নয়ন মাহমুদ
কবি ও কথাসাহিত্যিক
নয়ন মাহমুদ

প্রেয়সীর সমাধিভূমি

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

তুমি লেখক, কাজেই চাইলেই তুমি সবকিছু লিখতে পারবে না, বিশেষত এখানে সৎ থাকা তুলনামূলক কঠিন। অসংখ্য সীমারেখার মধ্য দিয়েও জানি তুমি লিখবে, কেননা লেখনীতে আছে এক অনাবিল সুখ। সবকিছু শিখতে হয়। লিখতে লিখতে কিংবা পড়তে পড়তে সঞ্চিত অভিজ্ঞতায় অনেক কিছুই শিখে যাবে। হয়তো প্রাথমিক ধাপে লিখছো ঘোড়া সম্বন্ধে, কিন্তু ঘোড়সওয়ারে এসে তোমার কলম থেমে গেল। এভাবে তুমি উপলব্ধি করবে নিজের সীমাবদ্ধতা। তখন তুমি পঠন পাঠনে মনোযোগী হবে। বিশেষত দর্শন তোমায় খানিকটা পথ দেখাবে। ফলে কিছু চিন্তা ঝড়ে যাবে। সময়ের ব্যবহার এবং অপব্যবহার করে অধিকাংশ বিষয় তোমার বোধগম্য হবে, অধিকাংশ বিষয় তুমি বুঝবে না। তখনও তুমি লিখবে এবং লেখনীতে থাকবে অতিকথন, বাহুল্য। চোখের সামনে বিচিত্র জীবনপ্রণালী দেখে, লোকজনের কথাবার্তা শুনে– সেগুলো নিশ্চয়ই জীবন সম্পর্কিত, এভাবে ক্রমশ অদ্ভুত অভিজ্ঞতার সন্নিবেশ ঘটবে তোমার চেতনায়, অবচেতনে।

আমি হলফ করে বলছি, সর্বোচ্চটুকু দিয়ে লেখার চেষ্টা করবে তুমি, কিন্তু কস্মিনকালেও পরিতৃপ্তি পাবে না। কেননা ভালোর বিমূর্ত চিত্র অসীম। তবু সঠিক পদক্ষেপে তুমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আমাদের গল্প শোনানোর ব্যাপারে। যদিও বা গল্পপাঠে আমাদের চিন্তায় বৈপ্লবিক কোনো পরিবর্তন আসবে না, কিন্তু আমরা পাঠক উপলব্ধির নির্যাসে আনন্দদায়ক দ্যোতনায় আপ্লুত হবো। সেজন্য তোমায় ধন্যবাদ। তোমার অধ্যবসায় এবং প্রচেষ্টা সঠিকভাবে চললে একটি নির্দিষ্ট সময় পর, হয়তো দু এক বছর কিংবা দশক পেরিয়ে প্রাথমিক অবস্থার উত্তরণ ঘটবে এবং তুমি নিপুণ শব্দে ফুটিয়ে তুলবে ঘোড়সওয়ার। নিয়ম রক্ষার খাতিরে সাক্ষাৎকারে তুমি আমাদের জানাবে, আমি যতটুকু জানি তার থেকেও অধিক শিখেছি বুদ্ধদেব বসুর কাছ থেকে। হয়তো বলবে, বুদ্ধদেব বসু ছিলেন একজন যোদ্ধা যিনি শব্দকে তীরের মতো ব্যবহার করতেন। একদম সঠিক বিন্দুতে তীর নিক্ষেপের মতো শব্দ প্রয়োগ। স্মৃতিচারণে বলবে, লেখালেখির প্রাক মুহুর্তে পুরো গ্রীষ্মকাল কেটেছে বেশ কিছু বইয়ের অনুবাদ করে, হয়তো জোসেফ কনরাড কিংবা শার্ল বোদলেয়ার। জানাবে, সেটি ছিল ছাপার উদ্দেশ্য বহির্ভূত লেখা আত্মস্থ করার এক অনন্য উপায়। ভবিষ্যতে যারা লিখবে তাদের উদ্দেশ্যে বলবে, আমরা এবং আমাদের পারিপার্শ্বিকতা থেকে অবশ্যম্ভাবী লেখনী দূরত্ব বজায় রেখে চলবে এবং লেখা অবশ্যই পাঠকের চিন্তায় এক গভীর ছাপ রেখে যাবে। তাছাড়া লেখার মধ্যে থাকবে আলাদা এক আবেদন। এ কথা বলে ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে আমাদের অবগত করাবে এবং এখন সেটি উত্তম পুরুষেই শোনা যাক।


২.


রাত অতিক্রান্ত সকালে, পাখির ডাকে নয় স্রেফ নুসরাতের ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেল। হো হো করে হাসতে হাসতে বললো, উফ্ লেখায় এত কাটাকুটি, পাঠ উদ্ধার করতে পারিনি, কীসব যে লেখেন আল্লায় জানে। এখন কবিমশায় তাড়াতাড়ি উঠুন। সময় খুবই সীমিত। ফুরুৎ করে সে উড়ে গেল। মাথায় বিগত রাতে পড়া বইয়ের রেশ, ঘুম, আধা ঘুম, স্বপ্ন, জাগরণ এবং পুনরায় শুয়ে থাকার তাগিদ শরীরের, কিন্তু অন্যদিকে নুসরাতের ডাক। যাক, বরং আরেকটু শুয়েই থাকি। নুসরাত আমার দূর সম্পর্কের মামাতো বোন, আমার নানীর সঙ্গে এসেছে। অনেক ভালো মেয়েটা, ওর সঙ্গে যেন আমার পূর্বজন্মের পরিচয়। কিছুক্ষণ পর নুসরাতের কণ্ঠ ভেসে আসছে কানে, না এত সুন্দর কবুতরের বাচ্চা জোড়া জবাই করতে দেব না। আম্মা বলছে, দাও মা। অনেক বাক বিতণ্ডার পর শেষে হার মেনে নিল নুসরাত। কুরুক্ষেত্রের লড়াই বেঁধেছিল যেন আমার কক্ষে। একি আপনি এখনো ঘুমে? সারারাত কী কী সব বই পড়ে! আল্লা! উঠুন উঠুন। বৌ নাই তো এইজন্য বাঁধনছাড়া। কী হলো, এখনো শুয়ে আছেন যে! মুখে হাই তুলে যখন বিছানা ছেড়ে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখন মুখ ফসকে বলে ফেলি, একি আমার লুঙ্গি কোথায়? নুসরাত লজ্জায় মুখ আরক্ত করে বললো, ছিঁ। তারপর সে উধাও।

নুসরাতকে নিয়ে বাগানে হাঁটা, গল্প করা, হাসা, ঝগড়া করা, পাশাপাশি বসে চোখে চোখ রাখা, হয়তো কখনো অনিচ্ছাকৃতভাবে হাতে হাত রাখা, প্রকৃতির সান্নিধ্যে এসে আত্মভোলা দুজন দুজনা—-দুটি হলুদ প্রজাপতি।

– আপনার প্রিয় লেখক কে?
– কেউ না।
– আ জ ব। হেঁয়ালি করে কথা বলেন কেন?
– ঐ দেখ পানকৌড়ি! সুন্দর না?
– (অভিমানের স্বরে) না।
– ভালো! চলো নৌকায় গিয়ে উঠি।
– হুম। আচ্ছা, আপনি কী হতে চান?
– কিছুনা।
– আ বা র? আমি কিন্তু চলে যাব।
– ঠিক আছে আর বলবো না।
– আচ্ছা, আমি যদি একদিন মরে যাই …..
– অসম্ভব–তুমি অমর।
– পাগল!…

মাঝে মাঝে নানুবাসা গিয়েছি, কখনো নুসরাতের সঙ্গে দেখা হয়েছে, কখনো হয়নি। সে ঐ একবারই এসেছিল আমাদের বাড়িতে। হয়তো সময়ের পরিক্রমায় ওকে ভুলে গিয়েছি। কিন্তু একদিন আম্মা এসে বলছে, বাবা আমার একটা কথা রাখতে হবে তোমায়? কথা? কী কথা আম্মা? আমি নুসরাতের সঙ্গে তোমার বিয়ে ঠিক করেছি। আম্মা আমার চোখের ভাষায় সম্মতির ছাপ দেখতে পেলেন। এই সংবাদে সত্যিই আমি আনন্দিত। কিন্তু বিয়ে করার মতো আর্থিক অবস্থা তখনো আমার গড়ে ওঠেনি। ঠিক আছে আম্মা, একটা চাকরি হয়ে গেলে….. আম্মা আমায় থামিয়ে দিয়ে আগামী পরশু তোমার বিয়ে, ব্যস : জীবনে অন্তত একটা পুণ্যের কাজ করো। পুণ্য? কী বলছেন আম্মা, আমি কখনো পাপ পুণ্য নিয়ে ভেবেছি? আম্মার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল। আম্মা বললো, নুসরাত ক্যান্সারে আক্রান্ত রাশেদ।

হাসপাতালে ওর সঙ্গে আমার সাতদিনের সংসার। আমি আমার সাধ্যমত নুসরাতকে খুশি রাখতে চেষ্টা করেছি। মূলত ওর প্রাণ চাঞ্চল্যময় হাস্যজ্বল মুখ দেখে বিশ্বাস করার উপায় ছিল না যে, সে এভাবে আমাকে একা ফেলে চলে যাবে। হাসপাতালে সে একটা মুহূর্ত চোখের আড়াল হতে দ্যায় নি। বাইরে হয়তো ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলছি, সে রাশেদ, রাশেদ বলে হুলস্থুল কাণ্ড বানিয়ে ফেলতো। আমি নুসরাতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতাম, এইতো সোনা, আমি এখানে। শিশুর মত তখন সে বলতো, আমাকে ফেলে কোথাও যাবে না তুমি, কোত্থাও না। নুসরাত কারও থেকে খাইয়ে নিতো না। না ওর মায়ের কাছ থেকে, না বাবা। ওকে যখন খাইয়ে দিতাম, সে বলতো, না, আগে তুমি খাও। প্রিয় কোনো কবিতার লাইনের মতো বাক্যটি আজও গেঁথে আছে হৃদয়ে আমার—না, আগে তুমি খাও।

হাসপাতালে নুসরাত যেন হাঁপিয়ে উঠছে। আমি এখানে আর একমুহূর্ত থাকবো না, স্বামীর উঠানে গিয়ে এবার আমি সংসার করবো। আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো রাশেদ। হয়তো আবার কখনো সে বলছে, আমাদের ছোট্ট সুন্দর একটা খোকা হবে, শরীর হবে কোমল নরম। কী বলো রাশেদ, হবে না? হ্যাঁ হবে, হবে নিশ্চয়ই। আমি তোমায় ভালোবাসি নুসরাত। সে বললো, জানি।

সন্ধ্যায় নুসরাতের সমাধিভূমি থেকে ভেসে আসে এক বাণী, আচ্ছা আমি যদি একদিন মরে যাই…. আমি বলি, অসম্ভব–তুমি অমর। সে বলে, পাগল!


চাঁদকুটি (সরকার পাড়া), রংপুর।
০৯ এপ্রিল ২০২০


 

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu