তরুন ইউসুফ
জন্ম ১৯৮৯ সালের ২৬ মার্চ সিরাজগঞ্জের সলঙ্গায়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর পাশের পর বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উপপরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন। উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত গ্রন্থ: না গৃহী না সন্ন্যাসী (২০১৮), কান্না হাসি রম্য রাশি (২০১৯)।
তরুন ইউসুফ

কী চাই

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

কী


চাই?

অনেক কিছু চাই।

ভালো রেজাল্ট চাই, তারপর চাকরি চাই। চাকরি হলে সুন্দরী বউ চাই। বাড়ি চাই গাড়ি চাই, সোনা দানা আরও কত কিছু চাই।

এ চাওয়ার শেষ কোথায়? শেষ নেই।

যেহেতু আমাদের চাওয়ার শেষ নেই এবং পাওয়াতে আনন্দ নেই, তাই সিরিয়াস কথা বলার আগে চলুন সোনা এবং দানা বিষয়ক একটা গল্প শোনা যাক।

গল্পটি একটু দুষ্টু গল্প। তবে যারা দুষ্টু ও ফাজিল কিসিমের তাদের কাছে এ গল্প পানসে মনে হবে। কারণ তারা এ গল্প কয়েকশ বার শুনে ফেলেছেন। তবে যারা আমার চেয়ে একটু বেশি শিষ্ট তাদের ক্ষেত্রে এ গল্প না শোনার সম্ভাবনাই বেশি। তাদের জন্যই গল্পটি বলছি।

“স্বামী-স্ত্রী গাড়ি করে কোনো এক জায়গায় বেড়াতে যাচ্ছিল। পথে হঠাৎ ডাকাত আক্রমণ করে বসল। গাড়ি থামিয়ে টেনে হিঁচড়ে মহিলাকে বের করে আনা হলো। ডাকাত সর্দার হা রে রে করে দাঁত কিড়মিড়িয়ে মহিলাকে ভয় দেখিয়ে বলল, তোর কাছে টাকা পয়সা, সোনা দানা যা কিছু আছে সব দিয়ে দে। নইলে একদম জানে মেরে ফেলব।

মহিলা অবশ্য ডাকাতের এহেন হুমকিতে তেমন কোনো ভয় পেল না। বরং একটু তাচ্ছিল্য করেই বলল, আমার কাছে তেমন কিছুই নেই। তারপর গাড়িতে বসা তার স্বামীকে দেখিয়ে বলল, তারচেয়ে ঐ লোকের কাছে যান। ওর কাছে একটা সোনা আর দুইটা দানা আছে। ওগুলো নিয়ে যেতে পারেন। ওগুলো কোনো কাজেই আসে না।”

এটা তো গেল দুষ্টু গল্পের দুষ্টুমি, কিন্তু চিন্তা করে দেখেন– সোনা দানাসহ বস্তুগত জিনিসের লোভ কী ভীষণভাবে আমাদেরকে চেপে ধরেছে। এটা আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? আমরা কেউই তা জানি না। না জেনেই ছুটছি, হাপাচ্ছি তারপর আবার ছুটছি। এভাবে একসময় এক্সপায়ারি ডেট শেষ হলে ভীষণ একটা অতৃপ্তি নিয়ে টেসে উপরে চলে যাচ্ছি। ব্যস খেল খতম।

এখন হয়ত আপনারা বলবেন, এই যে তুমি এত নীতি কথার খই ফুটাচ্ছ– তোমার অবস্থা শুনি? তোমার কি কোনো ধরনের লোভ নেই? তুমি কি একদম গান্ধীজির মত হয়ে গেলে নাকি, এই বয়সেই কৌমার্য ধারন করেছ?

না তেমন কিছুই আমার ক্ষেত্রে ঘটেনি। আমার অবস্থাও ঐ আপনাদের, সরি অন্যদের মতোই। ভেতরে চাওয়া আর লোভ জমে জমে এত বড় পাথরের আকার ধারন করেছে যে, সেই বোঝা বহন করা সম্ভব হচ্ছে না আর। নিজেকে একটু মুক্ত করা দরকার। তাই আবোল-তাবোল বকছি।

আরেকটি গল্প শোনা যাক। গল্পটি মহামতি সক্রেটিসকে নিয়ে। কোথায় পড়েছি মনে নেই। হুবহু বয়ানও করতে পারব না। শুধু গল্পটির সারকথা বলছি– ‘সক্রেটিসের কোনো এক শিষ্য গুরুকে সুন্দর সুন্দর জিনিস দেখাবেন বলে সক্রেটিসকে নিয়ে একটি রকমারি জিনিসের দোকানে গেলেন। কিন্তু সেইখানে গিয়ে শিষ্য পড়লেন চরম অস্বস্তিতে। কারণ সক্রেটিস যা-ই দেখছিলেন; তাতেই তার চোখ ঝলমল করে উঠছিল। শিষ্য ভাবলেন, সক্রেটিস এতদিন কিছু দেখেননি। তাই তার মধ্যে কোনো মোহ জন্মায়নি। কিন্তু আজকে এতকিছু দেখে তার মধ্যে মোহ জন্মেছে। তাহলে সক্রেটিসও বস্তুগত জিনিসের লোভে পড়ল! একটু পড়ে সক্রেটিস শিষ্যকে ডেকে আনন্দিত গলায় বললেন, দেখো দেখি কাণ্ড! পৃথিবীতে কত আজব জিনিস আছে কিন্তু মজার ব্যাপার হলো কোনো কিছুরই আমার প্রয়োজন নেই।’

সক্রেটিস দার্শনিক ছিলেন। প্রয়োজনের বাইরে তাঁর বস্তুগত তেমন কোনো চাহিদা ছিল না। নিজের ভাবনা, মনের সৌন্দর্য দিয়ে যে জগত তিনি গড়েছিলেন সেই জগতের মধ্যে বসবাস করতেন। বাইরের কলুষতা, বস্তুগত মোহ তাদের চিন্তাকে কখনো প্রতারিত করতে পারেনি।

কিন্তু সাধারণ মানুষ এই যেমন আমি যখন বাইরে বের হই চারিদিকে হাজারো লোভনীয় জিনিসের পসরা দেখি। যেন চারিদিকে চকচকে রঙিন লোভ। আমার চোখও চকচক করে ওঠে। হাজারো বাসনা আমার চিন্তাকে গ্রাস করে ফেলে। আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলি। মনোগত ভালবাসা মায়া স্নেহ সবকিছু আমার কাছে ম্লান হয়ে যায়। আমি তুচ্ছ জিনিসটাকে বড় করে নিজের ভেতরটাকে মারিয়ে দেই।

একটা গল্প বানাই আপনাকে দিয়ে। আপনার মেয়ে বন্ধুটি যে আপনাকে ভীষণ ভালোবাসে, তাকে নিয়ে বেশ সুখেই আপনার দিন কাটছিল। হঠাৎ করে আপনাদের সাথে আরেকটি জুটির পরিচয় হল। আপনি লক্ষ্য করলেন, ছেলেটি প্রতিদিন নতুন নতুন শার্ট পরে আসে এবং জানতে পারলেন শার্টগুলো তাঁর মেয়ে বন্ধুর গিফট করা। আপনি এই বিষয়টি নিয়ে আপনার মেয়ে বন্ধুর কাছে গল্প করলেন। সে মজা করে গল্পটি শুনল এবং বলল, তোমাকেও একটি শার্ট দেয়া দরকার।

আপনি দ্বিতীয় দিন একই গল্প করলেন এবং সে গল্পটি শোনার পর একই কথা বলল। আপনি তৃতীয় দিন একই ধরনের গল্প করতে গিয়ে দেখলেন মেয়েটির মুখ শুকনো এবং সে গল্পটি শুনতে চাচ্ছে না। আপনি ভাবলেন, বা রে! মুখ শুকানোর কী আছে? আমি তো শার্ট গিফট চাইনি যে মুখ শুকনা করতে হবে।

নিঃসন্দেহে আপনার ভাবনা ঠিক। আবার আপনি যখন শার্ট বিষয়ক গল্প করেছেন, আপনার বন্ধুটি ধরেই নিয়েছে গিফট বিষয়টি আপনার ভালো লেগেছে এবং সেজন্য আপনাকে শার্ট গিফট করতে চেয়েছে। কিন্তু কোনো কারণে সে পারছে না বলে সে কষ্ট পাচ্ছে। সুতরাং এটাও ঠিক, আপনি যখন শার্ট বিষয়ক কোনো গল্প করেন; তখন তাঁর নিজের অক্ষমতার কথা মনে পড়ে এবং তাঁর ভেতরটা রক্তাক্ত হয়। আপনি বুঝতেই পারলেন না তাঁর কষ্টের কথা। মনে মনে বললেন, ভালোবাসার গুষ্ঠি কিলাই।

আসলে জানেন, মানুষ কী চায় নিজেই জানে না। বলবেন পুরান কথা। ঠিক, আবার সত্য কথাও বটে। এই যে আপনি আমি আমাদের চারপাশের সবাই প্রতিনিয়তই কিছু না কিছু চাই। না পেলে হতাশ হই। আবার যখন কোনোকিছু পাই চেয়ে দেখি যা চেয়েছিলাম আসলে সেটা আমার চাওয়াই ছিল না। যখন শরীর ছাড়া প্রেম পাই, তখন ভাবি সবকিছুই যদি না দিলা তো কিসের প্রেম। আবার শরীরের চাহিদা মিটে গেলে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ি, তখন ইচ্ছে জাগে একটু মানবিক প্রেম পেতে। আর যখন দুটোই পাই, তখন মনে হয় ব্রহ্মচারী হওয়াই ভালো ছিল।

শুরু করেছিলাম গল্প দিয়ে, শেষ করছি ঘটনা দিয়ে। আমার ছোট খালু, জানতে পেরেছি উনি ব্রেন ক্যানসারে আক্রান্ত। কিছুদিনের মধ্যেই মারা যেতে পারেন। কতই আর বয়স। বড়জোর পঁয়তাল্লিশ হবে। উনি কিন্তু জানেন ওনার মাথার ভেতরে একটি টিউমার হয়েছে, সেটা একটা সাধারন টিউমার। টিউমারটি অপসারণ করলেই সে ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু আসলে তা নয়। আমরা তাকে মিথ্যা করে বলেছি যে তার মাথার ভেতরের টিউমারটি সাধারণ।

তাঁর কথা শুনলে, চোখের চাহনি দেখলে আপনি বুঝতে পারবেন, তিনি ভীষণভাবে বাঁচতে চান। তাঁর সমস্ত কিছুর বিনিময়ে আরও কিছুদিন সন্তান, স্ত্রী, স্বজনদের ভালোবাসার মাঝে থাকতে চান। অথচ চাওয়ার পরেও হয়ত তিনি বাঁচতে পারবেন না।

আবার আমরা মাঝে মাঝেই দেখতে পাই অনেক মানুষ সুস্থ সবল, সবকিছুই আছে কিন্তু একটু ভালোবাসা নেই বলে ইচ্ছে করে মরে যাচ্ছে। কোথায় যেন পড়েছিলাম ভালোবাসা মানুষের জীবনকে মূল্যবান করে। তাইতো মনে হয়। তাহলে কী চাই, ভালোবাসা কিন্তু কিভাবে? তা তো জানি না।

শেষ করছি, কিন্তু শেষ করার আগে… নেড়ি কুকুরগুলো দেখেছেন নিশ্চয়ই। শক্ত সামর্থ্য কারও দ্বারা তাড়া খাওয়ার পর যখন দৌড়াতে না পারে, তখন দাঁত বের করে রুখে দাঁড়ায়। আমার অবস্থা ঠিক তাই। যদি বলেন, কে তাড়াচ্ছে আপনাকে। নিজের চাওয়া এবং পাওয়ার লোভে নিজেই নিজেকে তাড়াই প্রতিনিয়ত। নিশ্চয়ই মনে মনে গাল দিলেন, বেটা উল্লুক। খালি ফাইজলামি।


(এই লেখাটি লেখার মাস ছয়েক পর আমার খালু মারা যান। উনি অত্যন্ত সুদর্শন এবং প্রাণবন্ত একজন মানুষ ছিলেন। তার বেঁচে থাকার আকুতিমাখা চোখ এখনও আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। আমার এই লেখাটি আমার প্রয়াত খালু সাইফুল ইসলামকে উৎসর্গ করছি।)


 

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu