অলোক আচার্য
অলোক আচার্য। বসবাস করেন পাবনায়। তিনি একজন সাংবাদিক এবং লেখক। সাংবাদিকতার পাশাপাশি গল্প ও প্রবন্ধ লিখে থাকেন তিনি।
অলোক আচার্য

হরিপদ মাস্টার

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

হরিপদ মাস্টার চেয়ারে হেলান বসে আছেন। তিনি নারায়নপুর হাই স্কুলের হেডমাস্টার। তার মুখ দিয়ে চুকচুক ধরনের শব্দ হচ্ছে। এর মানে হলো তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন। তার সামনে ছাত্রদের বসার বেঞ্চগুলো ফাঁকা। কারণ স্কুল বন্ধ। তিনি প্রতিদিন অভ্যাসবশত স্কুলে এসে খানিকক্ষণ সময় কাটিয়ে যান। তার দৃষ্টি এখন ক্লাসের জানালা দিয়ে বাইরের জলপাই গাছটার দিকে। গাছের ডালে দুটো পাখি মারামারি করছে। তবে ষ্পষ্ট দেখতে পারছেন না সেগুলো কোন পাখি। বয়স হয়েছে। চোখে মনে হয় ছানিও পরেছে মনে হয়। ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন। তবে দেখানোর উপায় নেই। দেশের অবস্থা খারাপ। খুবই খারাপ। মিলিটারীতে সারা দেশ ছেয়ে গেছে। পিঁপড়ার মতো মিলিটারী নামছে। তাদের হাতে অস্ত্র। পাখির মতো গুলি করে মানুষ মারছে। এ অবস্থায় ডাক্তার দেখানোর চিন্তা করা যায় না। ফাঁকা ক্লাসের দিকে তাকিয়ে তার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। অন্য সময় হলে কত হৈ চৈ হতো। বেশি দুষ্টুমি করার চেষ্টা করে ফরিদ। অবশ্য তার ক্লাসে টুঁ শব্দটিও হতো না। এরকমই নিরব থাকতো। তার ক্লাসে কেউ কথা বলার সাহস করে না। কথা বললেই কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা আছে। অপরাধ কম হলে কম শাস্তি। কম শাস্তি হলো কান ধরে মুচড়ে দেয়া। তিনি যখন কান টানেন ছাত্রদের মনে হয় কোনো ধাতব পদার্থ তাদের কান টেনে ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে। অপরাধ গুরুতর হলে কথা আলাদা। অফিস থেকে হরিপদ মাস্টারের বেত আনা হয়। যে সে বেত না। স্পেশাল বেত। জোড়া বেত। একটা বাড়ি পরলেই মাংস ছিড়ে আসার মতো অবস্থা হয়। কাউকে দু’টার বেশি মারেন না। দুই বাড়ি খেয়েই ছাত্ররা হাত চেপে ঘন্টাখানেক ঝিম মেরে থাকে।

শূন্য ক্লাসে হরিপদ মাস্টার একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। কী যে হলো দেশটার। ক্লাস বন্ধ করে তিনি বেরিয়ে আসেন। স্কুলের গেটের সামনে এসে তার স্কুলের সায়েন্সের শিক্ষক বদিউজ্জামানের সাথে দেখা হয়ে গেলো। তিনি লোকটাকে খুব একটা পছন্দ করেন না। আবার হেডমাস্টারও তাকে পছন্দ করেন না। এর কারণ হলো হেডমাস্টার হওয়ার দৌড়ে তিনিও ছিলেন। কিভাবে যেন সেটা আর হলো না। নানা ঘটনার পর হরিপদ হেডমাস্টার হয়ে যান। তাছাড়া তিনি প্যাঁচের মানুষ। সব বিষয়েই তিনি ঘুরিয়ে কথা বলেন। তাকে দেখে হরিপদ মাস্টার পাশ কাটিয়েই যাচ্ছিলেন। বদিউজ্জামানই তাকে ডাক দিলেন।

‘এই যে স্যার, কোথায় যাচ্ছেন? স্কুলে প্রতিদিন এভাবে বসে থাকার দরকার কী? বাজারে আসেন। গল্পগুজব করি। দেশের খবরাখবর রাখাও আপনার দায়িত্ব। কী বলেন? নাকি দায়িত্ব অস্বীকার করতে চান। আপনি ভালো শিক্ষক। তাই বললাম স্যার। নিজ গুণে ক্ষমা করবেন।’

হরিপদ মাস্টার কিছু বললেন না। এই লোকের সাথে তার কথা বলতে মোটেই ভালো লাগে না। যুদ্ধ শুরুর কিছুদিন আগেই তিনি একদিন হরিপদ মাস্টারের রুমে আসেন। ইনিয়ে বিনিয়ে নানা কথা বলার পর আসল কথায় আসেন।

‘দেশের খবর টবর কিছু রাখেন, স্যার?’

‘কিসের খবর?’

‘এই যে দেশের অবস্থা খারাপ। যুদ্ধ লাগতে পারে। অনেক হিন্দু তো বাড়িঘর বিক্রি করে ইন্ডিয়া চলে গেছে। আপনার কোনো পরিকল্পনা আছে নাকি। থাকলে জানাবেন।’

‘আমি তো খারাপের কিছু দেখি না। সমস্যা থাকতেই পারে। এর মধ্যে বাড়িঘর বিক্রি করে চলে যাওয়ার তো কিছু দেখি না। খারাপ কিছু কপালে থাকলে তা এখানেও হবে আবার ইন্ডিয়াতেও হবে।’

‘বিষয়টা গোয়ার্তুমির না স্যার।’

‘আমি গোয়ার্তুমি করছি? নিজ দেশকে ভরসা করা গোয়ার্তুমি করা।’

‘আমি স্যার আপনার ভালোর জন্যই বলছিলাম। ভালোমতন বিবেচনা করেন। বাড়িঘর বিক্রি করতে চাইলে গোপনে আমাকে জানাবেন। ভালো দাম দেব।’

‘জ্বি, আচ্ছা।’

এই ধরনের মানুষের সাথে দেখা হলে চুপ করে থাকাই উত্তম। তিনি চুপ করে থাকলেও বদিউজ্জামান বললেন, ‘আমার প্রস্তাবটা মনে আছে তো, স্যার? রাজী থাকলে বলবেন। এখন সবাই এমনিতেই ছেড়ে যাচ্ছে। আপনি আমার স্কুলের হেডমাস্টার। আপনার প্রতি আমার একটা দায়িত্ব আছে তো! টাকাও পেলেন আবার জীবনটাও বাঁচলো।’

হরিপদ মাস্টার কিছু না বলে দ্রুত পায়ে হেঁটে বাজারের দিকে গেলেন। বাজারে লোক সমাগম নেই। অল্প কিছু দোকানপাঠ খোলা। এক দোকানে মনে হয় রেডিও বাজছে। তাই ঘিরে কয়েকজন বসে আছে। তার খবর শুনতে ভালো লাগে না। তবে দেশের এই অবস্থা নিয়ে হরিপদ মাস্টার সত্যিই চিন্তিত। সবসময় মিলিটারীর ভয়। তার গ্রাম নারায়নপুরে এখনো মিলিটারী আসেনি। আসতে কতক্ষণ! রাজাকারের কমিটি তৈরি হয়েছে। তারা নাকি গ্রামের দেখাশুনা করবে! পাকিস্থানের ক্ষতি হয় এমন কাজ হতে দেবে না! তাদের কেউ কেউ হরিপদ মাস্টারের বাড়ির আশেপাশে ঘোরাফেরা করে। হরিপদ মাস্টার জীবনে কারো ক্ষতি করেছেন বলে মনে পরে না। স্কুল আর বাড়ি এই নিয়েই সারাজীবন কাটিয়েছেন। স্কুল থেকে ফিরে ছাত্র পড়াতেই তার সময় কেটে গেছে। এখন কেউ পড়তে আসে না। সেই সময়টা তিনি বাড়ির বাইরে একটা জলচৌকিতে বসে সময় কাটান। দুএকজন তার সামনে দিয়ে যায়। আদাব দিয়ে, জানতে চায়, মাস্টার সাবের শরীরডা ভালো নাকি? কারো প্রশ্নের উত্তর দেন আবার কারো প্রশ্নের দেন না। বউটা অনেককাল আগেই মরে গেছে। একটা মেয়েকে অনেক কষ্টে বড় করেছেন। নাম বাসন্তী। সেই মেয়ে এখন বিবাহযোগ্য। ভয় যত এই মেয়েকে নিয়ে। একা একা বাড়িতে থাকে। বিয়ের কথা হচ্ছিল। এর মধ্যে দেশে যুদ্ধ বেধে গেলো। তার কেউ ক্ষতি করবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন না। তবে মিলিটারী তার ক্ষতি করলেও করতে পারে। ওরা বাঙালীদের ঘৃণা করে। ওরা নাকি বেছে বেছে প্রথমে হিন্দুদের মারছে। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। মেয়ে বউদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে। এই গ্রামে এখন দুএক ঘর ছাড়া কোনো হিন্দু নেই। সবাই চলে গেছে। সেখানে কোনোমতে পৌঁছাতে পারলেই নাকি নিশ্চিন্ত। অথচ তার সারাজীবন এই নারায়নপুর গ্রামে কেটেছে। মরতে হলে এখানেই মরবে সে। কিন্তু বাসন্তীর কী হবে? গত সপ্তাহে তার খুড়তুতো ভাই নিবারণও চলে গেলো। যাওয়ার আগে অবশ্য তার সাথে দেখা করে গেছে। তখন রাত বারোটার মতো হবে। বাসন্তী ঘুমিয়ে গেছে। হরিপদ মাস্টার ঘুমায়নি। তার অনিদ্রা রোগ শুরু হয়েছে। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে তার এই রোগ শুরু হয়েছে। একটু পরপর বুক কেঁপে ওঠে। ভয়টাও মনে হয় বেড়েছে। কয়েকবার তিনি বাসন্তীর ঘরে গিয়ে দেখেন সব ঠিক আছে কি না। এভাবে শেষ রাতের দিকে তার চোখ লেগে আসে। দরজায় টোকা পরার শব্দে হরিপদ মাস্টার উঠে দরজা খুললেন।

নিবারণ ঘরে ঢুকেই বললেন, ‘দাদা ব্যাগ ট্যাগ যা গোছানোর গুছিয়ে নাও। হাতে বেশি সময় নেই। ঘাটে নৌকা বাধা আছে। ভোরের আলো ফোটার আগেই আমরা গ্রাম ছাড়াবো।’

হরিপদ মাস্টার কিছু না বুঝেই বললেন, ‘কোথায় যাবো? গ্রাম ছাড়াতে হবে কেন?’

তার এ কথায় নিবারণ মহা বিরক্ত হলো। ‘এত কথার সময় নাই তো দাদা। আমাদের এখনই রওনা দিতে হবে। একবার পৌঁছাতে পারলেই কাজ শেষ।’

‘কী বলিস তুই? আমার গ্রামে আমি নিরাপদ না, ইন্ডিয়ায় নিরাপদ?’

‘তুমি খবর টবর রাখো না দাদা তাই একথা বলছো। এ গ্রামে রাজাকার বাহিনী তৈরি হয়েছে। ওরা মিলিটারীর সাথে যোগাযোগ করছে। এ গ্রামে মিলিটারী আসলে প্রথমেই ধরবে হিন্দুদের। তোমার কথা না হয় বাদ দাও। বাসন্তীর জন্য চিন্তা করো। মেয়েটা বিয়ের উপযুক্ত। তুমি নিশ্চয়ই চাও না ওর কোনো ক্ষতি হোক।’

‘তাহলে ওকে নিয়ে যা। আমি থাকি আর কিছুদিন। দেখি কী হয়।’

‘তাহলে তুমি যাবে না। এখানে মিলিটারীর গুলি খেয়ে মরবে?’

‘মরতে হলে মরবো। কতজন তো মরছে। তারা কী পালিয়ে গেছে? আমার রক্তে এ মাটি ভিজলেও আমি শান্তি পাবো। পালিয়ে গিয়ে শান্তি পাবো না।’

হরিপদ মাস্টার না যাওয়ায় তার মেয়ে বাসন্তীও যেতে রাজী হলো না। শুকনো মুখে নিবারণ চলে গেলো। সে রাতে ভোরেও তার ঘুম হলো না। তিনি শেষ রাতে পাশের মন্দিরে গিয়ে বসে রইলেন।

বাজারে লোকজন না দেখে তিনি ধীরে ধীরে বাড়ির পথ ধরলেন। তার খিদে পেয়েছে। বাসন্তীর রান্না মনে হয় এতক্ষণে শেষ হয়ে গেছে। মেয়েটাকে একটু সময় দেয়া দরকার। সারাদিন একা একা চুপচাপ থাকে। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। এসময় মেয়েদের বাইরে বের হওয়াও নিরাপদ নয়। ঘরেই তার সময় কাটে। মা মরা মেয়েটা তার কাছে অযত্নেই বড় হয়েছে। মুখ ফুটে কোনোদিন কিছু চায়নি। বাসন্তীর কথা মনে করে তিনি দ্রুত পা চালালেন। বাড়ি ফিরেই তিনি বাসন্তীকে ডাকতে লাগলেন। তার ডাকে কেউ সাড়া দিল না। তিনি ঘরের ভেতর দেখলেন। কোথাও নেই। এদিক সেদিক খুঁজে বাড়ির পেছন দিকটায় গেলেন। বাসন্তীর কাপড়ের ছেড়া অংশ দেখে তিনি চমকে উঠলেন। পেছন দিকে ঘন জঙ্গল মতো জায়গা। হরিপদ মাস্টার তখন জ্ঞানশূন্য। বাসন্তী মা রে……. বলে চিৎকার করতে করতে তিনি সেই ঘন জঙ্গল ভেদ করে ছুটতে লাগলেন। তার আর্তচিৎকার দূরের কোনো প্রান্তরে মিশে যাচ্ছিল।


 

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu