ওবাইদুল ইসলাম

যে স্বপ্নটা আমাদের হলো না

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

ঠিক সাতাশ দিন পর অনুপমদা ক্যাম্পে ফিরে এলেন। আমার একটু বেশিই খুশি হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু আমি খুশি হতে পারছি না। যে মানুষটা কঠিন সময়েও মুখে কী করে হাসি ধরে রাখতে হয় তা শেখায়, আজ হাসির প্রতিদানে তার মুখের হাসিটা আর নেই। যাকে দেখছি তাকে অনুপমদা বলা যায় না। পুরো-দস্তুর পাগল বলতে হয়– ছেঁড়া প্যান্ট, উসকোখুসকো লম্বা চুল, শরীর ভেঙে গেছে, মুখটা পোড়া। দাঁড়িটাও যেন সময়ের তুলনায় বেশিই বেড়েছে। খুব বেশিই যে ধকল গেছে এবং সে যে ভয়ানক অসুস্থ সেটা স্পষ্ট। এই বিভিন্ন বয়সী মানুষের ক্যাম্পে আমরা হাত উড়ে যাওয়া, গুলি লেগে পঙ্গু হয়ে যাওয়া, এমন কী আমাদের কারো মৃত লাশ গ্রহণ করতেও আমাদের মানসিকতায় তেমন নাড়া দেয় না। সহজেই গ্রহণ করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কিন্তু মানসিকভাবে ভেঙে পড়া কাউকে গ্রহণ করতে আমাদের সমস্যা হয়। এখানে আমাদের মানসিকতা এক রাখতে হয়। আমরা বলতে তেইশ জন। কোনো রকম পিছুটান, মানসিকতায় বিন্দু পরিমাণ ফাটল ধরালেই আমাদের মৃত্যু। এ মৃত্যু মানসিক মৃত্যু। মানসিক মৃত্যুই আসল মৃত্যু। শারীরিক মৃত্যু কেবল মানসিক মৃত্যু থেকে মুক্তি দেয়। আমাদের প্রতিদিনই এই মৃত্যুর সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু তারপরেও আমরা শারীরিক মৃত্যু চাই না। আমরা অন্তত একদিন বেশি হলেও বাঁচতে চাই। যুদ্ধ করতে চাই। স্বাধীনতা চাই। খুব সাদামাটা সংসারে পরম মমতা মাখা মুখ দেখে মরার স্বাধীনতা।

অনুপমদা মারা গেছে। যেরকম মরণ দেখে আমরা অভ্যস্ত তেমনটা নয়। আমার কাছে মৃত্যুর নতুন স্বরূপ প্রকাশ পায়। সে আর আগের মত কাছে আসে না। আমাদের তেমন আর ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’ গানটা গাওয়া হয় না। স্বাধীনতার পর ‘স্বাধীন’–কে আমরা কী কী গল্প শুনাবো সেই গল্প আর আমাদের করা হয় না। মাঝে মাঝে আমরা অপারেশনে যাই। যুদ্ধ করি। পাশাপাশি লড়ে যাই। হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের কথা হয়। মুখের কথায় প্রকাশ করার মতো সে কথার মিষ্টতা এখনো মনুষ্য সভ্যতায় আসেনি।

সময় আমাদের যোদ্ধা করেছে। আবার এই সময়ই আমাদের থেকে কাউকে কাউকে শহীদ করে দেয়। ২৩ জন থেকে আমরা কখনো হয়ে যায় ১৭ কিংবা ১৫। আবার নতুনেরা এসে আগের ক্ষতগুলো ঢেকে দেয় নতুন নতুন উদ্দীপনায়। আমরা যুদ্ধে ডুবে যাই। নতুন প্ল্যান সাজাই। ধ্বংসস্তূপের উপর আমাদের সংসার গড়ি। এই একটা যায়গায় অনুপমদাকে আগের অনুপমই পাই। এই একটা জায়গায় আমাদের একাগ্রতা এক। আমাদের যুদ্ধটা এক।

কিন্তু অনুপমদা, যাকে আমি বলি ‘ভাই’ তার যুদ্ধটা ছিলো দ্বিমুখী। বাইরে দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ। আর অন্তরে এই নিষ্ঠুর সময়ে সদ্য পৃথিবীতে আসা ছেলে স্বাধীনের জন্য যুদ্ধ। স্বাধীন নামটা আমিই দিয়েছিলাম। একদিন রাতে বাংলাদেশ বেতার শুনে আমি ঘুমাতে যাই। অনুপমদা জেগে থাকেন। আমাদের দুর্গের পাহারাদার হয়ে এদিক সেদিক হাঁটতে থাকেন। কিছুদিন আগে তার একটা ছেলে হয়েছে। আমি নাম দিয়েছি ‘স্বাধীন’। আমি বললাম আমাদের ছেলের নাম হবে–স্বাধীন। আমাদের বলছি কারণ আমাদের আত্মাটা ছিলো এক। আমাদের সংসারটা ছিলো এক। এই দেশটাই সবচেয়ে বড় সংসার। আমাদের সংসার। স্বাধীনদের চোখে আজ ঘুম নেই। অনিশ্চয়তা, উদ্বাস্তুতায় কেবল দিক বিদিক ছুটে চলেছে। স্বাধীনদের পাশে অনুপমদার মতো পাহারাদার নেই। স্বাধীনরা আজ ভীষণ অরক্ষিত। অরক্ষিত এই দেশ।

ঢাকার নামী হিন্দু পরিবারে জন্ম অনুপমদার। হিন্দুদের উপর নির্যাতনের মাত্রা ছিলো বর্ননাতীত। আর একটু নাম ধাম থাকা মানে ছিলো ভয়ঙ্কর নির্যাতন। তারপর মৃত্যু। হাজার হাজার হিন্দু পরিবার ভারত চলে যাচ্ছিল। অনুপমদা তার পরিবারকে যশোর রেখে এলেন। পথে পথে যে বাংলাদেশ সে দেখে এসেছিল তা আমাদের এক করে দিলো। নিছক ধর্ম আমাদের আলাদা করতে পারেনি। বয়স আমাদের দূরত্ব বাড়াই নি। আমরা একই রকম চিন্তা করি। একই রকম সংসার করি।যুদ্ধের সংসার পাতি।

যুদ্ধের পর দেশটা কিভাবে গড়বো সেই চিন্তা করি। স্বপ্নের গল্প করি। এতে আমাদের প্রশান্তি লাগে। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে আসে। আমরা ভবিষ্যৎ দেখতে পাই। আমরা নতুন বাংলাদেশকে স্পর্শ করার অনুভূতি পাই।

অনুপমদারও বাংলাদেশকে স্পর্শ করার নেশা পেয়ে বসেছিল। স্বাধীনকে অসময়ে পৃথিবীতে নিয়ে এসেছিল বলে তার মধ্যে কেমন একটা বোধ কাজ করতো। এই পৃথিবী যেখানে নিজেদের বাসের যোগ্য না, সেখানে এতো এতো অনিশ্চতায় নতুন একটা প্রাণ। যার পেছনে জন্ম থেকেই অন্ধকার, ভয় তাড়া করে চলেছে অনবরত। স্বাধীনই ছিলো ভূমিষ্ঠ হওয়া নতুন বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে ছুঁয়ে দেখতে কার না ইচ্ছা করে? সে তার সন্তানকে দেখতে চেয়েছিল।

স্বাধীনকে পাওয়া যায়নি। পরিবারের কাউকেই পায়নি সে।অনুপমদা পাগলের মতো ফিরে এসেছে। আবার যুদ্ধ করেছে। মানুষ হিসেবে যতটুকু শক্তি দিয়ে যত রকম যুদ্ধ করা যায়। কিন্তু আমার এই যোদ্ধার সাথে স্বাধীনতা প্রাপ্তির শেষ যুদ্ধ করা হয়নি। অসহায়ের মতো তাকে আহত যোদ্ধা ক্যাম্পে ফেলে রেখে চলে এসেছিলাম। তার পায়ে গুলি লেগেছিল। তার যুদ্ধের শেষ আর হয়নি। স্বাধীনতাকে স্পর্শ করাও হয়নি তার।

চলে আসার সময় আমাকে বলেছিল– মানুষ আসলে কখনোই স্বাধীন হতে পারে না। মানুষের ভেতরে পরাধীনতাকে আঁকড়ে ধরার প্রবণতা প্রবল। মানুষ স্বাধীন হয়। আবার নতুন করে পরাধীনতার শিকলে আসতে চাই। হতে পারে সেটা ভালোবাসার শিকল। সংসারের শিকল। এই শিকল কেবল মৃত্যুতেই ছেঁড়ে। তাই মৃত্যুতে মানুষের ভয়। বন্ধন ছেঁড়ার অসহ্য কষ্ট।

আমি অনুপমদার সেই বন্ধনের শিকলের পরাধীনতা রাখিনি। ছিঁড়ে স্বাধীন হয়ে চলে এসেছিলাম।

আমার বয়স এখন ৭১। মাঝে মাঝে শাহবাগে যাই। এখনো আমার অধিকার আদায়ের যুদ্ধ শেষ হয়নি। আজ শাহবাগ থেকে ফিরতেই অনুপমদাকে দেখি। যেন ৪৭ বছর বয়সী বাংলাদেশের মতোই নিজের ভরে ন্যুব্জ শরীর। শুধু একটা পা নেই। পঙ্গু। অনেক কথা হলো। পুরনো দিনের মতোই হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের কথা। যাওয়ার সময় বলে গেল– স্বাধীনকে আমি আর খুঁজে পাইনি। যে স্বাধীনতা চেয়েছিলাম সেটাও পেলাম না। জানো তরুণ, আমার স্বপ্নটা কেবল আমাদের হলো না।

আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসলো। আমি অনুপমদাকে দেখতে পেলাম না। যেন একটা বাংলাদেশ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। সামনে এগিয়ে যাচ্ছে নাকি পেছনে যাচ্ছে সেটা বুঝতে পারলাম না।


 

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu