আশরাফ উল আলম শিকদার
জন্ম ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৪, লেখাই এখন সারা-দিনের কাজ। সেই সাথে বিজ্ঞাপণ, প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেক্টনিক্স মিডিয়া ও ওয়েব ডিজাইন করেন শখে। পেশা: টিভি, ও সিনেমার জন্যে চিত্রনাট্য লেখা। ১৯৯০ সাল থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিজ্ঞাপণী সংস্থায় ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হিসাবে কাজ করেছেন দুদশক। নেশা ঢাকার ইতিহাস আর কবিতা লেখা।
আশরাফ উল আলম শিকদার

হেমলক

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

আশরাফ উল আলম শিকদারের গল্প

হেমলক


“শোন বাবলু, বিয়ে করতে চাও করো, তবে…”

বাবুলই কথায় বাঁধ সাধলো, “করতে চাও করো, মানে কী ভাইজান? আপনে কি বিয়া না করবার কন?”

সন্ধ্যের আলো গভীর হয়ে ঠিক রাত হয়ে ওঠবার আগেই দেওয়ানবাড়ির মাঠের পাশে বাবলুর চায়ের দোকানে এসে বসে চার ছ-জন মাঝ বয়সী বাউন্ডুলে। সেলীম তাদেরই একজন। গত সাত বছর এই পাড়াতেই তার বসবাস। দিলকুশার কাছাকাছি নিম্ন মধ্যবিত্তদের ভাড়ার-বাসায় থাকবার বেশ উত্তম স্থান। অফিস থেকে বাসে এসে নেমে, বাসায় ঢোকার আগে সরাসরি গিয়ে বসে বাবুলের চায়ের দোকানে। মাঠের বৈকালিক তারুন্য কেটে যাবার পর সবে যুবকদের এসে জোড়ে জোড়ে চরে বেড়াবার সময় হয়েছে। বাবলুর এই চায়ের দোকানে এই সময় এসে বসাটা সেলীমের গত চার পাঁচ বছরের অভ্যাস। এখানে বসে বসেই দু-তিন জন অপরিচিত মানুষ বন্ধু হয়ে উঠেছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে এক কাপ চা, আর দৈনিক প্রথমআলো পত্রিকা নিয়ে বসে ঘন্টা খানিক সময় আর অফিস থেকে ফিরে ঘন্টা তিন-চার বাবুলের দোকানে বসে আড্ডা মারা; এইটুকু সময়ে সে একেবারে মুক্ত বিহঙ্গ–স্বাধীন মানুষ।

এই সময়টুকুতে সে বাংলাদেশ তো বটেই ভারত, আমেরিকা, চীনকেও ছেড়ে কথা বলে না। সকালের খবরকাগজে চোখ বোলাবার সময় সে সান্ধ্যেয় বৈঠকে ঝড় তোলবার বিষয়াদি সংগ্রহ করে নেয়। সন্ধায় বাবুলের দোকানে বসে চায়ের কাপে ঝড় তোলে স্বাধীন জনমত হিসেবে।

বাবুলই বলছিল, “সেলীম ভাই, শালা আমার বাপের জ্বালায় অস্থির হয়ে গেলাম। আমার বিয়ে বিয়ে করে পাগল হয়ে গেলো বুড়োটা। আজকে আবার মেয়ে দেখতে যেতে হবে; দোকান পাট ব্যাবসাপাতি বন্ধ রেখে…! এমনিতে শালা করোনার জন্যে বেচা কেনা নেই…।”

সেলীম জানতে চায়, “কোথায় যাবা, বাবা, মেয়ে দেখতি?”

“শাখারিপট্টি!”

সেলীমের মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল প্রায়, ওখানে তো সব হিন্দুদের বসবাস। তবে হঠাৎ করে মাথায় কী যেন একটা কূটনৈতিক চিন্তা আসায় সে প্রশ্নটা করলো ঘুরিয়ে। “কয়েক দিন পরেই না পুজো?”

“পুজোর জন্যেইতো তাড়া হুড়ো এত, পুজো শেষেই বিয়ে। এক ছুটিতে কম্ম সাবার!”

“দূর্গা পুজোর তো আর বেশী দেরী নেই রে! এখনও মেয়ে দেখাই ফাইনাল হয় নি?”

“দূগ্গা পুজাই কি শেষ, সেলীম ভাই। আরো পুজা আছে। বিয়ে হবে কালী পুজার পর।”

এত দিনেও সে জানতো না বাবুল আসলে হিন্দুর ছেলে। সেলীম কিছুক্ষণ হা করে বসে থাকে, নিজেকে খুব বোকা বোকা মনে হয়। মনে মনে বলে, “ও, শালা! বাবলু হিন্দু, জানলাম এতদিন পরে, আমিতো বোকাচোদা বনে গেলাম। শালা মালাউনদের নিয়ে না জানি কত কী আলফাল বলেছি ওর সামনে! ছিঃ ছিঃ কাজটা ভালো হয় নি।” বাবলু ছেলেটা অসাধারণ ভালো ছেলে। ওর হাতের চা মানে তো একেবারে জান্নাতের লেমন টি!

নিজের কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাবটা মুছে ফেলতেই সেলীম তার দার্শনিক মতবাদটা দিলো, “শোন বাবলু, বিয়ে করতে চাও করো, তবে…”

“করতে চাও করো, মানে কী, ভাইজান? আপনে কি বিয়া না করবার কন?”

“না, না তা বলি না, বলি অবশ্যই বিয়া করবা, তবে দেইখা, শুইন্ন্যা!”

বাবলু স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ে, “তা তো অবশ্যই। বাপে তো দেইখা শুইন্ন্যাই আনতেছে।”

“বাপে না, বাপে না রে শালার ভাই। তুমি নিজে দেইখ্যা বুইঝা নিবি। মেয়ে যেনো শিক্ষিত হয়।”

পাশেই বসে ছিল সোবহান। এই অঘোষিত বাউন্ডুলে দলেরই পুরাতন সদস্য। নিজে একটা ইংরেজী স্কুলের মাষ্টার আর ওর বউ আবার আরো বড় একটা  স্কুলের মাস্টার। সে ফোস করে ওঠে, “কেনো শিক্ষিত হলে কী হবে?”

তার পাশে বসে চায়ে সুর তুলে চুমুক দিয়ে খাচ্ছিল বশির। বিভিন্ন ব্যবসা করতে নেমে লস খাওয়া পাবলিক। তার ধারনা, পৃথিবীর সবাই চিটিংবাজ, সে একাই ভালো। তার বিএ পাশ বউয়ের ধারনা সে খুবই বোকা-শোকা মানুষ। সাভারে তার বাপ-দাদার অনেক সম্পত্তি। তাই ভেঙ্গে ভেঙ্গে স্বামীকে ব্যবসাতে নামায়। বশিরের বাপেরও যে অবস্থা খারাপ তা নয়। বরং শ্বশুর বাড়ির সম্পত্তি থেকে তাদের সম্পত্তিই বেশী। সমস্য হলো ওর বাপ বেঁচে আছে; চার ভাই। ভাগ বাটোয়ারা কিছু হয় নি। আর ওর শ্বশুর মারা গেছেন, বেঁচে আছে শাশুড়ী। আর ওর বউই তাদের একটা মাত্র সন্তান।

ইংরেজী স্কুলের মাষ্টার সোবহান ফোস করে ওঠে, “কেনো শিক্ষিত হলে কী হবে?”

বশির শুনছিল, কিছু বলে না। সে চায়ে সশব্দে চুমুক দিয়ে চোখ উচিয়ে এমন ভাবে তাকায়, যার অর্থ সেও প্রশ্নটা করলো।

বাবুলও গরম কেৎলি দিয়ে পানি ঢেলে ঢেলে চায়ের ছোট ছোট কাঁচের গ্লাস ধুতে ধুতে আগ্রহ ভরে তাকিয়ে থাকে।

সেলীম বলে, “তোমার-আমার বাপ-দাদাদের আমলের দর্শন হলো, বংশের মেয়ে কালোও ভালো। তবে আজকালকার কথা আলাদা। এখন বলা উচিৎ, শিক্ষিত মেয়ে কালোও চলে!”

বশির চায়ের গ্লোসটা রেখে প্রতিবাদী কন্ঠে বলে ওঠে, “চলে কী, চলে কী! নারীদের সন্মান করতে শেখেন নি, সেলীম ভাই!”

সোবহান হেসে ওঠে, “শ্বশুর বাড়ি থেকে মাল টেনে আনতে হলেই না নারীদের  সন্মান করতে শিখবো!”

বশির সোবহানের কথার গূঢ় অর্থ বুঝে ফেলে, “কথাটা কি ঠিক কইলেন সোবহান ভাই?”

সোবহান বলে, “আপনে কলাম আবার কথাডারে ইউ-টার্ণ দিয়া নিজের দিকে লয়েন না।” বলেই সে বশিরকে পাশ কাটিয়ে জোর দেয় সেলীমের কথায়। “সেলীমভাই, শিখিত মাইয়া বিয়া করলে কী লাভ? আপনি নিজে কি লাভ পাইছেন আগে হেই কথা হুনি, কন?”

গত চার বছর পরিচয়, তবে আজ এই প্রথম বশিরের মনে হলো, “সোহান সাহেব নাকি ইংরেজি স্কুলের মাস্টার! তার মুখের বাংলা এত খারাপ হইবো কেন!”

সেলীম ভেচকি দিয়ে একটা অতি রহস্য ফাঁস করার পূর্বমুহূর্তের চাপা হাসি হাসে। অসম্ভব কোনো ম্যাজিক দেখিয়ে ফেলবে এমন একটা আত্মবিশ্বাস কন্ঠে ঢেলে কথা শুরু করে, “ভাই, আমার স্ত্রী লেখা পড়া জানে না, .. ”

বাবলু সমেত বশির আর সোবহান তিনজন চমকে ওঠে। বশির বলে ওঠে, “কী কন না কন…?”

“হ্ ভাই ঠিকই কই, আপনাগে ভাবি কেলাস এইট পাস।”

বাবুল অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, “দেখলে, কথাবার্তা হুনলে তো মনে হয় এমএ বিএ পাশ দিছে চার পাঁচ বার।”

সেলীম দুঃখের হাসি হাসে মুচকি হেসে। হতভম্ব হয়ে সোবহান বলে, “ এ কী হুনাইলেন সেলীম ভাই, তার সাথে কথাবাত্রা কয়া আমি ভাবছিলাম বিএ পাশ তো করছেই।“

সেলীম একটা দীর্ঘ্যনিশ্বাস ফেলে বলে, “না রে ভাই; সে কেলাস এইট পাস। তাও আবার গ্রামের ইসকুলের কেলাস এইট। মানে ঢাহা শহরের কেলাস থিরি। আর আজকালকার কেজি ইসকুলের হিসেবে বড়জোর ওয়ান!”

বাবুল হেসে হেসে বলে, “তয় আপনি দেখি আমারে উপদেশ দিলেন, শিক্ষিত মেয়ে বিয়া করনের?”

সেলীম রেগে ওঠে, “হ, দিছি, উপদেশ দিছি। উপদেশ দেওনের জ্ঞাণ অর্জন করছি বইলেই উপদেশ দিছি।”

রশিদ চিন্তিত হয়ে ওঠে, “সেলীম ভাই, তা কী জ্ঞান অর্জন করেছেন, কোথা থেকে করেছেন? মানে কোন ইন্সিটিউশন থেকে জ্ঞাণ অর্জন করলেন?”

“আমার নিজের বাড়ির ইন্সিটিটিউশন থেকে জ্ঞান অর্জন করেছি।”

এবার ইন্সিটিটিউশনের কথা আসাতে সোবহান মাস্টার আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। “তা কী শিকসেন ভাই।”

সেলীম বলে, “শিখছি, অশিখিত মেয়ে বিয়ে করা আর একটু একটু করে বিষ খাওয়া এক কথা।”

বাবলু হা করে তাকিয়ে। বশির বিরক্তিসূচক চু-চা করছে। সোবহান আবার বলে ওঠে, “কেন, হেতায় কি আননেরে প্রতি দিন হেমলকের চুমু দি ঘুম পাড়ায়ে রাখচে?”

বাবলু-বশির-সেলীম তিনজনের কেউই হেমলক চেনে না। বশির আর সেলীম ভাবে কোথায় যেন শুনেছে হেমলকের কথা। নামটা চেনা চেনা, স্পষ্ট করে মনে নেই বা জানেই না। উদগ্রীব হয়ে তাকায় তিনজনই তবে জানতে চায় বাবুলই, “সোবহান ভাই, কিসের চুমার কথা বললেন, ভাই?”

সোবহান পেশায় মাষ্টার, জ্ঞান জাহির করবার সুযোগ সে একটুও নষ্ট করলো না। “হেমলক, খ্রিষ্টপূর্ব থ্রি হানড্রেড নাইনটি নাইন-এ হেমলক বিষ খাওয়াইয়া সক্রেটিসকে মিরুতুদন্ড দেওয়া হয়েছিল।”

বাবলু এ উত্তরে কিছুই বুঝলো না। তার সতৃষ্ণ দৃষ্টিও তাই সরলো না, শুধু ঠোট বিড় বিড় করে, “সকরেতিস তো কোরবান-ভার বড় শালার ছোট পোলার নাম, তারে হেমলকে বিষ দিছে কেন? পোলায় বাঁছসে না মরসে? তা হেমলক কী বিষটা দিছে?”

সোবহান তার প্রচন্ড রাগ চেপে রেখে, অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত মানুষদের সাথে চলতে হয় বলে মনে মনে বেশ আফশোস করে বিরক্ত স্বরে উত্তর দেয়, “হেমলক কোনো মাইনষের নাম নারে গাধা। হেমলকটাই বিষ!”

“হেমলক কেমন বিষ ভাইজান?”

“আমি তো কহনো খাই নাই তাই এর স্বাদ জানা নেই!”

“না, না ভাইজান, আমি টেস্টের কথা কই নাই, কই ইয়াবার মতো ট্যাবলেট, ফেন্সিডিলের মতো পানি পানি, নাকি হেরোইনের মতো পাউঠার?”

“ধুতুরা দেখছো, ধুতুরা ফুল? ধুতুরা ফুলের নাহাল।”

কথাটা বাবুলের বিশ্বাস হলো না।

সোবহান তার কথার মনমতো উত্তর পায় নি। সে আবার চেপে ধরে, “হ, হইলো অশিক্ষিত। তাতে আপনের সমস্যা কি হতিছে? তাকে দেইখে বা কথাবাত্রা কয়ে তো বোঝনের উপায় নেই সে আনএডুকেটেড!”

“সমস্যাটা হেইখানেই। মাইনষে বোঝে না তো না বুঝুগ, সে নিজেও বোঝে না সে আসলেই আনএডুকেটেড মহিলা। হে এডুকেশনের চোদ্দগোস্টি ঢোকাতে চায় আমার বাচ্চা বাচ্চা দুইটা মেয়ের মধ্যে।”

“হেইয়েতো খারাপ কিচু না!” অবাক হয়ে প্রশ্ন করে বশির, “আজকালকার বাচ্চা কাচ্চাদের যা অবস্থা! আমগের সময় আমরারা বই ছাড়া কিচ্চু বুজতাম?”

সেলীম ভেঙ্গচি মেরে ওঠে, “আমগের সময় আর ছেলটা কী, ছেলটা কী? মাঠে মাঠে হা ডু ডু আর ফুটবল। বাড়িতে বই ছাড়া আর কি কিচু ছেল?”

বাবলু হা করে সব শুনছিল। ও আগেও দেখেছে, এই সব ঢাকাইয়া শুদ্ধ বাংলা বলা লোকজন স্বরূপে ফিরে এলে কেমন ভড় ভড় করে খাস দেশী ভাষায় উত্তেজনা প্রশমন করে।

ক্রমে বেরিয়ে এলো সেলীমভাইয়ের স্ত্রী ক্লাশ এইট পাস। মেয়ে দুটোর পেছনে সারাটা দিনই পড়া পড়া করে লেগে থাকে। প্রথম প্রথম মেয়েরাই শুধু বিরক্ত হতো, আস্তে ধিরে সেলীম ভাইও বিরক্ত হয়ে উঠেছে। তবু কিছু বলা যায় না। মায়ের শাসন মেনে নিতেই হবে। মেয়েরা পড়াশোনা করছে না দেখলেই তার চিৎকার চেচামেচী শুরু হয়ে যায়।

এক শুক্রবারে সাপ্তাহিক ছুটিটা বাড়িতে কাটাবে ভেবে সেলীম ছিল বাসাতে। যথারীতি ওর মেয়েদের ওপর মাতৃ শাসনের বাড়াবাড়ি চলছিল; দেখে খুব নরম গলায় সেলীম তার বউকে বুঝিয়ে বলবার চেষ্টা করেছিল, শুক্রবারটা একটু না পড়লে সমস্যা কিছু হবে না। উত্তরে তার স্ত্রী প্রকাশ করলো তার মনের কথা, সে চায় না তার মেয়েরাও লেখাপড়া না শিখে ওর মতো কোনো অযোগ্য মানুষের হাতে পড়ুক। এরপর আর সেলীম কিছু বলে নি। আফসোস করলো নিজের সন্তানদের দুর্ভাগ্যের কথা চিন্তা করে।

সোবহান এবার দুঃখ করে জানালো তার বউ উচ্চ শিক্ষিত ঠিকই, স্কুলে শত শত ছেলে মেয়েকে পড়ায় ঠিকই তবে নিজের ছেলেটাকে কখনো পড়তে বসতে বলে না। আবার রান্না-বান্নার কোনো আগ্রহ নেই, ডিম ভাজলে তাও বিস্বাদ লাগে। তবে হ্যা, গলার জোর আর মেজাজ, মাসাল্লা।

বশির বেশ উচ্চৈ স্বরে বয়ান করে তার স্ত্রীর গুণাগুণ। খুব বেশী শিক্ষিত নয়, ছেলে মেয়েকে পড়াতে বসে না ঠিকই তবে তাদের লেখাপড়ার দিকে সজাগ নজর তার। রান্নাও যে বলে বেড়ানোর মতো ভালো করে তা নয় তবে আগ্রহ আছে, স্বাদ মন্দ নয়, নতুন নতুন ডিস কিছু না কিছু রাধেই ইউটিউব দেখে ছুটির দিনগুলোতে। কিন্তু তার গলার তেজ– কথার হূল বড় বিষময়।

বাবলু মন দিয়ে সবার কথা শোনে। পরে কয়েক দিন রাতে শুলে ওর কানে বাজতে থাকে সবার কথা। শাখারীপট্টিতে পাত্রী দেখা হয়েছে, তবে বিয়ে সাদির ব্যাপার। কোথায় যেন আটকে গেলো বিয়েটা। তারপরেও আরো দুটো মেয়ে দেখা হয়েছে তবে বিয়েটা হলো না। পুজো চলে আসলো।

সেলীম সকালেই খবরটা পেলো, দুর্গাপুজার মহা অষ্টমীর দিন বুধবার ভোরে কুমিল্লা শহরের নানুয়াদীঘির একটি পুজামণ্ডপে কোরআন শরীফ পাওয়া গিয়েছে। পরে একদল লোক কোরআন শরীফ অবমাননার অভিযোগ তুলে ওই পুজামণ্ডপে হামলা ও ভাঙচুর চালায়। হঠাৎ করে সেলিমের আত্মার মধ্যে তার গ্রামে কাটানো কৈশোরকালীন ছাত্রজীবনের সব-কিছু-না-মেনে-নেওয়া-মনটা ফুঁসে ওঠে। দেহে সাতচল্লিশের রক্তপায়ী পূর্বপুরুষের রক্ত উতলা হয়ে ওঠে। এত দিন পরেও ওর কেনো যেন মনে হয় ব্রিটিশরাতো এ দেশটা দিয়ে গিয়েছিল মুসলমানদের।

