নয়ন মাহমুদ
কবি ও কথাসাহিত্যিক
নয়ন মাহমুদ

যুক্তিতর্ক

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

নয়ন মাহমুদের গল্প: যুক্তিতর্ক


মহামান্য চেয়ারম্যান সাহেব, আমি জব্বার হোসেইন, নিবাস মুন্সিপাড়া। গত তিন সপ্তাহ ধরে সুনিয়মিত গরুটির ওপর আমি নজর রাখি। পেটের ভাত হজম করে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে মাঠ পর্যায়ে নেমে পড়ি। কখন গরুটিকে ক্ষেতে নিয়ে আসা হচ্ছে। কে নিয়ে আসছে। কতক্ষণ পর পর এসে পানি খাওয়ানো হচ্ছে। গরুটির অবস্থান পরিবর্তন। এমনকি কবে কোথায় গরুর হাট। গরুটি কি মূল্যে বিক্রি হতে পারে। হাট খরচ। দালালের খপ্পরে পড়ার সুযোগ আছে কিনা। ইত্যাদি। আমি এধরনের বিভিন্ন উপাত্ত বিশ্লেষণ করে, গত বৃহস্পতিবার বিকাল চারটা সাতান্ন মিনিটে গরুটি চুরি করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিই। এক্ষেত্রে আমার পরিসংখ্যান বিদ্যা ফলপ্রসূ অবদান রেখেছে। ঝুঁকি নিয়েও আমার ভাবনা ছিল। আর ঐ ব্যাটা, জনাব বরকত উল্লাহ বলে কিনা, গরুটি সে চুরি করবে? আপনি-ই বলুন, গরুটি চুরি করার অধিকার কার ওপর বর্তায়? নিশ্চয়ই আমার। কারণ আমার শারীরিক ও মানসিক খাটুনি পণ্ডশ্রমে পর্যবসিত হোক, এটি নিতান্তই অমানবিক। কিন্তু সে এসব তো বুঝলোই না, বরং আমার কপালে পাটকেল ছুঁড়ে মারলো। পরিশেষে মহানুভব চেয়ারম্যানের কাছে আমি এর সঠিক বিচারের দাবি রাখি।

মাননীয় চেয়ারম্যান সাহেব, আমি বরকত উল্লাহ, নিবাস পশ্চিম হাজীর বাজারের বিপরীত। আমার ঘরে প্রসূতি স্ত্রী আছে। আয় একপ্রকার নেই বললেই চলে। ডাক্তার বলেছেন, গর্ভকালীন সময় পুষ্টিকর খাবার খেতে। এটি সন্তান ও জননীর জন্য মঙ্গলজনক। আমি আগে কখনো চুরি করি নাই। সন্তান জন্মানো (জৈবিক) ও সন্তানের নাম রাখা (সামাজিক) এই দুই খাতে যে ব্যয় হবে, তা গরুটি বিক্রি করে পাওয়া সম্ভব বলে আমার ধারণা। তবুও যে কিছু ঋণ হবে না, তা কিন্তু নয়। তবে সেটি পুনরুদ্ধার করার মতো সামর্থ্য আমার আছে। পরবর্তী প্রজন্ম টিকিয়ে রাখতে সামান্য গরু চুরিকে আমি আমূলে নিই নাই। আপনি অবগত আছেন, শুধুমাত্র জিনগত কারণে এক প্রকার পুরুষ ইঁদুর, বংশবিস্তার করার সাফল্য অর্জন করার জন্য নির্ঘাত মৃত্যু জেনেও, যৌনমিলন করে। কিন্তু ঐ বাইঞ্চোদ ভবিষ্যত প্রজন্মকে নস্যাৎ করতে চায়। কত্ত বড় নেমকহারাম! তাই আমি সন্তানের কথা ভেবে তাকে ঢিল ছুঁড়তে বাধ্য হয়েছি। আমি সজ্ঞানে কোনো অনৈতিক কাজ করিনি। অথচ তার মধ্যে এই সাধারণ বোধটুকুও নেই। আমার চুরির মতো মহৎ কর্মে বাঁধা প্রদান করায়, আমি তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কামনা করে বক্তব্যের সমাপ্তি টানছি।

সাত গ্রামের মুরুব্বী জনাব চেয়ারম্যান সাহেব, আমি কাহাতক কসাই। সারাই বাজারে আমার দোকান। লোকজন আমার সুনাম সুখ্যাতি সম্বন্ধে জানে। ওজনে কম দিয়েছি, কেউ বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে না। জনাব জব্বার হোসেইন একদিন আমাকে গরুটি দ্যাখায়। আমি দাম বলি এবং সে ঐ দামে সন্তুষ্ট হয়। যদিও এর আগে গরুটির প্রকৃত মালিক জালাল মিয়ার সাথে আমার দাম দস্তুর মেলে নাই। কিন্তু সে প্রসঙ্গ এখানে অপ্রাসঙ্গিক। আমি বলতে চাই, চোর ধরার ফলে আমার ব্যবসায়ে যে ক্ষতি সংঘটিত হয়েছে, সেই ক্ষতিপূরণের দাবি দাওয়া পূরণ করা হোক। আমার ঘরেও বাল বাচ্চা আছে। তাছাড়া আমার ভোক্তারা আজ মাংস কিনতে পারে নাই। আমার কসাই জীবনে আজ-ই প্রথম দোকান বন্ধ, যা আমার সুনাম ও প্রতিপত্তিতে কালো দাগ ফেলেছে। অতএব জনাবের নিকট আকুল আবেদন, সার্বিক দিক বিবেচনা পূর্বক আমায় ক্ষতিপূরণ দানে বাধিত করবেন।

মাননীয় চেয়ারম্যান মহোদয়, আমি জালাল মিয়া, গরুর বর্তমান মালিক। সম্প্রতি গরুটি আমি খামার থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসি। বস্তুত গরুটি ধানখেতে প্রবেশ করায় ক্ষুব্ধ চাষা আশাদুল্লাহ খামারে রেখে আসে। জরিমানা বাবদ চারশ টাকা আমার খরচা যায়। গরুটির মালিক হয়ে ওঠার গল্প আপনাদের জানা দরকার। পরলোকগত শ্বশুরের কৃপায় গরুটি আমার হস্তগত হয়। কেনার সাধ্য না থাকলেও গরুকে ভালোবাসার বিশাল মন ছিল তার। তাই তিনি অপরের গরু পোষা শুরু করেন। দীর্ঘ দশবছর পর তিনি গরুর প্রজন্ম পরম্পরায় ভাগ বাটোয়ারা হিসাবে একটি বাছুর পান। সেই বাছুরটি বড় করেন। মেয়েকেও তিনি সমান ভালোবাসতেন। তাই মেয়ের সাথে গরুটি আমাকে উপহার হিসেবে দ্যান। আল্লাহ তাকে বেহেশত নসীব করুন (আমিন)। শ্বশুরের দেয়া উপহার ও শেষ স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলার নীল নকশা প্রণয়নকারীদের সুষ্টু তদন্তের মাধ্যমে চিহ্নিতকরণ ও দোষী সাব্যস্ত করে, কঠিন শাস্তির জোরালো দাবি জানিয়ে আমি আমার বক্তব্য এখানেই শেষ করছি। ধন্যবাদ।

চেয়ারম্যান সাহেব, কৃষি অর্থনীতির মূল ভিত্তি। সেখানে গরুটি ধানখেতে প্রবেশ করে শস্যের যে বিনাশ ঘটায়, তার প্রভাব পড়তে পারে মানুষের খাদ্যসংকটে। ফলে গ্রামে দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক কিছুই না। তাছাড়া রয়েছে মানুষের জীবন সংশয়ে পড়ে যাওয়ার সমূহ বিপদ। গভীর অনুসন্ধিৎসা ও বিশ্লেষণে আমি গরুটি খামারে দেয়ার সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হই। যদিও প্রথমে আমি জালাল মিয়াকে অবগত করাই। কিন্তু সে সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারে নাই। বিচারে এই বিষয়টিও বিবেচনায় নিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করছি। জ্বী, আমি আশাদুল্লাহ, চাষবাস করে অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখি।

সকলের কথা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করলাম। আপাত অর্থে যদিও পরিস্থিতি জটিল মনে হচ্ছে, কিন্তু ততটা কি জটিল? কথাবার্তা জব্বার হোসেইনকে দিয়েই শুরু করি। তিনি পরিসংখ্যান প্রয়োগ করে যে গবেষণা সম্পাদনা করেছেন সেটির অনুলিপি সংরক্ষণ করার জন্য বলা হলো। পরবর্তীতে এই ধরনের কাজে যারা সম্পৃক্ত হবে, তাদের কথা বিবেচনায় এনে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো। আমরা জানি, গ্যালিলিওকে সত্য প্রচার করতে গিয়ে জেল খাটতে হয়েছিল। কাজেই কপালে ঢিল ছোঁড়া অস্বাভাবিক কিছুই নয়। এক্ষেত্রে ঐতিহাসিক আরও কিছু বিবৃতি দেয়া যাবে। মূলত নতুনত্বকে মেনে নেয়া সব সময়ের জন্যই কঠিন। জ্ঞানী, বিদ্বান জব্বার হোসেইনের প্রতি রইলো আমার প্রাণঢালা অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। (জব্বার হোসেইনের মুখে প্রশান্তির ছাপ) এবার বরকত উল্লাহ প্রসঙ্গে আসি। তার বর্তমান পারিবারিক দূর্দশার প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে তার ঢিল দেয়াকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা হলো। তবে সন্তান সম্ভবা স্ত্রীর ভরণপোষণ ঠিকঠাক পালন করাটা তার অবশ্য কর্তব্য। আয় নাই, এই খোঁড়া যুক্তি দাঁড় করানো তার ঠিক হয় নাই। এতে আমাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু আমি জনদরদী মানুষ। তাকে মাফ করে দেয়া আমার কর্তব্য, শুধুমাত্র যদি সে গরুটি চুরি করা থেকে নিজেকে অব্যাহতি দ্যায়, তখন। (বরকত উল্লাহ নিজেকে চুরি সংক্রান্ত সমস্যা থেকে নিজেকে খারিজ করে নিলেন) একদম! সবার আগে কৃষি, মানুষের মৌলিক অন্যতম প্রধান চাহিদা খাদ্য। আশাদুল্লাহকে ভবিষ্যত খাদ্য ঘাটতির বিপদ থেকে রক্ষা করার গৃহীত পদক্ষেপকে স্বাগত জানাই। (আশাদুল্লাহর বুক গর্বে ফুলে উঠলো) শোনেন, কশাই কাহাতক যদি চেয়ারম্যানের গরু জবাই ও মাংস কাটায় নিজেকে নিযুক্ত রাখে, তাহলে নিশ্চয়ই তার বিরাট সুনাম রটবে। এইদিক বিবেচনায় গরুটি জবাই করা হবে এবং এর দায় দায়িত্ব অর্পণ করা হবে কাহাতক কশাইয়ের ওপর। যাতে করে তার ব্যবসায়ের সমূহ ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া যায়। (কাহাতকের মুখে খুশির প্রতিচ্ছবি) এদিকে জালাল মিয়া, শ্বশুরের কাছ থেকে গরুটি যৌতুক হিসেবে নিয়েছে। এটি তার মস্ত বড় অন্যায়। তবে শ্বশুরের স্মৃতি রক্ষার্থে আমি সজ্ঞানে নতুন একটি অন্যায়ের সূত্রপাত ঘটাতে যাচ্ছি। যাতে তার মানসপটে আজীবন একটি ছাপ থাকে। মনে রাখবেন মানুষ সুখ, আনন্দ, হাসি-খুশির মুহূর্ত ভুলে যায় নিমেষেই। দুঃখ, বিষাদ, অন্যায়, শোষণ আর অবিচারকে মনে রাখে দীর্ঘদিন। স্মৃতিকে জাজ্বল্য রাখার জন্য গরুটি জবাই করে সব মাংস আমার ফ্রিজে রাখার জন্য বলা হলো। ধরুন, গরুটি চুরির পরিকল্পনা যদি সফল হতো, সেক্ষেত্রে কি হতো? তবে যেহেতু জালাল মিয়ার স্ত্রী ভুতে বিশ্বাস করে এবং আমি যাবতীয় কুসংস্কার বিশ্বাসী মানুষদের শ্রদ্ধা করি। কাজেই ঝোপজঙ্গলে গড়া টয়লেটে শিং দুটি রাখা হবে, যাতে ভুতের উপদ্রব থেকে জালাল মিয়ার স্ত্রী মুক্তি পায়। এক্ষেত্রেও আমার উদারতাও প্রশংসার দাবিদার। উপরন্তু চামড়া বিক্রি করার অর্থ মসজিদে দান বলে গণ্য হবে।

চেয়ারম্যানের পেয়াদা গরুটি নিয়ে গেলে সবাই চেয়ারম্যানের বিচারে সন্তুষ্ট হয়ে যে যার ঘরে যায়। শুধুমাত্র জালাল মিয়ার স্ত্রী চিৎকার করা শুরু করে, না, মানি না এই বিচার। আমার বাপের গরু সে নিয়ে যাওয়ার কে? তোমার কি ঐ কুত্তার গর্দানটা কেটে নেয়ার হিম্মত নাই? তুমি কিসের পুরুষ? তোমার গরু আরেকজনে ভোগ করে। আর তুমি মিয়া কাপুরুষের মতো চুপ করে থাকো। তখন জালাল মিয়া বলে, ‘গরুটি চুরি হয়ে গেলে তো শিং দুইটাও পাইতি না’। জালাল মিয়ার স্ত্রী বলে, ‘ওয়াক থু’। সে এই থু কাকে দ্যায় বোঝা যায় না। সামগ্রিক বিচার প্রক্রিয়াকে, স্বামীকে, চেয়ারম্যানকে, নাকি নিজেকে? তবে এই ঘটনার পর গ্রামে জালাল মিয়ার স্ত্রী ভূতে পাওয়া নারী বলে পরিচিতি পায়। এই যা উপরি পাওনা।

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu