উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় গত কয়েক দিন ধরে ঢাকার একটি কর্মজীবী হোস্টেলে অবস্থান করছেন সফিক আহমেদ। যে আশার বীজ বুনে ঢাকায় এসেছেন সেটি ক্রমেই নিভে যাওয়ার উপক্রম এখন তিনি বুঝতে পারেন। তবুও অপেক্ষা করছেন শেষ পর্যন্ত কী হয় তা দেখবার জন্যে। এসেছেন উত্তরের চায়ের শহর পঞ্চগড় থেকে। অবশ্য তিনি শহরের মানুষ নন। বাস করেন শহর থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত নিজ গ্রাম বিলাসপুরে। পরিসংখ্যান কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন পঞ্চগড় সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসে। ভার্সিটির পাঠ সম্পন্ন করবার অল্প সময়ের মধ্যেই চাকরি পেয়েছিলেন। নিজ গ্রামে অবস্থানের প্রবল অভিপ্রায় থেকে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অন্য কোনো চাকরিতে আবেদন করেননি। আট বছর যাবৎ উপজেলাতেই কর্মরত আছেন। সততার সাথে সেবা প্রদানের মাধ্যমে উপজেলায় অনেকের প্রিয়ভাজন ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। বয়স চৌত্রিশ পেরিয়ে গেলেও বিয়ে করা হয়ে ওঠেনি এখনও। সংসারে রয়েছেন মা এবং ছোট বোন। মায়ের বয়স ষাট পেরিয়েছে। ছোট বোন পড়াশুনা করছে হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুরে। বাবার রেখে যাওয়া সামান্য সম্পত্তির পরিমাণ আরও স্ফীত হয়েছে তার প্রজ্ঞাপূর্ণ নিবিড় তত্ত্বাবধানে। মাছ, মাংস, শাক সবজি জাতীয় প্রতিটি দ্রব্যের যোগান আসে নিজস্ব ক্ষেত খামার থেকে।
শৈশব থেকে বেড়ে ওঠা পরিশীলতার ছাপটি ধরে রেখেছেন এখনও। শারীরিক অবয়ব দর্শনে তার কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। স্বাভাবিকতার তুলনায় ওজন কিছুটা বেশি। উচ্চতা কম হওয়ায় তুলনামূলকভাবে অতিরিক্ত স্থুলকায় মনে হয়। মাথাভর্তি চুল, ঘন কালো গোঁফ এবং সমৃদ্ধ ফর্সা মুখমণ্ডলে সুদৃশ্য কালো ফ্রেমের চশমা পরেন সবসময়। ইস্ত্রি করা শার্ট, প্যান্ট এবং জুতো পরিধান করে যখন মোটর সাইকেলে অফিসের দিকে যাত্রা করেন তখন কমবেশি অনেকেই তার দিকে মুগ্ধতা ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকেন। তাকিয়ে থাকবার নেপথ্যে অবশ্য যথেষ্ট কারণ রয়েছে। গ্রামের কারো কোনো সমস্যা হলে ত্রাতা হিসেবে সবার আগে তাকেই পাওয়া যায়। বিশেষত শিক্ষা এবং সামাজিক প্রতিবন্ধকতা বিষয়ক সমস্যাগুলোয়। কিছু দিন আগেও গ্রামের এক শিক্ষার্থী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে অধ্যয়নের সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু আর্থিক দীনতার কারণে তার বাবা ভর্তি করাতে মোটেও রাজি ছিলেন না। পড়াতে চেয়েছিলেন পঞ্চগড় সরকারি কলেজে। অনেক কষ্টে বাবাকে বোঝানোর পর নিজেই ব্যয় নির্বাহ করে সেই মেয়েটিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, ভর্তির পর বিশ্ববিদ্যালয় হলে অবস্থানের ব্যবস্থা করবার পাশাপাশি টিউশনিরও ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। গ্রামে আসবার পর থেকেই দিনের পর দিন এমন অজস্র উদাহরণ সৃষ্টি করে গ্রামের প্রায় প্রতিটি মানুষের শ্রদ্ধাপূর্ণ আস্থা অর্জন করে চলেছেন সফিক। অবশ্য তিনি তার এই ইতিবাচক প্রয়াসটির চর্চা করে আসছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন সময় থেকেই। পড়াশুনার পাশাপাশি শীতার্তদের শীতবস্ত্র প্রদান করা, বন্যাদূর্গতদের সাহায্য করা, রক্তদান এবং সংগ্রহ করাসহ সংশ্লিষ্ট কাজে ব্যাপৃত থাকতে খুবই সন্তুষ্টি বোধ করতেন তিনি।
ঘড়ির কাঁটা সাত সংখ্যাটিকে ছাড়িয়ে গেছে। বিছানায় শুয়েই ছিলেন সফিক, এক প্রচ্ছন্ন ইতিবাচক ভাবনায় নিজেকে আবৃত রাখবার মাধ্যমে। পলাশীতে অবস্থিত কর্মচারী হোস্টেলের একটি কক্ষে অবস্থান করছেন। কক্ষটির পরিধি অত্যন্ত সংকীর্ণ। এই ছোট্ট পরিধির মাঝেই গাদাগাদি করে বসানো রয়েছে দুটো বিছানা। আয়তনে বিছানা দুটো অত্যন্ত ক্ষুদ্র। কোনোরকমে একজন মানুষ শুতে পারবেন। তবে খুব বেশি লম্বা হলে সেই মানুষটিকে অবশ্যই দু’পা ভাজ করে রাখতে হবে। দুটো বিছানার একটি ফাঁকাই রয়ে গেছে। অন্যটিতে আছেন সফিক। প্রতিদিনের মতো আজকেও একটু পরেই উঠতে হবে তাকে। যেতে হবে আগারগাঁয়ে। অবশ্যই দশটার মধ্যে। কর্মরত অফিসের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। পলাশী থেকে আগারগাঁয়ের দূরত্বটি অনুমান করলে সহজেই উপলব্ধি করা যায়– কত সময় লাগতে পারে। আর যানজটে পড়লে সেই সময়টি যে বৃদ্ধি পাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সেই বিষয়টিকে বিবেচনায় নিয়ে যানজটের বিভীষিকাময় তীব্রতা এড়াতে প্রতিদিন সকাল সাতটাতেই যাত্রা শুরু করেন সফিক। আজও নাস্তা সেরে তাই করলেন। চাকরির বয়স আট পেরিয়েছে গত ডিসেম্বরে। এ বছরের ডিসেম্বর প্রায় নাকের ডগায়। কিন্তু সিলেকশন গ্রেডের গেজেট এখনও প্রকাশিত হয়নি, কবে নাগাদ হতে পারে সেটিও স্পষ্ট নয়। অথচ গ্রেড প্রাপ্তির সব শর্তই নির্দিষ্ট সময়ের আগেই পূরণ করেছেন সফিক। তাই কোনো উপায় না দেখে ঢাকায় আসা। ছুটি ছিল তিন দিনের। ইতোমধ্যে চার দিন পেরিয়ে গেছে। নিয়ত প্রত্যাশার প্রদীপটি নিজের অন্তর্মনে প্রদীপ্ত রেখে আসা-যাওয়া করছেন। কিন্তু চার দিনে তেমন কোনো শুভ ইঙ্গিত মেলেনি। সামনে আরও কতদিন যে অপেক্ষা করতে হবে তা অনুমান করতে পারছেন না।
যানজটের ছোট্ট বিভীষিকাময় অধ্যায়টুকু সম্পন্ন করে আজ সৌভাগ্যবশত দশটায় চলে আসলেন আগারগাঁয়ে। কিছুটা ক্লান্ত। স্ট্যান্ড থেকে সামান্য দূরত্বেই হেড অফিস। প্রচণ্ড ভীড়ের মধ্য দিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। অফিসের সামনে এসেই ব্যাগটা গুছিয়ে নিলেন। ভীড়ের মধ্যে ঠিকমতো কাঁধে রাখতে পারছিলেন না। মনে হচ্ছিল, ব্যাগটা না থাকলেই বোধহয় ভালো হতো। বিশাল বিল্ডিং। উদাস দৃষ্টি মেলে তাকালেন অফিসের সাইনবোর্ডটির দিকে। প্রাপ্তির প্রত্যাশায় এগিয়ে চললেন। ছন্দবদ্ধভাবে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকলেন। অফিসের সামনেই অনেক লোক সমাগম। অতি সন্তর্পণে ডিউটি অফিসারের কক্ষে প্রবেশ করতে পারলেন তিনি। প্রথম দিন শুধু অপেক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন, ডিউটি অফিসারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারেননি। দ্বিতীয় দিনে দেখা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। হয়ত অফিসের বাইরে অপেক্ষমান লোকগুলিরও একই অবস্থা। কক্ষটিতে প্রবেশের পরপরই ডিউটি অফিসারের স্বতস্ফূর্ততায় এক ধরনের প্রসন্নতা বোধ করলেন সফিক।
‘আসুন আসুন, বসুন। কেমন লাগছে হেড অফিসের পরিবেশ।’ সালাম দেয়ার সুযোগ না দিয়েই ডিউটি অফিসার হাতের ইশারায় বসতে বললেন। প্রথম দিকে ডিউটি অফিসারের গম্ভীর ভাব বেশ ভাবনায় ফেলেছিল সফিককে। তার সমস্যাটি নিয়ে শেষ পর্যন্ত আলোচনা করতে পারবেন কিনা এ নিয়েই দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন। চারদিনে অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে তার আচরণ। মোটা ফ্রেমের চশমা, উজ্জ্বল রঙের টি-শার্ট পরিহিত দীর্ঘদেহী ডিউটি অফিসারের হাসোজ্জ্বল প্রতিমূর্তি দেখে বোঝার উপায় নেই যে, তার অন্তর্মন জুড়ে এত জটিলতা। স্বভাবজ ভঙ্গিতে সফিকের জবাব–‘ভালোই তো যাচ্ছে, তবে আমার কাজটা হয়ে গেলে আরও ভালো যেত। দেখুন আজ চারদিন হচ্ছে ঢাকায় আছি, বোঝেনই তো থাকা খাওয়া, যাতায়াত, আনুষঙ্গিক ব্যয় নির্বাহ– এসব আমার কাছে এখন সহনশীলতার বাইরে চলে গেছে।’
‘তা বুঝতে পারছি, কিন্তু কেবলই তো যাওয়া আসা শুরু করলেন, কিছুদিন ঘোরাফেরা করুন, অফিসের ভাবটা বুঝবার চেষ্টা করুন। হয়ে যাবে। যা চান তাই হবে। আজকে আসুন।’ মোটা লোমশ হাত দুটি টেবিলের উপর রেখে আয়েশের ভঙ্গিতে উত্তর প্রদান করলেন ডিউটি অফিসার। পুনরায় হাসোজ্জ্বল ভঙ্গিতে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আর কিছু বলবার সুযোগ পেলেন না সফিক। চায়ের বেশিরভাগ অংশ পান না করেই চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। মেঘে ঢাকা আকাশে হঠাৎ করে আজ কিছুটা শুভ্র আলোর স্ফুরণ দেখা গেলেও তার স্থিতি খুব বেশি সময় স্থায়ী হলো না। বুঝতে পারলেন ডিউটি অফিসারের কাছ থেকে প্রাপ্ত স্বল্পায়ু আলোর দ্বারা বিশাল বিস্তীর্ণ মেঘের কালো আস্তরণ দূর করা মোটেই সম্ভব হবে না। কীভাবে সেই আলোর স্ফুরণ বৃদ্ধি করা যেতে পারে সেটিই ভাবনার মূল বিষয় হিসেবে প্রতীয়মান হতে থাকলো তার অন্তর্জগতজুড়ে।
এক ধরনের অস্বস্তি নিয়ে ধীরে ধীরে অফিস থেকে বের হলেন সফিক। মেঘমুক্ত নীল আকাশ, যানজটও সহনীয় পর্যায়ের, ব্যস্ততাও সকালের তুলনায় কিছুটা কম। আজকের জন্যে নিজেও এখন পুরোপুরি কর্মমুক্ত। সিদ্ধান্ত নিলেন হেঁটেই কিছুটা পথ এগুবেন। বেতার ভবন এবং কপিরাইট অফিস পেরিয়ে ফার্মগেট অভিমুখে এগিয়ে চললেন। রাস্তার দু’ধার বেশ পরিচ্ছন্ন। বা দিক থেকে প্রচণ্ড বেগে শুদ্ধ বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। অনবরত হেঁটেই চলেছেন তিনি। নির্মল বাতাসের কারণে হাঁটবার সময় বেশ প্রশান্তি অনুভব করছেন। ডিভাইডারের মাঝে রোপণকৃত সুদৃশ্য বৃক্ষরাজি সমৃদ্ধ করেছে ঢাকার সৌন্দর্য। এই মুহূর্তে কোনোভাবেই মনে হচ্ছে না যে– এটি ঢাকা শহর। কিছুটা পথ এগিয়ে এসে আবার ভীড়ের মধ্যে পড়ে গেলেন। হেঁটে হেঁটে সামনের দিকে এগুনো অসম্ভব বিরক্তিকর। তাছাড়া হাঁটাহাঁটিতে খুব একটা অভ্যস্ত নন তিনি। কোনোরকমে বাকি পথটুকু পাড়ি দিলেন। ফার্মগেট চক্ষু হাসপাতালের সামনে এসেই থমকে দাঁড়ালেন। হাঁপিয়ে পড়লেন প্রচণ্ডভাবে। সমস্ত শরীর ঘেমে একাকার হয়ে গেল। শার্টের উপরের বোতামটি খুলে ফেললেন। মাথা খানিকটা নিচু করে বুকের ভেজা খোলা অংশটুকু দেখে নিলেন। অনেক কষ্টে ধীর পায়ে হেঁটে এসে ফার্মগেট ওভারব্রিজের ঠিক পাশেই অবস্থিত বিশাল বৃক্ষটির ছায়ার নিচে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। লক্ষ্য– কিছুটা স্বস্তি প্রাপ্তির আকুলতা। পাশের রেস্টুরেন্ট থেকে আসা বিরিয়ানির সুঘ্রাণ তার ক্ষুধা নিবৃত্তির আগ্রহটিকে বাড়িয়ে দিলো। মনস্থ করলেন দুপুরের খাবারটা এখানেই খেয়ে নেবেন। যদিও এ ধরনের খাবারে মোটেও অভ্যস্ত নন তিনি। তাছাড়া টানা চারদিন রেস্টুরেন্টের খাবার খেয়ে অস্বস্তির চরম সীমায় এসে পৌঁছেছেন। বড় বেশি সমস্যায় না পড়লে রেস্টুরেন্টের খাবারে খুব একটা আগ্রহ বোধ করেন না তিনি। তবুও স্থির করলেন– খেয়ে নেবেন। খাবার অভিপ্রায় নিয়ে রেস্টুরেন্টের কাছাকাছি এলেন। আকারে ছোট রেস্টুরেন্টটির এক কোণার সিটে গিয়ে বসলেন। ছোট টেবিলের উপর দু’হাত রেখে বসে থাকলেন কিছুক্ষণ। ধূলিবালিযুক্ত ফ্যানের পাখা ধীর গতিতে ঘুরলেও কিছুটা প্রশান্তি বোধ করছেন এ কারণে যে, তিনি ঠিক ফ্যানের নিচেই বসেছেন। যদি আরো কিছুদিন থাকতে হয় তবে নিয়মিত রেস্টুরেন্টের খাবার গ্রহণ করা তার শরীরের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না। মনে মনে ভাবতে থাকলেন, উত্তরণের কোনো উপায় খুঁজে বের করা যায় কিনা। আত্মীয়ের বাসায় যেতে কখনই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না সফিক। এমনকি খুব ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের বাসাতেও বিশেষ প্রয়োজন না থাকলে যান না। রেস্টুরেন্টে বসেই ভদ্রতার খাতিরে এক কাপ চা খেয়ে সেখান থেকে বিদায় নিলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন রওয়ানা হবেন গুলিস্তানের এক আত্মীয়ের বাসায়। অতীতে অনেকবারই সেই আত্মীয় তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু স্বভাবজ প্রবৃত্তির কারণে কখনই সেখানে যাওয়া হয়নি। ঘড়ির দিকে তাকালেন। হাতে এখনও যথেষ্ট সময় রয়েছে। ন্যূনপক্ষে তিনটে পর্যন্ত সময়কালকে বাসা বাড়ীতে দুপুরের খাবার সময় হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। গুলিস্তানের বাসে উঠবার জন্যে দ্রুত ওভারব্রিজ পেরিয়ে রাস্তার অপর প্রান্তে আসলেন।
অসংখ্য যাত্রীর সাথে নিজেও দাঁড়িয়ে রইলেন। অপেক্ষা করতে থাকলেন বেশ কিছুটা সময়। চতুর্দিক থেকে আসা অনবরত গাড়ীর শব্দে কিছুটা বিচলিত হলেন। অতঃপর গুলিস্তানের বাসে উঠে বসলেন। কারওয়ান বাজার পর্যন্ত স্বাচ্ছন্দ্যেই আসলেন। শাহবাগে এসে একটু জ্যাম থাকলেও সেটিকেও উত্তীর্ণ করে স্বল্প সময়ের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের সামনে চলে এলেন। সূর্য ঠিক মধ্যগগনে। প্রচণ্ড খরতাপের মধ্যে বাস থেকে নামলেন। ব্যাগ থেকে নীল রঙের ছোট্ট ছাতাটি বের করলেন। ছাতা মেলে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রাস্তার পাশেই কনফেকশনারি এবং মিষ্টির দোকানগুলি গভীর মনোযোগের সাথে পর্যবেক্ষণ করতে থাকলেন। প্রায় পঞ্চাশ মিটার দূরত্বের একটি বৃহৎ মিষ্টির দোকানের দিকে এগিয়ে গেলেন। এক কেজি মিষ্টি কিনবার পর সামান্য দ্বিধা নিয়ে কিছু আপেলও কিনলেন। অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা পূর্বের তুলনায় অনেকটাই হ্রাসপ্রাপ্ত হলেও এখনও বেশ হিসেবি তিনি। অযথা পয়সা খরচ করা তার স্বভাব বিরুদ্ধ। তবুও অনেক ভেবে চিন্তে মিষ্টির সঙ্গে ফল কিনলেন যাতে করে ভালোভাবে আপ্যায়িত হওয়া যায়। তাছাড়া এই মুহূর্তে রেস্টুরেন্টে না খেয়ে যে কোনো বাসা বাড়ীতে খাবার গ্রহণ করা তার জন্যে অত্যন্ত জরুরি। তাই বাসে বসে শুধু মিষ্টি নিয়ে যাত্রা করবার ভাবনাটিকে খুব একটা ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করতে পারেননি তিনি। গুলিস্তান হকি স্টেডিয়াম থেকে আজিজ ভাইয়ের বাসার দূরত্ব সামান্য। শুধু শুধু রিকসা ভাড়া করে যাত্রা করা প্রয়োজনীয় মনে করলেন না। এক হাতে মিষ্টি এবং অন্য হাতে ফলের ব্যাগ নিয়ে হেঁটে হেঁটেই সন্তুষ্ট চিত্তে রওয়ানা হলেন। গ্রামে থাকতেই আজিজের নামটি আজিজ ভাই-এ রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল। সে সূত্রে সফিকও তাকে আজিজ ভাই হিসেবে সম্বোধন করেন।
আজিজ ভাইয়ের গ্রামের বাড়ী সফিকের বাড়ী থেকে খানিকটা দূরে। বাবা পঞ্চগড়েই থাকেন। যে কোনো সমস্যা হলেই সফিকের শরণাপন্ন হন। এর আগেই সন্তানের সাথে ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্যে আসলেও থাকতে পারেননি। কিন্তু তার পুত্র আজিজ ভাই ঢাকায় এসেছে অল্প বয়সেই। ভারী যন্ত্রপাতি ক্রয় বিক্রয়ের ব্যবসা করে। ব্যবসা করে উপার্জনও করেছে প্রচুর। যখন এলাকায় বাস করতো তখন সমস্যা হলেই সফিকের শরণাপন্ন হতো। বাস্তবতা এবং ভালোলাগা দুটো বিষয়ের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করেই আজিজ ভাই সফিক সাহেবের সঙ্গে সম্পর্কটি অটুট রেখেছে।
কিছুটা পথ পেরিয়ে একটি ফ্লেক্রিলোডের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালেন সফিক। মোবাইলে আজিজ ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করলেন। আসতে সামন্য দেরী হবে বলে ফোন করলেন বন্ধু সৌরভকে। বুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে এখন ঢাকায় বাস করছে। সাথে স্ত্রী এবং সন্তান রয়েছে। কিছুদিন পূর্বে কল্যাণপুরে একটি ফ্ল্যাটও কিনেছে। ওর সাথে দেখা করবার প্রচণ্ড ইচ্ছে হলো মধ্যাহ্নের এই তীব্র রোদের প্রাখর্য উপেক্ষা করে। কিন্তু সৌরভ তার কলটি রিসিভ করলো না। হয়ত ব্যস্ত। দ্বিতীয়বার কল দেবার কথা ভাবলেও শেষ মুহূর্তে আর কল করলেন না।
কিছুক্ষণের মধ্যে আজিজ ভাই আসলো। আধুনিক পোশাকে সজ্জিত আজিজ ভাইকে এতটা পরিচ্ছন্ন দেখতে পাবেন তা কখনোই আশা করেননি সফিক। কড়া পারফিউম এর গন্ধ দূর থেকে অনুভূত হচ্ছে। গায়ের রঙ আগের তুলনায় অনেক শ্যামল হয়েছে। স্বাস্থ্যও বেশ ভালো দেখাচ্ছে। ঠোঁটের রঙ দেখে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, পান খাওয়ার অভ্যেসটি ত্যাগ করতে পারেনি এখনও। বাম কপোলের মাঝখানের তিলটি অবিকৃতই রয়ে গেছে। নীল রঙের জিন্সের প্যান্ট, সুতি সাদা শার্ট, হাতের দামী ঘড়ি দেখে বোঝাই যাচ্ছে তার উন্নতি কোন পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। সফিককে দেখবার পর উচ্ছ্বসিত বোধ করলো আজিজ ভাই। ভীষণভাবে উৎফুল্ল হয়ে জড়িয়ে ধরলো সফিককে। জড়ানো অবস্থায় স্বাভাবিকের তুলনায় বেশ কিছুটা সময় রইলো। ব্যবহারের অতিমাত্রিক আতিশায্যে খানিকটা বিব্রত বোধ করলেও মনে মনে ঠিকই এক ধরনের পুলক অনুভব করলেন সফিক। বুঝতে চেষ্টা করলেন খাবারের ধরনটা বোধহয় ভালোই হবে। ভারী খাবার তো অবশ্যই। আজিজ ভাইকে বেশ তৎপর দেখাচ্ছে। সফিককে নিয়ে গলির মধ্যে দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। গলিটি পরিচ্ছন্ন নয়। রাস্তাটাও অমসৃণ এবং সরু। বেশ কিছু ইট আঁকাবাঁকাভাবে বিছানো। হোঁচট খাবার সম্ভাবনা প্রবল বিধায় সফিককে সাবধানে চলতে বললো। বাসাগুলি বহুতলবিশিষ্ট হলেও অনেক পুরোনো। বাসার বাম পাশের দেয়ালটিতে শ্যাওলা জমে সবুজ আকার ধারণ করেছে। কম করে হলেও পনেরটি বাসা পেরিয়ে ওরা এসে পৌঁছলো। চারতলা বিশিষ্ট বাসার চারতলাতেই থাকে আজিজ ভাই। সিঁড়ি বেড়ে উঠতে লাগলো দুজনই। উঠবার সময় শরীরের মধ্যে এক ধরনের অবসন্ন ভাব অনুভব করলেন সফিক। বুঝতে পারলেন তার শরীর ঘেমে গেছে। কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে ফ্লোরের একদম সামনে এসে পৌঁছলেন। ছোট্ট কামরার ফ্ল্যাটে পরিচ্ছন্ন ড্রইং রুমে বসলেন সফিক। ফ্যানের পাখার গতি আস্তে আস্তে বাড়তে থাকলো। কিছুক্ষণের মধ্যে ক্লান্তি কিছুটা কমে এলো। মিষ্টি ও ফলের প্যাকেট সোফার ওপরেই ছিল। সেগুলোকে অতি দ্রুত আজিজ ভাইয়ের হাতে তুলে দিলেন। প্যাকেটগুলো পেয়ে যে ধরনের তৃপ্ততার বোধ আজিজ ভাইয়ের মুখাবয়ব থেকে প্রত্যাশা করেছিলেন সফিক, সেটির উপস্থিতি লক্ষ করতে পারলেন না। তবুও প্রচ্ছন্ন এক ভালো লাগার বোধ কাজ করতে শুরু করলো তার অন্তর্মনের কোণে কোণে। সবদিক বিবেচনায় এটি অনুমিত যে, ভালো কিছু অপেক্ষা করছে তার জন্যে। সফিককে ড্রইং রুমে রেখে আজিজ ভাই ভেতরে প্রবেশ করলো। বেশ কিছুটা সময় পেরিয়েও গেল। অনেকটা অসহায়ের মতো অপ্রসন্ন দৃষ্টি নিয়ে রুমের চতুর্দিকে তাকাতে থাকলেন তিনি।
‘দুপুরে কিন্তু খেয়ে যেতে হবে ভাইজান।’ কিছুক্ষণ পর ভেতরের রুম থেকে বের হয়ে এসে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে অনুরোধ করলো আজিজ ভাই। আজিজের মুখাবয়বে বিষণ্ণতার ভাবটি স্পষ্টতই অনুভব করতে পারলেন সফিক। কিছু সময় পূর্বের প্রাণোচ্ছল আজিজ ভাইকে যেন কোনোভাবেই আর আবিষ্কার করা যাচ্ছে না। মধ্যগগনে সূর্যের অবস্থান দেখেও যদি দুপুর না হয় তবে কখন দুপুর– এই ভেবে প্রচণ্ড ক্রোধান্বিত হয়ে নিজের মনে নিজেকেই প্রশ্নবানে জর্জরিত করতে লাগলেন সফিক। বাসায় অপেক্ষা করার কথা বললেও কথার ভেতরে এক ধরনের ফাঁক লক্ষ করে আর অপেক্ষা করবার প্রয়োজন অনুভব করতে পারলেন না তিনি। দীর্ঘ সময় আজিজ ভাই ও তার স্ত্রীর কথোপকথন বুঝতে না পারলেও অনুমান করতে মোটেও অসুবিধে হয়নি যে– অবস্থা নেতিবাচকতার দিকেই গড়াচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই তার কথার স্বর অনেকটাই মন্থর হয়ে এলো। বেশ অতৃপ্ত মন নিয়েই বের হবার জন্য আজিজ ভাইকে অনুরোধ জানালেন। টেবিলের ওপরে ট্রেতে রাখা টুকরো টুকরো আপেল এবং বিস্কুট সাজানোই ছিল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও এক টুকরো আপেল খেয়ে নিলেন। গেট অবধি সফিকের সঙ্গে আসলো আজিজ ভাই। তার শারীরিক অবয়বে এক ধরনের অপরাধবোধের ছাপ লক্ষ করতে পারলেন সফিক। কিন্তু সেটি তাকে বুঝতে না দিয়ে দ্রুত সেখান থেকে বিদায় নিলেন।
বাইরে এসে শ্যাওলা জমা ছোট দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে ঘড়িটি একবার দেখে নিলেন। এখনও দুটো বাজতে প্রায় মিনিট বিশেক বাকি। ধীর গতিতে গুলিস্তানের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। অপ্রস্তুতভাবেই হাঁটতে থাকলেন। গুলিস্তানের কাছাকাছি এসে সে সুযোগটি আর রইলো না। রাস্তার পাশে হকার আর সাধারণ মানুষ সৃষ্ট কৃত্রিম জ্যামে সংকটাপন্ন অবস্থা তাকে আরো সতর্ক হয়ে হাঁটতে বাধ্য করলো। হাঁটার গতি বাড়িয়ে দ্রুত তিনি বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে চলে এলেন। মসজিদের মূল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েক মুহূর্ত ভেবে মোবাইল ফোনটি বের করে কল করলেন নীরবকে। নীরবও তার অত্যন্ত ভালো বন্ধু। বেশ কিছুদিন যাবৎ ঢাকায় অবস্থান করছে। ভালো একটি মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করছে। নীরবও কলটি রিসিভ করলো না। প্রথম কলটি মিসড হওয়াতে কিছুটা দ্বিধান্বিতভাবেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও দ্বিতীয় কলটি দেয়ামাত্রই অপর প্রান্ত থেকে নীরবেব কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। ‘লাঞ্চ করছি তো, তাই ভাবলাম তোকে পরে ফোন করি, তা তুই কোথায়, ঢাকায় এসছিস নাকি?’ অত্যন্ত আড়ষ্ট হয়ে সফিক বললেন– ‘হ্যাঁ, ঢাকায়, এ মুহূর্তে গুলিস্তানে।’
গুলিস্তানে অবস্থানের কথা শুনবার পর উচ্ছ্বসিত হয়ে নীরব দুপুরে বাসায় লাঞ্চ এর আমন্ত্রণ জানিয়ে সফিককে আসতে বললো। বিষয়টি সাধারণভাবে স্বাভাবিক হলেও এ মুহূর্তে সফিকের কাছে একটু অস্বাভাবিকই মনে হলো। কোনোভাবেই সুযোগটি হাতছাড়া করবার কথা ভাবতে পারলেন না। বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকে ফুলবাড়িয়া রোড পর্যন্ত দ্রুত গতিতে হেঁটে এসে একটি রিকশা নিয়ে নীলক্ষেতের দিকে যাত্রা করলেন। গুলিস্তান থেকে ফুলবাড়িয়া রোডে আসতেই দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেল। প্রবল উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মধ্যে দিয়ে তৃপ্ততার উপলব্ধিকে নিশ্চিত করবার আশা নিজের ভেতর সঞ্চারিত করে পথচলা শুরু করলেন। রিকশাওয়ালাকে দ্রুত চালানোর জন্যে বারবার অনুরোধ করলেন। ফোন করে নীরবের অবস্থানটি জেনে নিলেন। বাসাতেই আছে এখনও। পরিবার নিয়ে শুরু থেকেই নীলক্ষেতে অবস্থান করছে। নীরবের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ থাকলেও কখনও ওর বাসায় যাওয়া হয়ে ওঠেনি সফিকের।
গতকাল থেকে এ্যাসিডিটিতে ভুগছেন সফিক। গত কয়েকদিনে হোটেলের খাবার গ্রহণ সেই মাত্রাটিকে যেন প্রচণ্ডভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। তাছাড়া ভরা দুপুরে আজিজ ভাইয়ের বাসায় খালি পেটে নিজেরই কেনা ফল খেয়ে তার সুফলটি ভোগ করতে হচ্ছে এখন। দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে রিকশা। সঠিক সময়ে পৌঁছতে পারবেন ভেবে প্রসন্নতা কাজ করছে সফিকের মনোজগতজুড়ে। নীলক্ষেতের সামনে এসেই রিকশা থামিয়ে দ্রুত ভাড়া প্রদান করে মিষ্টির দোকান অভিমুখে হাঁটতে শুরু করলেন। ফল না কিনে মিষ্টি আর সন্দেশ কিনলেন অনেক বেশি পরিমাণে। লক্ষ্য– বাসায় কোনোভাবেই যেন কাক্সিক্ষত প্রত্যাশাটুকুর ভরাডুবি না ঘটে। নীরব বাসার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলো। আট বছর আগে যেমন চেহারা ছিলো মনে হচ্ছে ঠিক তেমনই আছে। লম্বা নাক, ঘন কালো পরিপাটি চুল, উজ্জ্বল ফর্সা রঙে ইন করা নীল শার্টের সাথে কালো প্যান্টের কম্বিনেশন– সঙ্গে জুতো পরা অবস্থায় অনেক স্মার্ট দেখাচ্ছে ওকে। নীরবের হাসোজ্জ্বল মুখ দেখে খুশিতে আত্মআস্থায় প্রচুর বিশ্বস্ত সফিক। সহজেই অনুমান করতে পারলেন– এবারের মতো মিস হবার কোনো সুযোগ নেই। মিষ্টি আর সন্দেশের প্যাকেটটি নীরবের হাতে তুলে দিলেন।
পাঁচ তলা ভবনের নীচতলায় নীরবের ফ্ল্যাট। বাইরে থেকে বেশ পরিপাটিই মনে হচ্ছে। দরজা খোলাই ছিল। সহজেই দুজনে ভেতরে প্রবেশ করলো। ভেতরটাও অনেক সজ্জিত। সোফার এক পাশে একটি বিশালায়তন বুক সেলফ ড্রইং রুমের মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ। সিলেবাসের পড়াশুনার বাইরে অনেক বই পড়তো নীরব। এবং ক্লাসে যারা গ্রন্থ পাঠে আগ্রহী ছিলো কমবেশি সবার জন্যে বিভিন্ন ধরনের বই নিয়ে আসতো। সেলফে বইয়ের বিপুলতা থেকে বোঝাই যাচ্ছে আজ অবধি সেই অভ্যেসটি ধরে রেখেছে ও। কয়েকটি বনসাই সাজিয়ে রেখেছে দেয়ালের কোণ ঘেষে। দেয়ালে টাঙানো প্রাকৃতিক দৃশ্য সম্বলিত বেশ কিছু মনোরম জলরংয়ে অঙ্কিত পেইন্টিং বৃদ্ধি করেছে রুমটির সৌন্দর্য। ছোটবেলা থেকেই ওর রুচি অনেক উন্নত। অন্যান্য বন্ধুরা যেখানে তাদের পোশাক পরিচ্ছদ কিংবা রুমের পরিবেশ নিয়ে উদাসীন থাকতো সেখানে নীরব ছিলো পুরোপুরি ব্যতিক্রম। ওর বাসার ব্যক্তিগত কক্ষটি সবসময়ই ছিল পরিপাটি। যে সাইকেলটি ক্লাস সিক্রে নিয়ে এসেছিল সেই সাইকেলটিই উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত ব্যবহার করেছিল। সাইকেল দেখে বোঝার কোনো উপায়ই ছিল না– এটি সাত বছরের পুরোনো। নীরব মিষ্টির প্যাকেটটি হাতে নিয়ে খানিকটা বিরক্তির সাথে বললো– ‘এসব আনতে গেছিস ক্যান, তুই ড্রইংরুমে একটু অপেক্ষা কর, আমি প্যাকেটটা তোর ভাবীকে দিয়ে আসছি। খুব বেশি দেরি হবে না, অফিসের বস ভীষণ কড়া, তাড়াতাড়ি না গিয়ে উপায় নেই।’ এ কথাটি শুনবার পর অবচেতনাতেই সফিকের মনের অতলান্তের দরোজায় একটি অপ্রসন্ন সন্দেহের হাত কড়া নাড়তে থাকলো। বসে থাকা অবস্থায় মাংস আর মাশ কলাইয়ের ডালের ঘ্রাণ যখন রান্নাঘরের সীমানা পেরিয়ে ড্রইং রুমে এসে পৌঁছছিল তখন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছিলেন না তিনি। অনেকটা ধরেই নিয়েছিলেন কাক্সিক্ষত লক্ষ্যের দিকে এগুনো এবারে সম্ভব হবে। কিন্তু, ‘অফিসের বস ভীষণ কড়া।’ কথাটি শুনবার পর আর আশাবাদী হতে পারলেন না সফিক। অনেক দিনের পুরোনো বন্ধু নীরব। সে কি নিজেও তৃপ্ত থাকতে পারবে তাকে ভালোভাবে আপ্যায়ন না করে! সীমাহীন অতৃপ্ততা হৃদয়জুড়ে বিরাজমান থাকলেও একটি সূক্ষ্ম আশার বীজ বুনতে শুরু করলেন সফিক।
‘চল, চল দেরি হয়ে গেছে। ভাবলাম বাসায় প্রথম এলি, তোকে ভালোভাবে আপ্যায়ন করি। কিন্তু তা আর হয় কীভাবে? বুঝলি, এমন চাকরি করি প্রতিদিন ঠিকমতো যে খেতে পারবো তারও সুযোগ নেই, তুই অনেক ভালো আছিস রে।’ কথাগুলি বলতে বলতে বাসা থেকে বেরিয়ে অফিসের দিকে রওয়ানা হলো নীরব। অনিচ্ছা সত্ত্বেও উপায়ন্তর না দেখে সফিক তার বন্ধুকে সঙ্গ দেবার কাজটি করতে লাগলেন অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই। যদিও স্বাভাবিক হওয়া এই মুহূর্তে তার জন্যে অত্যন্ত কষ্টের। স্বল্প সময়ের মধ্যে চলে আসলেন নীরবের অফিসে। অফিসটি অত্যন্ত গোছালো। আলাদা কক্ষে বসে নীরব। ব্যক্তিগত টেলিফোন, ল্যাপটপ, ডেস্কটপ কম্পিউটারসহ প্রয়োজনীয় সকল উপকরণই স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে– অফিসে তার ইতিবাচক গ্রহণযোগ্যতা এবং প্রয়োজনীয়তা। ইজি চেয়ারে বসে পুরো শরীর এলিয়ে দিয়ে পিয়নকে ডাকলো নীরব। কিছুক্ষণের মধ্যেই দরোজাটা আস্তে করে টেনে নিয়ে পিয়ন এসে রুমের ভেতরে প্রবেশ করলো। পিরিচের মধ্যে সজ্জিত বিস্কুট টেবিলের ওপর রাখলো। দরজা খোলা রাখা অবস্থায়ই লাল চায়ের দুটি কাপ দিয়ে গেলো। ক্ষুধার্ত থাকায় ভদ্রতার খাতিরে একটি বিস্কুট রেখে সবকটিই খেয়ে নিলেন সফিক। পানি খাবার পর অত্যন্ত ধীর গতিতে চায়ের কাপে চুমুক দিতে শুরু করলেন। নীলক্ষেত থেকে পলাশীর দূরত্ব সামান্য। বিষয়টি নীরবের কাছে গোপন রেখে ভেবে নিলেন বের হয়েই হোস্টেলে যাবেন। ঘণ্টাখানেক নীরবের অফিসে অবস্থানের পর বের হয়ে এলেন সফিক। সফিকের সাথে বাইরে আসবার ইচ্ছে থাকলেও অফিসের ব্যস্ততার কারণে নীরবের পক্ষে সেটি আর সম্ভব হলো না।
নীরবের অফিস থেকে বের হতেই বিকেল পাঁচটা পেরিয়ে গেল। হাঁটতেও আর ইচ্ছে করছিলো না। রিকশা ডাকবেন এমন সময় মোবাইলের রিংটোনটি বেজে উঠলো। অপরিচিত নম্বর। তবে বুঝতে পারলেন ঢাকা থেকেই কেউ ফোন করেছে। রিসিভ করবার পর ও প্রান্ত থেকে সৌরভের পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পারলেন। বিষণ্ণতার মধ্য দিয়েও অবচেতনাতেই ভেতরে ভেতরে পুলকিত বোধ করলেন। ক্লাসের মধ্যে সৌরভ ছিল সর্বোচ্চ মেধাবী। যে কোনো অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করবার ক্ষেত্রে ও ছিলো অসাধারণ। বিতর্ক, আবৃত্তি, রচনাসহ যে কোনো প্রতিযোগিতায় ও-ই একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে স্কুল থেকে অংশগ্রহণ করতো এবং প্রতিটি বিষয়ে প্রথম স্থান অধিকার করতো। ওর প্রতি প্রায় সব স্যারদেরই ছিল অগাধ আস্থা। এস. এস. সিতে যখন ও বোর্ড স্ট্যান্ড করেছিল তখন ডি.সি, এস.পি, ইউ. এন. ও থেকে শুরু করে জেলার সব কর্মকর্তা ওকে নিয়ে ভীষণভাবে উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন। রেজাল্ট প্রকাশের পরদিন হেড স্যার প্রতিটি ক্লাসরুমে ওকে নিয়ে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সামনে বক্তৃতা দিতে বলেছিলেন। সাত পাঁচ ভাববার পর সৌরভের প্রাণিত অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারলেন না সফিক। পুরোপুরি মনস্থ হলেন ওর বাসায় যাবার।
কল্যাণপুরের বাসে উঠে পড়লেন। দিনমনির অস্তরাগ শেষে কুমারীত্বে পদার্পণ করে সন্ধ্যাটি হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে আসছে। নিয়ন আলোতে শহরের সৌন্দর্যের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে অনেকটাই। বাসের ভেতর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। সিট ফাঁকা ছিল না। ক্রমাগত ভীড় বেড়েই চলেছে। ঢাকা কলেজের গেটের সামনে এসে সেই ভীড়টি অসহনীয় পর্যায়ে চলে এলো। চরম বিরক্তিকর অবস্থার মধ্য দিয়ে যাত্রা করতে থাকলেন। ধানমণ্ডি পেরিয়ে শিশুমেলার সামনে এসে একটি সিট পাওয়ায় কিছুটা স্বস্তি বোধ করলেন। সিটে বসলেন ঠিকই কিন্তু দাঁড়িয়েই রইলো বাস। প্রায় চল্লিশ মিনিট বসে রইলেন শিশু মেলার সামনেই। বসা অবস্থায়ই সৌরভকে ফোন করে বাসার লোকেশন জেনে নিলেন। লোকেশনটি একদমই সহজ। সৌরভের কাছ থেকে শুনবার পর বুঝতে পারলেন সফিক। কল্যাণপুরে নামবার পর সরাসরি সৌরভের বাসা অভিমুখে এগুতে থাকলেন। কল্যাণপুর ওভারব্রিজ পার হয়ে যতই সামনের দিকে যাচ্ছিলেন ততই বন্ধু সৌরভের প্রতিচ্ছবিটি ভেসে উঠছিল ওর মননে। বন্ধু হিসেবে সৌরভ ছিলো অসাধারণ। তার সঙ্গে সৌরভের সম্পর্ক ছিলো সবচাইতে ঘনিষ্ঠ। স্বাভাবিকভাবে ওকে দেখবার ইচ্ছেটিও প্রচণ্ডভাবে জাগ্রত হয়েছিল সে মুহূর্তে। বাসার একদম সামনেই ঢিলেঢালা কালো রঙের জিন্সের প্যান্ট এবং টি-শার্ট পড়ে দাঁড়িয়ে ছিলো সৌরভ। কিন্তু কোনোভাবেই মেলানো যাচ্ছিলো না ওকে। এমনিতেই দেখতে কালো, তার ওপর ওজন সম্ভবত অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে, গত বছরও ওর ওজন এতটা বেশি ছিল না যতটা না এখন মনে হচ্ছে। সামনের দিকের চুলগুলিও প্রায় সবটুকুই উঠে গেছে, চশমা দেখে বোঝাই যাচ্ছে পাওয়ার পূর্বের তুলনায় বেড়েছে। তবুও তার পুরো অবয়বজুড়ে এক ধরনের প্রজ্ঞাপূর্ণ পরিপক্বতার ছাপ স্পষ্টরূপে ফুটে উঠেছে। কিছু বলবার আগেই সফিককে জড়িয়ে ধরলো সৌরভ। দুজন মিলে দ্রুত ফ্ল্যাটে প্রবেশ করলো। গল্পে এতটাই জমে গিয়েছিল যে, কখন এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি। বিশাল ড্রইং রুমে বসেই অনবরত গল্প করছিলো ওরা। সফিক প্রত্যাশা করছিলেন হয়ত সৌরভের স্ত্রী অথবা অন্য কেউ এসে খোঁজ খবর নেবে। কিন্তু সেটির অনুপস্থিতি দেখে চিন্তার রেখাটি স্ফীত হতে শুরু করলো। বাথরুমে যাবার কথা বলে বাসার চারদিকটা লক্ষ করলেন। কাউকেই দেখতে পেলেন না। বাথরুম থেকে কিচেন রুমের দূরত্ব একটু বেশি হলেও পানি খাবার কথা বলে ভেতরে প্রবেশ করলেন। কিচেন রুমে প্রবেশের পর পরই ফ্রিজ হয়ে গেলেন সফিক। অনেক চেষ্টা করেও কোনো ধরনের ঘ্রাণের অস্তিত্ব পেলেন না। ভদ্রতার খাতিরে একটি পানির পট সঙ্গে নিয়ে আবার এসে বসলেন ড্রইং রুমে। মুখে খানিকটা খুশির আবহ তৈরি করবার চেষ্টা করে জিজ্ঞেস করলেন–‘কিরে সৌরভ, বাসায় আর কাউকেই দেখছি না, তুই না ফোনে বললি ভাবী বাসাতেই আছে! একটি শ্বাস নিয়ে আবারও বললেন– ‘তোর বাচ্চাদেরকেও দেখছি না, ওরা কোথায়?’
কিছুটা অপ্রস্তুতভাবে বলতে লাগলো সৌরভ– ‘আর বলিস না, তোর ভাবী শপিং এ গেছে, প্রায়ই যায়, শপিংও করে চাইনিজও খায়, বুঝলি, ওর সামনেই তোর সঙ্গে ফোনে কথা বললাম।’ এরপর আরও কিছু বলবার উপক্রম করতেই সৌরভকে থামিয়ে দিলেন সফিক। সফিকের কথাটি শুনবার পর সৌরভের ঠোঁট দুটি প্রায় শুকিয়ে এলো। এই মুহূর্তে বিশেষ কিছু বলবার আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন সফিক। সীমাহীন কষ্টের উদ্রেক ঘটলেও কিছু কিছু বাস্তবতাকে যে মেনে নিতে হয় সেই সত্যটি দারুণভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো এ মুহূর্তে, ওর জীবন দর্শনে। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সৌরভের সঙ্গে আর বেশিক্ষণ গল্প চালিয়ে যাবার সুযোগ পেলেন না। এগারটার মধ্যেই হোস্টেলে পৌঁছতে হবে। তাই সৌরভের অনুরোধ সত্ত্বেও আর অবস্থান করলেন না তিনি। সফিকের এমন অবস্থা দেখে সৌরভও প্রস্তুতি নিলো বাসা থেকে বের হবার। রাস্তার দু’ধারেই অসংখ্য মানুষের ছুটোছুটি। সেদিকে বিন্দুমাত্র দৃষ্টি ছিল না কারুরই। জনবহুল পরিবেশ কোনোভাবেই ওদের মধ্যে চলমান দুর্লভ মুহূর্তটিকে বাস্তবতার আবহ দ্বারা ম্রিয়মাণ করে তুলতে পারলো না। কল্যাণপুর ওভারব্রিজ অবধি হেঁটে আসলো দু’জনই। খুব শক্ত করে সফিকের বাম হাতটিকে নিজের ডান হাতের মধ্যে ভরে নিয়ে এতক্ষণ পর্যন্ত ধরে রাখছিলো সৌরভ। বাসের কাছাকাছি আসতে নিজেই ওর হাতটিকে সফিকের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিলো। স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে রইলো সৌরভ। কোমরে রাখা হাত দুটি সোজা করলো তখনই যখন চলন্ত অবস্থায় একটি বাসে উঠলেন সফিক। মুহূর্তের মধ্যে দুজনই আলাদা হয়ে গেলো। বাসে তুলে দেবার পর হাফ ছেড়ে বাঁচলো সৌরভ। ‘যাক! অনেকটাই বেঁচে গেছি।’ মনে মনে অনুভব করলো। স্ত্রী আসবার পূর্বেই সফিকের প্রস্থানেসে যে স্বস্তি বোধ করলো তা তার অনুভূতিতেই প্রস্ফুটিত হলো। যদিও যতই হাঁটছে ততই বন্ধু সফিকের সাথে শৈশব স্মৃতিগুলি তার স্মৃতিপটে ভেসে আসছে।
রাস্তায় জ্যাম না থাকলেও ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে বাস। স্বল্প সময়ের মাঝেই কলাবাগানও পেরিয়ে গেল। আশা করছেন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে হোস্টেলে পৌঁছুতে পারবেন। শব্দ না করে জানালার গ্লাসটা সরিয়ে দিয়ে ডান হাতের কনুইটি জানালার ফ্রেমে রেখে হাতটি ডান গালে চেপে একমনা হয়ে তাকিয়ে থাকলেন নিঃসীম প্রশান্ত আকাশের দিকে। আকাশের দিকে তাকিয়ে আকাশের নিঃসীমতার মাঝেই যেন খুঁজতে থাকলেন তার অতীতের কিছু স্মৃতিকে। সেই স্মৃতির ফ্রেমে এক এক করে ফুটে উঠতে থাকলো তার মা এবং একমাত্র বোনের পাশাপাশি তার অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীর ছবি। এরই মধ্যে তার স্মৃতিতে আরো একটি বিষয় ফুটে উঠলো– যেটি তার বিয়ে। আত্মীয়-স্বজনদের বাইরেও শুভাকাঙ্ক্ষীদের মধ্যে থেকেও প্রচণ্ড চাপ আসতে থাকলো ওর ওপর বিয়ের পাটটি চুকিয়ে দেবার। এবং এটি গত তিন-চার ঈদেও এসেছিল কিন্তু সফলতার মুখটি আর দেখা হয়নি। এই মুহূর্তে সংসার জীবন শুরু করবার কথা ভাবতেই ভীষণভাবে আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়লেন সদ্য অতীত হওয়া কিছু স্মৃতি রোমন্থন করে। তার কল্পিত জীবনে প্রবহমান স্নিগ্ধ স্রোত বাধাগ্রস্থ হয়ে পড়বে না তো বিয়ের কারণেই! কিছুটা হতাশা আর বিরক্তির চিহ্ন ফুটে উঠলো তার চোখেমুখে। মননে স্থির হতে থাকলো বিয়ে করলে যে নারীটি তার জীবনে আসবে সে কি সেই রোমন্থিত স্মৃতির প্রতিটি নারী চরিত্রের মতই হবে? কোনো কিছুই ভাববার অবকাশ পেলেন না সফিক। এতটা সীমাহীন জটিলতার সম্মুখীন হতে হবে সেটি উপলব্ধি করতে পারেননি এখানে আসবার পূর্বে। পঞ্চগড়ের ফেলে আসা প্রকৃতি ভীষণভাবে কাছে টানছে তাকে। মনে মনে প্রচণ্ডভাবে কামনা করতে থাকলেন– এই মুহূর্তে যদি পঞ্চগড়ে যাওয়া যেত!
এই ভাবনার ভেতর দিয়েই বাসটি পৌঁছে গেল পলাশী রোডে। যাত্রী কম থাকায় হেলপারের মধ্যে কোনো তাড়া লক্ষ করা গেল না। মনে হচ্ছে কিছুটা সময় এখানে দাঁড়িয়েই থাকবে বাস। স্থির চিত্তে বাস থেকে নামলেন সফিক। এগারটা বাজতে মিনিট পনের বাকি। ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকলেন হোস্টেলের দিকে। মূল রাস্তার পাশের রেস্টুরেন্টগুলোর সামন দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ করেই কেন যেন দাঁড়িয়ে পড়লেন। রেস্টুরেন্টগুলোর দিকে গভীর দৃষ্টি প্রক্ষিপ্ত করে সময়ের সীমাবদ্ধতার কথা চিন্তা করে পরক্ষণেই আবারো হাঁটতে শুরু করলেন।
হোস্টেলের চারদিকটা বেশ পরিচ্ছন্ন। মূল ফটকের সামনে রোপিত ঝাউগাছ সৌন্দর্যের মাত্রা বৃদ্ধি করেছে। সীমানার পাশ দিয়ে সারি সারি বৃক্ষ এবং প্রত্যেক ভবনের সামনে বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের সমারোহ হোস্টেলের পরিবেশকে করে তুলেছে মনোরম এবং স্নিগ্ধ। মূল গেট পেরিয়ে নিজ কক্ষের দিকে হাঁটতে থাকলেন সফিক। মোবাইল ফোনের রিংটোনটি বেজে উঠলো। একবার পকেটে হাত দিয়ে আবার হাতটি পকেট থেকে বের করে হাঁটতে থাকলেন। চারতলা ভবনের নীচতলায় তার কক্ষ। মানিব্যাগ থেকে চাবিটি বের করে রুমের তালা খুললেন। রুমের ভেতর প্রবেশ করেই লাইট ও ফ্যানের সুইচ অন করলেন। মশারিটি ঝুলানোই ছিলো। চাদরটিও ছিলো অগোছালো-মেসের বোর্ডারদের বিছানাপত্র সাধারণত যে অবস্থায় থাকবার কথা, ঠিক তাই। সেদিকে দৃষ্টি প্রক্ষিপ্ত না করে সরাসরি বাথরুমের দিকে চলে গেলেন সফিক। চোখে মুখে ভালোভাবে পানি ছিটিয়ে বেশ কিছুক্ষণ আয়নার সামনে দাঁড়িয়েই রইলেন। আবারও রিংটোন বেজে উঠলো। রিংটোনের শব্দ শুনতে পেলেও রিসিভ করবার আগ্রহ প্রকাশ করলেন না। হয়ত তিনি বুঝতে পারলেন রিংটোনটি কার হতে পারে? বেসিনের আকার ছোট হওয়ায় খানিকটা নিচু হয়ে দু’হাত ভরে সামান্য পানি নিয়ে মাথা ভেজানোর পর আরো বেশ কিছুক্ষণ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন। গভীর মনোনিবেশের সাথে নিজেকে অনবরত দেখতে থাকলেন। শেষ কবে এত গভীরভাবে নিজেকে আয়নার সামনে দেখেছেন সেটিও মনে করতে পারছেন না।
বাথরুম থেকে আসবার সময়ই লাইটটি অফ করে ডিম লাইটটি অন করে মশারি টেনে ভেতরে প্রবেশ করলেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও মশারির প্রান্ত অংশটি তোশকের ভেতর সেঁধিয়ে দিলেন। বিছানায় শুয়ে পা দুটিকে যতটা সম্ভব ছড়িয়ে রাখবার চেষ্টা করলেন। হাত দুটি মাথার নীচে রেখে অবিরাম ঘূর্ণায়মান ফ্যানটির দিকে তাকাতে থাকলেন। মাথার মধ্যে ক্রিয়ারত অসহ্য যন্ত্রণার ভাব কিছুটা কমে এলো। সম্পূর্ণ শরীর জুড়ে অনুভব করতে থাকলেন ক্লান্তি শেষের প্রশান্তি। আবারো রিংটোনটি বেজে উঠলো। মোবাইল স্ক্রিনের আলোয় ফ্যানের পাখাগুলিকে প্রত্যক্ষ করা না গেলেও প্রবলভাবে পাখাগুলির ঘুরন্ত শব্দ কানে আসছে। মোবাইল ফোনটি টেবিলের ওপরই ছিলো। বাম হাত দিয়ে মশারিটি একটুখানি তুলে টেবিল থেকে ফোনটি হাতে নিলেন। রিংটোন বেজেই চলেছে। উিউটি অফিসারের নামটি মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে উঠছে। বালিশ থেকে মাথা তুলে পা’দুটোকে সামনে নিয়ে সোজা হয়ে বসলেন। শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি দ্রুত হয়ে এলো সফিকের। বেশ কিছুটা সময় বসেই রইলেন। স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করলেন। অতঃপর শান্ত হয়ে গভীর ভাবনায় মগ্ন রাখলেন নিজেকে। তৃতীয়বারের মতো কল রিসিভ না হওয়ায় ভেবে নিলেন হয়ত আর কলটি আসবে না। তাই মোবাইল ফোনটি বালিশের পাশে রেখে ডান হাত মাথার নিচে রেখে ঘুমোবার চেষ্টা করলেন। চোখের পাতা দুটি আপনা আপনি বুজে এলো। একটু পরেই আবারও রিংটোনটি বেজে উঠলো। বালিশের পাশেই রাখা ফোনটি চরম বিরক্তি নিয়ে হাতে নিলেন। স্ক্রিনে পুনরায় ডিউটি অফিসারের নাম দেখবার পর রিসিভ করলেন। শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি এবার আর অস্বাভাবিক হলো না। অপর প্রান্ত থেকে ডিউটি অফিসারকে কোনো ধরনের কথা বলবার সুযোগ না দিয়ে নিজেই অনবরত বলা শুরু করলেন– ‘শুনুন, আমি তো আপনাকে গত তিন দিন ধরেই অনবরত বলে আসছি কোনো ধরনের আর্থিক সংশ্লিষ্টতা ছাড়া যদি কাজ হয় তবেই আমি সামনের দিকে এগুতে পারি, অন্য কোনো পথে আমার পক্ষে চলা সম্ভব নয়, বিষয়টি ভেবে দেখলে আমি খুশি হবো। ভালো থাকবেন।’ অতি সন্তর্পণে কল কেটে দিয়ে রিংটোন সাইলেন্ট রেখে পুনরায় ঘুমোবার চেষ্টা করলেন সফিক।