রফিকুর রশীদ
জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর, মেহেরপুরে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষাজীবন শেষে ১৯৮৩ সালে সিলেটের এক চা বাগানের অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার হিসেবে শুরু হয় তার কর্মজীবন। মন টেকেনা চা বাগানে। যোগ দেন কলেজ শিক্ষকতায়। এখানো আছেন সেই পেশাতেই, মেহেরপুরের গাংনী কলেজে। একান্ত নিভৃতে কাব্যচর্চা দিয়ে লেখালেখির সূত্রপাত হলেও সত্তর দশকের শেষভাগে পত্রপত্রিকায় গল্প লিখেই আত্মপ্রকাশ সাহিত্যজগতে।
রফিকুর রশীদ

খোঁয়ারি

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

কথিত ক্রসফায়ারে স্বপন নিহত হবার তিন দিন পর মনি পাগলিও মারা গেল। মারা গেল মানে বিবিসি বাজারের পাকুড়তলায় তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল। পাকুড় গাছের শেকড় বাকড়ের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবেই কবে কবে একটুখানি খোঁড়ল তৈরি হয়েছে, প্রাচীন গুহার মতো সেই খোঁড়লের মধ্যে সে ঘুমানোর মতো করে মরে পড়ে আছে, বাম দিকে মাথা হেলিয়ে কাৎ হয়ে শোয়া। মুখ দিয়ে গাড়িয়ে পড়েছে খানিক রক্ত। রক্ত, নাকি পানের পিক? অনেকক্ষণ মাটিতে পড়ে থেকে কালচে হয়ে গেছে সেই পানের পিক অথবা রক্তের দলা। মনি পাগলি কখন মরেছে কে জানে!

কিন্তু এই দুই মৃত্যুকে এক সূত্রে জড়িয়ে কথা উঠছে কেন?

স্বপন নিহত হবার পর এই বিবিসি বাজার একেবারে থমথমে হয়ে যায়। এমনিতেই এটা বাজার হয়ে ওঠার মত কোনো জায়গাই নয় আদৌ। মীরপুর গাংনী এবং আলমডাঙ্গা এই তিন থানার সীমানা এসে মিলেছে এই মোড়ে। তিন থানা চলে তিন জেলার নিয়ন্ত্রণে— পূর্বে কুষ্টিয়া, পশ্চিমে মেহেরপুর, দক্ষিণে চুয়াডাঙ্গা। একদা এক থাকলেও এখন পৃথক তিন জেলা। তিন জেলারই যেন বা শাসনের বাইরে এই জিরো পয়েন্ট। এক সময় আশেপাশে কোন লোকালয় ছিল না, তবু যে কী দুঃসাহসে জংলিছাপা কাপড়ের ঝোলার মধ্যে তিন ব্যান্ডের ফিলিপস রেডিও ঝুলিয়ে নিবারণ দাস এই মোড়ে এসে ঢপ্ দোকান খুলে বসেছিল— কে জানে! গানবাজনা যা হলো তাই হলো, সকাল সন্ধ্যায় বিবিসির খবর শোনাই মুখ্য। ঊনসত্তর-সত্তরের সেই উদ্দাম দিনের কথা। মানুষ তখন খবর গিলে খায়। লালটুপির মিছিল করে এসে নিবারণের দোকানের টোপা বিস্কুট খায়, ঢক ঢক করে পানি খায়, গরম পানিতে চায়ের লিকার খায় এবং সন্ধ্যের পর রাজ্যের খবর গিলে খায়। বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, রেডিও পিকিং— কী নয়? খবর হলেই হলো। আবার ঢাকা বেতার থেকে যে-রাতে জসীমউদ্দীনের মধুমালা কিংবা বেদের মেয়ে প্রচার করে, সে দিন নারী পুরুষ শিশু বৃদ্ধ সব রকম শ্রোতায় ভরে যায় এই মোড়। তখনও ঘরে ঘরে রেডিও ঢোকেনি। তাই নিবারণের রেডিওর এত কদর। দেখতে দেখতে আরো দুচারটে দোকান বসলে জায়গাটার নাম হয়ে যায় বিবিসি বাজার। মুক্তিযুদ্ধের সময় সারা দেশ যখন ত্রাসে কাঁপছে, হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে বাড়িঘর ছেড়ে পালাচ্ছে, নিবারণ তখনও নির্বিকার। নিবারণের বাবা-কাকা সবাই বর্ডার টপকে চলে গেল ইন্ডিয়ায়, নিবারণের তাতে কিছুই যায় আসে না। তার যুক্তি পরিষ্কার— দুর্গম কাদা-পাঁক ভেঙে আর্মি আসবে কী করে? অতোই সোজা! খুব গর্ব করে আবার কাব্যচরণও সে আওড়াতো— ‘বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি, বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।’ দেশের মধ্যে সেই দুঃসময়ে গেরিলাদের জন্যে দুর্জয় ঘাঁটিই হয়ে উঠেছিল বটে নিবারণের দোকান। আশ্রয়, খাদ্য, তথ্য, সব কিছুর সেন্টার। যুদ্ধের একেবারে শেষাশেষিতে এসে দুর্বৃত্তরা ঠিকই একদিন হানা দেয় সেই দুর্জয় ঘাঁটিতে। নিবারণকে হত্যা করে। বিবিসি শোনার রেডিও ভেঙেচুরে মাটিতে মিশিয়ে দেয়। পুরো বাজার পুড়ে ছাই। তবুও বিবিসি বাজার নামটা থেকেই যায়। বিবিসি বাজারে ধ্বংসযজ্ঞের দিন আশ-পাশের বেশ কয়েকটি গ্রামও আক্রান্ত হয়। গেরিলা নিধনের নামে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়। নির্যাতিত হয় বেশ কয়েকজন নারী। কিন্তু রাত পোহাতে না পোহাতে সে লজ্জ্বা তারা ঢেকে ফেলে। ঢাকা পড়ে না হাশেম মাস্টারের মেয়ে হানুফার লজ্জ্বা। রাত পোহালেই তার বিয়ের দিন। যুদ্ধের দামামার মধ্যে বিয়ে দিতে চায়নি হাশেম মাস্টার। পাত্রপক্ষের পীড়াপীড়িতেই রাজি হওয়া। তারা পাকিস্তানের পক্ষের মানুষ. সাহস আর আত্মবিশ্বাসে তাদের বুক ভরা, যুদ্ধের অজুহাতও তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়— গন্ডগোল থেমে গেল বলে। সপ্তম নৌবহর আসতে দেরি নেই। হানুফার মা অবশ্য বিয়েতে মত দেয় অন্য কারণে। যে কোনো মুহূর্তে বেইজ্জতী হবার আশংকা থেকে মুক্তি পাবার প্রত্যাশায় সে স্বামীকেও সম্মত করায়। যেন বা বিয়ে হলেই মেয়ের উজ্জত নিরাপদ হয়ে যাবে। কিন্তু শেষরক্ষা আর হলো কই! বিয়ের আগের দিনই দুর্বৃত্তরা তাকে তুলে নিয়ে যায় মেহেরপুর ক্যাম্পে। দেশের বিজয় অর্জিত হলে পেটের জমিনে পবিত্র বীজ নিয়ে বিধ্বস্ত শরীরে হানুফা যখন ফিরে আসে তখন গ্রামের কেউ কেউ তাকে চিনতে পারলেও বাড়ির লোকেরা যেন বা চিনতেই চায় না। তারপর কী হয় তার? ঘরে ঘরে তখন বিজয়ের উল্লাস। কে রাখে হানুফার খোঁজ! গৃহপালিত পশুপাখি আশ্রয়চ্যুত হলে কি পাগল হয়ে যায়? তাহলে মানুষ কেন পাগল হবে? অথচ হাশেম মাস্টার নিজে মুখে জানিয়ে দেয়— হানুফার মাথার ঠিক নেই, রাতের আঁধারে ঘর ছেড়ে পালিয়েছে, নির্ঘাৎ পাগল হয়ে গেছে।

বিস্মৃতিপ্রবণ মানুষজন বহু বছর পর এই বিবিসি বাজারে মনি পাগলিকে দেখে হঠাৎ চমকে ওঠে। চোখ গোল গোল করে তাকায় কেউ কেউ। একটু পুরানো, একটু বয়সী মানুষেরা তো নিজেদের চোখ রগড়ে মনি পাগলিকে জিগ্যেস করেই বসে— কে গো তুমি? মুখের আড়া খুব চেনা চেনা লাগে যে! যাকে ঘিরে এত কৌতূহল তার কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। সে হি-হি করে হাসে। মাথা ভর্তি রুক্ষ চুলের ভেতরে চিমটি দিয়ে উকুন তুলে আনে, নখের ডগায় চিড়ে চ্যাপ্টা করে টিপে মারে, তারপর আঙুলের দাগ গুনে হিসেব করে… একাত্তর…বাহাত্তর। উকুন গোনে নাকি আর কিছু— কে বলবে সেই কথা! তবে প্রায়ই তার উকুনের গননা শুরু হয় একাত্তর থেকে। মধ্যবয়সী এক মহিলা। ভাঙাচোরা শরীর। চেহারা থেকে লাবণ্যের সব বাতিই প্রায় নিভে গেছে, তবু কোথায় যেন পড়ন্ত বেলায় একটুখানি দীপ্তি তখনো লেগে আছে। সে যে কোত্থেকে এলো, এখানে কী কাজ তার— কিছুই বলে না  কাউকে। নিজের নামটাও বলে না সে। উল্টো প্রশ্ন করে, নাম শুনে কী করবা মনি? এই এক মুদ্রাদোষ তার— ছেলেবুড়ো সবাইকে সে মনি বলে। আসল নাম খুঁজে না পেয়ে, মানুষজন তাকে মনি পাগলি বলে ডাকে। এই ধারার নামকরণে তার আপত্তি আছে বলেও মনে হয় না। ডাকলে সাড়া দেয়। আসলে পাগলি বলতে যেমনটি বুঝায়, সে মোটেই সে রকম নয়। পরনের কাপড় খুলে কখনো উলঙ্গও হয় না, কারো কোনো কথায় ক্ষেপেও যায় না, বিশেষ অসংলগ্ন আচরণও করে না। তবু তার আদি অন্ত উদ্ধার না করে মানুষ স্বস্তি পায় না বলে অত্যুৎসাহী কয়েকজন তাকে ঠেলতে ঠেলতে গ্রামের মধ্যে নিয়ে যায়, মনের কোনে উকি দেওয়া সংশয় নিরসনের জন্যে হাশেম মাস্টারের বৃদ্ধা স্ত্রীর সামনে হাজির করে। কিন্তু ফলাফল দুর্বোধ্যই থেকে যায়। বৃদ্ধা মুখে আঁচল টেনে ফ্যাঁচ করে কেঁদে ওঠে বটে, তবু ওই অশ্রুপাত দিয়ে কিছুই স্পষ্ট হয় না। হাশেম মাস্টার এই পাগলিকে দেখে শনাক্ত করতে পারত কিনা তাও আর জানার উপায় নেই, গত বছর সে চলে গেছে পরপারে। এই বাড়িঘর, গৃহকর্ত্রী, বাড়ির অন্যান্য সদস্য— কাউকে দেখেই মনি পাগলির কোন ভাবান্তর দেখা যায় না। ফলে এক প্রকার হতাশ হয়েই যে যার গন্তব্যে চলে যায়। মনি পাগলিও এ বাড়ি দুদিন ও বাড়ি দুদিন কাটিয়ে ফিরে আসে বিবিসি বাজারে।

বিবিসি বাজারে তখন পার্টির ছেলেদের দুর্দান্ত প্রতাপ। অবশ্য এই প্রভাব প্রতাপ নতুন কিছু নয়। তিন থানার মিলনস্থল হওয়ায় স্বাধীনতার পর থেকেই নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির একটা গ্রুপ এখানে বসে বন্দুকের নলে তেল মাখাতে থাকে। এরা আবার বাংলাদেশকেই স্বীকার করে না। অস্ত্রের গরমে যখন তখন তড়পায় আর শ্রেণী-শত্রু খতম করে বেড়ায়। রক্ষীবাহিনীর লালঘোড়া এতদূর দাবড়াতে আসে না বটে, ওদেরই দুই গ্রুপের বন্দুক যুদ্ধে এক গ্রুপ নিঃশেষ হয়ে যায়। তবে সমূলে নিঃশেষ হয় না। গাছের কচি ডগার মত ছেঁটে দিলেই নতুন কুশি বেরোয়। সামরিক সরকারের বরকন্দাজ হয়ে ভাড়া খাটে, এদিকে মুখে সাম্যবাদের কথা বলে ফেনা তুলে ফেলে। মোহাম্মদ নাসিম ফেলেছিল বটে একজাল, বেশ গুছিয়েও এনেছিল, কিন্তু সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে আবার সব— ছাড়া ঘোড়া ময়দানে খাড়া। এখন এ ময়দানের নেতৃত্ব হাতকাটা স্বপনের। এক হাত তার কাটা বটে, কিন্তু অন্য হাত তার বিশাল লম্বা, বহুদূর বিস্তৃত। চওড়া তার বুকের পাটা। কী সরকারি আর কী বিরোধীদলের নেতা, সবাই স্বপনবাহিনীকে হাতে রাখতে চায়। শোনা যায়— এমপি সাহেবের সঙ্গেও তার গোপন সমঝোতা আছে। গত নির্বাচনের আগে হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে স্বপনবাহিনীর সদস্যরা যে শীতল সন্ত্রাস চালিয়েছে, বর্তমান এমপি তারই সুফল পেয়েছে। এলাকায় এমন অনেক ঘটনাই স্বপনবাহিনীর নামে সংঘটিত হয়, যা হয়তো শুরুতে জানেই না স্বপন। বিবিসি বাজার কেন্দ্রিক সশস্ত্র পার্টির উপস্থিতির কথা গত তিরিশ বত্রিশ বছরে মোটামুটি তা সবাই জানে। ব্যাপারটা ওপেন সিক্রেটের মতো। জানে, কিন্তু কেউ তাদের ঘাটাতে চায় না। এর মধ্যে কখন সর্বহারা আসে, কখন ইপিসিপি, কখন গণবাহিনী, কিংবা কখন যে নেতৃত্বের রদবদল হয়ে সিরাজের হাত থেকে কানা বাদলের হাতে আসে, অথবা আত্মঘাতী সংঘর্ষে সেই বাদল খতম হলে যে কোথা থেকে কীভাবে লাল্টুর অভ্যুদয় ঘটে, আবার তারই ধারাবাহিকতায় কখন কীভাবে এ নিষিদ্ধ সাম্রাজ্যে যুবরাজ স্বপনের অভিষেক ঘটে— এত গভীর খোঁজ খবর সাধারণ মানুষ রাখে না। পার্টির ছেলেরা অতি সাধারণ হয়ে তাদের সঙ্গে মিশে থাকে বটে, তবু এক অনতিক্রম্য দূরত্ব ঠিকই থেকে যায়। বিবিসি বাজারের সবাই দেখতে পায়— অদৃশ্য এই দূরত্বের পাঁচিল অবলীলায় টপকে যায় মনি পাগলি। প্রায় প্রকাশ্যেই সে এসে জাপটে ধরে স্বপনকে, সারা মুখে হাত বুলায়, আকুল হয়ে জানতে চায়— অ মনি, কিছু খাওনি? মুখ ক্যান শুকনা?

আকুলতা দেখে মনে হয়, স্বপনের শুকনো মুখ দেখে তার বুক ফেটে যাচ্ছে, এক্ষুণি সে বুঝি ভাত তরকারির থালা এগিয়ে সামনে ধরবে। নিজেরই নেই চালচুলো ঠিক, সে কোথায় পাবে ভাতের থালা?

সব চেয়ে অবাক কান্ড, এত যে দাপুটে স্বপন, কোনোদিন কখনো সে মনি পাগলির উপরে বিরক্ত হয় না। কোনো প্রতিবাদ করে না। কী যে জাদুর কাঠি বুলিয়ে দেয় পাগলি, স্বপন তখন পোষমানা সিংহশাবক হয়ে যায় যেনবা। নীরবেই স্নেহসুধা পান করে। একদিন তো প্রকাশ্যে জনসমক্ষে সে ছুটে এসে স্বপনের গালে কপালে অসংখ্য চুম্বন রেখা এঁকে দেয়। বাস্তবিকই পানের দাগে ভরে যায় মুখমন্ডল।

কেবল সেই দিনই স্বপন একটু বিরক্তি প্রকাশ করে— তুই এখন যা তো মা, আমার কাজ আছে।

মা?

যেন হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে একটুখানি চমকে ওঠে মনি পাগলি। বিস্ফরিত চোখে চেয়ে থাকে স্বপনের দিকে। মাতৃবয়স্কা এক মহিলাকে কথার টানে মা বলেছে, সেটাই স্বাভাবিক। এতে আবার কার কী প্রতিক্রিয়া হলো সে দিকে ভ্রুক্ষেপ করার সময় কোথায় স্বপনের! দলবল নিয়ে সে বসেছে মিটিঙে। জনযুদ্ধ গ্রুপের হায়দার ক্রমশ এগিয়ে আসছে, গোপন তথ্যে জানা গেছে— ঝিনাইদহ শৈলকূপা পেরিয়ে চুয়াডাঙ্গার মধ্যে ঢুকে পড়েছে, এখনই একটা সিদ্ধান্ত না নিলে নয়। এই টানটান উত্তেজনার মধ্যে কী বলতে সে কী যে বলেছে, ছিঁচকাঁদুনে বালিকার  মতো সেই কথায় অভিমান করলে চলে? অথচ স্বপনের মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনি পাগলি সত্যি এক সময় ছোট মানুষের মতো কেঁদে ওঠে। তারপর আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে চলে যায় পাকুড়গাছের গুহাগৃহে।

বটপাকুড়ের গাছ ছায়াপ্রদায়ী শাখা প্রশাখা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে শেকড়প্রতিম ঝুরি নামিয়েছে বটে, কিন্তু কখন যে বুকের মধ্যে এমন গুহাসদৃশ খোঁড়ল তৈরি করে রেখেছে, তা আবার বিশেষ কারো নজরে পড়েনি। দু’চারজন ছেলে-ছোকরা সেই খোঁড়লে বসে গাঁজা তামাক টানে, কিন্তু মনি পাগলি এসে সেইখানে ঘরকন্না পেতে বসলে তারা উম্মুল হয়ে পড়ে। তখন পাগলিকেই তারা নানাভাবে জ্বালাতন করে। এমন কি কুৎসিত ইশারা ইঙ্গিত পর্যন্ত করতেও বাধে না তাদের। অথচ স্বপনের একদিনের ধমকেই সবকটা শেয়াল লেজ গুটিয়ে পালায়। মনি পাগলি যে সারাদিন রাত ওই খোঁড়লশয্যায় শুয়ে বসে কাটায় এমনও নয়। ইচ্ছে হলেই পাখির মতো উড়াল দেয়। কোথায় যায়, কোথায় খায়, কী করে, কোথায় বা থাকে, কে তার খবর রাখে! দু’চারদিন কিংবা বড়জোর এক সপ্তাহর মধ্যে সে ঘুরে আসবেই বিবিসি বাজারে। আবার স্বপনের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে, হেসে উঠবে। কিংবা আঁচলে চোখ মুছে বলবে— কেমন আছ মনি? এমনি বিচিত্র ছকে সাজানো তার জীবন যাপন। তার সমুদয় আচরণের মধ্যে সর্বদা কার্যকারণ সম্পর্ক খুঁজলে মেলানো মুশকিল হবে। তার হাসি এবং কান্নার যুক্তি মোলানো যেমন ভার তেমনি অন্য সব আচরণেরও যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত কঠিন।

এই তো মাসখানেক আগে একদিন কোত্থেকে যেন ছুটটে ছুটতে এসে স্বপনের কোলের উপর থেকে এসএমজিটা তুলে নিয়ে দৌড়ে চলে গেল মাঠের ভেতর। চৈত্রের খাঁ খাঁ দুপুর। বিবিসি বাজারে তখন বিশেষ লোকজন নেই। যারা আছে তারা অবাক হয়ে মনি পাগলির কান্ড দ্যাখে, কেউ বলে— ধর ধর, পাগলিকে ধর। বলে বটে, দুচারজন পিছে ছুটে যায়ও, কিন্তু পাগলিকে কেউ আটকে ধরে না। এদিকে স্বপন তো হেসেই খুন। এ কী একটা হাসির ঘটনা হলো! স্বপনের সব চেয়ে প্রিয় অস্ত্র। কখনো বেহাত করে না। কারো হাতে ছাড়ে না। শিষ্য সাগরেদরা মুখের দিকে তাকায়। কোনো ইশারা ইঙ্গিত পায় না। কী করবে তারা? না, স্বপন কাউকে কোনো আদেশ নির্দেশ দেয় না, অস্ত্র উদ্ধারে তৎপরও হয় না, হাসতে হাসতে একবার কেবল বলে ওঠে— পাগলি কোথাকার! অথচ পাগলির কান্ড দ্যাখো— দৌড়াতে দৌড়াতে সে গেল মাঠের মাঝখানে যেখানে এক গর্ত আছে সেইখানে। গর্তে পানি নেই। আছে আকুন্দ-ভাটের ঝোপ জঙ্গল। সেই জঙ্গলের মধ্যে অবলীলায় বিসর্জন দেয় স্বপনের মহামূল্য অস্ত্রটি। তারপর অবার ছুটতে ছুটতে ফিরে এসে স্বপনের সামনে হাত উল্টিয়ে ঘোষণা করে— নাই। নাই মানে? দু’হাত উল্টিয়ে বারবার জানায়, নাই নাই। যেনবা খেলতে খেলতে কোনো এক শিশু খেলনা লুকিয়ে রেখে খেলার সঙ্গীকেই বিভ্রান্ত করে— নাই-নাই।

খানিক পরেই মোটরসাইকেল ভটভটিয়ে পাকুড়তলায় এসে দাঁড়ায় গাংনী থানার মেজো দারোগা, তার পেছনে চওড়া গোঁফঅলা এক সেপাই। এখানে কী কাজ তাদের, কে জানে! বাজার চলতি দু’চারজন মানুষ মনে করে— আগাম পুলিশের গন্ধ পেয়েই হয়তো মনি পাগলি এভাবে ত্রস্ত হাতে স্বপনের অস্ত্র সরিয়ে ফেলেছে। কিন্তু সে কি জানে না— তিন দিগরের তিন থানার পুলিশের সঙ্গেই বিবিসি বাজারের সশস্ত্র বাহিনীর অলিখিত এক অনাক্রমণ চুক্তি আছে! সে চুক্তি তো আজকের নয়, তিন দশকেরও অধিক সময় ধরে এমনটিই হয়ে আসছে। থানার পুলিশ বদলায়, এদিকে এই গুপ্তবাহিনীরও নেতৃত্ব বদলায়, তবু ওই চুক্তি আর বাতিল হয় না। এমন কি আনুষ্ঠানিকভাবে নবায়নেরও প্রয়োজন হয় না। কাজের মধ্যেই পরিচয়। এই দুর্গম গ্রামাঞ্চলে দুর্ধর্ষ আসামি ধরতে হলে থানা পুলিশকে এই বাহিনীর উপরে নির্ভর করতে হয়। গায়ে সরকারি পোশাক জড়িয়ে ত্যাঁদড়ামি করতে গেলে তার ট্রিটমেন্টও আছে। সরকারি অস্ত্রসহ দুচারটি পুলিশ সাবড়ে হজম করা কোনো ব্যাপারই না। চুয়াত্তর পঁচাত্তর সালে তো সরকারি অস্ত্র আর ওদের খাকি পোশাক নিয়ে এই বিবিসি বাজারে রীতিমতো উৎসব হয়েছে, আকাশে গুলি ফুটিয়ে তোপধ্বনিও দেয়া হয়েছে। তারা কেন অদৃশ্য এই চুক্তি ভাঙতে যাবে? তাদের স্বার্থে তো কোনদিন ঘা দেয়নি। না, মেজো দারোগা মোটরসাইকেল থেকে নামেই না। সেপাইটা গিয়ে ভিসিআর-মিন্টুর কানে কানে কী যেন বলে এবং বাম হাতে বখশিস নিয়ে চলে যায়।

এই ঘটনার পর হঠাৎ একদিন যৌথবাহিনী এসে বিবিসি বাজার ঘিরে ফ্যালে। দ্রুত হাতে শুরু করে চিরুনি অভিযান। স্বপন যখন বুঝতে পারে তাকে আটকের জন্যেই এই আয়োজন, তখন আর মোটেই দেরি করে না সে। একটি গুলিরও অপচয় না ঘটিয়ে সে সারেন্ডারের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফ্যালে। এর আগে অপারেশন ক্লিনহার্টের সময় বহু হার্ট এ্যাটাকের ঘটনা ঘটেছে, সম্প্রতি শুরু হয়েছে ক্রসফায়ারের পালা। না, এ নাটকে সে নামতে চায় না। পকেট থেকে মোবাইল বের করে ক্ষিপ্রভঙ্গিতে পরিচিত বোতাম টিপে কানে ধরে। কান থেকে নামিয়ে আবার বোতাম টেপে। আবার। আবার। এতক্ষণে খেয়াল করে মনিটরে উদ্ভাসিত লেখা— নো নেটওয়ার্ক। ক্ষোভে দুঃখে ছুঁড়ে ফেলে দেয় মোবাইল সেট। মাথার উপরে দু’হাত তুলে এগিয়ে আসে। নিজে থেকেই ঘোষণা দেয়— আমিই স্বপন। হাতকাটা স্বপন।

স্বপনকে এ্যারেষ্ট করে কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে ফ্যালে। ওদের গাড়িতে তোলে। গ্রাম্য রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে দৈত্যের মত গোঁ গোঁ করতে করতে ওরা চলে যায়।

পরদিন নাটকের পূর্ব নির্ধারিত দৃশ্যটি ঠিকই মঞ্চস্থ হয়। বিচার-বিহীন ক্রসফায়ার হত্যা তালিকায় আরও একটি নাম যুক্ত হয়— দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের নিষিদ্ধ ঘোষিত পার্টির আঞ্চলিক নেতা, কুখ্যাত সন্ত্রাসী, ; দশ মামলার পলাতক আসামি স্বপন ওরফে হাতকাটা স্বপন। সেই অস্ত্র উদ্ধারের কেচ্ছা, সেই ক্রসফায়ারের গল্প, সেই একই প্রতিভাহীন বালক রচিত কাহিনীর পুনরাবৃত্তি।

এত বড় এক ঘটনা ঘটে গেল, অথচ মনি পাগলি এ সবের কিছুই টের পেল না। এ দুদিন যে সে কোথায় ছিল-কে জানে! সেখানে কি এই ক্রসফায়ার কেচ্ছার এতটুকু ঝলকানি পৌঁছেনি? স্বপনের মৃত্যুর ঠিক তিনদিন পর সে ফিরে আসে। বিবিসি বাজার তখন থমথমে। জনসমাগম নেই বললেই চলে। যারা আছে তারাও মুখ টিপে ঠারে ঠারে কথা সারে। খরা-দগ্ধ বিরান মাঠের মধ্যে দিয়ে অত্যন্ত শ্লথ পায়ে হেঁটে আসে মনি পাগলি। স্পন্দনহীন বিবিসি বাজারে এসে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করে না সে। বাজারের কেউ যেচে তার সঙ্গে কথা বলে না। কেউ সাম্প্রতিকতম এই ক্রসফায়ার কেচ্ছাটিও তাকে শোনায় না। তবু দিনের শেষে ঘুরতে ঘুরতে ভিসিআর মিন্টুর দোকানের সামনে এসে হঠাৎ সে আর্তনাদ করে ওঠে— মনি কই, আমার মনি?

কে দেবে জবাব এই প্রশ্নের? যারা এই আর্তনাদ শুনতে পায় তারা পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। যথার্থ জবাবটি খুঁজে পায় না। পাগলিকে কী জবাব দেবে! মনে হয় পাগলিরও জবাবের খুব প্রয়োজন নেই। সে হি-হি করে হাসতে থাকে। কী যে হাসির খোরাক পায়, এ হাসি তার থামতেই চায় না। আর সে কী বিশ্রী সেই হাসি! হাসিও যে এমন কুৎসিত, কদর্য হয়, নির্মম, ভয়ঙ্কর হয়— সেদিন মনি পাগলির সেই শরীর হিম করা হাসি না শুনলে কেউ বুঝতেও পারবে না, বিশ্বাসও করতে পারবে না। অতপর এই সুন্দর হিম শীতল হাসিটি মুখে নিয়েই মনি পাগলি তার গুহাগৃহে মরে পড়ে থাকে। তার মৃত্যু স্বাভাবিক নাকি অস্বাভাবিকতার বৃন্তে ঝুলন্ত মাকাল ফল— এ এক অপরীক্ষিত প্রশ্ন হয়েই থেকে যায়।

বিবিসি বাজার এবং সন্নিহিত গ্রামগুলোর মানুষজন এই দুই মৃত্যুর মধ্যে যেমন যোগসূত্র আবিষ্কারে তৎপর হয়, তেমনি এই দু’টি জীবনের মধ্যেও ঘনিষ্ট কোনো সম্পর্ক আরোপের স্বপক্ষে সম্ভাব্য যুক্তিসমূহ খুঁজে পেতে যুক্তি দাঁড় করাতে সচেষ্ট হয়। স্মরণ করতে চেষ্টা করে— দুজনের মধ্যে কে আগে এসেছিল এই বিবিসি বাজারে? সে কতদিন আগের কথা। মানুষ কি তখন সভ্য হয়েছিল?


 

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu