তরুন ইউসুফ
জন্ম ১৯৮৯ সালের ২৬ মার্চ সিরাজগঞ্জের সলঙ্গায়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর পাশের পর বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উপপরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন। উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত গ্রন্থ: না গৃহী না সন্ন্যাসী (২০১৮), কান্না হাসি রম্য রাশি (২০১৯)।
তরুন ইউসুফ

গণপ্রজাতন্ত্রী

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

অফিস শেষে বাসায় ফেরার জন্য অফিস বাসে বসে আছি। ক্লান্তি লাগছে খুব। অফিসে খুব কাজ ছিল বলা যায় না। তবে অফিসটাকে মাঝে মাঝে খুব ক্লান্তিকর মনে হয়। বাইরে গুমোট গরম, মেঘলা আকাশ সকাল থেকে। ভেবেছিলাম খানিকটা বৃষ্টি হবে। কিন্তু বৃষ্টির নামগন্ধ নেই। মেঘলা আকাশের কারণে গরমটাও চেপে বসেছে আরেকটু বেশি।

বাস দাঁড়িয়ে আছে অফিস থেকে একটু দূরে। ফুটওভার ব্রিজ থেকে ২০ গজ হবে। জায়গাটা মূত্রত্যাগের জন্য খুবই বিখ্যাত। যততত্র মানুষ জলত্যাগ করছে। পদচারী রাস্তা হয়ে গেছে মূত্রত্যাগের স্থান। সুতরাং ওখান দিয়ে যারা চলাফেরা করে তাদের সবাইকেই সাধারণত নাকমুখ চেপে পথ চলতে হয়। আবার পথচারীদের মধ্যে আনেকেই আছে যারা নিজেরাও সেখানে জলত্যাগ করে।

এসবের জন্য এমনি রাস্তায় চলা দুষ্কর, তার উপর ড্রেন সংস্কারের জন্য রাস্তা কাটা হয়েছে। পথচারীর দুর্ভোগ হয়েছে আরও বেশি।

আমাদের বাস যেখানে দাঁড়ানো, সেখানেও প্রসাবের কড়া গন্ধ ভেসে আসছে। আমিও নাক চেপে বাসের ভেতর বসে থেকে অপেক্ষা করছি, কখন বাস ছাড়বে। বাস ছাড়বে ৬টায় এখন বাজে ৫টা ৫০। অর্থাৎ এখনও মিনিট দশেক বসে বসে মূত্রের গন্ধ ভোগ করতে হবে। কী আর করা!

অপেক্ষা করছিলাম। এমন সময় লক্ষ্য করলাম মধ্যবয়স্ক একজন লোক। কাঁধ ছাপানো চুল, পরনে সাদা শার্ট এবং সাদা লুঙ্গি। একদম নির্লিপ্তভাবে লুঙ্গি উচিয়ে সটান জলত্যাগ করতে বসে গেল। মানুষ সাধারণত রাস্তায় বসে প্রসাব করলেও একটু রাখ-ঢাক করে রাস্তার উল্টো দিকে বসে। কিন্তু এ ব্যক্তি তা করল না। সে উদাস নয়নে রাস্তার দিকে মুখ করে বসল। তার ঠিক হাত পাঁচেক দূরেই আমাদের বাস দাঁড়ানো। বাস থেকে সব দেখা যাচ্ছে। বাসে শুধু সিনিয়র কলিগই না, মহিলা কলিগও আছেন। বিষয়টি খুবই অস্বস্তিকর। তারা অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসল। আমরা না হয় বাসের ভেতর বসে আছি, মুখ ঘুরিয়ে বসলাম। কিন্তু পথচারী যারা রাস্তা কাটার কারণে তাদের ওদিক হয়েই যেতে হচ্ছিল, তারা এই ঘটনায় আরও বেশি বিব্রত হচ্ছিলেন। সবচেয়ে বেশি বিব্রত হচ্ছিলেন মহিলা পথচারীরা। যে ব্যক্তি রাস্তায় বসে এই কাজ করছিল, একটু ভালোভাবে লক্ষ করলেই বোঝা যায় সে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে এই কাজটি করছে। শুধু তাই নয় বিষয়টি সে খুব উপভোগ করছিল।

আমার আশ্চর্য হওয়ার আরও বাকি ছিল। ঐ ব্যক্তির এই দুষ্কর্ম সম্পন্ন হওয়ার পরও কোনো এক অজানা কারণে লুঙ্গি উচিয়ে তখনও বসে আছে। শুধু তাই না, মাঝে মাঝে তার লিঙ্গ হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করছে।

এই ঘটনা এভাবে প্রত্যক্ষ করার পর আমার মুখ দিয়ে স্বতস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে আসল, ‘শুয়োরের বাচ্চা।’

এছাড়া আর কি বেরোতে পারে বলুন?

পাশের কলিগকে ঘটনাটা দেখিয়ে বললাম চলেন একটা কাজ করি, পেছন থেকে গিয়ে লাথি মেরে ওকে ড্রেনে ফেলে দেই।

সেই কলিগ আমার এ প্রস্তাবে হেসে ফেলল।

প্রত্যুত্তরে বলল, ভাই কী আর করবেন বলেন? জাতিগতভাবে আমাদের বেশিরভাগ মানুষের এই রকম অবস্থা। লাথি মারতে গেলে কয়জনকে মারবেন। দেখবেন প্রায় পুরো জাতিকেই লাথি মেরে ড্রেনে ফেলে দিতে হবে। তা কি সম্ভব?

সম্ভব নয় বটে। তবে ঐ ব্যক্তির জন্য তিনটি কাজ করা সম্ভব হলে ওর উচিত শিক্ষা হত।

লাথি মেরে ড্রেনে ফেলে দেয়া।

যেহেতু তার ঐ যন্ত্রের খুব বড়াই, ওটা কেটে দেয়া।

সটান চেন খুলে দাঁড়িয়ে ওর মুখের উপর প্রস্রাব করে দেয়া।

তাহলে ওর বেশ খানিকটা শিক্ষা হতো।

যাই হোক, এগুলো কোনটাই যেহেতু আমাদের পক্ষে করা সম্ভব নয়। তাই মনের দুঃখ মনে রেখে চলুন আমাদের যারা ‘প্রজাতন্ত্রের গণপ্রজা’ তাদের অবস্থা দেখে নেই। এটা দেখতে হলে যে পুরো বাংলাদেশ চষে বেড়াতে হবে তা কিন্তু না। আমার বাসা থেকে মতিঝিলের দূরত্ব হাঁটাপথে বড়জোড় চল্লিশ মিনিট। এই চল্লিশ মিনিটের পথ যদি আপনি একটু খুটিয়ে লক্ষ করেন, তাহলেই আমাদের গণপ্রজাদের অর্থাৎ আমাদের প্রকৃত চরিত্র আপনার সামনে উদোম হয়ে যাবে। চলুন তবে যটনা খুটাই–

 

মিঠা গলি মিঠা নয়

আমি যে গলিতে বাস করি, এটার নাম মিঠাগলি। এটি একটি কানাগলি। সুতরাং গলিতে ঢোকা এবং বের হওয়ার রাস্তা একটাই। গলির শেষ মাথায় আমার বাসা। গলির নাম মিঠাগলি হলেও এই গলি দিয়ে চলাফেরার অভিজ্ঞতা মোটেই মিঠা নয়। বরং বাড়াবাড়ি রকমের তিক্ত। এ গলির প্রধান বৈশিষ্ট্য– এখানে এলাকার প্রায় অর্ধেক কুকুর বাস করে। সব স্বাধীন কুকুর। মালিক ছাড়া। গলির ছোট্ট একটা অংশের বস্তির মতো জায়গায় যে কয়েকঘর লোক বাস করে; তারাই সাধারণত কুকুরগুলোর দেখভাল করে। ছোট ছোট বাচ্চারা হরহামেশাই কুকুরের সাথে জড়াজড়ি করছে, কুকুরের কান মোচড়াচ্ছে, যারা একটু বেশি ছোট তারা একটা ললিপপ কুকুরের সাথে শেয়ার করে খাচ্ছে। আমি মাঝে মাঝেই প্রত্যক্ষ করি, ছোট ফুটফুটে একটা বাচ্চা ললিপপ একবার নিজে চাটছে, পরেরবার কুকুরের দিকে এগিয়ে দিচ্ছে। কুকুর একচাটা দেয়ার পর বাচ্চাটা আবার চাটছে। একদিন বাচ্চাটার মাকে ডেকে বিষয়টা জানাতেই সে উত্তর দিল, সমস্যা নাই আমরা কুত্তারে গোসল করাই। কিছু হইব না।

তার সচেতনতা দেখে আমার মনটা ভরে গেল। যেহেতু কুত্তারে তারা গোসল করায় তাই আর কোনো সমস্যা নাই। তাদের সমস্যা না হলেও অনেকের সমস্যা হতে পারে। কারণ বেশিরভাগ কুকুরের গলাতেই জলাতঙ্ক নিরোধক টিকা দেয়ার পর যে বেল্ট বাঁধা হয়, তা বাঁধা নেই। তার মানে এই কুকুরগুলোকে টিকা দেয়া হয়নি। তাহলে বোঝেন অবস্থা। কুকুর কামড়ে যে কোন সময় আপনার জলাতঙ্ক বাঁধিয়ে দিতে পারে।

কুকুরের কথা বাদ দিলাম। এই গলির ভেতর চলতে গেলে মানুষের ব্যবহার্য এবং আহার্য অনেক কিছুর সাথে আপনার পরিচয় হবে।

যেমন ধরেন তরকারির খোসা, ডিমের খোসা, জবাইকৃত মুরগীর রক্ত, নাড়িভূরি, কুকুরের বিষ্ঠা তো আছেই সাথে বাচ্চার ব্যবহৃত প্যামপার্স, কনডমের ছেড়া প্যাকেট কিংবা মাঝে মাঝে ব্যবহৃত কনডম, পচাভাত-তরকারিসহ হেন জিনিস নাই মানুষ রাস্তায় ফেলছে না। মজার ব্যাপার হলো, সিটি কর্পোরেশনের দেয়া কোনো ডাস্টবিন এখানে নেই। থাকলেও লাভ হতো বলে মনে হয় না। অথচ অল্প কয়েকঘর লোক ব্যতিত বেশিরভাগ লোকই বিল্ডিংয়ে বাস করে। তাদের প্রধান দায়িত্ব সকালে উঠে পলিথিনে মুড়ে ময়লাগুলো রাস্তায় ফেলা এবং গলির কুকুরের দায়িত্ব পলিথিনের সেইসব ময়লা চারিদিকে ছড়ানো। আমার শুধু আশ্চর্য লাগে এই ভেবে যে, একটু পর ঐ রাস্তা দিয়ে তারাই যাবে এবং তাদের পায়েও এসব নোংরা লাগবে তবু তাদের বিকার নেই কেন!

না তাদের বিকার নেই। তারা দিনের পর দিন রাস্তায় এসব ফেলে যাচ্ছে নির্বিকারভাবে।

এই গলির আরেকটি বড় শিক্ষা হলো, রোদ-বৃষ্টি ছাড়াই ছাতা নিয়ে এই গলিতে চলা ভালো।

বলছেন কেন? তবে শুনুন।

খুব স্মার্ট হয়ে ধোয়া জামাকাপড় পরে সকালে অফিস করতে বের হয়েছেন। রৌদ্রোজ্জ্বল ঝকঝকে আকাশ। মনে মনে কোন এক প্রিয় গানের কলি ভাজতে ভাজতে আগাচ্ছেন। হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই ঝপাত করে খানিকটা পানি আপনার গায়ে এসে পড়ল। আপনি আশ্চর্য হয়ে উপরের দিকে তাকানোর পর বুঝবেন পানি পড়ার রহস্য। মূল কারণ হলো, পাশের বিল্ডিং থেকে কোনো লোক কুলি করে পানিটা রাস্তার দিকে ছুঁড়ে মেরেছে। পানির তো আর পাখা নেই যে উড়ে অন্য কোথাও গিয়ে পড়বে। তাই পড়েছে আপনার গায়ের উপর। ব্যাস স্মার্ট হয়ে বের হওয়া বের হয়ে গেল। আপনি হয়তো খানিকটা চিল্লাপাল্লা করবেন। কিন্তু তাতে তো আপনার কোনো লাভ হলো না। শুধু তাই না, ঐসব বিল্ডিংয়ের কারও কাশি চাপল। ব্যাস, কাশতে কাশতে ওয়াক থু বলে রাস্তার দিকে ছুঁড়ে দিল কেল্লা ফতে। অথচ এদের প্রত্যেকের বাসায়ই নিশ্চয়ই বেসিন আছে। থাকলেও ভাবখানা এমন, আমি না হয় একদলা কাশিই ফেললাম, তুমি তো নিজেকে বাঁচিয়ে চলবে তাই না।

 

গলির মাথার উদাস রিকশাওয়ালাগণ

রিকশাওয়ালারা কখন উদাস হয়?

ধরুন অফিস যাওয়ার জন্য আপনার খুব তাড়া। রিকশাওয়ালারা সেটা বুঝতে পারলো, ব্যাস রিকশাওয়ালা উদাস হয়ে গেল।

কিংবা বৃষ্টি নেমেছে। রাস্তায় পানি জমেছে। আপনার পায়ে স্যু পরা। আপনি জুতা খুলে যেতে পারছেন না, কারন জুতা হাতে নিয়ে কতদূর হাঁটবেন। আবার জুতা পরেও যেতে পারছেন না। জুতার ভেতর পানি ঢুকবে। ভেজা জুতা নিয়ে সারাদিন অফিস করা দুষ্কর। এই যখন উভয়সঙ্কট অবস্থা ঠিক তখনই দেখবেন রিকশাওয়ালা উদাস হয়ে গেছে।

তখন আপনি জিজ্ঞেস করলেন, মামা যাবে নাকি?

বেশির ভাগ রিকশাওয়ালাই উত্তর দেবে– না। উদাস হয়ে অন্য দিকে তাকাবে, নয় আপনার দিকে তাচ্ছিল্যমাখা একটা হাসি দিয়ে মৌন হয়ে যাবে।

এইভাবে বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করার পর একজন হয়ত আপনার সাথে কথা বলবে। তারপর এমন ভাড়া চাইবে, মনে হবে একি রিকশাওয়ালা না ডাকাত। শুধু তাই নয় এরা একটা সিন্ডিকেটের মতো। এক শেয়াল যা বলবে অন্যরা ওভাবেই হুক্কা হুয়া করতে থাকবে। ওরা যা ভাড়া চাইবে তাতে রাজি হলে আপনি যাবেন, না হলে নাই। আশ্চর্যের বিষয় হলো, বেশিরভাগ সময়ই এরা অলস বসে থাকে। তাহলে এরা চলে কীভাবে? ঢাকা শহরে যে খরচ, তাতে আমি প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরি করে চলতে পারি না, এরা অলস বসে থেকে চলে কীভাবে? কথা প্রসঙ্গে আমার বাড়িওয়ালাকে আমার কৌতূহলের বিষয়ে জানাতেই উনি একটু বিজ্ঞ হাসি দিয়ে খানিকটা গোঁফে তা দিয়ে নিলেন। তারপর একটু রসিক ঢঙে বললেন, যেসব রিকশাওয়ালা এখানে দেখছেন তাদের প্রত্যেকেরই একাধিক বউ। কেউ কেউ মুসলমানি কোটা পূরণ করে চারটা পর্যন্ত বিয়ে করে। প্রত্যেক বউই বিভিন্ন বাসায় বুয়ার কাজ করে। ধরেন একবউ যদি মাসে গড়ে পাঁচ হাজার টাকাও ইনকাম করে, চার বউয়ের ইনকাম বিশ হাজার। এটা তো মিনিমাম ইনকাম। বেশি হলে চিন্তা করেন কী অবস্থা! তাহলে কী কাজ করতে ভালো লাগবে?

ঘটনা শুনে আমি আশ্চর্য হতেও ভুলে গেলাম। এই ঘটনা আমার এক বিজ্ঞ কলিগকে জানাতেই বললেন, ভাই এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। আমরা প্রত্যেকেই যে যার জায়গায় অসৎ। কোনো লেভেলেই সততার বালাই নেই। সে রিকশাওয়ালা বলেন আর অফিসার বলেন সবার অবস্থা এক। কথাটা আমার খুব মনে ধরল। আসলেই আমরা যে যার জায়গায় অসৎ।

 

ফুটওভার ব্রিজের ভিক্ষুকেরা

কমলাপুর ফুটওভার ব্রিজ। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ফুটওভার ব্রিজ। শুধু তাই না এটা এক টুকরো বাংলাদেশও বলা চলে। হেন কিসিমের লোক নাই যে, এর উপর দিয়ে চলাচল করে না। চাকরিজীবী, চোর, বাটপার, রোডসাইড রোমিও, প্রেমিক জুটি, স্কুল-কলেজগামী ছাত্রছাত্রী, তরকারিওয়ালা, ফেরিওয়ালা, হকার, হাওয়াখোর, গাজাখোর, খুনিসহ সবধরনের লোকের দেখা আপনি পাবেন এখানে। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রজাতি হলো ফুটওভারব্রিজের ভিক্ষুকেরা। বাসাবো মুগদা অংশ থেকে আপনি হেঁটে যাচ্ছেন কমলাপুর হয়ে মতিঝিল কিংবা ঐদিককার কোনো জায়গায়। উঠতে গিয়েই দেখবেন তিন-চারজন জাঁকিয়ে বসেছে। এদের মধ্যে দু’একজন আপনার কাপড়চোপড় ধরে টান দিতে পারে। ভিক্ষা মুখে চাওয়া যায়। কিন্তু এরা মুখের কথায় বিশ্বাসী না। কাপড় ধরে টান দেন। তাই পাজামা পরে কিংবা লুঙ্গি পড়ে যদি কেউ ঐদিক দিয়ে হেঁটে যেতে চান, তবে তাদের জন্য সাজেশন হলো পাজামার ফিতার গিট্টুটা একটু টাইট করে নেবেন। না হলে টেনে খুলে দিতে পারে।

পাজামাসহ ইজ্জত বাঁচিয়ে আপনি সফলতার সাথে উঠে গেলেন ওভারব্রিজের উপরে। উঠেই দেখবেন, একজন সুরেলা গলায় গান গাচ্ছে, ‘আল্লার নবী মোস্তফায় রাস্তা দিয়া হাঁইটা যায়’ টাইপের গান। হাত বাড়িয়ে ধরেছে সামনের দিকে। আপনি ফুটবল খেলা ভালো জানলে মেসির মতো পাশ কাটিয়ে সহজেই চলে যেতে পারবেন। একটু সামনে চোখ বন্ধ করে আরেকজন আওড়াচ্ছে, ‘ভাই আমি অন্ধ গরিব, আল্লার ওয়াস্তে আমাকে কিছু সাহায্য করুন।’ সে দাঁড়িয়েছে রাস্তার মাঝখানে। তাকেও আপনার পাশ কাটাতে হবে। দু’কদম সামনে এগিয়েই দেখবেন বাচ্চা একটা ছেলে পা-ভাঁজ করে জিহ্বা বের করে অদ্ভুত আওয়াজ করছে। তার সামনের থালায় বেশ টাকা পয়সা জমে উঠেছে। একটু সামনে আগালে শক্ত-সমর্থ বৃদ্ধ এবং একজন মহিলা। তারা স্বামী-স্ত্রীও হতে পারে। কারণ মাঝে মাঝেই ভিক্ষার পাশাপাশি তাদেরকে ঝগড়াঝাটিও করতে দেখা যায়। এদের বৈশিষ্ট্য হলো– এরা ভিক্ষা চাইতে চাইতে আপনার গা মাথা হাতিয়ে দেবে। আপনি যদি একদিন ঝাড়ি দেন, তবে আপনাকে চিনে রাখবে। পরদিন একটু বেশি করে গা হাতিয়ে দেবে। অবশ্য যাদের মাইগ্রেন টাইপের কিছু আছে, তারা এদের দিয়ে মাথা ম্যাসাজ করিয়ে নিতে পারেন। আর তাতে যদি আপনার না পোষায় তাহলে ফুটবলারের মতো চুপচাপ পাশ কাটিয়ে যাওয়াই ভালো। এই শক্ত-সমর্থ বুড়ো ভিক্ষুক আবার বেশ স্মার্টও বটে। কারণ তার স্মার্ট ফোন আছে। একদিন দেখলাম, লুঙ্গির গিট্টুর ভেতর থেকে ফোন বের করে একজনকে ঝাড়ি দিয়ে বলছে,

‘ধুর ব্যাটা, খালি কাজের সময় ফোন দেস। পড়ে ফোন দে। এখন অফিস টাইম না।’

এইরকম ওঠা থেকে নামা পর্যন্ত অর্থাৎ যেখানে এক চাচা ‘তিনটা খালি পাঁচ, লাগবো নাকি খালি পাঁচ’ বলে তারস্বরে চেচিয়ে দৈনিক পত্রিকা বিক্রি করছে; সে পর্যন্ত গুনলে বারো থেকে তেরো জন ফ্রিলান্স্যার ভিক্ষুক প্রতিদিন ভিক্ষা করে যাচ্ছে। এই অংশটুকু হাঁটতে বড়জোর মিনিট পাঁচেক লাগবে। এই পাঁচ মিনিটেই যদি আপনি দশ-বারোজন ভিক্ষুকের দেখা পান, তাহলে আমাদের গণপ্রজার কত অংশ ভিক্ষুক একটু কল্পনা করুন?

 

দশ মিনিটের হাঁটাপথ, গণতন্ত্রের অবাধ চর্চা

যারা বলেন, দেশে গণতন্ত্র নেই। তাদের মুখে ঝাঁটা। আপনি চলে আসুন কমলাপুর স্টেশনের সামনের রাস্তায়। আপনাকে নিয়ে আমি মতিঝিল শাপলা চত্ত্বর পর্যন্ত হাঁটব এবং এই দশ মিনিটের হাঁটাপথে আপনাকে আমি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবো, কত মুক্তভাবে আমাদের দেশে গণতন্ত্র চর্চিত হচ্ছে।

আমরা অবশ্য রাস্তার বামপাশ দিয়ে হাঁটতে পারবো না। কারণ রাস্তার বামপাশের অর্ধেকাংশ জবজবে ভেজা।

আপনি বলবেন, ঝা চকচকে রৌদ্দুর দিন, ভেজা হবে কেন?

একটু ভালোভাবেই লক্ষ করলে দেখতে পারবেন, অনেকেই দাঁড়িয়ে সটান চেনখুলে যন্ত্রখানা বের করে নির্বিকারে মুতে যাচ্ছে। আর মুতবেই না বা কেন? এটা স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশে। মুতেও যদি একটু সুখ না পাওয়া যায় তবে গণতন্ত্র ধুয়ে কি পানি খাবো। এটা মুক্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ব্যক্তি স্বাধীনতার চমৎকার বহিঃপ্রকাশ। সুতরাং আপনাকে রাস্তার ডানপাশ দিয়ে যেতে হবে। কিন্তু এইদিকে গেলে খানিকটা জখম হওয়ার সম্ভাবনা আছে আপনার। কমলাপুর স্টেশন থেকে যারা সাধারণত মতিঝিলের দিকে যায়, রিকশায় গেলে রিকশাওয়ালা এবং রিকশাআরোহী কেউই রাস্তার ঠিক দিকে যেতে আগ্রহী নয়। তারা বেশিরভাগ সময় রাস্তার উল্টোদিকেই চলাফেরা করে। আপনি হেঁটে যাচ্ছেন। ব্যাস, বলা নেই কওয়া নেই পেছন থেকে এসে কোনো একটা রিকশার চাকার বর্ধিতাংশ আপনার পায়ে গোত্তা দিয়ে গেল। প্যান্টটাও একটু ছিড়লো, সাথে পায়ের চামড়া খানিকটা উঠে গেলো। তাই নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে হলে পদচারী রাস্তায় আপনাকে উঠতে হবে। কিন্তু স্বাধীন রাষ্ট্র। পদচারী রাস্তা দখল হয়ে দোকানের বর্ধিতাংশ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবু জখম থেকে বাঁচতে হলে সেখানে উঠে চলতে হবে। সবাই নিজেকে বাঁচাতে এ কাজটাই করে। হাঁটতে হাঁটতে কেউ কেউ ‘এক্সকিউজ মি’ বলে সামনে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে দেবে। আপনি হুমড়ি খেয়ে পড়েও যেতে পারেন।

এবার আসুন ধূমপায়ী পথচারীদের কথায়। এনারা স্বাধীন সন্তান। পাবলিক টয়লেটের থেকে শুরু করে পাবলিকের হেন জায়গা নেই যেখানে তারা ধূমপান করেন না।

একদিনের ঘটনা শুনুন। অফিসের বাস মিস করেছি, রিকশা পাইনি। তাই পা-জোড়াই একমাত্র ভরসা। সেই ভরসাতেই হণ্টন কার্য সম্পাদন করে প্রায় অফিসের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। দ্রুত হাঁটছি। আরও অনেকেই হাঁটছে। হঠাৎ করে হাতে আগুনের ছ্যাঁকা খেয়ে ‘উহ’ করে চিল্লায়ে উঠলাম। লক্ষ করলাম, এক লোক সিগারেট খেতে খেতে বাদশাহী মেজাজে হাঁটছে। ভাবখানা এমন– কারও ছ্যাঁকা লাগলো না পুড়লো এটা তার বিষয় না। তার বিষয় না হলেও বিষয়টা তো আমার। কারণ ছ্যাঁকা তো লেগেছে আমার। আমি একটু মেজাজ চড়া গোছের লোক। মেজাজ আরও চড়ে গেল। বুকের পাটা ত্রিশ ইঞ্চি হলেও ওটা চিতিয়েই চিতাবাঘের মতো গর্জন করে তার সামনে দাঁড়ালাম। কিন্তু চোরের মায়ের বড় গলা হলে যা হয়। সে আমাকে সরি তো বললই না উপরন্তু আমার সাথে ঝগড়া শুরু করে দিলো। আমিও কম যাই না। তুমুল ঝগড়া। ঝগড়ার এক পর্যায়ে লোকটি বলল,

‘মন্ত্রীরা সিগারেট খেলে তো কিছু বলতে পারেন না। আমরা খাইলেই দোষ।’

আমি প্রত্যুত্তরে বললাম, মন্ত্রীরা গু খেলে কি আপনি খাবেন?

এই কথার পর লোকটি আর কিছু বলল না। আমিও ঝগড়ায় ক্ষান্ত দিয়ে অফিসে ঢুকে পড়লাম। ঢুকে দেখি লিফটের সামনে বিশাল লাইন। ল্যাও ঠ্যালা সামলাও। অবশেষে যখন নিজের চেয়ারে বসলাম, তখন রীতিমত হাঁপাচ্ছি। হাঁপাবো না কেন? রিকশাওয়ালার সাথে বচসা করে, ভিক্ষুক সামলে, রিকশার গুতা খেয়ে, বিড়িখোরের ছ্যাঁকা খেয়ে পিতৃপ্রদত্ত প্রাণটা নিয়ে অফিস পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছি এই তো কত! এখন কাজে মনোযোগ দিতে হবে। কিন্তু কীভাবে দেব? ক্লান্ত শরীর ঝিমুনি আসছে। কাজ করব কীভাবে? আমি গণপ্রজাতন্ত্রের গণপ্রজাদের কর্মচারী। আমিও তো গণপ্রজারই অংশ। আর প্রজাদের যে চিত্র দেখলেন, তাতে তন্ত্রের কী অবস্থা হবে, সেটা বুঝতেই পারছেন। তাই আকাশ পাতাল চিন্তা না করে ঝিমুনি ভাবটা কাটানোর জন্য মনে মনে নচিকেতার গান ভাঁজতে থাকি–

‘আমি সরকারি কর্মচারী

ও আমি সরকারি কর্মচারী…’


This is an original content which is written by a DORPON author. Copying and publishing any part of the content is strictly prohibited.

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu