পূব আকাশে আলো ছড়াতেই এক ঝাঁক পাখি উড়ে গেলো। পাখির চোখে একদিন চোখ রেখে পুরোটা দুপুরকে বিকেলের দিকে টেনে নিয়েছিল দিনা; সেসব দিনগুলো কত দ্রুত পেছনে চলে যায়। যেতে যেতে রেখে গেল যা, তার নাম স্মৃতি। স্মৃতি মুছে ফেলা যায় না। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে।
দিনা! ও দিনা! চল চল বেরুবি।
বলতে বলতে রোকেয়া আক্তার এসে ওর ঘরের দরজায় দাঁড়ালেন। দিনার দিকে তাকিয়ে তিনি চোখ কপালে তুললেন।
– ওমা আজ যে এখনও রেডি হোস্ নি? বেলা কত হলো খবর আছে? সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। পৌঁছাবো কখন বল দেখি? রাস্তার জ্যামের কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। আর মাত্র একঘন্টা বাকি আছে কারখানার গেইট বন্ধ হয়ে যাবে। মাথা কুটলেও ভেতরে ঢুকতে পারবি তারপর? পারবি না রে। কী হয়েছে তোর?
– শরীরটা কেমন গুলিয়ে আসছে, মাথা ঘুরছে। চোখে ঝাপসা দেখছি। সব বিতৃষ্ণা লাগছে। তুমি যাও আপা। সুপারভাইজারকে ফোন করে দিবো। তুমিও তাকে বলে দিও একটু।
– তোর কী হয়েছে? দেখি দেখি চোখ দেখি জণ্ডিস নয় তো?
– জন্ডিস ছাড়া কি বমি হতে পারে না?
– পারে আরেক কারণে। তবে তুই যে বিয়েই করিস নি!
– অন্য রোগেও বমি হতে পারে আপা। তুমি এখন যাও, নয় তো তোমারও দেরি হয়ে যাবে। আর শুনো পৌঁছে সুপারভাইজারকে বলে দিও।
– বলে দিবো বা তুই ফোন করবি, সব ঠিক আছে। তুই যে এমাসে তিনদিন ছুটি কাটিয়েছিস্। সাময়িক ছুটি নিয়েছিস দু’দিন। এখন আর সুযোগ দিবে কি? ওর শর্ত অনুযায়ী আর একদিন ছুটি পাবি। এখন মাসের বাইশ তারিখ। কোনো কারণ যদি আরও জরুরী কিছু হয়? তখন কী করবি? তার চেয়ে ভালো এখন চল। যাবার সময় ঔষধ নিয়ে নিস্। সুপারভাইজারকে বলে একফাঁকে বেরিয়ে আসিস খারাপ লাগলে।
দিনা দেখলো কথায় যুক্তি আছে। সে তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়লো। শরীর খারাপ বলে রান্না করেনি। খাবারও নেয়নি দুপুরের। মোড়ের দোকান থেকে চারটে পরোটা, একটা ডিম ভেজে নিয়ে খালি বক্সে ভরে নিল। নাস্তা এবং দুপুরের খাবার হয়ে যাবে। ঘড়ি দেখলো সাতটা পঁয়তাল্লিশ বাজে।
তারা যখন কারখানার গেইটে পৌঁছালো তখন ঢংঢংঢংঢং ধ্বনিতে মুখরিত হলো কারখানার চৌহদ্দি। দ্রুত হেঁটে গেইট দিয়ে ঢুকে পড়লো তারা। দলবেঁধে ছুটে চলা শ্রমিকদের সাথে কলকল হাসি, কথা, আর সুবাস ঢুকে কারখানাকে প্রাণচঞ্চল করে তুলল। পথের পাশে মাথা চেপে বসে পড়লো দিনা। এতোক্ষণ কারখানায় পৌঁছানোর টেনশনে সে তার শারীরিক অশান্তির কথা ভুলেই গেছে।
রাবেয়া আক্তার ঢুকেই পৃথক হলো। দিনার পা আটকে যাচ্ছে মাটির সাথে। করো কাঁধে ভর দিয়ে বারান্দায় যেতে পারলে হতো। গেইটের সামনের জায়গাটুকু ফাকা হয়ে যেতেই দারোয়ানের চোখে পড়লো। সে কাছে এসে জানতে চায়– কী হয়েছে?
দিনা উত্তর না দিয়ে বললো– একটু পানি দিবেন এনায়েত ভাই?
এনায়েত উল্ল্যাহ “আনছি” বলে চলে গেলে দিনা অপেক্ষা করে।
পানির বোতলে চুমুক দিয়েছে মাত্র, এমন সময় সুপারভাইজারের হেড়ে গলা– এই কে! কে! কে ওখানে বসে বসে পিডার চুসছে?
তিনি কাছে এসে দিনাকে চিনতে পেরে বিরক্ত হলো। কারণ- এই মেয়েটিকে কিছুতেই বশে আনতে পারেনি সে। গার্মেন্টসে কাজ করতে এসে ন্যাকামো দেখায়। এই ন্যাকামো দেখে ফোসকা উঠে। খাল-খন্দকের মানুষ ঢাকা শহরে এসে ঠাঁটে-বাটে বাঁচতে চাইলেও পারবে না। এদের যে পাখা গজায়; সে পাখা ভেঙে দিলে এরা কদাকার নর্দমা। নর্দমা কখনও ভব্যসভ্য হয়ে উঠতে পারে না।
দিনার দিকে কামুক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আপাদমস্থক পরখ করে সুখ অনুভব করে রশিদ। মনে মনে খিস্তি করে, “আহ্ সুখ! সুখরে! তোকে আমি ভোগ করবো। সরাসরি না পারি এই এমন করে মনে মনে হলেও। মাপ নাইরে তোর! মাপ নাই! একটা একটা করে যদি তোর পালক না ছিঁড়ে ফেলি, তবে আমার নামও রশিদ নয়!”
দিনা জড়োসড়ো হয়ে উঠে দাঁড়ালো। রশিদ বড্ড মায়াময় মোলায়েম কণ্ঠে বললো– থাক থাক একটু জিরিয়ে নে। আহা সোনার শরীর। কী হয়েছে’রে তোর? ভাইকে বল। তোর সব সমস্যা সমাধান করে দেবো। ধর দেখি ভাইয়ের হাত।
এই বলে অপেক্ষা না করে দিনার হাত নিজের হাতে পুরে নিয়ে প্রশান্তিতে শ্বাস ছাড়লো। তারপর বললো–আহ্ জ্বরে পুড়ে যাচ্ছিস্ যে। চল আমার আফিস কক্ষে বিশ্রাম নে। ওষুধ পত্তর আনিয়ে নেই। খেলে সুস্থ লাগবে।
দিনার সত্যি কেমন অবশ অবশ লাগছে। সে একা চলবারও শক্তি হারাচ্ছে। তবু রশিদের কাছে নত হলো না। বললো– দরদ লাগলে ছুটি দিয়ে দেন।
– ছুটি নিবি নিস্। তোর সব ছুটি কাউন্টও করবো না। জেদ করিস্ না। চল দেখি।
দিনার কপালে ভাঁজ পড়ে। চোখগুলো ছোট হয়ে ওঠে। সে শুকরের মতো কদাকার চরিত্রের ভদ্রবেশী লোকটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ভাবে– এরা কি মেয়েদের ভোগের বস্তু ছাড়া কিছুই ভাবে না? চায় না মেয়েরা ঘরের বাহিরে আসুক। কাজ করুক? এদের অহংকার চূর্ণ হয় কেন এতে? এদের এমন সংকীর্ণতার জন্য সমাজ এবং দেশের উন্নয়ন বাধার মুখে পতিত আজ। কবে মুক্তি পাবে মুখোশধারীদের থেকে অবলা নারীরা? কত বড় বড় কথা বলে মিছিল মিটিংয়ে নারীবাদী মানুষেরা। তার পরিবর্তন হচ্ছে কোথায়? সব যেই সেই। পানিতে ঢিল ছোঁড়ার পরে যেমন পানি ফের এক হয়ে যায়। এরাও তাই। সবই সভা, সমাবেশ, মিছিল, মিটিং এরপর পুনঃরায় এক। নারীদের সত্যিকার অর্থে যেন কোনভাবেই মুক্তি নেই। হায়রে নারী জন্ম; হায়রে ভাঙাচোরা সমাজ ব্যাবস্থা!
দিনা শক্তি সঞ্চয় করে নিজে হেঁটেই রশিদের অফিস কক্ষে এলো। মনে মনে ভাবলো, যা হোক ওষুধ খাওয়া, একটু রেস্ট নেওয়া হবে, মন্দ কি? কষ্টের মধ্যেও সতর্ক ভাবে বসে রইল। কিছুক্ষণ পর দারোয়ান এসে ওষুধ ও খাবারের একটা প্যাকেট দিয়ে গেলো। দারোয়ান চলে যেতে দিনার দিকে এমন ভাবে তাকালো যে, সব কেমন রহস্যময় লাগলো। কিন্তু সেই দৃষ্টি, কী বলতে চায়? বুঝতে পারে না দিনা।
প্যাকেট খুলে স্যান্ডুইস এগিয়ে দেয় রশিদ দিনাকে। নিজেরটা খাওয়া শুরু করে। কাউকে ফোনে আসবার জন্য আমন্ত্রণ করছে। বেশ হাসি খুশি দেখাচ্ছে তাকে। রশিদ ওষুধ খুলে এগিয়ে দেয় দিনার দিকে। দিনা যে রশিদকে এতোদিন চিনতো, সে রশিদকে কোথাও খুঁজে পেল না এই আচরণে। সে মুগ্ধ হলো। কিছুক্ষণ আগেও যাকে শুকরের মতো লাগছিল। তাকে এখন ফেরেশতার মতো লাগছে।
ওষুধ খেয়ে দিনার ঝিমঝিম ভাব আসে। চোখগুলো জড়িয়ে আসছে ঘুমে। এসময় রুমে ঢুকলো দু’জন। তারা রুমে ঢুকেই অশ্লীল কথাবার্তা শুরু করে দিলো। দিনার কান গরম হয়ে উঠছে। সে পালাতে চায় এখান থেকে। কিন্তু তার শরীর ক্রমশ চৈতন্য হারাচ্ছে। আরেকজন এসে ঢুকতেই পরিচিত পারফিউমে গন্ধ পায় দিনা।
চাচাতো ভাই অদিত্য এই পারফিউম ব্যবহার করতো। ছোটবেলায় কতো চকোলেট, আইসক্রিম খাইয়েছে। লেখা-পড়া তেমন ভালো ছিল না। বাবার ব্যবসার হাল ধরেছে। কত বছর তার সাথে দেখা নেই। অথচ গন্ধটা ঠিক চেনে দিনা। প্রাণে লেগে থাকা গন্ধ কখনও কি ভুলতে পারে মানুষ?
অপরিচিত লোকটি ফিসফিস করে কিছু বললো। সবাই রুম থেকে বেরিয়ে গেল। দিনার চোখ মেলে রাখা কষ্টকর। সে শুনতে পায়, পায়ের শব্দ ঘন হয়ে আসছে। আরো আরো কাছে। তারপর হাতের স্পর্শ তার গালে। ক্ষণকাল সে ভাবে এই হাত কি তার অহংকার চূর্ণ করে দেবে? সেসময় পরিচিত কণ্ঠস্বরে দিনার চেতনা হারাতে বসা ভেতরটায় চমকায়। যেন দূরে নিজের গাংনি গ্রামের জলাশয় থেকে ভেসে আসা অজস্র অতিথি পাখির ডাক। সেই ডাকের কণ্ঠগুলো একটি কণ্ঠ হয়ে তার কানে দোলা দেয়– দিনা! দিনা! এই দিনা… আমি অদিত্য! মেয়েদের নিয়ে অনেক মজা করেছি। আজ বোনের সাথে জড়িয়ে যাবো বুঝিনি। ওই শালা কয়টা ওষুধ খাওয়ালো তোকে কে জানে!