সে রাতে শুয়ে শুয়ে সেলীমের মনে হয়েচ্ছে বাবুলের মতো অন্যান্য হিন্দুরাওতো এ দেশে মিলে মিশেই আছে, তাহলে সমস্যা হয় কেনো! কী চায় ওরা, কেনো এমন অন্যায় কাজ করে। সংখ্যাগুরুদের ধর্ম অবমাননার দুঃসাহস পায় কীভাবে! তারপরে দিন দুই ধরে এই চিন্তাটা সেলীমের মাথার মধ্যে ঘুরছিল। একবার মনেও হয়েছিল বাবলুর চায়ের দোকান এখান থেকে নিষিদ্ধ করা উচিৎ। শুক্র-শনিবার ওদের অফিসে যাওয়া হয়েছে ঠিকই তবে সন্ধ্যের পর আর বাবলুর দোকানে বসা হয় না।

বাবলুর দোকান বন্ধ, পুজোর জন্য। এই দেওয়ানবাড়ির মাঠের এক পাশেও একটা পুজোর প্যান্ডেল পড়েছে। এখানে গন্ডোগোল হবার তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে কারো কারো মনে সহিংসতা জেগে উঠতে পারে ভেবে এখানে মজবুত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়েছে পুলিশ সদস্যরা।

অফিস থেকে ফিরে দেওয়ানবাড়ি মাঠের পুজা মন্ডপের এমন নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখে সেলীমের মনে হলো, এতটা না হলেও হতো! এবং তখনি সোবহানকে কাছে পেয়ে মনের কথাটা বলে ফেললো তার কাছে। সোবহান স্কুল মাস্টার, তার মতামতের  মূল্য অনেক; সমাজে এবং সেলীমের কাছেও। সেলীম আশা করেছিল সোবহানও ওর কথা সর্মথন করবে। সোবহান বরং বিরক্ত হয়ে বললো, “তাহলে কি আপনে মনে করেন ব্রিটিশরা এই দেশের সাথে ভালা কাম কইরে গেছে?”

“না, তা ঠিক না।”

“তাইলে এই ভাগাভাগিটা ঠিক হইলো কেমনে! হেরপরও যা হইয়াগেছে তাতো মাইন্না নিতেই হইবো। তয় আমরা যারা অহন বুঝতাছি আকামটা কেনো হেরা করছিল তারাতো আর গন্ডগোল না করাই কর্তব্য।”

সেলীম আর কিছু বলতে পারে নি। সেই দিন সারারাত চিন্তা করে শেষে সেলীমের ধারনা যথাযথভাবে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে তার কাছেও। পরের দিন সকালেই সেলীম খবর পেয়ে গেলো নানুয়াদীঘির পুজামণ্ডপে কোরআন শরীফ অবমাননার ঘটনা পেছনে কে বা কারা জড়িত তা একটা সিসিটিভির ফুটেজে ধরা পড়েছে। বিকেলের মধ্যে রাষ্ট্র হয়ে গেলো ইকবাল নামে এক রং মিস্ত্রির কথা। পরে তাকে এ্যারেস্ট করা হয়েছে।

পরের দিন বাস থেকে নেমে সেলীম দেখতে পেলো বাবলু চায়ের দোকানটা সেদিন খুলেছে। পা বাড়াতে গিয়ে সেলীমের পা আটকে গেলো। ছিঃ ছিঃ, বাবলুর ব্যাপারে সে এমনও চিন্তা করতে পেরেছিল। এখন মনে হচ্ছে সে আর কোনো দিনই বাবলুর দিকে হাত বাড়িয়ে বলতে পারবে না, “বাবুইল্লা, এক কাপ চা দে।”

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu