জীম হামযাহ
অনেকদিন পর অহনার সাথে দেখা।
দেখা করবো এমন সময় কোথা থেকে এসে লোকটা আমাকে আটকে দিলো। তারপর আমার প্রতি তাঁর ঝুলিতে যতো মুগ্ধতা আছে ঝাড়তে লাগলো। অনেকদিন থেকে কারও সাথে দেখা করার ইচ্ছা মনে পোষে থাকলে যা হয়।
‘একটি পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় প্রথম আপনার গল্প পড়ি। সেই থেকে আমি আপনার প্রতি মুগ্ধ। আপনার সব বই পড়েছি। বন্ধু বান্ধবদেরও গিফট করেছি। তারাও পড়ে খুব প্রশংসা করে…আর আমার স্ত্রীতো আপনার সেইই ভক্ত। কোন লেখা সামনে পেলে মিস করে না…।’
জানালো সে আমার খুব বড় ভক্ত! আমার সাথে দেখা করার বাসনা তার মনে অনেকদিন থেকে লুকিয়ে রেখেছে। আজ সে সামনে পেয়ে অভিভূত! নিজের লেখার, নিজের বইয়ের এমন প্রশংসা শুনতে ভাল লাগে না এমন লেখকের সংখ্যা পৃথিবীতে নগণ্য। আর আমিও বিরলদের মধ্যের কেউ নই। আমারও মনে পুলক জাগার কথা। মুখ বরাবর এমন ভক্ত পাঠকের মুগ্ধতার বাতাসে মিশে হয়তো নিজে ফুলে ফেঁপে ওঠার কথা। কিন্তু আমার মন মোটেও পাত্তা দিচ্ছে না তাতে। বরং তার প্রতি বিরক্তি আমার মনের কোণে মাথাচারা দিয়ে ওঠছে। আরে বেটা তুই আর সময় পাইলি না। এমন সময় আমাকে আটকালো যখন আমার মন এখানে নেই। আমার মনের নোঙ্গর পড়ে আছে অহনার মাঝে। যাকে কতোদিন, কতোরাত পরে আজ দেখেছি। এইবার যদি হাতছাড়া হয়ে যায় আর হয়তো কোনদিন দেখা হবে না। আহহারে অহনা! সেই কবে তার সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিলো, তারপর এমন লাপাত্তা হলো যে আর দেখা পেলাম না। দিনমান তাকে কতো খোঁজেছি। তার জন্য কত রাতকে হত্যা করেছি। গুগলে তালাস করেছি। ফেসবুকে তার নাম লিখে সার্চ দিয়েছি। নাহ, তাকে পাইনি। ধরে নেই হয়তো সে ফেসবুক ব্যবহার করে না। অথবা নিজের নাম গোপন রেখে ভিন্ন নামে ফেসবুক ইউজ করে। অহনার ব্যাপারটিও হয়তো এই ঘেরাটোপের বাইরে নয়।
আমি কথা যতো সংক্ষেপ করে আনতে চাচ্ছি, সে তার একক কৃতিত্বে কথার পিঠে কথা গেঁথে যাচ্ছে। এই লোকটি আমাকে সহজে ছাড়ছে না। আমি কৃতজ্ঞতা স্বরুপ মুখে খানিক হাসি লেপ্টে রেখে তার সাথে কথা বলছি। তারপ্রতি আমার তাচ্ছিল্য বা কোন অবহেলা প্রকাশ না পায় সেই চেষ্টাও ধরে রাখছি। লোকটার সাথে কথা বলতে বলতে আমার সতর্ক দৃষ্টি শপিংমলের দিকে। আমার অগোচরে যাতে অহনা বেরিয়ে না যায়। একবার ভেবেছিলাম, ভেতরে গিয়ে খোঁজবো। আবার এও মনে হলো, ভেতরে গিয়ে কোথায় খোঁজবো? হয়তো খোঁজলাম ফার্স্ট ফ্লোরে, সে থাকলো অন্য ফ্লোরে। আমি খোঁজছি আর হয়তো সে নেমে নিচে চলে গেলো! এভাবে হাতড়ানোর চেয়ে গেটে দাঁড়িয়ে থাকাটা অযৌক্তিক নয়। শেষ পর্যন্ততো তাকে গেট দিয়ে বের হয়ে আসতে হবে।
অপেক্ষমাণ সময়টুকু নিরামিষ কাটানোর চেয়ে ভক্ত পাঠকের সাথে আলাপ চালিয়ে যাওয়া মোটেও অযৌক্তিক নয়। নিজের চক্ষুটা কেবল সজাগ রাখলাম।
প্রথম যেদিন তার সাথে দেখা হয় সে এসেছিলো বোরকাবৃত হয়ে। পরীক্ষার হলে যখন বসলাম হলরুম একে একে ভরে গেলো। কিন্তু আমার পাশের সিট এখনও খালি। মনে মনে ভাবছিলাম কে হতে পারে আমার পাশের সিটম্যান? পরিচিত কোন বন্ধু বান্ধব হলে ভালো। একটুু হেল্পেরতো প্রয়োজন হয়। এসব ভাবতে ভাবতে সময় কাটায় কাটায় তখন বোরকাবৃত এক মেয়ে সিট খুজঁতে খুঁজতে আমার ব্রেঞ্চের পাশে এসে থামে। তারপর ডান বাম একনজর তাকিয়ে ব্যাগটা রেখে চুপচাপ বসে পড়ে। বসার সময় আমার দিকে তাকিয়েই আবার চোখ ফিরিয়ে নেয়। এবং আমাদের মধ্যে যে গ্যাপ ছিলো, যতোটুকু সম্ভব তার দূরত্ব বাড়িয়ে একেবারে ব্রেঞ্চের শেষ মাথায় আশ্রয় নিলো। যেন সম্ভব হলে ব্রেঞ্চটা টেনেটুনে আরেকটু লম্বা করে আরেকটু দূরত্ব তৈরি করতো। তারদিকে আমার আশাহত দৃষ্টি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে টেবিলের ওপর আনলাম। তার কাছ থেকে টুকটাক হেল্পের আশা ভঙ্গ হলো। এই মেয়ের সাথে কথা বলা দূরে থাক, চোখ তুলে তাকানোটাও মনে হয় যেন অপরাধ। এমনিতেই অপরিচিত কোন মেয়ের সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলার অভ্যাস আমার নেই। তাছাড়া পর্দাশীল মেয়েরা স্বাভাবিক লাজুক প্রকৃতির হয়। ওদের যে কেউ একটু সমীহের চোখে দেখে। তাদের নিয়ে বেশি ভাবারও সুযোগ থাকে না।
আমার সামনে মেয়েটা অতি ফর্সা, একেবারে ধবধবে। ধবধবে ফর্সা মেয়ে আমার ভাল লাগে না। এই মেয়েটা একটু খাটো। তার চুল দু পাশে ছড়িয়ে আছে। ফ্যানের বাতাসে বার বার তার চুল কাপঁছে আর সে খানিক পরপর কপালে এলানো চুল পেছনের দিকে সরিয়ে দিচ্ছে, অবাধ্য চুলগুলো আবার এসে পড়ছে। ঠোঁটে তার কড়া লিপিস্টিক। চেহারার দিকে তাকালে কেমন ঠোঁটকাটা আর ঝগড়াটে টাইপের মনে হয়। সে তার পাশের ছেলেটার কাছ ঘেষে বসে তার খাতার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে লিখছে। দু‘জন সমভাবে মাঝেমধ্যে ফিসফিস কথাবার্তা চালাচ্ছে। বরাবর পিছনে যে ছেলেটি বসেছে, আমার পিঠে কলম দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে অতিষ্ঠ করে তোলছে।
আমার সিটম্যান কোনো দিকে না তাকিয়ে এক নাগাড়ে লিখে যাচ্ছিলো। আর আমিও বেশিকিছু না ভেবে আমার মতো লিখছিলাম। এই লেখার ঘোরে হয়তো অজান্তে দু‘জনার মধ্যখানের গ্যাপটা একটু কমে এসেছে। দেখলাম তার দুই আঙুলের ফাঁকে কলমটা নড়ছে আর কাগজের ওপর শব্দের গাঁথুনী গেঁথে চলেছে। কোন দিকে তাকানোর ফুরসত নেই যেন এই মেয়েটির। তার লম্বা নিটোল অপরূপ দীর্ঘায়ত আঙ্গুলের কোলে কলমটা মনের সুখে নাচছে। বোরকার কালো হাতার শেষ প্রান্তে তার হাত কোমল কেয়া ফুলের মতো ফুটে আছে। যার পিঠে আঁকা মেহেদীর আল্পনা। আঙুলের মাথায় নখগুলো যেন রক্তজবার কলি।
আমি যে বসে বসে তার অনাবৃত হাত মুগ্ধ চোখে পাঠ করছি এ খবর এতোক্ষণে তার কাছে পৌছে গেছে। ঘাড় ফিরিয়ে আমার দিকে তাকাতেই কালো নেকাবের ফাঁকে তার ডাগড় ডাগড় দুটি চোখের চাহনিতে আমি ঝলসে গেলাম। সাথে সাথে আমার দৃষ্টি এসে আপন খাতায় ঠাঁই নেয়। আর মেয়েটির এই আনমনায় মূহুর্তে ঘটে গেলো আরেকটি ঘটনা। ফ্যানের ঝাঁপটা বাতাসে তার প্রশ্নপ্রত্রটি উড়ে এসে পড়লো আমার ওপর। সেটা সামলাতে মেয়েটা একটু উঠতে যেয়ে কী ভেবে যেন আবার বসে পড়ে। আর আমিও সেটা ধরতে না ধরতে পায়ের নিচে চলে গেলো। তার চোখ আমার চোখে আমার চোখ তার চোখে। আমার চোখ এমন ভাবে স্থির হলো, তাৎক্ষণিক দায়িত্ববোধটাও আমি ভুলে গেলাম। সে আনত নয়নে প্রণত আঙুলের ইশারায় আমাকে শুধু বললোÑপ্লীজ!
আমি প্রশ্নপত্রটি তার হাতে তুলে দিলে সে কৃতজ্ঞ হাসিতে চকচকে চোখে খুব সংক্ষেপে বলে– থ্যাংস! নেকাবের আড়ালে থাকা তার হাসি দেখিনি, পাঠ করেছি। সে আবার মধ্যাখানের দূরত্ব দৈর্ঘ করে ব্রেঞ্চের শেষ মাথায় গিয়ে বসলো।
পরের দিন একটু দেরিতে পরীক্ষার হলে আসি। আমার সিটে গিয়ে দেখলাম আরো একটি মেয়ে বসে আছে। দুজন খুব প্রীতিলাপে ব্যস্ত। আমাকে দেখেই পাশের মেয়েটি চলে যায়। আমি বসতে গিয়ে অবাক হলাম! গতকালের বোরকা আবৃত মেয়ে আজ এসেছে একেবারে ভিন্ন সাজে। পরনে ফুলহাতাসমেত মার্জিত পোশাক, মাথায় গোলাপি হিজাবের আবরনে তার মুখায়ব মোমবাতির স্নিগ্ধ আলোর মতো দীপ্ত।
সবাই যখন পারস্পরিক সহযোগীতার আলাপ আলোচনায় যতোটুকু সম্ভব এক অন্যের কাছাকাছি বসার চেষ্টা করছে এই ভাবিনী মেয়ে তখন আমার থেকে যতোটা সম্ভব দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। যেন আমি অচ্ছুত, যেন আমার হাওয়া লাগলেও তার গঙ্গাস্নান করতে হবে।
মেয়েটির এমন আচরণ আমার কাছে কেমন একটা অস্বস্থির বাতাবরণ তৈরি করে। তার এমন আচরন আমার গায়ে অপমানের কাঁটা ফুটায়। নিজেকে সংবরণ করলাম। তার প্রতি আমার বারবার চাহনী তার দম্ভের খিলানকে আরও পুরো করে তোলবে। মনকে বুঝালাম তাকে ভ্রুক্ষেপও করা যাবে না।
কিন্তু তার প্রতি আমার কৌতূহল থেকেই গেলো!
এর আগে এই অপ্সরীকে ক্লাসেও যেমন দেখিনি, কলেজেও কোনো দিন দেখেছি বলে মনে পড়ে না। না দেখারই কথা, তার জন্য ওর কোনো দোষ নাই। কেননা আমি নিজে সারা বছরে কয়দিন কলেজে এসেছি আর কটা ক্লাস করেছি? এমনও হতে পারে যেদিন আমি এসেছি সেদিন সে আসেনি বা সে যখন এসেছে আমি থাকি নি। তাছাড়া এমনও তো হতে পারে বোরকা পড়ে আসায় খোলসের আবরনে থাকা মুক্তোকে চিনতে পারি নি!
আচ্ছা, আমি কি অজানা অচেনা এই মেয়েটির প্রতি আবিষ্ট হয়ে যাচ্ছি? এর আগেতো কখনো কারো প্রতি এতোটা মোহগ্রস্থ হই নি। এও সত্য যে কখনো কোনো মেয়েকে এতোটা কাছে পাই নি। আমার ভাবনার করিডোরে এসে মেয়েটি বার বার কড়া নাড়াতে থাকলো।
আচমকা হাতের ধাক্কা সামলাতে না পেরে আমার কাঠপেন্সিলটি নিচে পড়ে গড়াতে গড়াতে গিয়ে তার পায়ের কাছে স্থির হয়। সে নিচের দিকে তাকালে তাকে সুযোগ না দিয়ে তড়িৎ করে টেবিলের নিচে ঝুকে কাঠপেন্সিলটা তুলতে যেয়ে তার পায়ে চুম্বকের ন্যায় আমার দৃষ্টি আটকে যায়। পেন্সিলটা যাতে আমার তুলতে সুবিধে হয় সে তার পা একটু সরিয়ে লম্বা করে রেখেছে। আর তাতে তার গোড়ালি পর্যন্ত অনাবৃত। আমার নিষ্পলক চোখ দেখতে পায় তার কোমল পায়ের নিচে কতো হৃদয়ের রক্তক্ষরণ। আমার কান শুনতে পায় কতো পুরুষের অসহায় আর্তনাদ!
যখন দেখলাম আড়ালে আবডালে অনেক চন্দ্রাহত সাপ লুকুচুরি খেলছে, আমি আঁচ করলাম দূর থেকে যারা তীরবিদ্ধ কাছ থেকে আমি তাদের থেকেও বেশি যখম প্রাপ্ত।
আমার মনে এক অনুরক্তি ধীরে ধীরে পাতা গজানো শুরু করল।
মেয়েটি আমার পাশে রূপের দীপ জ্বালিয়ে স্থবির বসে আছে অথচ আমি তাকে আমার হৃদয়ের বিচে না তুলে নির্লিপ্ত বসে আছি। কতোজন ঔত পেতে আছে অথচ আমি তাকে কোনো বেড়া দিয়ে আগলে রাখারও চেষ্টা করছি না!
অনেক মানুষ এমন আছে, যাদের ভেতরের নদীতে স্রোত প্রবল হয়, কল্লোলিত হয়। ঢেউয়ের পর ঢেউ আছাড়ি-বিছাড়ি খায় তার বুকে, কিন্তু সে কাউকে দেখাতে পারে না তার ভেতরের এই উথাল পাথাল। কারো কানে পৌঁছাতে পারে না তার হৃদনদীর কল্লোল। সে কেবল তার আন্দোলিত নদীর আলোড়নের তটে অসহায় নেত্রে নির্বাক অপেক্ষা করে একজন মনের মানুষের, যে স্বেচ্ছায় এসে এখানে দাঁড় ফেলবে।
আমার মন বলল, এই মেয়েটি অন্যান্য মেয়েদের থেকে আলাদা। রক্ষণশীল পরিবেশে বেড়ে ওঠেছে। অন্য মেয়েদের মতো ছেলেদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলে নি। দলবেধে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে নি। কারো সাথে কোনো দিন কোনো পার্টিতে বা তুমুল আড্ডায় যায় নি। সে সব সময় চলেছে আপন গা বাঁচিয়ে খুব সতর্ক পদে। তার লাজুক আড়ষ্ট হৃদনদীতে স্রোত এসেছে, তরঙ্গায়িত হচ্ছে কিন্তু লজ্জাবিষ্ট সংকির্ণতায় কারো কানে সেই ছন্দ পৌছাতে পারছে না। তার মন অপেক্ষা করছে কোনো মনের মানুষের তাই হয়তো নিজের চোখ আটকাতে পারে নি। আমার দিকে তার সতর্ক ডাহুকি চাহনি একসময় ধরা পড়ে যায়। আর তাতে ভেঙে যায় আমারও বাঁধ।
তার নাম অহনা। পুরো নাম সাইয়্যিদা হাবিবা অহনা। তার কথা বার্তার ভঙ্গিমায় ছিলো আভিজাত্যের ছাপ। অসাধারণ আর্ট। সে কথা বলতো কম। খুব ছোট ছোট কথায় মোলায়েম আর নিচু স্বরে বুঝিয়ে দিতো, কিন্তু খুব স্পষ্ট ভাবে। যখন কথা বলে তখন তার টানা টানা চোখে ও তার গালে মনোরম শিল্পকর্ম ফুটে ওঠতো যা তার না বলা কথাকে পেলব মাধুর্যে ফুটিয়ে তুলতো। আর তখন তার প্রতিটি পাপড়িতে জেগে ওঠতো কমনীয় কৌমুদী।
দু‘জনের মধ্যে দূরত্ব কিছুটা কমে এলো। আমি এখন ইচ্ছা করলে স্পর্শ করতে পারি। চাইলে তাকে আমার বাহুবন্ধনেও নিয়ে আসতে পারি। সে তার সহজাত লাজুকতার কারণে নিজ থেকে কথা বলতো কম। অপেক্ষা করতো কখন আমি তাকে কিছু জিজ্ঞেস করি। কথা বলার সময় দেখে কে ফেলবে, এমন একটা ভয় কাজ করতো তার মধ্যে।
আমাদের আলাপ ছিলো পরীক্ষার প্রশ্নকেন্দ্রিক। প্রশ্নটা বুঝতে সমস্যা নেই, উত্তরটাও জানা । তারপরও অযথা একে অন্যকে প্রশ্ন করতাম। স্পষ্ট শাহজাহান সম্পর্কে একটা প্রশ্ন এসেছে, প্রশ্নের সাথে মোটেও যায় না তবুও সে আমাকে জিজ্ঞাস করে– তাজমহল কিসের নিদের্শন? আমি তারদিকে খানিক তাকিয়ে মনের মাধূর্য মিশিয়ে ধীরে ধীরে বললাম– প্রেম-ভালবাসার। তারপর সে গুনগুন স্বরে কী যেন বললো, স্পষ্ট বুঝা গেলো না। জিজ্ঞেস করলাম– কিছু বললেন? সে দুষ্ট হাসি হেসে চোখ বাঁকিয়ে বলে– মনোযোগ দিয়ে লিখুন নয়তো খারাপ করবেন।
একদিন একটি প্রশ্নে হিমশিম খাচ্ছি। অহনা জানতে পেরে তার লেখা উত্তরপত্রটি আমার খাতার নিচে ঢুকিয়ে দিয়ে বললো– চটফট লিখে ফেলুন।
আবার কখনো সে বললো, তার পেনটা ডিস্টার্ব করছে। আমি তাৎক্ষণিক আমার কলমটা তাকে দিয়ে দিলাম। পরীক্ষা শেষে সে কলমটা ফেরত না দিয়ে তার ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলো। তারপর আরেকটি কলম বের করে হাতে দিয়ে বললো– রেখে দিন।
আমার হৃদয়ের বিচে অনুরক্তির শিকড় পোক্ত হয়ে ডালপালা জড়িয়ে ছড়িয়ে পাতাবহুল হতে লাগলো। কিন্তু আমার আড়ষ্টতা আর জড়তার লতায় পাতায় বার বার আটকে যাচ্ছি। একবার ভেবেছিলাম, বন্ধুদের কাছে শেয়ার করি। কিন্তু আমার বন্ধুরা যা ফাজিল, শুনলে তুমুল হৈ চৈ শুরু করবে। এবং আমার অগোচরে আমার নাম করে তাকে ফুলের তোড়া দেয়াও তাদের পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়।
কিন্তু না। আমি এই নিষ্কলঙ্ক ফুলের গায়ে কোনও বিরক্তির ছাপ ভাসতে দেবো না। আমি ধীরে স্থিরে পরিকল্পিত ভাবে এগোতে চাই। কথাবার্তায় সবসময় সতর্ক থাকি যাতে সে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে না পড়ে। আমি নিজেকে তার হৃদয়ে আরো গভীরভাবে প্রোথিত করার চেষ্টা অব্যাহত রাখলাম।
পরীক্ষার শেষ সময়ে আমি খুব ব্যস্ত হয়ে পড়তাম। প্রশ্নের কটমট চাহনী, সময়ের চোখ রাঙ্গানী আমাকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখতো। তখন আমার সম্পূর্ণ মনোযোগ থাকতো নিজের খাতায়। প্রায়দিন এমন হতো, স্যাররা বাধ্য হয়ে আমার খাতা কেড়ে নিতেন। সে একেকদিন লেখা শেষ করে কিছুক্ষণ বসেও থাকতো। একসময় বলতো– আসি।
আমি সময়ের অভাবে তারদিকে না তাকিয়ে সংক্ষিপ্ত উত্তরে বলতাম– হুম।
হল থেকে বেরিয়ে আমাদের কথা বলার সুযোগ থাকতো না। তার বাবা বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন মেয়ের জন্য। আর সে বাবার কাঁধে হাত রেখে চড়ে বসতো। আমি তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইতাম আর সে আমার প্রতি একহাসি রোদ ছড়িয়ে দিতো।
পরীক্ষা শেষ হয়ে আসছে। অথচ আমি সংঙ্কোচের প্রাচীর টপকে যেয়ে তাকে আমার মনের কথা বলতে পারছি না। বারবার আমি লজ্জার দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছি। না, এভাবে সামনা সামনি বলতে পারবো না। সিদ্ধান্ত নিলাম যেভাবে হোক তার মোবাইল নাম্বার নিয়ে এসএমএস করবো। কিন্তু আফসোস আমি অহনার চেয়ে আরো ভীরু। তারচেয়েও আরো আনাড়ি। চাইতে গেলে কে যেন আমার মুখ চেপে ধরে।
পরীক্ষার শেষ দিন। আমি দৃঢ়চিত্তে আজকের দিনটাকে ঠিক করেছি। যেভাবে হোক তার নাম্বারটা অন্তত চেয়ে নিতে হবে। কিন্তু শেষদিনেও যে কপালে এমন ছেদ লিখা ছিলো তা কে জানতো? পরীক্ষার হলে প্রবেশ করে আমরা যখন আলাপ জুড়ালাম, কথার গাঁথুনি এগিয়ে চলছে, দুজনার চোখের আকুলতা নাগরদোলার মতো দোল খাচ্ছে ঠিক এমন সময়ে স্যার এসে কটমট চোখে তাকিয়ে আমাদের থামিয়ে দিলেন। প্রায় ধমকের সাথে বললেন– এই মেয়ে ওঠো! আমি মাথা নিচু করে বসে রইলাম। প্রথমবার বলাতে সে উঠলো না। স্যার এবার তার দিকে আঙুল তোলে আওয়াজ চড়াও করে বললেন– এই মেয়ে উঠো বলছি! আমি লক্ষ করলাম তার অসহায় কাঁপুনি। অপমানিত চেহারা লাল–বিবর্ন, ঘর্মাক্ত। তার চোখ ছলছল করছে যেন এখনই কেঁদে ফেলবে।
খাতা নিয়ে স্যারের পিছুপিছু মাথা নিচু করে এমনভাবে হাঁটছিলো যেন সুযোগ পেলে ভূগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। আমি তার দিকে কেবল অসহায়ভাবে তাকিয়ে রইলাম। দেখলাম অনেকগুলো চোখ এমনভাবে দৃশ্যটি উপভোগ করছে। কারণ এমন ঘটনার আশায় তারা বহুকাল বুক বেঁধেছিলো। আমার মাথা আপনা হতে নত হয়ে আসে।
অপমান আর ক্ষোভে মনটা ভীষণ ভারি। ইচ্ছে করছে পরীক্ষা না দিয়ে চলে যাই। অহনা সামনের প্রথম ব্রেঞ্চে বসে আছে মাথা নিচু করে। লিখছে না কাঁদছে বুঝা যাচ্ছে না। মনের আকাশ জুড়ে কালো মেঘে ছুটছে। চিবুকে কলম ঠেকিয়ে গাল ফুলিয়ে বসে আছি। কখনো স্যারের দিকে কটমট তাকাচ্ছি। শাস্তি যদি দিতে হয় আমাকে দিতে পারতেন। মনে মনে তার এই আচরণের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।
দেড় ঘন্টা চলে গেলো, খাতায় একটি অক্ষরও বসাতে পারলাম না। শেষে মনটাকে খুব টেনেটুনে নিয়ে এলাম এই বলে যে, পাশের মার্ক তুলে চলে যাবো। আমি উত্তরপত্রে মন দিলাম।
লিখতে লিখতে হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, আহনা নেই! মাথা উঁচু করে পুরো হল চোখ ঘুরিয়ে নিলাম, নাহ্, নেই। আর বসতে পারলাম না। তাৎক্ষণিক ওঠে খাতা জমা দিয়ে বাইরে এসে খুঁজতে শুরু করলাম।
সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজে না পেয়ে আমি নিরাশ হয়ে বসে পড়লাম।
সেদিন আমার বিষণ্ণ মনকে কোনো ভাবে টেনে নিয়ে বাসায় ফিরলাম। আমার বিষণ্ণতা রুমমেটদের নাড়া দিয়েছে অথচ তাদের কাছে কিছু বলতে পারছি না। তারাও আমার বিষণ্ণতায় অতি উৎসাহী হয়ে ওঠলো যখন, আমি বাড়িতে চলে গেলাম।
এরপর অনেকদিন কেটে গেছে আমি অনেক জায়গায় খুঁজেছি অহনাকে।
মানুষের মন এমন হয়, আজ যেটার প্রতি তার মন ব্যাকুলভাবে আকৃষ্ট হয়েছে, সময়ের ব্যবধানে পরিস্থিতির পালাবদলে পরিবর্তনশীল মন একসময় সেটার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে বা হতাশ হয়ে ভিন্ন কিছুতে ঝুলে পড়ে। আমাকে বর্তমান তার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ায়ে ধীরে ধীরে অহনার বোঝাটা অনেকটা হালকা করে দেয় ঠিকই, কিন্তু একেবারে বিলীন হয়ে যায় না। আমার একাকীত্বে মনের কোণে অহনার উপস্থিতি টের পেতাম। একাকী সময়ে আমার হৃদমাজারে জেগে ওঠতো, আর আমার উচাটন মন তখন কী এক আবেদনে হন্য হয়ে ওঠতো।
গ্রীষ্মের দুপুর। যখন চারদিক ঘিরে খা খা রোদ নামছে। কয়েকদিন ধরে বৃষ্টির দেখা নেই। আকাশের বুকে মেঘের ছিটেফোঁটাও নেই। ভ্যাপসা গরম আর ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে জীবন হাঁপিয়ে ওঠেছে। বাতাসে কান পাতলে কেবল শুনা যায় বিরহী সুর। আমার রুমমেট খাটে শুয়ে প্রেমিকার সাথে আবেগী মালা গাঁথছে। শুনতে শুনতে আমার অতৃপ্ত মন একসময় ক্ষেপে ওঠলো। একরাশ বিরক্তি নিয়ে চলে গেলাম ছাদে। কাঠফাটা খা খা রোদে প্রকৃতিতে বিরাজ করছে দীর্ঘশ্বাসের মতো বিষণ্ণতা। পিপাসা, ক্লান্তি,অবসাদ আর দহনে চারপাশ নিরক্ত। আমি আনমনে এপাশ ওপাশ করছি। কিন্তু এই আনমনাতেও রেহাই পেলাম না। পাশের বাসার ছাদের একটি কোণ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে একটি আমগাছ। এবং তার কয়েকটি ডাল এসে পড়ছে ছাদের ওপর। নজরে এলো এক ষোড়শী পাতার আড়ালে দাঁড়িয়ে মোবাইল কানে হৃদয় উজার করে দিচ্ছে। কথা বলতে বলতে কখনো গাছের কচি পাতা ছিড়ছে। কখনো কখনো কপালে এসে পড়া চুল সরিয়ে দিচ্ছে পেছনে। বেশিক্ষণ তাকাতে না পেরে দৃষ্টি যখন ফিরিয়ে আনলাম, দেখলাম দক্ষিণ পাশে দাঁড়িয়ে আছে যুবক যুবতী। গা ঘেষে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে হাসির প্রলেপে কী সব কথার সুতাহীন মালা গাঁথছে। যুবক হঠাৎ কী বললো আর মেয়েটি উল্লসিত হাসিতে তার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে। যুবকটিও তাকে মমতার আলিঙ্গনে সামলে নেয়। আমার কানের পাশদিয়ে করুণ আর্তনাদে একঢেউ বিরহী বাতাস বয়ে গেলো। ভালবাসায় ভরপুর পৃথিবীতে নিজেকেই কেবল একা দেখতে পেলাম। ছাদ থেকে নেমে এসে বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে দিলাম। ডুবে গেলাম এক পৃথিবী শূন্যতার হাহাকারে। এতো এতো মানুষের ভীড়ে আমি এতোটাই একা এতোটাই নিঃসঙ্গ, কথা বলার মতো মানুষ নেই। আমার হৃদয়ে এতো ব্যথা কিন্তু কোনো সাপুড়ে মেয়েও নেই যে আমার হৃদয়ে তার শিঙ্গা বসিয়ে ব্যথাটা একটুও কমাবে।
চারদিকের পারিপার্শ্বিকতা আমাকে এতোটা আঘাত করলো যে, আমার জীবনটা মনে হলো লবনহীন তরকারির মতো।
নিজেকে শাসালাম, অহনার কথা এতো ভাবিস কেন, ও তোর কে?
একটু বুদ্ধি করে ট্রাই করলে ও তোর কে না হতো?
আরে থাক থাক মেয়েদের আকাল পড়ছে নাকি, ওর মতো অনেক আছে।
হ্যাঁ আছে ঠিক, কিন্তু অহনা ডজন ডজন নেই, সে একজনই।
আমার মন আমার সাথে তর্ক জুড়েছে!
আমার লাচার মন আমাকে টেনে টেনে একদিন আবার কলেজে নিয়ে গেলো, যদি তাকে পেয়ে যাই। জানি সে আসার কথা নয় তবুও খুঁজলাম। নাহ্, পেলাম না। এমনকি যে মেয়েটা সেদিন পরীক্ষার হলে তার সাথে গল্প করেছিলো তাকেও না। নিরাশ হয়ে যেখান থেকে মেয়েদের কমন রুম দেখা যাচ্ছিলো সেখানে গিয়ে বসি।
আমি কখনো পত্রিকায় নজর বুলাচ্ছি, কখনো জানালার বাইরে চোখ রাখছি। একের পর এক পাতা উল্টাতে উল্টাতে চারতলা থেকে দুতলার অফিসের দরজায় চোখ পড়ে। আমি বিস্ময়ে লক্ষ করলাম অহনার বাবা একটি ফাইল হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসছেন। পেছনে নীল ড্রেসের সাথে গোলাপী হিজাবে মোড়া তার হিজাবী কন্যা! তৎক্ষণাৎ পত্রিকা ছুড়ে দৌড় দেই। করিডোর ছাড়িয়ে তার কাছাকাছি চলে এলাম। সে তার বাবার পিছুপিছু হাঁটছিলো, আমাকে দেখামাত্র থমকে দাঁড়ালো! এবং এমনভাবে তাকিয়ে রইলো যেন পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য দেখছে। অথবা এমনভাবে তাকালো যেমন তাকিয়ে থাকে কোনো আপনজনকে দীর্ঘ বিরতির সাক্ষাতে। সে ডান বাম চোখ ঘুরিয়ে ঢোক গিলে দৃষ্টি নামিয়ে নিলো।
আমার দৌড় দেখে এরিমধ্যে অনেকে তাকাতে শুরু করেছে। একসাথে অনেকগুলো কৌতূহলী চোখ ঘটনার কেন্দ্রে একীভূত হয়েছে। আমি নিজেও একটু বিব্রত হয়ে গেলাম। দৃষ্টি এড়ালো না অহনার বাবারও। তিনি আমার দিকে ও অহনার দিকে চোখ কুঁচকে বিস্ময় ও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। মাথা নীচু করে অহনা বাবার পেছনে হাঁটা শুরু করলো। মেয়েকে বাইকের পিছনে বসিয়ে স্টার্ট দেয়ার সময় আরো একবার ভালো করে দেখে নিলেন আমাকে। বাইক চলতে শুরু করলে কথাভরা ছলছল নয়নে সে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো,যতোক্ষণ না চোখের আড়াল হলো। আর আমিও পাথরের মূর্তির মতো তাকিয়ে থাকলাম তার চলে যাওয়া পথে।
তারপর থেকে আমি আরো হন্য হয়ে গেলাম। প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘন্টা কলেজ গেটে বসে থাকি তার অপেক্ষায়। সে আসে না। গোলাপ হাতে ভবঘুরের মতো হাঁটি শহরের পথে পথে, তাকে পাই না। কোনো হিজাব পরা মেয়ে দেখলে ছুটে যাই। কিন্তু না, সে নয়।
আগামী আজ হচ্ছে,আজ কাল হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে অতীতের গর্ভে,অতীতও হারিয়ে যাচ্ছে অতীতের অতলে। ধীরে ধীরে একসময় অহনা ঝড়টা থামে। পরবর্তীতে সে আমার জীবনে একটা ঝড় বলে মনে হয়েছিলো। ঝড় বেশীক্ষণ স্থায়ী হয় না। আসার সময় অনেক সেজে আসে এবং প্রকৃতিকে নাড়িয়ে দিয়ে চলে যায়। আবার একটা সময় দমকা বাতাস ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতেও থেমে যায়। অহন ঝড়ও একসময় ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে থেমে যায়। এ ঝড় হয়তো আমি নিজেই থামিয়ে দিয়েছিলাম। ব্যর্থ হয়ে যখন শূন্য খাতা নিয়ে নীড়ে ফিরলাম এবং নিজেকে প্রবোধ দিতে দিতে বাস্তবতায় নিয়ে এলাম। আমার সব খেয়াল এনে স্থির করলাম একটি জায়গায়। আমি আবারও লেখালেখিতে মন দিলাম, সিরিয়াসলি। বিভিন্ন পত্রÑপত্রিকা, লিটম্যাগে গল্প, কবিতা ছাপা হতে থাকলো। আমার একটা পরিচিতি বাড়লে জনপ্রিয়তাও পেতে লাগলাম। একটি পত্রিকায় সহকারি স¤পাদকের পদে আছি। বাজারে নতুন বই আসছে। এসব ব্যস্ততা নিয়েই আমার দিনকাল। যদিও এ পর্যন্ত আমার জীবনে অনেক প্রাপ্তির খাতা খালি তবুও অনেক তৃপ্তি নিয়ে বেঁচে আছি। অহনা নামের সেই মেয়েটি আজ কেবল স্মৃতি। মাঝে মধ্যে মনে পড়েলে আমি তাকে গল্পের চরিত্র বানিয়ে নিই। আমি জানি না অহনা আমার কোনো গল্প পড়েছে কি না। পড়লেও আমাকে চিনেছে কি না।
আজ হঠাৎ মেঘ না চাইতে এমন বৃষ্টি নামবে কখনো ভাবি নি।
শহরের ব্যস্ততম এ রাস্তায় সিটি শপিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছি রাস্তা ক্রস করার জন্য। লম্বা জ্যামে গাড়ির চাকাগুলো থেমে আছে। আমি ফাঁকফোকর গলে ওপাশে আসতে আসতে এক হিজাবী কন্যার ওপর চোখ পড়লো। প্রথমবার ফিরিয়ে আনলেও জানি না কিসের টানে আবারও চোখ পড়লো তার ওপর। কেমন যেনো চেনা চেনা মনে হলো চোখদুটো। আমার মনের পটে ভেসে ওঠলো অহনার ছবি। ‘দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।’ মনে মনে রবীন্দ্রনাথের এই লাইন জপতে জপতে রাস্তা পার হয়ে তার দিকে আসতে আসতে নিশ্চিত হলাম, এই সেই অহনা! একদিন যে আমার হৃদরাজ্য উথাল-পাথাল করে দিয়েছিলো!
আমার বুকের ভেতরে দমকা বাতাসের তীব্র আলোড়ন শুরু হলো।
আমি আর আগের মতো ভীতু নই। আজকাল আমি বেশ সাহসী। আমি এখন নির্দ্বিধায় তার সামনে দাঁড়াতে পারবো। কথা বলতে পারবো নিঃসঙ্কোচে। আজ আর পিছু হঠার কোনো কারণ নেই। অন্তত কুশলটুকু তো জিজ্ঞেস করতে পারবো।
যেন হাজার বছরের পরিচয়ের সূত্র আমাকে তারদিকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। আমি তার কাছাকাছি আসতেই সে সিটি শপিংয়ের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলো। আমি তার পিছু নিয়েছি এমন সময় লোকটি হাজির হলো। সে আমার দিকে এমনভাবে তাকালো, আমি রীতিমতো থতমথ খেয়ে গেলাম! অলিক কিছু দেখছে এমনভাবে তাকিয়ে আমাকে বললো– আপনি অমুক না?
আমি হ্যাঁ সুচক মাথা নাড়তেই, আমার হাতটা ধরে তার বুকে জড়িয়ে নেয়।
আমি ঠিকই বুঝেছি, আপনিই হবেন। আমি ঠিক চিনতে পেরেছি আপনাকে। আপনাকে একবার কাছ থেকে দেখার অনেক ইচ্ছে ছিলো আমার কিন্তু পাই নি, বইমেলাতেও পাই নি আপনাকে।
লোকটি কথার পিঠে কথা গেঁথে যায়। প্রথমে অস্বস্তি লাগলেও পরে ভাবলাম, এখানে দাঁড়ানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। অহনার সাথে দেখা হওয়ার কনফার্ম রাস্তা এ একটাই। শেষ পর্যন্ত তাকে এদিকেই বেরিয়ে আসতে হবে।
আমার স্ত্রীর কাছেই প্রথম আপনার কথা শুনি। ও আপনার অসম্ভব ভক্ত।
কথায় কথায় জানতে পারি তিনি একটি ব্যাংকে চাকুরি করেন। মাত্র তিনমাস হলো তাদের বিয়ে হয়েছে। মাসের শেষে মোটা মাইনে নিয়ে সুখের সংসার। অনর্গল কথা বলছেন। যতো মোটা মাইনের চাকরি হোক না কেন সে তাতে সন্তুষ্ট নয়। তাঁর ধারণা আমিই সফল মানুষ।
আপনারা এমন কাজ করে যাচ্ছেন, জীবনেও কতো সম্মান পাচ্ছেন, মরার পরও মানুষ যুগযুগ ধরে আপনাদের স্মরণ করবে। আমাদের জীবন খেয়েধেয়েই তামাম। কিন্তু আপনাদের তা নয়। মারা গেলে কেউ আমাদের মনে রাখবে না। আপনারা থেকে যাবেন আপনাদের লেখায়।
নদীর এপার যেমন নিশ্বাস ছেড়ে বলে তার সর্বসুখ ওপারে নিশ্চিত, আর ওপারও দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে সুখের খনিতো এপারে। মানুষের জীবনও এর ব্যতিক্রম নয়। নিজ নিজ অবস্থানে সন্তুষ্ট মানুষের সংখ্যা খুব অল্প।
সে সংঙ্কোচিত হয়ে হাত কচলাতে কচলাতে বললো– আপনাকে এখানে দাঁড়িয়ে রেখে কথা বলা ঠিক হচ্ছে না। কোথাও বসলে ভালো হতো, চলুন।
না, থাক। আমি এখানে একজনের অপেক্ষায় আছি।
ও-আচ্ছা, আচ্ছা। আমার স্ত্রী ভেতরে গেছে আমিও তার অপেক্ষা করছি। এক্ষুনি এসে যাবে। আপনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলে ও খুব খুশি হবে।
সে ফোন করলো– এই তুমি কোথায় আমি বেরোনোর গেটে আছি, তাড়াতাড়ি এসো, সারপ্রাইজ আছে!
ফোন রেখে আবার আমার সাথে কথা শুরু হলো– জানেন, আমার স্ত্রী কবিতা লেখার চেষ্টা করে। আমাকে দেখায় কিন্তু আমি কী আর কবিতা বুঝি? কিছু যদি মনে না করেন আপনার কাছে একদিন নিয়ে আসবো।
আমি কথা বলার ফাঁকে গ্লাসডোরের দিকে সতর্ক নজর রাখছিলাম। দেখলাম, গ্লাস ধাক্কাদিয়ে বেরিয়ে আসছে অহনা। আমার ভেতরে আনন্দের ঢেউ চোখ উপচে পড়তে লাগলো। আমি তার দিকে এগিয়ে যাবো, তখনই লোকটা বলে উঠলো– এইতো আমার স্ত্রী এসে গেছে। দৌড়ে গিয়ে অহনার হাত ধরে টানতে টানতে তাকে আমার সামনে এনে বললো– আমার স্ত্রী, অহনা। দেখতো অহনা উনাকে চিনতে পারো কি না!
অহনা তখন শুকিয়ে কাঠ! একবার আমার দিকে তো আরেকবার তার স্বামীর দিকে তাকায়। স্বামী তার অপারগতা বুঝে নিজে পরিচয় করাতে লাগে।
অহনা একবার ঢোক গিলে। জিব দিয়ে শুকনো ঠোঁট চেটে ভিজিয়ে নিলো আরেকবার। এরপর কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো– জ্বী, মানে, আপনাকে আগে কোনো দিন দেখিনি কিন্তু আপনার বই পড়েছি, খুব ভালো লাগে। আপনার সাথে দেখা হয়ে খুব ভালো লাগছে।
অহনার স্বামী লোকটাকে সহ্য করতে পারছি না, সে কথা বলবেই। আবার শুরু করলো– ও খুব লাজুক। হঠাৎ কারো সাথে কথা বলতে খুব লজ্জা পায়। তারপর আবার অহনার দিকে তাকিয়ে বললো– এতো লজ্জা কিসের, তোমার কবিতা লেখার ব্যাপারটা আমি উনাকে বলছি। একদিন তুমাকে নিয়ে যাবো, দেখে দিবেন।
অহনা মাথা নিচু করে তার পায়ের নখের দিকে তাকিয়ে রইলো।
আমি আর থাকতে পারছি না। আমার খুব অস্বস্থি হচ্ছে। আমি চলে যেতে চাইলে লোকটি আগলে দাঁড়ালো– তা কি করে হয়। আপনাকে সাথে নিয়ে আমরা সবাই খাওয়া-দাওয়া করবো।
সে নাছোড়!