হবে না-হয় জীবন্ত সমাধিস্থ হতে হবে! বলো, কী চাও তুমি?

প্রেমিক সেলিমকে ছাড়া বেঁচে থাকা মৃত্যুর সমান; অতএব, মৃত্যুকেই বেছে নেয়। বন্দী সেলিমের মুখে অট্টহাসিতে; পাগলের মতো উচ্চস্বরে হাসতে থাকে। সম্রাট বাবর ভীত-সন্ত্রস্ত, শাহজাদা সেলিম কী তার লোক-লস্কর নিয়ে পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করবে! হাসির দমগে সম্রাটের বুকের মধ্যে কাঁপুনি আরম্ভ হয়। বাতাসের ডানায় ভর করে ওই কাঁপুনি যেনো রাজ্যময় ছড়িয়ে পড়ছে!


 

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu