আবু তাহের
কবি ও গল্পকার
আবু তাহের

যে জীবন কুকুরের বিড়ালের

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

ভার্চুয়াল উঠানে ভেসে বেরানো ছোটো এই গল্পটি আপনি নিশ্চয়ই পড়ে থাকবেন। আনসার গল্পটা পড়ার পর তার শত শত গ্রাহককে শুনিয়েছেন। কাজের ফাঁকে সামান্য অবসর পেলেই বলতে শুরু করেন– স্বর্গের দরজায় তিন ব্যক্তি দণ্ডায়মান, ঈশ্বরের, অলৌকিক কণ্ঠস্বর ভেসে এল—‘তোমাদের মধ্যে মাত্র একজন স্বর্গে আসতে পারবে।’ প্রথমত ধর্মপূজারি: আমি আপনার উপাসনায় নিজেকে সপে দিয়েছিলাম, স্বর্গে প্রবেশের অধিকার আমারই বেশি। ঈশ্বর নিশ্চুপ। দ্বিতীয়ত সমাজসেবক: আমি সারাটা জীবন আপনার সৃষ্টির সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছি, গরীব-দুখির দুঃখ দূর করেছি, স্বর্গে প্রবেশের অধিকার আমারই বেশি। ঈশ্বর নিশ্চুপ। তৃতীয়ত বেসরকারি চাকুরিজীবী: আমি মৃত্যুবদী একটা কোম্পানিতে চাকরি করেছি পৃথিবীতে আমার মতো কষ্ট… ‘থাম’, ঈশ্বর আবেগী কণ্ঠে ধমক দিয়ে বসলেন– আর একটা শব্দও বলবি না…আমারে কান্দাবি নাকি পাগলা…আয় ভেতরে আয়…তোর সারা জীবন বসের ঝাড়ি খাওয়া, পদোন্নতি না হওয়া, বছর শেষে বেতন না বাড়া, অফিস-রাজনীতি সামলানো, বিনা পয়সায় ওভারটাইম, রাত করে বাড়ি ফেরা, বাসে ঝুলে আসা-যাওয়ার কষ্ট, উইকেন্ডেতে বাসায় কাজ করা, পরিবারকে সময় না দেওয়া, সংসার চালানোর কষ্ট…কয়টা বলবো…সেন্টিমেন্টাল করে দিলি রে পাগলা…আয় ভেতরে আয়…

আনসার গল্পটি হয়তো এই জন্যই বলে যে, সেও একটি ফুড প্রোডাক্ট কোম্পানির সেলসম্যান। এই শহরের দক্ষিণ কোণায় একটি খুপড়ি বস্তিতে বউ আর ছয় বছরের মেয়েটিকে নিয়ে ছোটো সংসার। ষাটোর্ধ্ব বাবা-মা থাকেন গ্রামের বাড়িতে, এখান থেকে প্রায় একশো কিলোমিটার ঢালুর দিকে। আনসার বুড়ো বাবা-মাকে ফেলে বউ-মেয়েকে নিতে চায়নি। বাবা-মায়েই জবরদস্তি করে সাথে জুড়ে দিয়েছে, এখানে তার খাওয়া-দাওয়া, যত্ন-আত্তির কোনো মানুষ নেই।

আনসার অফিস ফিরে ঘুমানোর আগে প্রতিদিন মার্কেটিং হেডের কাউন্সিলিং-গুলো স্মরণ করে, ‘দিনের রুটিন রাতে ঘুমানোর আগে ঠিক করে রাখতে হইবো, কাজের স্থান, কাস্টোমার টার্গেট, পন্যের বিবরণ, প্রতিদ্বন্দ্বীদের গতিবিধি ইত্যাদি। আনসার এইসব ভাবে আর সকালের অ্যালার্ম অন করে ঘুমের ভেতর প্রবেশ করে। রুমানা বেশ কতকবার বলেছে ‘দরকার নেই অ্যালার্মের। সকালবেলা ঠিক সময় আমিই ডেকে দেবে।’ বউয়ের কথায় মোটেও ভরসা হয় না। অ্যালার্ম দিয়ে ঘুমায়, আবার ঘুমের ঘোরে বারবার ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে, অ্যালার্ম ঠিক আছে কিনা! অথবা অ্যালার্ম বেজেছে সে হয়তো শুনতে পায়নি। এইসব করতে করতে প্রতিদিন সূর্য ওঠে, প্রতিদিন দেরী হয়ে যায়। আগামীকালের ঘামভেজা শার্ট পরদিন আবার গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে পড়ে। বসের সামান্য একটা দেশলাই কাঠির ইঙ্গিতে সারাদিন পুড়তে থাকে। পুড়তে পুড়তে যখন মধ্যরাতে লাল হয়ে ঘরে ফেরে তখন রুমানা আনসারকে আর চিনতে পারে না। অথচ রুমানা প্রতিদিন ভাবে কাল হয়তো ঠাণ্ডা বাতাস বইবে, কালের দিনটা হয়তো একটা শান্ত স্নিগ্ধ দিন হবে। না, প্রতিদিনই আনসার বারুদের শরীরে একটা আগুন নিয়ে ঘরে ফিরে। কতো ব্যর্থ রাত, কত শত ব্যর্থ স্বপ্ন নিয়ে রুমানা চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আনসারের জন্য অপেক্ষা করে! দিন যায়, সপ্তাহ যায়, আনসারের সাইকেল চড়ে রুমানার রমননগর যাওয়া হয় না। প্রতিরাতেই তার ঘর থেকে একটা কয়লাভর্তি ট্রেন, মধ্যরাত ছেড়ে চলে যায় সকালের উদ্দেশে।

আজ বৃহস্পতিবার, মাসের শেষদিন। শুক্রবার-শনিবারের পর বরিবার সবেবরাতের ছুটি। সূর্যের কিরণে বালির মতো আনন্দে চিকচিক করছে আনসারের মন। সে ফুরফুরে উচ্ছ্বাস নিয়ে গোসল সেরে খেতে বসেছে। রুমানা আনসারের ভাতের থালায় লাফা শাখের ঝোল ঢালতে ঢালতে ঠোঁটভর্তি স্নিগ্ধ হাসি চেপে বলে, আজি সকালে মাই নাস্তা খাবার সময় কি কহচে জানেন? মাঝরাতি আসে সকালে বের হয় যাছে লোকটা কায় মা? আনসার তখন লাফা শাকের ঝোলে সাঁতার কাটা ভাতগুলো পাঁচ আঙুলের ভেতর আটকানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। আর ভাতগুলো ঘোলাপানির মাছের মতো আঙুলের ফাঁক দিয়ে ছুটে পালানোর চেষ্টা করছে। আনসারের কাছে মনে হয়, অধরা ভাতগুলো ঠিক শহরের একেকটি মুদি দোকানদার। সে থালায় মধ্যে শহরের অলিগলির দোকানগুলো কল্পনা করার চেষ্টা করে। বউয়ের কথায় খুব মনোযোগী হতে পারে না।

খাওয়া সেরে তার সব কিছু সাজগোছ করে বের হওয়ার সময় বউকে গ্রামের বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিতে বলে উল্টোপাশে ঘুরাতেই চোখ পড়ল, ঘুমন্ত মেয়েটার দিকে, মেয়েকে নিয়ে তার বউয়ের কথাটা মনে করার চেষ্টা করল। “মাঝরাতি আসে সকালে বের হয় যাছে লোকটা কায় মা?” কথাটার মিনিং খুঁজতে খুঁজতে মুখটা পানসে হয়ে আসে আনসারের! পানসে মুখ নিয়েই বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়।

সকাল ও দুপুর এ দুই টাইম বাসে সিট পাওয়াটা বড় কষ্টকর। এখানেই মনটা বিগড়ে যায় আনসারের। লোকালবাসে ঝুলতে ঝুলতে তাকে কর্মের ভেতর ঢুকতে হয় আবার ঝুলতে ঝুলতে বের হয়ে আসতে হয়। অন্যদিনের তুলনায় আজকের ভীড়টাও দম আটকানো। পা রাখার জায়গা পর্যন্ত নেই।

লোকাল বাসে উঠলে মেয়েদের হেফাজতের কথাটা প্রায় মাথায় আসে আনসারের। আজও কয়েকজন স্ত্রীলোক তার সামনে পিছনে দাঁড়ানো। এতোই ঘেঁষাঘেঁষি যে, কয়জন দাঁড়ানো নির্দিষ্ট করে বলতে গেলেও বারবার হিসাব গুলিয়ে যায়। আনসার মেয়েদের একটু বেশি করে জায়গা ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। আবার কখনো কখনো হিংসে করে, এই জন্য যে, বাসে নির্দিষ্ট সিট দখল করে মেয়েরা নিজেরাই নারী-পুরুষ বৈষম্য সৃষ্টি করছে। বাসের ভীড় ভাট্টার ভেতর আনসারের ফোনটা বেজে ওঠে। এপকেট ওপকেট হাতরাতে হাতরাতে কল কেটে যায়। ফোনটা বের করে দেখে– জোনাল ম্যানেজার। অবিরাম গাড়ির হর্ন, চেচামেচি, ঠেলাঠেলির মধ্যে ফোন দেওয়ার ইচ্ছে হয় না, কিন্তু একটু এদিক ওদিক হলেই সর্বনাশ হয়ে যাবে। আনসার ভেবে চিনতে ফোন ব্যাক করে সালাম দেয়, প্রত্যুত্তরে ভেসে আসে, কি মিয়া ফোন তুলতে কষ্ট হয়?

স্যার বাসে আছি খুব গোলমাল, একটু পরে ফোন দেই?

রাখো মিয়া গোলমাল, আমি সারাদিন তোমার ফোনের অপেক্ষায় বইসা থাকবো? হুনো, আজকে হ্যান্ডসাম একটা কালেকশন দিবা বেতন দিবার লাগবো তো নাকি?

জ্বি স্যার।

সব মালপত্র ভ্যানে নিয়া ডিস্টিবুটারের কাছ থেইকা টাকা নিয়া ব্যাংকে লাগায়া দিবা আজ ব্যাংক আওয়ার দুইটা মনে রাইখো।

জ্বী স্যার। ওকে।

কিছুক্ষণ পর আনসার বাস থেকে ভীড় ঠেলে মানতে গিয়ে সামান্য একটা হোঁচট খায়, এই সামান্য হোঁচটে তার ডান পায়ের জুতার তলাটা খসে পড়ে। আনসারের মনে হয়, সে প্রতিমাসেই ভাবে এই মাসের বেতনটা পেলে একজোড়া নতুন জুতা কিনবে। কিন্তু পুরো মাসের বাকী পরিশোধ করতে করতে তা আর হয়ে ওঠে না।

আনসারের আর ইচ্ছে হয় না, দীর্ঘ ছ’মাসে ছয়বার সেলাই করা জুতা দুটো আবার মুচির কাছে নিয়ে যায়। কিন্তু সময়টা এমনই খারাপ মুচির কাছে না নিয়ে উপায় নেই। অথচ সন্ধ্যায় হলে সে হয়তো আর মুচির কাছে যেতো না। বেতনের প্রথম টাকাটা দিয়ে একজোড়া নতুন জুতোই কিনে ফেলত।

আনসার মুচির কাছে যায়, ছেঁড়াটা দেখায়, মুচি জুতাটা উল্টেপাল্টে দেখে বলে, তার আরও অনেকগুলো কাম আছে দেরি হবে।

আনসার দ্বিতীয় মুচির কাছে যায়, সে তার যন্ত্রভর্তি বাক্সটার উপর হেলান দিয়ে উদাস ভঙ্গিতে সিগারেট ফুঁকাচ্ছে। আনসারকে এগিয়ে আসতে দেখে আগেভাগেই বলে, ভাই দেরি হইবে।

লজ্জা ও রাগে আনসারের চোখ লাল হয়ে যায়, আগপিছু করতে করতে তৃতীয় মুচির কাছে গেলে, মুচকি হেসে বলে, ভাই এই জুতা ঠিক করে কি করিবেন, এই জুতাত তো সেলাই তাকিবার নোহয়।

আনসার বলে, ভাই কাজে বাহির হইচি, কোনোপ্রকার আটকায়া দেন, দিনটা কাটুক।

মুচি যত্নের সাথে জুতাটা সেলাই করে, আনাসার মুচির বাক্সের উপর পা তুলে বসে একটা সিগারেট ধরায়।

সেলাই শেষ হলে আনসার ছুটে যায় ডিস্টিবুশনে, মালামাল রিজার্ভে তুলে ঈদের ফূর্তি নিয়ে মাঠে নামে, রোদে চিকচিক করছে চারপাশ। মন ভালো থাকলে যে কোনো পরিবেশেই ভালো লাগে। মন ভালো না থাকলে ঠিক এর উল্টোটা দেখায়।

কিছুক্ষণের মধ্যে কর্মসীমায় প্রবেশ করে, মুখ ভারী হয়ে আসে আনসারের, অন্য দিনের তুলনায় বৃহস্পতিবার পণ্যের চাহিদা বেশি থাকে, কিন্তু আজ সম্পূর্ণ উল্টোচিত্র। পরপর তিনদিন ছুটি, অল্প মেয়াদের পণ্যগুলো কেউ রাখতে চায় না। রাখতে চাইলেও তিনদিন পর টাকা দেবে, অনেকই বলছে।

আনসার খুব অনুনয় বিনয় দেখিয়ে দু’একটা প্যাকেট গুজে দেওয়ার চেষ্টা করে। কেউ নেয় কেউ ফিরিয়ে দেয়। আনসারেরা যাওয়ার পথে পণ্য দিয়ে যায়, ফেরার পথে কালেকশন নিয়ে ফেরে।

ফিরতি পথে আনসারের চোখ ছানাপড়া হয়ে যায়, কোনো দোকান থেকেই শতভাগ কালেকশন পাওয়া যায় না, কেউ অর্ধেকটা দেয় তো কেউ দু’একটা প্যাকেটেই ফিরিয়ে দিয়ে বলে, ভাই, বিক্রিবাট্টা ভালো নোহয়, তিনদিন দোকান বন্ধ থাকিবে, হুদাই প্যাকেটগুলা ইঁদুর তেলাপোকা কাটিলে আরও ঝামেলা বারিবে।

আনসারের শরীর ঘামতে থাকে, ধীরে ধীরে ঘামটা এতোই বেড়ে যায় যে, ভাদ্র মাসের জমাট মেঘ থেকে ছড়াছড়া বৃষ্টি পড়ার ন্যায় কপাল থেকে ঘাম ঝরে।

কিছুক্ষণের মধ্যে ম্যানেজারের ফোন আসে, কল ধরতে গিয়ে আনসারের আঙুল কাঁপতে থাকে। দু’হাতে মোবাইলটা শক্ত করে চেপে, কলটা রিসিভ করে। ম্যানেজার বলে, কি সব মাল বিক্রি করছোস? আনসারের জিহ্বা পর্যন্ত শুকিয়ে যায়, খুব কষ্ট করে দু’টো ঢোক গিলে আলতো করে উত্তর দেয়, না, স্যার। কও কি? কতোডি আছে? আনসার, আছে স্যার! ম্যানেজার, আছে তো বুঝলাম কতোডি আছে?

আনসারের মুখে কোনো কথা ফোটে না, এবার তার পাসহ কাঁপতে আরম্ভ করে। এই মিয়া কথা কও না ক্যান? স্যার সামনে তিনদিন ছুটি দোকানপাট বন্ধ থাকবে, অনেকই মাল রাখতে চায় না। তোমার কাছে এই হিসাব হুনবার চাইছি, আরে বানচোদ মাল কতোডি আছে এইডা কও! আনসারের চোখে জল ছলছল করে ওঠে, ঠিক মিষ্টি হাওয়ায় পুকুরের স্বচ্ছজল যেমনটা করে। রিজার্ভ ভ্যানচালাকের কাছে জল লুকানোর জন্য উল্টো পাশে মুখ লুকিয়ে বলে, অর্ধেকের একটু কম আছে স্যার। ম্যানেজার বলে, কাজ করো, না দোকানদারের বাল ফালাও, সব মাল শেষ কইরা ডিস্ট্রিবিউটাকে কালেকশন জমা দিয়া তারপর বেতনের লাইগা ফোন দিবা।

ম্যানেজার ফোন কেটে দেয়, আনসার মাথা নিচু করে একটা টি-স্টলের ভেতরে ঢুকে দুই গ্লাস পানি খায়। তারপর হাইওয়ে রাস্তাটার দিকে চেয়ে থাকে। প্রতিটি মানুষ ছুটছে নিজ গন্তব্যে। তার বুঝি কোনো গন্তব্য নাই, অবসর নাই। তার শুধু কাজ, শুধু দোকানদারের দ্বারে দ্বারে ঘোরা, আর গালি খাওয়া। একদিকে দোকানদারের কটু কথা অন্যদিকে ম্যানেজারের বিদ্রুপাত্মক ধমক। অন্যদিন এ কথাগুলো আনসারের কিছুই মনে হতো না। কারণ এগুলো মার্কেটিং সেক্টরের প্রতিদিনের সম্ভাষণ, এক-দুদিন বেতন বন্ধ থাকে, তারপর আবার ঠিক এসে যায়। কিন্তু আজকে সব রাস্তা এসে আটকে গেছে সবেবরাতের কাছে। এরকম একটা দিনে এরকম একটা লম্বা ছুটিতে সে যদি বয়স্ক মা-বাবার কাছে ফিরতে না পারে তাহলে তারা কিছুই মুখে তুলবে না। এদিকে বউকেও রেডি থাকতে বলছে, এখন কাকে কি অজুহাত দেখাবে?

আনসার নিজেকে শক্ত করে চোখে-মুখে পানি দেয়, তারপর সামনের বেঞ্চটাতে শরীরটা ছেড়ে দিয়ে একটা সিগারেট ধরায়। হঠাৎ তার মনে পড়ে সকালের সেই মুচির কথা যে তার যন্ত্রের বাক্সর উপর হেলান দিয়ে উদাস ভঙ্গিতে সীগারেট টানছিল। আনসারের কাছে মনে হয় মুচিরা প্রত্যেকেই একেকটা কোম্পানির মালিক।

এক নুলা ভিখারি এসে আনসারের ধ্যান ভেঙে দেয়, ভিখারি বলে, হালুয়া রুটি খাওয়ার তানে দুইটা টাকা দিবো নাকি বাড়ে!

আনসারের মনে পড়ে, সে জয়তুনের বাজারে মাল দিতে যায়। ছোটো একটা বাজার, সেখানে থাকে এক পাগল। এই পাগলের অত্যাচারে কোনো কুকুর বাজারে দাঁড়াতে পারে না। এমনিতে যতোটুকু দৌড়ানি দেয়, কার থেকে বেশি দেয়, যদি দেখে বাজারের আশেপাশে ফেলে দেওয়া কোনো খাবারে মুখ বসিয়েছে কুকুর। আনসার ভাবে জয়তুন বাজারের পাগলটারও একটা রাজ্যপাট আছে, তার নেই।

আনসার ট্রেনের হুইসেল শুনে স্বচকিত হয়, এটাই আজকের শেষ ট্রেন, যে ট্রেনটা তার গ্রামের স্টেশন হয়ে চলে যাবে রাজধানীর দিকে। যে ট্রেনটা পৌঁছানোর পর তার বাবা-মায়ের ভেঙে যাবে ছেলে ফিরে আসার প্রতীক্ষা।

আনসারের শরীরটা বিদ্যুৎ বাল্বের মতো ফস্ করে জ্বলে ওঠে, চট করে দাঁড়িয়ে পাশের দোকানে যায়, রাগে ক্ষোপে ঠোঁট কাঁপতে থাকে তার। দোকানদার ঠাণ্ডা গলায় বলে, ভাই আইছেন, তুমার তানেই অপেক্ষা করছিনু, নাহলে কতক্ষুনে দোকান বন্ধ করে চলে গেনু হয়। সবেবরাতের তানে দশভাগে একটা গরু কিনিছি বুঝিছেন, ঐটা জোভো করিছে এতক্ষুনে ভাগ বাটোয়ারা বসা সারা। জলদি গোশত আনিবা যাবা লাগবে, তুমার বিস্কুটলা ঘুরায় নও, বেচা-বিক্রি নাই, সোমবার আসেন সেলা বেশি করে নেয়া যাবে।

ফাজলামি বন্ধ করে তাড়াতাড়ি টাকা দেও, বিক্রিমাল ফেরত হয় না।

তাহলে সোমবার টাকা নেন, বিস্কুটগুলো দোকানে রেখে দিয়ে দোকানদার ঝাপ ফেলানোর চেষ্টা করে।

আনসার বাঁধা দিয়ে বলে মাল না লাগলে সকালে বলার লাগে, এখন ফেরত নেয়া হবে নাই, টাকা দেন।

দোকানদার আনসারকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। না, আনসার কিছুতেই সরবে না। দোকানদার বিস্কুটগুলো হাতে নিয়ে রাস্তার মধ্যে ছুড়ে মারে, ফাটো এইঠে থেকে, আর কোনোদিন যেন মোর দোকানের সামনত না দেখু।

বিস্কুটের কার্টুনটি ছিঁড়ে কয়েকটি প্যাকেট এদিক ওদিক ছিটকে পড়ে। আনসারের রাগ আয়ত্তের বাইরে চলে যায়, নিজেকে সামলাতে না পেরে দোকানদারের শার্টের কলার শক্ত করে চেপে ধরে। সামান্য বাকবিতণ্ডা থেকে এবার চিৎকার চেচামেচিতে রূপ নেয়। রিজার্ভ ভ্যানচালক আনসারকে যতোই টেনে-হিচড়ে সরিয়ে আনার চেষ্টা করে আনসার ততোই শক্ত করে চেপে ধরে শার্টের কলার। আশেপাশের পথিকসহ, কয়েকজন আসার পূর্বেই দোকানদার সুপারি কাটার শর্তাটা নিয়ে আনসারের মাথায় স্বজোরে আঘাত করে। ভ্যানচালক দোকানদারের হাতটা দ্রুত ছটকে দেওয়ার চেষ্টা করেও সম্পূর্ণ সফল হতে পারে না। শর্তার নিচের একটা আংঠা বাম কানের লতিতে লেগে লতিটা ছিঁড়ে যায়। সাথে সাথে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটা শুরু করে। ইতোমধ্যে আশপাশ থেকে প্রচুর মানুষের সমাগম ঘটে গেছে। তাদের মধ্যে দু’একজন আনসারকে ধরে সামনের একটা বেঞ্চে বসিয়ে দেয়। রক্তে আনসারের শার্টটা লাল হয়ে আসে।

আনসার আঙুল দিয়ে কানটা চেপে ধরে চুপচাপ বসে থাকে। উপস্থিত লোকজনের মধ্যে কেউ আনসারের পক্ষে, কেউ দোকানদারের পক্ষে কথা বলে। যদি উপস্থিত লোকজনগুলো আনসারের হৃদয়ের রক্তক্ষরণটা একটু দেখতো তাহলে কি তারা কিছু জানতে পারতো?

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu