আল-আমীন আপেল
বাংলাদেশের রংপুর জেলার সদর উপজেলায় জন্ম। পড়াশুনা বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর-এ। তরুণ লেখক। কবিতা ও ছোটগল্প লিখে থাকেন।
আল-আমীন আপেল

জ্যৈষ্ঠমধু

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

জ্যৈষ্ঠের শেষাশেষি। গাছে গাছে জারুল, সোনালু ফুলের হাসি ফুটতে শুরু করেছে। সোজা মাথা বরাবর বেহায়ার মতন তাপ ছড়িয়ে হাসছে চিরযৌবনা সূর্যটা! সে তাপের একটু ঝলক এসে চুমো দিচ্ছে আমার চাপদাড়িতে ভরা খসখসে গালে। এটাকে অন্য কোনোদিন হলে আমার ষোড়শী প্রেয়সী রুবির খানিক ‘উষ্ণতার চুম্বন’ মনে করতাম’; যেহেতু সেটা মনে করার সুযোগ পাচ্ছি না, তথাপি এটাকে সূর্যের নির্লজ্জতা হিসেবে মেনে নিয়ে শান্ত হতে হচ্ছে। তবে বুকের বাপাশে কামনার-ঈশ্বর খুব করে চেপে বসেছে। প্রেয়সী রুবির সাক্ষাত অতি জরুরী হয়ে পড়েছে। অথচ সারা দেশজুড়ে লকডাউন চলছে। করোনা ভাইরাসের দাপটে বড়লোকি ব্যামো ‘কোভিড নাইন্টিন’ বাসা বেঁধেছে আমার দেশে।

‘গেল ২৪ ঘন্টায় রংপুরে নতুন করে ১৪জন আক্রান্ত’

গতকাল টিভিতে এ ব্রেকিং নিউজে চোখ পড়ে তো খানিক খেই হারিয়ে ফেলেছিলাম। ১৪জন, তেমন ভয়ানক সংখ্যা নয় হয়তো; তবে সে সংখ্যাটা যে আশপাশের এলাকায় এসে পড়ছে– এটা ভয়ানক ব্যাপার-স্যাপার। ভাবতেই ভেতরটা ‘ভয়ের শীতে’ কেমন জড়সড় হয়ে আসছিল বারবার। কুকরুলে একজনকে করোনা ভাইরাস চেপে ধরেছে। আমাদের বাড়ি থেকে সেখানকার দূরত্বটা খুব বেশি হলে দুই গ্রাম হবে।

এবার করোনায় অনার্সের ফাইনাল পরীক্ষাটা আটকে আছে। অন্যান্য বছর আমার জন্য ঈদ ঈদ লাগে এই সময়ে। কাঁঠাল, জাম, আম, লিচুর মন মাতানো সুঘ্রাণে মাতোয়ারা হয়ে থাকি। পুকুরপারে বসানো বাঁশের টঙে বসে পুবালী বাতাস লাগাই সারা গায়ে। আর মাঝেমাঝে খেয়াল করি– গতিহীন বাতাস লুঙ্গীর ভেতর দিয়ে প্রবেশ করে প্রবাহের গতি খোঁজে; নাকি কবি সুবোধ সরকারের কবিতার: লুঙ্গির নিচে একটা জীবনে, বাহিরে একটা জীবন– কথাটির সত্যতা যাচাই করতে চায় ‘বাতাস’?

ব্যাপারটা কী রকম ঘেন্নার ঠেকে আমার কাছে! অথচ রকিব ভাইয়ের আঠারো বছর বয়সী বউ বানিছা বিবি পাছায়, আধখোলা বুকে এ বাতাসের পরশ মেখে যেন পরম শান্তির খোঁজ পায়! আমাদের মধ্যে দুই-একজন বান্দর প্রকৃতির ছোকড়া আছে। ওরা মাঝেসাঝে উঁকি মেরে বানিছা ভাবির স্তনের আকার বোঝার চেষ্টা করে। ‘স্তনগুলো নিটোল নাকি ঝুলে গ্যাছে! মাঝারি নাকি বড়!’–এমন লুচ্চামি গবেষণা করে। সেসব ভেবে হস্তমৈথুন করে কিনা আমার জানা নাই। আবার স্বপ্নে বানিছা ভাবি রে কেউ বিছানায় পায় কিনা সে কথাও অজানা, পাইলেও পাইতে পারে। অমন ছোকড়াদের স্বপ্ন বা কল্পনার উপরে তো আমার কোনো হাত নাই!

কুকরুলে মামাবাড়ি। ওখানে ছোটবেলায় বেশি যাতায়াত ছিল; আজকাল পড়াশুনা, বাড়ির গৃহস্থলী নানা কাজের কারণে তেমন যাওয়া হয় না। নানা-নানীর অভাবটা মামা-মামী গত পাঁচ বছর ধরে পূরণ করার সাধ্যমত চেষ্টা করেন, সচরাচর। তবে নানা-নানীর মতন তেমনটা তো পারেন না, কেউই হয়তো-বা পারে না; বিধাতার নিয়ম এটা।

দুই বছর আগে জ্যৈষ্ঠমাসে হলো কী– কলেজ বন্ধ বলে মামাবাড়ি গেলাম। গিয়ে তো সারপ্রাইজড! মামাতো বোনটাকে সেই ছোটকালে ওর মামার বাড়িতে সন্তানহীনতার দুঃখ ঘোচাতে দত্তক দিয়েছিলেন আমার মামা। সে খবর অজানা ছিল অনেক দিন। ব্যাপারটা জেনেছি বেশ পরে। তবে এইসব কথার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে– এখানে একটা গল্প তৈরি হয়ে যায়।

মামাতো বোন তো অনন্যা, অসাধারণ সুন্দরী! চৌদ্দ বছরের উঠতি যুবতী। মধ্যবিত্ত বক্ষদেশের অস্পষ্ট মানচিত্র আর মুখের মায়াবী হাসির ছোবলে যেন ভড়কে যাচ্ছিলাম, মরে যাচ্ছিলাম সেদিন! সে মরণে যেন অপার্থিব একরাশ সুখ হলহলিয়ে আমার পৃথিবীকে কাব্যময় করে তোলে।

সময় আর সুযোগের হিসাব করে তাই ওর ঠোঁটে ঠোঁট রেখেছিলাম, সাহস করে। প্রচন্ড ত্রাসে ছিলাম। উল্টো কিছু হয়ে যায় নাকি, মামাকে বলে দেয় নাকি! কিন্তু, না! সেই ত্রাসকে পরিহাস করে সে প্রেমগন্ধীর মতন হেসেছিল সেদিন।

এই চপলা মেয়েটিই আমার প্রেয়সী। রুবি ওদের বাড়িতে বিশেষ আসে না ছুটিছাটা ছাড়া। আমারও আগের চেয়ে যাওয়া কমে গেছে। তেমন যাই না এখন, কোনো উপলক্ষ ব্যতীত।

তবে ওর সাথে আমার প্রেম জমে পউষে, তারচে’ এমন জ্যৈষ্ঠের গরমকালে কিংবা আষাঢ়ের দিনে। কারণ, মামা এ সময়গুলোতে ব্যস্ত থাকেন। আম-কাঁঠালের মৌশুম এলে আম-কাঁঠালের ব্যবসায় করেন। ফলতঃ বাড়িতে কম সময়ই তার দেখা মেলে। আমার আর রুবির প্রেমটাকে মামী বোধহয় সহজভাবেই নেন, আজ অবধি কিছু বলেন নি। আবার উল্টোও হতে পারে– দেখা গেল উনি কিছুই খেয়াল করেন না আমাদের এসবের। আম-কাঁঠালের মৌশুম পেরুলে মামা পাইকারী দরে ধান কেনা-বেচার ব্যবসায় ধরেন। মূলত টাকার সাগর থাকেন মামা। এই ভাসেন, এই ডুবেন! ভাসা-ডোবাই যেন তার কাজ।

কোনো একদিন পাটক্ষেত অথবা ভুট্টাক্ষেতের আড়ালে রুবি যদি আমাকে ডাকে, তবে আমার ভেতরের মানুষটার নিষেধ না শুনে বাহিরের মানুষটা ওর কাছে ছুটে যায়। আহা! মোহনীয় ঘ্রাণ ওর শরীরময়। এভাবেই জমে আমাদের জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় কিংবা পঊষ প্রেম।

এখন আসল কথা হচ্ছে: গতকালের ব্রেকিং নিউজটাতে আলবত শঙ্কাবনে যাওয়ার কথা সবার। এবং তাই হয়েছে। এলাকা লকডাউন করেছে পুলিশ। তবে আমার আবার জ্যৈষ্ঠপ্রেম জেগে উঠছে আজ! এখন রাক্ষুসে সূর্যের তাপে খানিকটা ভাটা পড়েছে। হেলে পড়া সূর্যের আধমরা আলো মাঝেমধ্যে নেচে নেচে উঠছে পুকুরের জলে। আজ বানিছা ভাবিকে দেখা যাচ্ছে না। মরণ রে যে বাঙালি আজকাল ডরাচ্ছে না, এটা আমার এই ভাবি ভুল প্রমাণ করে বাড়িতে দিব্যি ঘাপটি মেরে বসে থাকে। খিদের-ঈশ্বরের চে’ তো কামনার-ঈশ্বরের জোর আজ বেশি মনে হচ্ছে! মাথায় চেপে বসেছে জ্যৈষ্ঠদেবী রুবি। সাক্ষাতটা আজ করা চাই।

লকডাউন এরিয়া খুব কষ্টে ক্রস করে বাইসাইকেলে চেপে মামার বাড়ির পথে যাচ্ছি অনেকক্ষণ ধরে। রাস্তার দুধারে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেতে ধানকাটার পর নাড়া পড়ে আছে শুধু। কোথাও কোথাও পাটক্ষেত, ভুট্টাক্ষেত। দারুণ বাতাসে কামনার ঘ্রাণ, মনে চটকদার সময়! আহা!

বেলা গড়িয়ে পড়ন্ত বিকেল ডেকে এনেছে।

মামাবাড়ি সামনে, এ রাস্তা দিয়ে একটু মোড় ঘুরলেই। সে মোড়েই বাঁশ দিয়ে যাতায়াত বন্ধ করা হয়েছে। আমার কেন জানি পিলে চমকে গেল! মামাবাড়ির কেউ…!

না-হ্যাঁ এসব ভাবতে ভাবতে অনেক সময় নষ্ট করছিলাম আমি। বিশ্রী একটা ঘোরে পড়েছি যেন! হঠাৎ, আমাকে উদ্দেশ্য করে মুখের মাস্ক নামিয়ে খানিক দূর থেকেই কবির কাকার গলা হতে ভেসে আসে: ‘ওরে মিয়ার ব্যাটা! কোনঠে যাইস? আইজ বিয়ানবেলা একটা এম্বুলেনচ আসি রুবিক নিয়া গেল হাসপাতালোত। চেঙরিটাক বোলে ভাইরাস ধরছে! টিবিত দেখাইচে কাইল উয়ারে খবর বোলে! রেপোটত নাকি ভাইরাস পাইচে!’

আমি তো কিংকর্তব্যবিমূঢ়! কী বলে এসব কবির কাকা!

একটা এলো-হাওয়া যেন বয়ে গেল আমাকে ছুঁয়ে। আমার চোখের সামনে যেন ভাসছে একটা পাটক্ষেত। রুবি আমাকে ডাকছে। আমার ভেতরের মানুষটা বরাবরের মতন নিষেধ করছে কাছে যেতে। বাহিরের মানুষটাও আজ মোহগ্রস্ত হয়ে রুবির কাছে যেতে ভয় পাচ্ছে।

এই পাশটায় পটিয়া গ্রাম ওপাশে কুকরুল, মাঝখানে যোগাযোগ বিছিন্নের এ দেয়াল! এই গ্রামের বাতাস ওই গ্রামের বাতাসে মেশে। ওই গ্রামের বাতাস মেশে এই গ্রামের বাতাসের শরীরে। নিত্যকার এ সহজ ব্যাপারটাকে জটিল করেছে, বাতাসে আতঙ্কের বীজ ছিটিয়েছে ‘কোভিড নাইন্টিন’।

আমার চোখ হঠাৎ স্থির হলো এলাকায় বহিরাগত ঠেকাতে রাস্তার মোড়ে দেয়া বাঁশের বেড়ার দিকে। আজ এ বাঁধা ডিঙে মামাবাড়ি যাবার সাধ্য যেন নাই আমার! এ কথা ভেবে চোখ ভিজে আসছে আমার…! এটা স্রেফ আবেগজলের বুদবুদ। সত্যি নয় হয়তো-বা; এমনকি সত্যি হলেও আজ হাসপাতালে থাকা রুবির কাছেও যাবার ক্ষমতা বা ইচ্ছা কোনোটাই আমার নাই!

মুখে মাস্কটা ঠিক মতন পড়ে নিয়ে নিজের বাড়ির পথে হাঁটছি। সাইকেলে চেপে যাবার শক্তিটা তেমন পাচ্ছি না। পরিচিত রাস্তা ধরেই যাচ্ছি। স্মৃতির-ঈশ্বর রুবির সাথে পার করা সময়ের নানা স্মৃতি মনে তুলে দিচ্ছে।

স্মৃতি-রোমন্থনের ঘোর আমাকে যেন আরেকটা ঘোরে ফেললো! মনে হতে লাগলো হাসপাতালের আইসিইউ বেড হতে একটা পরিচিত স্বর ভেসে আসছে: এই বাবু, একটা চুমু দাও না! কতদিন! কতদিন আদর করো না মনে আছে?’


 

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu