পিন্টু রহমান
১৩ অক্টোবর ১৯৭৫ খ্রি: চুয়াডাঙ্গার কুমারী গ্রামে জন্ম, পৈত্রিক ঘরবসতি কুষ্টিয়া জেলার বাজিতপুর গ্রামে। মাতা: জিন্নাতুন নেছা ও পিতা: বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিবর রহমান। তিনি একজন কথাসাহিত্যিক। গল্পের ছলে ভাষার আঞ্চলিকতায় চিত্রায়ণ করেন বাঙাল-জনপদের বহুমাত্রিক জীবনাচার। উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত গ্রন্থ: পাললিক ঘ্রাণ (গল্পগ্রন্থ), পূরাণভূমি (উপন্যাস), কমরেড (উপন্যাস), পরাণ পাখি (গল্পগ্রন্থ)
পিন্টু রহমান

কাকা কাহিনী

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

ষাটোর্ধ্ব বয়সের অনেক কাহিনীই আজ তাঁর নিজের কাছে অজানা। ভাবতে বসেও কোনো কুল কিনারা হয় না। সবকিছু আবছা আবছা লাগে। বাবা শখ করে নাম রেখেছিল প্রাণ গোপাল হালদার। কিন্তু তার বিন্দুবিসর্গ এখন আর অবশিষ্ট নেই। কালের শোভাযাত্রায় যক্ষা রোগীর মতো ক্ষয়ে গেছে। প্রাণশক্তি হারিয়ে নিষ্প্রাণ। মহল্লার ছেলে বুড়ো সবাই তাকে কাকা বলেই জানে। এবং ঐ নামেই ডাকে। আগে শুনতে খারাপ লাগলেও এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। ছেলের কাকা, মার কাকা, দাদারও কাকা! এ আবার কেমন নিয়ম?

নামেই প্রাণ গোপাল। তাই তার মধ্যে প্রাণের অনুসন্ধান করা বাতুলতা মাত্র। অপুষ্ট শরীরে দাঁড়ি-গোফের ছড়াছড়ি। ধ্যানমগ্ন চোখ দুটি কোঠরাগত। এ বয়সে পেশা থাকার কথা নয়– তবু সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গলির মাথায় ঠাঁই বসে থাকে। কাজকর্ম জুটলে জুতা স্যাণ্ডাল সেলাই করে, না জুটলে নাই। মাথার উপর একটা বিবর্ণ ছাতা টাঙিয়ে নিজস্ব ভুবন তৈরি করে নিয়েছে। একান্তই তার নিজস্ব ভুবন।

বাপ দাদার ব্যবহারের কয়েক জোড়া চটি জুতা প্রতিদিন সম্মুখে থরে থরে সাজানো থাকে। দেখে মনে হয় এগুলোই তার ব্যবসার একমাত্র মুলধন। কাজ না থাকলে নিজের গামছা দিয়ে চটিগুলো পরিষ্কার করে । নতুন করে পালিশ লাগায়। কখনো কখনো নিবিড় ভাবে পর্যবেক্ষণ করে। ঐ চটির মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। ফেলে আসা অতীত হাতড়ে বেড়ায়।

— ও কাকা এমুন কইরি কি দেখতিছো গো?  চটিখান বেইচপা নাকি?  তা কত নিবা কও দিকিনি।

পথচারীর কথায় কাকা কর্ণপাত করে না। তাদের চালাকি বুঝতে পারে।

এই কাকাকে নিয়েই আমার গল্পের কাহিনী। কাকা কাহিনী। সারা বিশ্ব আজ ফুটবল জ্বরে আক্রান্ত। তার ঢেউ এসে লেগেছে গ্রামের অন্দরমহল পর্যন্ত। প্রায় প্রতিটি বাড়ির ছাদে বিশালাকার পতাকা। পত পত শব্দ তুলে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়। পারিবারিক বন্ধন ভেঙে মানুষ এখন দুই শ্রেণীতে বিভক্ত। কেউ ব্রাজিল কেউ আর্জেন্টিনা। খেলার আগে কথার লড়াই। চায়ের দোকানে প্রতিদিনই ঝড় ওঠে। হাতাহাতিও হয়। গভীর রাত পর্যন্ত চলে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। প্রথম প্রথম রং-বেরঙের পতাকা দেখে কাকার মনে খানিকটা খটকা লেগেছিল। চেনাজানা একজনকে জিজ্ঞেসও করেছিল।

— বাবুজি;  অ বাবুজি, আকাশে ঐসব কি উড়তিছে গো?

যখন শুনেছিল ওগুলো বিদেশী পতাকা,  মনে মনে আহত হয়েছিল। দেশটা আর কতবার হাতবদল হবে? মনের পর্দায় ক্ষণিকের জন্য হরিহরনের মুখটা উঁকি দিয়েছিল। হরিহরন তার আদরের ছোট ভাই। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে গিয়েছিল। কিন্তু কোনোদিন আর ফিরে আসেনি।

কাকার ছন্দবদ্ধ জীবন। বার্ধক্য আর দারিদ্র্যের কষাঘাত তাকে লতার মতো জড়িয়ে রেখেছে। কারো আগেও নেই পিছেও নেই। অর্ন্তমুখী মানুষ। ফুটবলের কথা জিজ্ঞেস করলে বড়জোর মোহনবাগান কিংবা ইষ্টবেঙ্গলের কথা  মনে পড়বে। অথচ চলতি বিশ্বকাপে তাকে নিয়েই যত টানা হ্যাঁচড়া! ঘটনার সূত্রপাত ব্রাজিলীয়ান প্লে মেকার কাকার লাল কার্ড পাওয়া নিয়ে। আর্জেন্টাইন ভক্ত সমর্থকরা এতে যারপরনাই উল্লসিত। কথার মারপ্যাঁচে প্রতিপক্ষকে তারা ঘায়েল করতে চায়। উঠতি বয়সের কয়েকজন যুবক হাসি হাসি মুখ করে জিজ্ঞেস করে— কাকা, আপনি নাকি লালকার্ড পেয়েছেন?

কাকা নিরুত্তর। ছেলেগুলোর হাবভাব সে ঠাঁহর করতে পারে না। অকারণ বিপত্তি। সাত সকালে মিথ্যা বলার কি এমন দরকার?  অন্য আরেক দলের মুখেও ঐ এক কথা।

— কাকা শেষপর্যন্ত লালকার্ড পাইলেন?

এই মিথ্য অভিযোগ শুনতে আর ভাল লাগে না। কাকা এবার মুখ খোলে।

— না গো বাবুরা, মুই কাড পাইনি। তুমরা ভুল শুইনিছো।

— ক্যান, সবাই তো বলতিছে।

— অরা মিছা কইতিছে। একখান কাডের লাইগ্যি মিম্বার, চ্যিয়ারম্যানের কাছোত কত্ত ঘুইরলাম! হাত পাও ধইরলাম। কিন্তুক কাম হইলো না গো। হেরা কয় মোর নাহি বয়স অয় নাই। ট্যাহা লাগবো। মেলা ট্যাহা।


 

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu