জীম হামযাহ

জ্বর এবং ক্যাফেইন

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

জীম হামযাহ-এর গল্প


জ্বর এবং ক্যাফেইন


মাইনষে কয় আমার কালা জ্বর হইছে। মাথামুথা ঠিক নাই। জ্বরের ঘোরে আবুল তাবুল বকি। ছাত্রীর মা ফোন দিলে একবার ডাকি খালা একবার কই আপা। পয়লা কই– স্লামালাইকুম খালা। শেষে কই– আচ্ছা আপা কমলে আইমু। আমি ওষুধ খাই, পাশের রুমের বিবাহিত ব্যাচলর ময়েজ চাচা বলেন– লাভ নাই, খাইলেও তিনদিন না খাইলেও তিনদিন। তিন দিনের দিন তিনি একই কথা কইলে আমি কই– তুমার মাথা যত্তোসব! জ্বরে আমি বিয়াঙ্গাজ। বিছানা থেকে লাফ দিয়া বসি। কই, আজ জ্বরের একদিন না হয় আমার একদিন। বাথরুমে গিয়া আচ্ছামতো পানি ঢালমু। গায়ের সব জ্বর আজ ধুইয়া ফেলমু। জ্বরের ঘোরে হাতড়াইতে হাতড়াইতে পাই রুমের বড় ভাইর টেবিলে শ্যাম্পুর পকেট। বড় ভাই স্টাইলিশ মানুষ। অদ্য সদ্য প্রেমে পড়ছেন। কতো কি যে মাখেন। রাতমান ফোনে ঘ্যানর ঘ্যানর করেন। আমারে কইন- একটু আঙ্গাজ কররে ভাই। চণ্ডিদাসের বর্ষি বাইতে বাইতে বহুদিনে পাইছি। ঘ্যান ঘ্যান শুনতে শুনতে আমি ঘুমাইয়া পড়ি। স্বপ্নে দেখি পরী আইছে। আমি তার পিছে পিছে দৌড়াই। ধরতে পারি না। উড়াল দেয়, উড়াল!

বাথরুমে গিয়া জ্বরের ঘোরে শ্যাম্পুর পকেট টিপে টিপে সব মাথায় ঢালি আর ঘষি। ঘষতে ঘষতে কই এ আমি কী ঘষাই? না হয় পিছলা না দেয় ফেনা। সারা জীবন দেখলাম শ্যাম্পু ঘষাইলে ফেনা হয়। এটা তেল তেল করে আর ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগে। জ্বরের ঘোরে মনে করি নিউ ফর্মূলা হয়তো। বিজ্ঞানী বানাইছে। দেশে কতো কি আইছে। দেশ কি আর আগের মতো আছে, কতো উন্নয়ন হইছে। কেউ কয় দেশ এখন সিঙ্গাপুর, কেউ কয় প্যারিস কত কী!

গোসল করি একটু আরাম পাইলেও পরক্ষণে জ্বর আবার আসি আমারে জড়াইয়া ধরে। তোষের মতো রইয়া রইয়া পুড়ায়। আমারে আরো কাবু করছে। আমি চুপচাপ শুইয়া আছি কাঁথা একটার ওপর আরেকটা উড়িয়া। রুমমেট বড় ভাই আসি কন– কিরে কী অবস্থা?

আমি মাথা নেড়ে বলি– ভালা নায়। তারপর বলি শ্যাম্পুর কথা। আপনার শ্যাম্পু আজব শ্যাম্পু!

তিনি কন– কছ কি?

হ ভাই, তেলতেল, কুলকুল। ঠাণ্ডা লাগে।

কছ কি এসব, আমার শ্যাম্পু…।

টেবিলের ওপর থেকে নিছি, একটাই নিছি ভাই।

আরে কছ কী, তুইতো আমার নবরত্ন তেল শেষ করি ফালাইছোস!

আমি তাজ্জব! জ্বরের ঘোরে বলি– আপনি কি পাগল?

তিনি আরও তাজ্জব! কী কছ এসব!

নবরত্ন এটা পাগলের তেল না?

তিনি এসে আমার মাথায় হাত দেন।

তোর তো ব্যাপক জ্বররে, ধান দিলে খই ফুটবে।

এক উড়ি ভাজিয়া ফালাইন।

না, না তোরে বাড়িতে পাঠাইতে হইবো। দেরি করা যাইতো না।

গাউর মাইনষেও কয় আমার কালাজ্বর হইছে। যে হাত দেয় সে কয় বাপরে বাপ মাথাতো আগুইন! ওষুধ-পত্র কিছুতে কাজে আসছে না। ডাক্তার কবিরাজ এক হইয়াও জ্বর ছুটাইতে পারছেন না। আমার দাদি আমারে নিয়া পেরেশান আর পেরেশান। তিনি শুরু করলেন তার নিজের কবিরাজি। নিমপাতা সিদ্ধ দেয়া বড় একমগ তিতা পানি আমার মুখে চেপে ধরি বলেন– খা-চোখ বন্ধ করি খা। গলগলাইয়া খা। আমি একটু খেয়ে গলগলাইয়া বমি করি। তব্ওু দাদি আমারে ছাড়েন না। বলেন– আঙ্গাজ করিয়া খা। কাঁটায় কাঁটা তুলে আর বিষে কাটে বিষ। আমি খাই আর হু-ওয়াক, হু-ওয়াক করি। দাদি কন– খা, কিরিমিরি খাইয়া খা…।

জ্বর আমারে ছাড়ে না। রাতে কমলে দিনে বাড়ে, দিনে কমলে রাতে বাড়ে। আম্মার চোখে মুখে আতঙ্ক। আমি নাকি আজকাল ঘুমের মাঝে পরী পরী বলে চিৎকার দিয়া উঠি। পশ্চিমের বাড়ির দাদা আসি কন– আমার আন্দাজ মনে হয় ঠিক। আমার মন কয় উপড়ি লাগছে। তারে নিয়া তান্ত্রিকের কাছে যাও।

তান্ত্রিক-ফান্ত্রিক এসবে আমার বিশ্বাস নাই। তবুও আম্মা আমারে নিয়া যাবেন। আমার নিস্তার নাই। সেদিন মেসের বড় ভাইও দেখতে এসে তিনিও আমার সাথে গেলেন। কী আর কইমু, তান্ত্রিক ফকিরের চোখ দুটা সিদ্ধিখোরের মতো। গায়ে তার ছেঁড়া কাঁথা। হাতে কুঁকড়া লাঠি। একটু পর পর কয়– হায় জঞ্জাল! হায় জঞ্জাল! আমার দিকেও চাইয়্যা কয়– হায় জঞ্জাল! আমি মনে মনে কই তোর চৌদ্দগোষ্ঠির মাথা শালা সিদ্ধিখোর। তারপর সে বিড়বিড় করি কিসব পড়ে বুঝি না। আর কয়– হায় জঞ্জাল! হায় জঞ্জাল। আমার দিকে তাকাইয়া আম্মারে জিকায়– ও গেছিলো কোথায়? আম্মা বলেন, কী জানি, শহরে লেখাপড়া করে, মেসে থাকে…। রুমমেট ভাই কন– না এমনিতো কোথায় যায় না। আমাদের সাথেই থাকে। মাঝে মইধ্যে ছাদে যায়। বাড়িওয়ালার চোখ ফাঁকি দিয়া যায়। রাতে বিরাতে বাসার ছাদে উঠি বসি থাকে…।

তান্ত্রিক চোখ না খোলেই কয়– হ বুঝছি, বুঝছি- হেই তুই কি ছাদে পরী দেখতে যাছ?

আমি জোরছে মাথা উপর নীচ করি আর বলি– হ, হ, মাঝে মাঝে আসে আবার অদৃশ্য হইয়্যা যায়।

হায় জঞ্জাল– তোর ছেলেরে কুড়ুলায় পাইছে। বেতালা কুড়ুলায় তারে পাইছে। এই কুড়ুলা ছুটাইতে হইলে চালান দেওন লাগবো। দুই কেজি বিরোইন চাউল আর একটা বাঙ দেয়া লাল মুরগা সেই সাথে মাটির পাতিল আর ৭১৩ টাকা। অমাবইশ্যার রাতে মনুগাঙে গিয়া উল্টা চালান দিতে হইবো।

আমার পেরেশান আম্মা ৭১৩ টাকার জায়গায় আস্তা একটা হাজার টাকার নোট দিয়া দেন। আমি কই আম্মা, আম্মা…। তান্ত্রিক খপ করিয়া আমার হাত ধরে নাভিতে তার পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল চেপে ধরি মাথায় পিঠে লাঠি ছুঁইয়া ধাক্কা দিয়া কয়- দূর হ ব-লা! সে তাবিজ দিয়া সাবধান করে– খবরদার এই তাবিজ নিয়া সদ্য বাচ্ছা হইছে এমন কোন আওরতের কাছে যাইতে পারবে না।

আমি প্রায় শুইয়া থাকি। কখনো উঠানে বের হয়ে একটু হাঁটাহাঁটি করি। পুবের বাড়ির ভাবির ছেলে হইছে। আমি ভয়ে দেখতে যাই না। ঘর থেকে হুঁয়া-হুঁয়া কান্না শুনি। বিহানে উঠানে বসি বসি রোদ পোহাইতাছি। চাচিরে দেখিয়া ডাক দিয়া কই- নাম কিতা রাখলায় গো। চাচি কন– ভাতিজারে আইয়া দেখলায় না। আমি জ্বরের কথা ভুলিয়া যাই। আইরাম আইরাম কইয়া বেতাল হইয়া দৌড়িয়া যাই। ভাবি ছেলেটারে আমার কোলে দেন। ছেলে আমার দিকে টলটলাইয়া চায়। ভাবি কন– দেখতে তোমার মতো লাগে। আমি কই– দূরও, আমি কিতা তার বাপ লাগি নি আমার মতো লাগে। ভাবি হাসেন…।

জ্বরের কথা কী কইমু, সেই রাতে আবার আমার ঝাকঝাকানি জ্বর আসে। দাদি কন– সব্বনাশ, সব্বনাশ তাবিজের সত্ত্ব নষ্ট হইগেছে! আম্মা জগ দিয়া মাথায় পানি ঢালেন…। আবার আমারে নিয়া তারা বেফানা-বেসামাল।

আব্বা ছুটি নিয়া বাড়িতে আসেন। আর আমার অবস্থা দেখিয়া সবাইরে বকাঝকা করেন। আমারে নিয়া যান শহরের হসপিটালে। আমার মেসের ভাই বন্ধু দাদা সবাই আমারে সেখানে দেখতে আসেন। বেডে শুইয়া থাকি। একটু পর পর সাদা এপ্রোন পড়া মেয়েটি আমার কাছে আসে। ওষুধ খাওয়ায়, সেবা-যত্ন করে। আর আমার দিকে ড্যাবড্যাবাইয়া চায়। জ্বরে ঘোরে আমি তারে পরীর মতো দেখতাম। জ্বর যখন একটু কমে দেখি সেই আগের মতো। পরীইতো! আমিও তার দিকে পিটপিটাইয়া তাকাই। সে সিরিঞ্জ হাতে নিয়ে বলে ভয় লাগে বুঝি। আমি কোন কথা কই না। শুধু তাকাই। তারে দেখি আর দেখি। দু চোখ দিয়া গিলিয়া দেখি। সে হাসে। ভয় পেয়ো না, আমি তুমারে ব্যথা দিমু না। তুমি ব্যথা পাইলে আমিও যে ব্যথা পাই। তার মুখে এমন কথা শুনে আমার ভেতর ছ্যাৎ করি উঠে। সে মিষ্টি কথার ফাঁকে আখতা আমার শরীরে হুল ঢুকিয়ে দিতো!

আমি তার দিকে তাকাইয়া থাকি। কোন কথা কই না। সে আমার পাশে বসে আমারে জিগায়– তুমি কি আমারে ভয় পাও? আমি মাথা নাড়ি, না, তুমিতো পরী। সে নিঃশব্দ অথচ আরও মোহনীয় হাসি দেয়। আমাকে অভয় দেয়– তুমি এখন অনেকটা সুস্থ্য আমার দিকে ভালো করে চোখ খুলে তাকাও।

ভয় লাগে!

কেন?

তুমি পরী, ভালো করি তাকালে যদি চোখ পুড়িয়া যায়!

সে উচ্চস্বরে হাসে। হাসতে হাসতে আমার উপ্রে ঢলিয়া পড়ে। আরও পাশ ঘেষি বসে বলে– তুমি অনেক দুষ্টু আর মিষ্টি। আমার মাথায় হাত বোলায়, চুলে হাত বুলায়, চোখে-মুখে হাত বুলায়। আমার আরাম লাগে। আরামে দু চোখ বন্ধ করি দেই…।

দাদি আমারে কইতেন পরী ধরছোস ফুল হইবো, ছাড়িস না ছাড়িস না। দাদির কথায় আমি হাসতাম আর কইতাম এটা ক্যাফেইন গো দাদি ক্যাফেইন…!

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাইছিলাম সেই কতোদিন আগে। জ্বরও ছাড়ার আজ বহুদিন গত হয়েছে। কিন্তু ক্যাফেইন আমারে ছাড়ে নাই!

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu